সবুজ মনের রসদ
Ichchhamoti Logo
কি লজ্জা !

সিকিম দেশটা অসাধারণ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যে ভরা । হিমালয়ের কোলে বসে থাকা এই রাজ্যে কোনটার অভাব নেই। এখানে যেমন রং-বেরঙের অর্কিড আছে , তেমনি আছে লম্বা ঠ্যাং -ওলা উঁচু পাইন গাছ. কোথাও পাহাড়ের খাঁজ দিয়ে তির -তির করে জল গড়িয়ে আসছে , আবার কোথাও অনেক উপর থেকে লাফ দিয়ে ঝরণা নিচে পড়ছে। আকাশ -ছোঁয়া পাহাড়ের মাথায় যখন বরফ পড়ে , তখন বেশ নীচের জায়গা -গুলো অন্ধকার কুয়াশায় ভরে যায় , যেন কেউ কালো কম্বল -মুড়ি দিচ্ছে।

এরকম এক জায়গা-তে আছে একটা গ্রাম - তার নাম 'রাংলি'। নামটা বেশ সুন্দর। আরো সুন্দর হল সেখানকার মানুষ গুলো। তাদের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন কিন্তু, ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা লোকালয় ওই জায়গার নিসর্গ -দৃশ্য যেন আরো বাড়িয়ে তুলেছে।

এখানে ভারতীয় সেনার অধীনে , বর্ডার-রোড ডিপার্টমেন্ট নামে সংস্থাটির একটা বড়সড় অফিস আছে। তার লাগোয়া কোয়ার্টার্স-ও কিছুটা জায়গা জুড়ে রয়েছে । কোয়ার্টার্স মানে, জলপাই -রঙ্গা , অর্দ্ধ চন্দ্রাকৃতি টিনের তৈরী ছাদ ও দেওয়াল। দুই প্রান্তে কাঁচ লাগানো, কাঠের দরজা। এখানেই সারি-সারি মশারী -সহ খাট পাতা ,কর্মচারীদের ঘুমানো বা বিশ্রাম নেবার জন্য। আমাকে একলা থাকার সুযোগ দেয়া হয়েছে , একটা আলাদা কিন্তু একই রকমের ঘর দিয়ে। তবে, এখানে কাউকে তার পরিবার আনতে দেওয়া হয় না -আমাকেও না। এই সংস্থাটির কাজ হলো পাহাড়ের মধ্যে দিয়ে সেনাবাহিনীর জন্য রাস্তা বানানো ও সারা বছর তার মেরামতি করা। আর যখন ,বিশেষত বর্ষায় , রাস্তায় ধ্বস নামে ,তখন দ্রুত পাথর -মাটি সরিয়ে রাস্তা চালু রাখা। আমার কাজ হল, সারা বছর এই লোকগুলোকে চালু রাখা।আমি যে ওদের ডাক্তারবাবু ! আমাকে অবশ্য স্থানীয় লোকদের ও দেখভাল করতে হয়। এজন্য ওরা আমাকে খুব খাতির করে I প্রয়োজনীয় সাহায্যটা-ও আমি পেয়ে থাকি। আমার কাছে একটা স্থানীয় ছেলে থাকে- আমার খিদমতগারীর জন্য। ছেলেটার বয়স আঠার -ঊনিশ। বেশ হাসিখুশী , আবার খুব পরিশ্রমী ছেলে। সে যেমন ভালো রান্না করতে পারে , তেমনি, দারুন চা বানায়। এই ঠান্ডা জায়গায় দিনে তিন-চার বার চা খেতে পেলে ভালো লাগে, কিন্তু নিজে করার উৎসাহ পাই না, আমার এই ছেলেটা সে ব্যাপারটা থেকে আমাকে মুক্তি দিয়েছে।

