
বাবা যখন জামশেদপুর থেকে দাদুকে দেখে ফিরলেন তখন রোহিন বাবাকে জিগ্যেস করেনি ওর জন্যে কিছু এনেছেন কিনা। বাবা যে ওর জন্যে জামশেদপুর থেকে কিছু আনবেন এমন আশা ও করেনি। আসলে রওনা হওয়ার আগেই স্কুল থেকে ওর নামে নালিশের যা ফিরিস্তি এসেছিল সেটা শুনে বাবা খুব রেগে গিয়েছিলেন। অর্কর সঙ্গে মিলে রোহিন নাকি ক্লাসের অন্য ছেলেমেয়েদের ভয় দেখিয়ে, মেরে, টিফিন কেড়ে নিয়ে যা সব কীর্তি করে বেড়াচ্ছে তা আর কিছুদিন চললে নাকি রোহিনকে স্কুল থেকে বার করে দেওয়া হবে। তা দিক! তাতে বয়েই গেছে রোহিনের! সুযোগ যখন পাচ্ছে তখন মজা করে নিলেই হল। আর এমনিতেও স্কুল থেকে তাড়ালে আর স্কুলে যেতে হবে না – হোমওয়ার্ক, দুনিয়ার টেস্ট পরীক্ষা টরীক্ষা কিছুই থাকবে না – দারুণ হবে!
ওর দাদা অবশ্য ওর ওই থিওরিটা শুনে বলল, "এটা তোকে কে বলেছে? ওই বোকা অর্কটা? ওই ছেলেটাই তোর মাথাটা খেয়েছে! ও সব কিছুই হবে না রে পাগলা! এই ভাল স্কুল থেকে তাড়িয়ে দিলে বাবা তোকে নিয়ে গিয়ে কোন একটা পচা স্কুলে ভর্তি করে দেবেন, তখন বুঝবি মজা!"
রোহিন অবশ্য দাদার কথায় কান দেয়নি। সে মা-বাবার কথাই শোনে না তো দাদা!
যাই হোক জামশেদপুর থেকে দাদু বাবার হাতে কী সব মোটা মোটা বই পাঠিয়েছেন দাদার জন্যে। সেটা মোটেই আশ্চর্যের কিছু না। যেটা আশ্চর্যের সেটা হল রোহিনের জন্যেও একটা জিনিস পাঠিয়েছেন – একটা চশমা! এমনি সাধারণ দেখতে একটা চশমা।
রোহিন সেটাকে দেখে, নেড়েচেড়ে বলল, "দাদুর কী মাথা খারাপ হয়ে গেছে? আমার জন্যে চশমা পাঠিয়েছে! আমার চোখ তো ভালই আছে!"
রোহিনের দাদু এককালে নামকরা চোখের ডাক্তার ছিলেন, এখন রিটায়ার করেছেন। কিন্তু যত ভাল ডাক্তারই হন না কেন চোখ পরীক্ষা না করে তো আর চশমা দেওয়া যায় না! বাবা কিন্তু ওর কথা শুনে গম্ভীর মুখে বললেন, "এই চশমাটায় পাওয়ার নেই। এটা বাবার ছোটবেলার চশমা ছিল। বাবা মানে তোমার দাদু তোমাকে এটা শুধু দুদিন পরে স্কুলে যেতে বলেছেন।"
রোহিন চশমাটা পরে দেখল। ওর ঠিকই হচ্ছে। ওটা পরে ওকে বেশ বিজ্ঞের মতন দেখাচ্ছে!স্কুলে পরে গেলে মন্দ হবে না। সবাইকে বেশ বোকা বানানো যাবে।
পরদিন স্কুলে চশমাটা পরে গেল রোহিন। অর্ক দেখে বলল, "বাহ, দারুণ দেখাচ্ছে তোকে!" পরক্ষণের আবার বলল, "জানিস সুস্মিতের কাকু ওর জন্যে বিদেশ থেকে পেন এনে দিয়েছেন – একটা নয়, দুটো নয় পাঁচখানা! ফাটাফাটি দেখতে ওগুলো। চল ওকে ভয় দেখিয়ে ওর কাছ থেকে দুটো নিয়ে নি, একটা তোর আর একটা আমার জন্যে!"
রোহিন অর্কর সঙ্গেই গেল। সুস্মিত মনে হয় ওদের মতলবটা আঁচ করতে পেরেছিল তাই পেনপগুলোকে তাড়াতাড়ি বক্সে পুরছিল।
অর্ক এক ধমক দিল, "এই কোথায় ঢোকাচ্ছিস! বার কর!"
