হেড কোয়ার্টারস কোম্পানির যে লঙ্গর - কমান্ডার, তার নাম সৎবীর সিং ,জাতি-তে রাজপুত। লোকটা একটু দাম্ভিক প্রকৃতির , আবার, নামের প্রতি সুবিচার করতে ব্যর্থ। একটু কান পাতলেই , ওর বিরুদ্ধে বাকি জওয়ানদের অসন্তোষের ফিস-ফিসানি শোনা যায় ।
সৎবীরের কাজ হলো , রোজ সন্ধ্যায় রোল - কলের সময়, জওয়ানদের মাথা গুনতি করে সেই হিসাবে রেশন তোলা এবং কুক-হাউসের হেডকুক-কে নির্দিষ্ট খাতায় সই করিয়ে সেটা হ্যান্ড-ওভার করা ।আমাদের সরকার , প্রত্যেক জওয়ানের জন্য যথেষ্ট পরিমানের রেশন বরাদ্দ করে রেখেছেন, যাতে তাদের কোন রকম অপুষ্টি না ঘটতে পারে। আর,এইখানেই ওই জওয়ান -দের অসন্তোষ বা অভিমান যে সৎবীর-সাব তাদের কে প্রাপ্য জিনিষ থেকে বঞ্চিত করে যাচ্ছেন ।একবার, ভজনলাল বলে এক কুস্তিগীর জওয়ান, এই নিয়ে কথা বলতে গিয়ে ওই সৎবীর-সাবের কাছে গালাগাল খায়, তারপরেও সৎবীর- সাব ওকে পর দিন ঝুট-মুট পি.টি-প্যারেড করিয়ে ছাড়ে। ভজনলাল ওর চেনা লোকদের বলেছে যে ও, এই ব্যাপারে আগামী সৈনিক -সম্মেলনে মুখ খুলবে।
সামরিক বাহিনীর জওয়ানদের কাজ হল যুদ্ধ করা ।কিন্তু যখন কোন যুদ্ধ নেই, তখন-ও কিন্তু তাদের নিয়মিত নিজেদের ফিট রাখার জন্য প্রচুর শারীরিক পরিশ্রম করতে হয়। সেজন্য সকালে পি.টি-প্যারেড এবং বিকেলে ভলিবল, বাস্কেটবল , হকি ইত্যাদি আবশ্যিক ভাবে অনুশীলন করার নিয়ম করা আছে ।এরপর সন্ধ্যায় জমায়েত হতে হয় রোল কল-এ। জওয়ান-রা কেউ 'বন্দী ' নয়, কিন্তু কারোর-ই সন্ধ্যার পর ইউনিটের বাইরে থাকার নিয়ম নেই [ বিশেষ অনুমতি, অথবা অন্য যুক্তিযুক্ত ঘটনা ছাড়া ] ।এটাতে আমি কোন মানবাধিকার লঙ্ঘন ইত্যাদি হিসাবে দেখি না, কারণ আমরা কি এইভাবেই বাড়ীতে বাবা-মায়ের শাসনে মানুষ হই নি ? আর, আর্মি-কে তো একটি অখন্ড পরিবার হিসেবেই দেখা হয়।
সন্ধ্যায় ইউনিটের একটি গেট(আর.পি.গেট) খুলে রেখে বাকি গুলো বন্ধ করে দেওয়া হয় আর তার চাবি বড় গার্ড-রুমে রাখা হয়। এখানে তিন শিফটে , চারজন করে রাইফেল-ধারী অতন্দ্র পাহারা দেয়। তারা কেমন ডিউটি করছে তা দেখার দায়িত্ব সাধারণতঃ পল্টনের সর্ব-কনিষ্ঠ অফিসার কে দেয়া থাকে। তবে, ওনার সাথে, এক গার্ড সহ সুবেদার মেজর সাহেব থাকেন।
যে গেটটা খোলা থাকে, সেখানে বালির বস্তা দিয়ে ঘেরা জায়গায় একজন রক্ষী অস্ত্র সহ ডিউটি দেয় -তাকে এক বিশেষ শব্দ-জোড়া জানিয়ে রাখা হয় ,যেটা নাকি রোজ বদলে দেওয়া হয়। এই শব্দ-জোড়া কে বলা হয় পাসওয়ার্ড এবং ইউনিটের প্রতিটি সৈন্যকে ( অফিসার সহ ) এই পাসওয়ার্ড মনে রাখতে হয়. বিশেষ করে যারা বাইরে যাচ্ছেন এবং ইউনিটে ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে যাবে। তাঁদের-কে ওই গেট দিয়ে ঢুকবার সময় ডিউটি দেওয়া জওয়ানের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তেই হয় , যে কিনা রাইফেলের ট্রিগার লক অন রেখে তাঁদেরকে পাসওয়ার্ড জিজ্ঞাসা করবে। এটা শুনতে যত হাস্যকরই লাগুক না কেন, ওই সময় পাসওয়ার্ড ভুলে যাবার জন্য তিনি যদি সেটা বলতে না পারেন, তবে, তিনি পদজনিত বা রোজকার পরিচয়জনিত কারণেও ওই সময় ভিতরে ঢুকতে পারবেন না ।তার পরের ব্যবস্থা পরে হবে ।আর, কেউ অন্য কোন ভাবে ঢুকতে গেলে অ্যারেস্ট তো হবেই, এমন কি গুলি খেয়েও মরতে পারে । আসলে, কিছু করার নেই - ফৌজে নিরাপত্তা ব্যবস্থা অনেকটা অন্ধ্I-কানুনের মত ।