ছেলেটা হল লেপচা জাতির মানুষ। সিকিমে এরা স্থানীয় লোক, এছাড়া এখানে আছে নেপালী এবং খুব কম সংখ্যক ভুটানী। তাদেরকেও স্থানীয় জন- গণ হিসাবেই ধরা হয়। যাই হোক , আমার এই ছেলেটা র নাম হলো ডোমা পাষাং। ওর বাবার নাম ছিল নরবু পাষাং । ডোমা তাঁর একটাই ছেলে। নরবু আমাদের সংস্থাটির একজন স্থানীয় কর্মী ছিলেন। কিন্তু, ডোমার যখন বারো বছর বয়েস, তখন একদিন মাল নিয়ে উঠবার সময় কি ভাবে পা পিছলে , পাহাড়ের গা বেয়ে অনেক নীচের খাদে পড়ে, নরবু মারা যান। ডোমার পড়াশুনো বন্ধ হয়ে গেল, কিন্তু সে বাবার জায়গাতে কাজ পেল। ঘরের অভাব মিটে যাওয়ায়, কিছুদিন কান্না-কাটির পর ডোমার মা, ছেলেকে নিয়ে এখন দিব্যি আছেন।

আমি তো তাই আমার কাজে বহাল হওয়া এই লেপচা ছেলেটার হাতে সব ছেড়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত থাকি। আমার ব্যাগ খোলা থাকে, মানিব্যাগ যেখানে, সেখানে রাখা। কিন্তু এখনও কিছু খোয়া গেছে বলে মনে হয় নি আমি অবশ্য কোন দিন খুচরো টাকা-পয়সা গুনে রাখি না। বড় নোট হলে, সেটা আলাদা কথা।

গতকাল আমাকে বড় সাহেব অফিসে ডেকে জানালেন যে নতুন কম্যান্ডারের দুই শ্যালিকা গ্যাংটক বেড়াতে গেছেন । ওনাদের গ্যাংটক-এ থাকাখাওয়া, মার্কেটিং এবংআগামী কাল ছাঙ্গু লেক, হরভজন বাবার মন্দির ও নাথু -লা পাস দেখিয়ে পাহাড়ের আরেক দিক দিয়ে এখানে ফিরিয়ে দিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব নিয়েছে ২৩৫-ছাঙ্গু ব্রিগেড। কিন্তু, কালিম্পং থেকে গ্যাংটক-এ যেতে এবং আসতে গেলে, যে দুটো রাস্তা আছে, তাদের মিলন-স্থল হল রাংলি। তাই, ওই দুই ম্যাডাম ফিরবার সময় এখানে লাঞ্চ করে সামান্য বিশ্রাম নেবেন। তারপর ওনাদের ওই-দিন কালিম্পং পৌঁছে দেবার দায়িত্ব পেয়েছি আমরা। আমাদের বড় জীপেরপাটাতন একটু পরিবর্তিত করে নিতে হবে যাতে বাত -এর যন্ত্রণা কাতর ওই দুই ম্যাডামের জীপে উঠতে কষ্ট না হয়. তারপর সারা পথের মধ্যে কোন শারীরিক অসুবিধা হলেও যাতে সামাল দিয়ে ভালোয়-ভালোয় পৌঁছে দিতে পারা যায়,তাই আমাকে ( যেহেতু আমি একজন চিকিৎসক), আমার সাহেব এল.ও.(লিয়াজঁ -অফিসার) হিসাবে রাখছেন। আমার সাথে আরেক জীপে চারজন লোক বেলচা-কোদাল নিয়ে চলতে থাকবে,রাস্তায় কোথাও গাড়ী যেন আটকে না পড়ে!সদ্য পোস্টিং পেয়ে আসা কম্যান্ডারের কোপে পড়া কারোরই কাম্য নয়।

সেনাবাহিনীর চাকরিতে কোন ব্যাপারে না বলতে নেই। এখানকার ধ্যান-ধারণা খুব সোজা - task given is task done !- কাজের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, মানে কাজটা হয়ে গেছে! ব্যস, আমার ল্যাঠা চুকে গেলো, এবার তুমি সামলাও! আমি-ও done,Sir বলে, স্যালুট করে চলে এলাম।