সুস্মিত ভয়ে ভয়ে পেনগুলোকে বার করে ডেস্কের ওপর রাখল। রোহিন তাকিয়ে দেখল ডেস্কের ওপর পাঁচখানা সরু লিকলিকে সাপ কিলবিল করছে! অর্ক হাত বাড়াতে যাচ্ছে দেখে সে ওর হাতটা টেনে সরিয়ে দিল, "থাক! ওই বাজে পেন আর নিয়ে কাজ নেই!"
ওর কথা শুনে সুস্মিত মুখ হাঁ করে তাকিয়ে রইল আর অর্ক রেগে বলল, "তোর কী হয়েছে বল তো? ওই রকম ভাবে চোখ পিটপিট করছিস কেন? অত সুন্দর পেনগুলোকে কিনা বললি বাজে দেখতে! আচ্ছা নে চল।"
টিফিনের সময় অর্ক ফিসফিস করে বলল, "আজ দেবপ্রিয়কে বেদম মার মারব বুঝলি? কাল ও টিচারের কাছে আমাদের নামে নালিশ করেছে। আর অন্বেষা লাঞ্চে কেক এনেছে ওর লাঞ্চটা কেড়ে নিতে হবে, বুঝেছিস? এক কাজ কর, আমি দেবুকে গিয়ে ধরি আর তুই কেকটা কেড়ে নিয়ে আয়। তারপর দুজনে মিলে খাওয়া যাবে," বলে অর্ক চলে গেল।
রোহিন অন্বেষা, স্নেহারা যেখানে বসে খায় সেই দিকে গেল। ওকে দেখেই ভয়ে সিঁটিয়ে মেয়েগুলো লাঞ্চবক্স ফেলে পালালো। রোহিন একটু এগিয়ে গিয়ে দেখল ওদের খাবারের বাক্সে থিক থিক করেছে পোকা! চমকে উঠল সে। কী হচ্ছে ঠিক বুঝে উঠতে পারছিল না সে।
অর্ককে খুঁজতে গিয়ে দেখল সে দেবপ্রিয়কে কোনঠাসা করে ফেলেছে। মেরেওছে বোধহয় এক দু হাত। হঠাৎ দেবপ্রিয়র অসহায় মুখটা দেখে ওর যেন কেমন মায়া হল। কিছু না ভেবেই এক ধাক্কায় অর্ককে ঠেলে ফেলে দিয়ে বলল, "দেবু, তুই পালা!"
দেবপ্রিয় পালিয়ে যেতে রোহিন দেখল অর্ক মুখ হাঁ করে ওর দিকে তাকিয়ে রয়েছে, "তোর কী হয়েছে বল তো? অন্যদিন হলে তুইও মনের সুখে ওকে কিল চড় মারতিস আর আজ তুই আমাকেই ঠেলে ফেলে দিয়ে ওকে যেতে দিলি!"
"তোর ভালোর জন্যেই করলাম রে! ও যদি আবার গিয়ে নালিশ করে তাহলে আমাদের স্কুল থেকে তাড়িয়ে দেবে!"
অর্ক আরো আশ্চর্য হয়ে বলল, "তুই তো স্কুল থেকে তাড়িয়ে দিলে বেঁচে যাবি বলেই জানতাম। মনে নেই? নো হোমওয়ার্ক, নো টেস্ট, নো এগজাম বলেছিলি না?"
"দুর বোকা! এই স্কুল থেকে তাড়ালে মা-বাবা নিয়ে গিয়ে অন্য কোন পচা স্কুলে ভর্তি করে দেবেন আর সেখানে যদি আমাদের চেয়ে বড়সড় চেহারার কেউ থাকে তাহলে সে তখন আমাদের নতুন পেয়ে কিলিয়ে কাঁঠাল পাকাবে!"
"তুই কী ভয় পাচ্ছিস?"
"দুর দুর ভয় না, বুদ্ধি দিয়ে ভেবে দেখা!"
স্কুল ছুটির পর পুল কারে করে বাড়ি যাওয়ার সময় অন্বেষা এসে ওকে একটা চকোলেট দিল, বলল, "এটা আজকে আমাদের লাঞ্চ না কেড়ে নেওয়ার জন্যে আমাদের তরফ থেকে!"