একবার হল কি, সৎবীর সিং গাড়ী নিয়ে তিন কিলোমিটার দুরে সাপ্লাই -কোরের অফিসে গেছিলেন , তাঁর ইউনিটের রেশন- ডিমান্ড বিষয়ে কোন কাজে। কাজটা মিনিট দশেকের, আর গাড়ী করে যেতে আসতে মোট এক ঘন্টা লাগার কথা ।তাই, বেরোতে বেরোতে তিনটে বাজলেও , উনি জানতেন যে সময়মত ফিরে আসা কোন ব্যাপার হবে না ।কিন্তু, মানুষ অনেক সময় ভাবে এক, আর ঘটনা ঘটে আর এক ।ফিরবার সময়, সৎবীর-সাবের গাড়ী আর স্টার্ট নিতে চাইলো না ।ওনার ড্রাইভার অনেক চেষ্টার পর হাল ছেড়ে দিল ।সৎবীর -সাব ওকে বললেন ,গাড়ী নিয়ে সাপ্লাই -কোরের গ্যারেজে চলে গিয়ে দেখতে যে ,কি হলো এবং গাড়ী সারিয়ে কাল সকাল-সকাল ইউনিটে ফিরে আসতে। ওনার হাতে কোন মাল বা কাগজ নেই, তাই উনি তাড়াতাড়ি হেঁটে এখন ইউনিটে ফিরে যাচ্ছেন।
সৎবীর সিং ইউনিটের মেন গেটে পৌঁছতে ছ'টা বেজেই গেল ।উনি দেখলেন যে নিয়ম মত গেট-টা বন্ধ। এখন পাসওয়ার্ড বলে ওই গেট-টা দিয়ে ঢুকতে হবে ।কিন্তু, কিন্তু ...., ঘর্মাক্ত সৎবীর খেয়াল করলেন যে উনি পাসওয়ার্ড টা মনে করতে পারছেন না ।উনি কোথাও সেটা লিখেও রাখেন নি। [ তখন মোবাইল ফোন বলে কিছু পৃথিবীতে ছিল না ।এখন আছে, এখন আর্মি-ও সিকিউরিটি-র নিয়ম পাল্টে ফেলেছে] ।উনি ঠিক করলেন , একটু সন্ধ্যা হোক। তখন, বড় গার্ড-রুমের পাশে বেড়ার ফাঁক দিয়ে চেকিং করার ছলে ভিতরে ঢুকে পড়া যাবে। উনি বড় গার্ড-রুমের দিকে এগোলেন।
এদিকে আবার , সৎবীর-সাবের ড্রাইভার টেলিফোন করে আর. পি. গেটে জানিয়ে দিল যে সে গাড়ী নিয়ে সাহেবের হুকুম মাফিক সাপ্লাই -কোরের ইউনিটে আজ থেকে যাচ্ছে কিন্তু সাব -জী নিজে ইউনিটে ফিরে যাচ্ছেন। সেই খবর পেয়ে ইউনিটের সুবেদার মেজর প্রথমে মেন গেটে , পরে আর.পি. গেটে এসে দাঁড়ালেন। কিন্তু, সৎবীর সাবের দেখা না পেয়ে উনি ইতস্ততঃ পায়চারি করতে করতে হঠাৎ কাউকে যেন গার্ড-রুমের বেড়া ঠেলতে দেখলেন । উনি হাঁক পেড়ে , গার্ড-রুমের প্রহরীদের সতর্ক করলেন। মজার ব্যাপার হল , ওই দিন ওই সময় চারজন গার্ডের একজন ছিলো সেই ভজনলাল। সে কিন্তু আগেই সৎবীর সাবের ঘোরাঘুরি খেয়াল করে যাচ্ছিল এবং কি করবে তাও মনে মনে ঠিক করে রেখেছিল। সুবেদার মেজর সাবের হাঁক ,তাকে খুব সুবিধা করে দিলো। ও লাফ দিয়ে এগিয়ে গিয়ে বললো, " হাথ উঠাকে আগে বাড় ,নেহী তো দুশমনকো গোলি মার দিয়া যায়েগা।" তখন রোল কলের জন্য সকলেই ওই জায়গা দিয়ে যাচ্ছিলো এবং সৎবীর সাবের হেনস্থা তাদের চোখে পড়েও ছিল. কিন্তু , তারা যেহেতু 'ডিসিপ্লিনড সোলজার', তাই মুখ ঘুরিয়ে চলে গেল। ভজনলাল তখন-ও চীৎকার করছে, "পাস ওয়ার্ড বল, নহি মালুম তো, গার্ড-রুম কে তরফ চল -লেফট ,রাইট ,লেফট, ডাহিনে মুড়। আভি কদম তল.....।" সুবেদার মেজর সাহেব এগিয়ে গিয়ে বললেন, "বহত হুয়া ,ভজনলাল। ইনহে আভি ছোড় দো - তুমহারা সাব -জী হায় না ?" ভজনলাল ঠ্যালা মেরে গার্ড-রুমের ভিতরে সৎবীর সাব কে ঢুকিয়ে দিয়ে বললো , "হমে খুব মালুম হ্যায় সাব। লেকিন, কেয়া করে , হাম ভি তো ডিউটি সে মজবুর হুঁ !"" ভজনলাল এই কথাটা বলায় , সুবেদার মেজর সাহেবের কিছুই আর বলার থাকলো না - এটা যে ফৌজ ! ওদিকে , রাগে, দু:খে , অসহায়ত্বে আর নিজের বোকামির জন্য সৎবীর-সাবের মনে হল, তাঁর চোখ-মুখ ফেটে যেন রক্ত বেরিয়ে আসবে !
এই ছোট্ট বদলা নেওয়ার ঘটনা যে দু'জনেরই সারা জীবন মনে থাকবে, সেটা বলাই বাহুল্য।
ছবিঃ শিলাদিত্য বোস