আমি এবার পর পর কাজের ছক একটা নোট -বুকে টুকে নিলাম -কিছু যেন ভুলে না যাই, বাদ না পড়ে ! কোয়ার্টার মাস্টারের কাছেও খবর পৌঁছে গেছিলো। দেখলাম ,আমাকে খামে করে তিনটে পাঁচশো টাকার নোট্ দিয়ে কাগজে সই করিয়ে চলে গেল ! আমার-ই বয়সী লোক , শুনলাম সে গান ধরেছে - বচকে রহে না রে বাবা...!

আমি আমার "ছেলেটাকে"ডেকে টাকাগুলো দিয়ে বললাম , ঘরে রাখ। আমি খেয়ে আসছি। ফিরে এসে ওকে একটা কাগজে একটা স্কেচ এঁকে ভেহিক্যাল বিভাগের হেড মিস্ত্রীর কাছে পাঠালাম। ওখান থেকে ও যেন চলে যায় আর কাল খুব সকালে চলে আসে। কাল-ই তো , সেই ব্যাপার-টা !

সেই ব্যাপার-টা মাথায় এতো ঘোরাঘুরি করতে লাগলো যে বিকেলে খবরের কাগজ কিনতে বেরোলাম। এখানে এই সময় -ই বাসে করে কালিম্পং থেকে কাগজ আসে। সব টাকা -পয়সা নিয়ে ঘর টা তালা দিয়ে বেরোলাম। হেড মিস্ত্রী -র সাথে দেখা - ও বললো এক হাজার টাকা দিতে , মাল লাগবে কিছু। গাড়িটার পা-দানি পাল্টে আজই ঠিকঠাক করে দিয়ে কাল ও বিল নিয়ে আসবে। আমি টাকা দিয়ে, কাগজ কিনে ফিরে এলাম। সন্ধ্যা বেলা খবর এলো , গাড়ি রেডি ! আমার টেনশন অনেক কমলো। ফোনে মেস থেকে আমার ঘরে অল্প খাবার আনিয়ে , খেয়ে , দুগ্গা-দুগ্গা বলে শুয়ে পড়লাম।

পরদিন সকালে এসে ডোমা ঘুম ভাঙ্গালো , তারপর বসে গেলো আমার ইউনিফর্ম , জুতো , বেল্ট , টুপি -সেগুলো কে পরিষ্কার করবার জন্য। আমি চা খেয়ে আসার জন্য মেসে গেলাম। ঘরে ফিরে গিয়ে দেখলাম , জামা-কাপড় সব রেডি করে ও চলে গেছে। আমি তাড়াতাড়ি ইউনিফর্ম পড়ে নিলাম। আমার মেডিক্যাল ইন্সপেকশন রুমে লোক জমে যায় - আজ তো আগে কাজ সারতে হবে. অফিসে এত সময় আজ দিতে পারব না। মেসে গিয়ে লাঞ্চ -মেনু ও তার তৈরির তদারকি করতে হবে। ঝাল কম হবে , ভাত যেন গলে না যায়। রুটি পোড়ালে আমার মুখ পুড়বে। এরপর চায়ের ফ্লাস্ক গরম জলে ধুয়ে , ঠিক বেরোনোর মুখে গরম চা ভরে নিতে হবে। কিছু নোনতা বিস্কুট কিনে নেব I এই ভাবতে ভাবতে আমি পকেটে হাত ঢোকালাম। আরে, টাকাগুলো কই ? একটা 500/ র নোট্ পকেটে ,কিন্তু বাকি দুটো ?

কি লজ্জা !

