রতনের চোখ ফেটে জল আসছিল। তার বাবা শেষপর্যন্ত চোর? ছিঃ ছিঃ! দুঃস্বপ্নেও ভাবেনি কোনোদিন। রতনের বহুদিনের সখ একটা সাইকেলের। নতুন লাল চকচকে সাইকেলটা দেখে ভেবেছিল বাবা হয়ত তার মনের কথাটা বুঝতে পেরে টাকা জমিয়ে কিনে এনেছে। রতন জানে তার বাবা কোন স্থায়ী কাজ করে না। কখনো কোনো কারখানায় কাজ করে, কখনো বা রাজমিস্তিরির জোগাড়ে বা অন্য কিছু। বেশীরভাগ দিনই বাড়িতে বসে থাকে, হটাৎ হটাৎ বেরিয়ে যায়। বাবার ভরসায় থাকলে দুবেলা দুমুঠো জুটবে না, তাই মাকে লোকের বাড়ি কাজ করতে হয়। অবসর সময়ে সেলাই করে কিছু বাড়তি রোজগারের চেষ্টা করে। রতনও বাড়ি বাড়ি কাগজ বিলি করে। তাতেও সংসার চলে না। মা পাড়ার মুদির দোকান থেকে ধার বাকিতে জিনিষ আনে। সময়ে টাকা মেটাতে না পারার জন্য অনেক কটূক্তিও শুনতে হয়। বাবা কুঁড়ে, ঠিকমত সংসারের দায়িত্ব পালন করে না, মদ খেয়ে বাড়িতে এসে অশান্তি করে - ছোট থেকে এসব দেখে দেখে রতনের গা সওয়া হয়ে গেছিল। কিন্তু তাই বলে চুরি? মা বাবার কথোপকথন ভেঙ্গে চুরমার করে দিল রতনের কিশোর হৃদয়। সেদিন আর স্কুল যেতে ইচ্ছা করল না। সারাদিন বালিশে মুখ গুঁজে কাঁদল।
'কিচিরমিচির এপার্টমেন্ট' অ্যাসোসিয়েশানের জরুরী মিটিং। চুরির উপদ্রব এড়াতে বাড়ির নিরাপত্তা বাড়ানোর বিশয়ে আলোচনা। কদিন আগেই গাঙ্গুলি বাবুর ছেলের নতুন সাইকেল চুরি গেছে। "এর আগেও দুবার ডাক্তার বাবুর ছেলের সাইকেল চুরি হয়েছে", দেবজ্যোতি বাবুর গলায় উত্তেজনা। "আকাশেরটাও একবার গেছে", অসীমা দি যোগ করলেন। এছাড়াও বিল্ডিঙের আলো, গ্যারেজের কল, জুতো, চটি টুকটাক চুরি যেতেই থাকে। মিঃ সহায় বললেন "এতগুলো গাড়ি, বাইক থাকে গ্যারেজে, পার্টস খুলে বেচে দিলেই তো হল"। অরিন্দমের এক সহকর্মীর একবার গাড়ির কাঁচ ভেঙ্গে অডিও সিস্টেম চুরি হয়ে গেছিল। উনি সেকথাও বললেন। বাড়ির পেছনের পাঁচিলটা আরও উঁচু করতে হবে আর কাঁটা তারের জাল লাগাতে হবে। আপাতত এই দুটো কাজ জরুরী ভিত্তিতে করতে হবে। অ্যাসোসিয়েশানের প্রেসিডেন্ট আজাদ সব নোট করছেন। ফান্ডে কত টাকা আছে আর কত করে চাঁদা তুলতে হবে তারও একটা প্রাথমিক হিসেব হয়ে গেল। অসীমা দি বললেন "এই কেয়ারটেকার কাম সিকিউরিটি দিয়ে চলবে না। নিরাপত্তা বাড়াতে গেলে কোনো প্রাইভেট সিকিউরিটি এজেন্সি থেকে লোক আনতে হবে"। মিঃ মুখার্জি আর মিঃ গাঙ্গুলি প্রায় সমস্বরে বলে উঠলেন "ছোট স্ট্যান্ড এলোন বিল্ডিং আমাদের, কত টাকা মেনটেনেন্স ওঠে যে এত খরচা চালাবো? মেনটেনেন্সের টাকাই তো লোকে পকেট থেকে বের করতে চায় না"...