রোহিন তো থ।
দেবুরা ওর বাড়ির কাছেই থাকে। বিকলেবেলা মা অফিস থেকে ফেরার সময় দেবুর মার সঙ্গে দেখে হয়ে গেল। উনি আবার মার সঙ্গে রোহিনদের বাড়িতে চলে এলেন। রোহিনকে দেখে খুশি খুশি মুখে বললেন, "আজ দেবু বলছিল তুমি নাকি ওকে অর্কর হাতে মার খাওয়া থেকে বাঁচিয়েছো! এই রকমই একটু খেয়াল রেখো। ও খুব ভোগে তো তাই একটু দুর্বল। তা তুমি ভাল ছেলে হয়ে গেছো শুনে খুব আনন্দ পেলাম।"
যে রোহিনের নামে চিরকাল নালিশ ছাড়া কিছুই আসেনি সেই রোহিনের নিজের প্রশংসা শুনতে বেশ ভাল লাগল।
পরের দিন ওর মনে হল টিচারদের মুখের ওপর জবাব দেওয়াটা বোকা বোকা। অর্ক যখন সেটা করছে ক্লাসের অন্যরা মুখ টিপে টিপে হাসছে! লাঞ্চের সময় লাঞ্চ বক্স খুলে দেখল মা ওকে রকমারি সব খাবার দিয়েছেন। সেটা না খেয়ে অন্যের খাবার ছিনতাই করতে গিয়ে সময় নষ্ট করাটাও বোকামি।
এমনি করে সারা ক্লাসে রটে গেল যে রোহিন পালটে গেছে। অর্করও আর ওর সঙ্গে থাকতে ভাল লাগে না তাই সে অন্য ছেলেদের সঙ্গে থাকে।
ওর পাশে বসা শুভ্রদীপ একদিন দুম করে বলল, "তোর চশমাটা হওয়ার পর থেকেই তুই পালটে গেলি রোহিন!"
চমকে উঠল রোহিন। সত্যিই তো! দাদু তো মোটে দুদিনের জন্যে পরতে দিয়েছিলেন কিন্তু ও তো এই কদিন রোজই ওটা পরছিল।
সেদিন রাতে ফোনে দাদুর সঙ্গে কথা বলল রোহিন, "দাদু তোমার দেওয়া চশমাটায় ম্যাজিক ছিল। আমি ওটা বারোদিন পরে ফেলেছি আর ভাল ছেলে হয়ে আমার ভালই লাগছে!" দাদু হেসে বললেন, "সেটা তো খুব ভাল কথা দাদুভাই! আমি যখন তোমার বয়েসের ছিলাম তখন আমার মাথাতেও ভূত চেপেছিল। তখন আমার বাবার একজন বন্ধু ওই চশমাটা আমাকে দিয়ে দুদিন পরতে বলেছিলেন। ওটা পরার পর আমি বদলে গিয়েছিলাম। যাক, তোমার যখন ভাল হয়ে থাকতে ভাল লাগছে তখন ওই চশমাটা আর তোমার কাজে লাগবে না। তবে ওটা সামলে রেখে দিও। কখন কার কাজে লেগে যায় বলা তো যায় না!"
ওপরের গল্পটার মতন ভাল ছেলে/মেয়ে হওয়ার জন্যে তো কেউ চশমা পরে না, পরে ভাল করে দেখতে পাওয়ার জন্যে। সবাই জানে চশমা মানে দুটো কাচের টুকরো ফ্রেমে করে চোখের সামনে দেওয়া। ওই কাচের মধ্যে দিয়ে দেখলে যাদের চোখ খারাপ তারাও ভাল দেখতে পায়। গগলস বা সানগ্লাস পরলে সূর্যের আলোতে ভাল দেখা যায়, অনেক সময় আল্ট্রাভায়লেট রশ্মির থেকেও চোখকে রক্ষা করে এই রঙিন কাচ। চোখের সুরক্ষার জন্যে অনেককেই সেফটি গ্লাস পরতে হয় চোখে যাতে আঘাত না লাগে।
যীশু খৃষ্টের জন্মের এক হাজার বছর পর (১০০০ এডি) থেকেই মানুষ আবিষ্কার করে যে কিছু বিশেষ ধরণের কাঁচ দিয়ে ছোট জিনিস ভাল দেখতে পাওয়া যায়(কাঁচের আবিষ্কার অবশ্য খৃষ্টের জন্মের অনেক দিন আগেই হয়ে গিয়েছিল)। প্রথম প্রথম কাঁচের গুলি দিয়ে পড়া বা লেখার চেষ্টা করতেন চার্চের কিছু সন্ন্যাসী।

রিডিং স্টোন