আমার অফিসে গিয়ে রোগী দেখা শুরু করে দিয়ে , লেপচা ব্যাটা -কে জরুরী তলব করলাম। ও অফিসে আসতে ,ওকে বললাম , টাকাগুলো কোথায় ? ও অবাক হয়ে বললো , টাকা টেবিলে-ই কাল ছিলো , আজকে ও টাকা দেখে নি। রাগে মাথা ভীষণ গরম হয়ে গেল । ওকে বললাম, ঘর থেকে বেরিয়ে যা ! ও মাথা নীচু করে বেরিয়ে যাবার সময় বললো , সাব-জী আপনার ভুল হচ্ছে। আমরা ওই রকম মানুষ নই.! আমি মুখ খিঁচিয়ে আরো কিছু বলবার আগেই ফোন বাজলো। সাহেব জানালেন , ম্যাডাম -রা গাড়ি বদল করে নেবেন , কিন্তু মেসে খেয়ে সময় নষ্ট করবেন না। ওনাদের লাঞ্চ প্যাক ও চা নিয়ে আমি যেন চলে আসি।

ছেলেটা তখনো যায় নি বলে ওকে বললাম , ওই- সব কিছু মেস থেকে নিয়ে আসার জন্য। ও ফিরে এলে ওকে নিয়ে বড় সাহেবের অফিসে পৌঁছে ওকে ছেড়ে দিলাম। শুনলাম , মিনিট খানেকের মধ্যে গাড়িটা এসে পড়ছে। ছেলেটা আবার বললো , সাব-জী, আমরা ওই রকম কাজ করি না।

গাড়ি ঢুকলো , আমি আর আমার সাহেব , দুই ম্যাডাম -কে যথাযথ অভিবাদন জানানোর পর আমাদের গাড়ি -তে ওনাদের যত্ন করে তুলে ,নিজেও উঠলাম। পিছনে, আমাদের অন্য জীপটা-কে অনুসরণ করতে বলে , কালিম্পং -এর দিকে চলতে লাগলাম। আমাদের জীপের পা-দানী টা ওনাদের অসুবিধায় ফেলে নি। আর তখন -ই বিদ্যুত-ঝলকের মতো টাকার হিসেবটা.........। লেপচা ছেলেটার মুখ মনে পড়লো , ওর কথাগুলো বার বার কানে বাজতে লাগলো। মনে দারুন লজ্জা পেলাম।

কালিম্পং থেকে আমার ছেলেটার জন্য কিছু ভালো জিনিস অবশ্যই কিনে আনবো।


ছবিঃ শিলাদিত্য বসু

প্রদোষ প্রদীপ ভট্টাচার্য্য পেশায় চিকিৎসক । ভারতীয় সেনাবাহিনীতে কিছুদিন কাজ করার অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেন; বর্তমানে স্থায়ীভাবে কলকাতায় কর্মরত। স্কুলজীবন থেকেই লেখার অভ্যাস, কলেজে দেয়াল-পত্রিকার নিয়মিত লেখক ছিলেন। ছোটদের জন্য লিখতেই বেশি পছন্দ করেন।

আমরা, ভারতের জনগণ, ভারতকে একটি সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, সাধারণতন্ত্র রূপে গড়ে তুলতে সত্যনিষ্ঠার সঙ্গে শপথগ্রহণ করছি এবং তার সকল নাগরিক যাতে : সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ন্যায়বিচার; চিন্তা,মতপ্রকাশ, বিশ্বাস, ধর্ম এবং উপাসনার স্বাধীনতা; সামাজিক প্রতিষ্ঠা অর্জন ও সুযোগের সমতা প্রতিষ্ঠা করতে পারে এবং তাদের সকলের মধ্যে ব্যক্তি-সম্ভ্রম ও জাতীয় ঐক্য এবং সংহতি সুনিশ্চিত করে সৌভ্রাতৃত্ব গড়ে তুলতে; আমাদের গণপরিষদে, আজ,১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর, এতদ্দ্বারা এই সংবিধান গ্রহণ করছি, বিধিবদ্ধ করছি এবং নিজেদের অর্পণ করছি।

ফেসবুকে ইচ্ছামতীর বন্ধুরা