রতনের মনে শান্তি নেই। শুধু বাবা নয়, মায়ের ওপরেও চূড়ান্ত অভিমান হয়েছে রতনের। সব জেনেশুনেও মা কি করে চুপ করে থাকে? মাও কি তারমানে চুরিকে সমর্থন করে? এই সাইকেল টা তো সে ব্যাবহার করবেই না, বরং যার জিনিষ তাকে ফেরত দিয়ে আসবে। ঠিক করল সরাসরি বাবাকে জিজ্ঞেস করবে। বাবার প্রতি তার আর এতটুকু সন্মান নেই। ঘরে ঢুকে দেখল বাবা খেতে বসেছে। বেশ তাড়াহুড়োয়। কে জানে, রাতে হয়ত কোথাও চুরি করতে বেরোবে। রতন সোজা বাবার চোখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল "বাবা এই সাইকেলটা কোন বাড়ি থেকে চুরি করেছো?" "কি বললি তুই? তোর এত বড় আস্পর্ধা? এক চড়ে গাল ফাটিয়ে দেব" বলে ছেলের গালে সজোরে এক চোর কশিয়ে ভাতের থালা উলটে ফেলে চলে গেল রতনের বাবা। অমনি মাও খেঁচিয়ে উঠল "মানুষটাকে একটু খেতে পর্যন্ত দিলি না"। চোর স্বামীর প্রতি কিসের এত ভালোবাসা বা আনুগত্য রতনের মাথায় ঢুকল না। সহায় সম্বলহীন এক মহিলার এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজে বেঁচে থাকার জন্য একটা পুরুষকে আঁকড়ে থাকার যে কি প্রয়োজন তা বোঝার মত বয়েস হয়নি রতনের। কাগজ বিলি করার সুবাদে রতনের এপাড়া ওপাড়ায় যাতায়াত ছিল। তার মত আরও অনেক অনেক ছেলেরা সকালে কাগজ, দুধ, দিম, ফুল মালা বিলি করে বাড়ি বাড়ি। রতন হাঁসিখুশি স্বভাবের, তাই এদের অনেকের সাথেই ওর ভালো ভাব আছে। রতন কথার ছলে কায়দা করে জানার চেষ্টা করে কোন বাড়িতে সম্প্রতি সাইকেল চুরি হয়েছে। অনেক কাঠ খড় পুড়িয়ে অবশেষে একটা খোঁজ পায়। দু তিন স্টপেজ পরে এক পাড়ায় 'কিচিরমিচির' বলে এক ফ্ল্যাট বাড়িতে গত সপ্তাহে একটা লাল সাইকেল চুরি হয়েছে।
খানিকক্ষণ ইতস্তত করে অবশেষে রতন লাল লোহার গেটটা ঠেলে ফাঁক করে উঁকি মারল। কেয়ারটেকার ঘরে বসে জলখাবার খাচ্ছিল। রতনকে দেখেই "কি চাই?" বলে উঠল। রতন সাহস করে ভেতরে ঢুকল। সাইকেলটায় চোখ পরতেই কেয়ারটেকার যেন বাঘের মত ঝাঁপিয়ে পড়ল রতনের ওপর। রতন কিছু বলার আগেই তার কানটা ধরে এক চড় কশিয়ে বলল "তুইই তাহলে চুরি করেছিলি আমাদের টিনটিন দাদার সাইকেল। এই তো, সাইকেলের গায়ে টিনটিনের স্টিকার লাগানো"। টিনটিন কে বা কি রতন জানে না, কিন্তু সত্তিই তো কি একটা স্টিকার লাগানো আছে বটে। রতন তো এতদিন খেয়ালি করে নি ব্যাপারটা। হটাৎ করে বিনা দোষে চড় খেয়ে রাগে আর অপমানে মাথাটা ঝাঁ ঝাঁ করছিল রতনের, তবুও নিজেকে সামলে শান্ত গলায় বোঝানর চেষ্টা করল সত্যি কথাটা। কিন্তু কে শোনে কার কথা? চোর চোর করে ততক্ষনে সারা বাড়ি মাথায় করে ফেলেছে কেয়ারটেকার। ঠিকমত কাজ না করার জন্য সারাক্ষন অনেক কথা শুনতে হয় তাকে, এমনকি কাজ থেকে ছাড়িয়ে দেয়ার হুমকিও। আজ সে একটা বড় সুযোগ পেয়েছে বাহবা কুড়নোর। রতনের কথা শোনার সময় কোথায় তার? তার চেঁচামেচিতে আরও কিছু ড্রাইভার আর কাজের লোক জড় হয়ে গেছে ততক্ষণে। সবাই মিলে এক হাত নিচ্ছে রতনকে।