একেবারে স্বচ্ছ কাঁচ তৈরি হতে সেগুলো দিয়ে বল বানিয়ে দেখার চেষ্টা করত লোকে। ইটালির ভেনিস শহরের প্রথম ভাল করে 'রিডিং স্টোন' তৈরি করা শুরু হয়। এই পাথরগুলোকে বইয়ের পাতার ওপর রেখে লেখাগুলোকে পড়া হত। তারপর ক্রমে লোকে বুঝতে পারে যে কাঁচের টুকরোটাকে চোখের সামনে ধরলে কাজটা আরো সহজ আর ভাল হচ্ছে। অনুমান করা হয় যে ফ্রেমে কাঁচ ভরে প্রথম চশমা ইটালির পিসাতে ১২৬৮ সালে পাওয়া গিয়েছিল। যদিও কে আবিষ্কার করেছিলেন সেটা জানা যায়নি।

তবে এর পর থেকে বেশ কিছু শিল্পীদের আঁকাতেই চশমা পরা লোকজনকে দেখা গেছে। ১৪০০ সালে ইটালির ফ্লোরেন্স শহরটিতে বেশ ভাল চশমা (প্রধানত লেন্স) তৈরি হত। তখন এটা ধরে নেওয়া হয়ছিল যে তিরিশ বছর বয়স থেকে মানুষের চোখ খারাপ হতে শুরু করে এবং প্রতি ৫ বছর অন্তর পাওয়ার বাড়ার জন্যে চশমা বদল করতে হয়। এই সময়টা ইটালি থেকে প্রচুর পরিমাণে চশমা রফতানি হত। নানা রকমের চশমা, আর সেগুলোর দাম খুব একটা বেশি ছিল না কারণ ধরে নেওয়া হয়েছিল যে চশমা জীবনের এক অভিন্ন অঙ্গ, গরিব, বড়লোক সবারই প্রয়োজনের জিনিস।

এর পর ষোলশো এবং সতেরোশো শতাব্দীতে জার্মানি দারুণ দারুণ সব ফ্রেম বানাতে শুরু করে। লেন্স তৈরিতে অবশ্য তখনও ইটালিই সেরা। এই সব ফ্রেমগুলো হয় হাতে ধরা, নয় তো রিবন দিয়ে বাঁধা নয় নাকে বসানো (প্রিন্স নেজ) ধরণের ছিল।
আমরা যে ধরণের চশমা দেখি সেটা তৈরি হয় ১৭৩০ সালে ইংল্যান্ডে। এডুয়ার্ড স্কার্লেট নামে এক চোখের ডাক্তার এটা আবিষ্কার করেন।
প্লাস আর মাইনাস পাওয়ার মানে প্রেসবায়োপিয়া (বা হাইপারমেট্রোপিয়া -কাছের জিনিস ভাল করে দেখতে না পাওয়া – লং সাইট) বা মায়োপিয়া (দূরের জিনিস ভাল করে দেখতে না পাওয়া- শর্ট সাইট) হলে দু ধরণের লেন্স ব্যবহার হয়– কনভেক্স (উত্তল) বা কনকেভ (অবতল)।

বেঞ্জামিন ফ্র্যাঙ্কলিন
১৭৮৪ তে বেঞ্জামিন ফ্র্যাঙ্কলিন আমেরিকাতে বাইফোকাল চশমার আবিষ্কার করেন। ওনার প্রেসবায়োপিয়া আর মায়োপিয়া দুটোই ছিল তাই চশমা বদল করতে করতে ক্লান্ত হয়ে ওনার মাথায় বাইফোকাল তৈরির চিন্তাটা প্রথম আসে।

জর্জ এয়ারি
অ্যাস্টিগমাটিজম নামের চোখের অসুখের জন্যে সিলিন্ড্রিকাল লেন্সের আবিষ্কার হয় ১৮২৫ সালে। ব্রিটিশ জ্যোতির্বিজ্ঞানী জর্জ এয়ারি এই আবিষ্কারটি করেন।

এরপর নানা রকমের চশমা, চশমার কাচ আর ফ্রেম বাজারে আসতে থাকে। জামাকাপড়ের মতন চশমাও এক ধরণের ফ্যাশন হয়ে দাঁড়ায়। এখন এত রকমের চশমা পাওয়া যায় বাজারে যে গোনা ভার – বাইফোকাল থেকে এখন ট্রাইফোকাল, থ্রি ডি প্রোগ্রেসিভ ফোকাস, অ্যাডজাস্টেবেল ফোকাস, ফোটোক্রোমাটিক কত রকমের চশমার কাচ। এর মধ্যে বেশ কিছু ঠিক কাচও নয়, অনেক রকম কৃত্রিম জিনিষেরও ব্যবহার হচ্ছে কাচের বদলে। ইদানীং আবার মানুষ চশমা পরা ছেড়ে কন্ট্যাক্ট লেন্সও পরছে চোখে।
দেখা যাক, একদিন হয়তো রোহিনের দাদুর চশমার মতন মানুষকে ভাল করে দেওয়ার চশমাও বেরবে!
ছবিঃ উইকিপিডিয়া, ব্রিটানিকা, কলেজ অপট্রোমেট্রিস্টস্