রবিবারের সকাল। বাবুরা সব বাড়িতে। কেউ বা সদ্য উঠে চা আর খবরের কাগজ নিয়ে আরাম করে বসেছেন, কেউ বা বেজার মুখে থলি হাতে করে বাজারে বেরচ্ছেন। সাতসকালে এত হইচই শুনে সকলেই দৌড়ে নিচে নেমে এলেন। কেয়ারটেকার দারুন উত্তেজিত। "এই দেখুন দাদা, চোর ধরেছি। এই ছোঁড়াই আমাদের টিনটিন দাদার সাইকেল চুরি করেছিল। আজ নির্ঘাত আবার কিছু চুরি করার উদ্দেশ্যে ধুকেছিল। এইবার আর রতন প্রতিবাদ না করে পারল না। চিৎকার করে বলল "আমি চুরি করিনি। চুরি করলে কি সাইকেলটা নিয়ে আমি আবার এবাড়িতে আসতাম?" ছেলেটার কথায় যুক্তি আছে। এক তলার মিঃ চ্যাটার্জি জিজ্ঞেস করলেন "তাহলে ব্যাপারটা কি বল? এই সাইকেলটা তুই কোত্থেকে পেলি?" মিঃ চ্যাটার্জির শান্ত গলায় সাহস পেয়ে রতন পুরো ঘটনাটা গুছিয়ে বলল। রতনের কথা শেষ হওয়ার আগেই অসিমা দি চেঁচিয়ে উঠলেন "না না এসব ছোটলোকদের কথায় একদম বিশ্বাস করবেন না। এরা যা মিথ্যে কথা বলে!" শুনে ঘোষ বউদি বললেন "আমার তো মনে হয় ছেলেটা সত্যি কথাই বলছে। এবাড়ি থেকে চুরি করা সাইকেল নিয়ে ও এবাড়িতে আসবে কেন আর অন্য কিছু চুরি করতে এলে কি আর এই সকালবেলা দরজা ঠেলে জিজ্ঞেস করে ঢুকত?" অকাট্য যুক্তি বউদির।
টিনটিনের বাবা অরিন্দম গাঙ্গুলি এতক্ষণ চুপচাপ সব শুনছিলেন। তিনি রতনকে কাছে ডাকলেন। রতনের মাথায় আলতো করে হাত বুলিয়ে বললেন "সাইকেলটা আজ থেকে তোর"। রতন লাফিয়ে উঠে ঘাড় ঝাঁকিয়ে প্রতিবাদের সুরে বলল "না বাবু, আমি সে উদ্দেশ্যে আসি নি"। অরিন্দম ওর কাঁধে হাত রেখে বললেন "আমি জানি। আমি নিজের ইচ্ছায় সাইকেলটা তোকে দিলাম। এটা তোর সততার পুরষ্কার। আর এবার থেকে কোন অভাব বা অসুবিধে হলে আমার কাছে আসিস"। রতন হতবাক। খানিকক্ষণ ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। তারপর অরিন্দমকে একটা প্রনাম করে হাঁসিমুখে সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে গেল। "এটা কি করলেন দাদা? অত দামি সাইকেলটা দিয়ে দিলেন"? প্রায় সকলেই হইহই করে উঠলেন। অরিন্দম অল্প হেঁসে জবাব দিল "ছেলেকে আরেকটা সাইকেল কিনে দেয়ার ক্ষমতা আমার আছে, কিন্তু আজ যদি আমি ছেলেটার সততার মর্যাদা না দিতাম, সারাজীবনের জন্য একটা কিশোরের মেরুদণ্ড ভেঙ্গে যেত। একটা সাইকেলের চেয়ে মেরুদণ্ডের দাম যে অনেক বেশী"।
ছবিঃ পারিজাত ভট্টাচার্য্য