সবুজ মনের রসদ
Ichchhamoti Logo
টুথ ফেয়ারি আর দাঁতের মাজনের কথা

তুমি টুথ ফেয়ারির নাম শুনেছো? সেই যে বাচ্চাদের দাঁত পড়ে গেলে যে তাদের দাঁতগুলো নিয়ে যায় আর তার বদলে বালিশের নিচে রেখে যায় উপহার? পশ্চিমের দেশগুলোতে তার বিস্তর আনাগোনা।

সেই টুথ ফেয়ারি কী ভাবে এল তাই নিয়ে একটা গল্প আছে। অনেকদিন আগে মেঘের ওপারের এক দেশে থাকত এক পরি মাতা আর তার তিন মেয়ে। পরি মাতা রোজ তাঁর মেয়েদের পরি বিদ্যার শিক্ষা দিতেন। বড় আর মেজো মেয়ে খুব মন দিয়ে সব কিছু শিখত কিন্তু ছোট মেয়ের ওসবে মন নেই। সে শুধু সব সময় হেসে খেলে গান গেয়ে নেচে বেড়াতে চায়।

একদিন পরি মাতা ওকে আলাদা করে ডেকে বললেন, "তোমার দিদিরা কত পরিশ্রম করে সব বিদ্যা শিখে নিয়েছে কিন্তু তোমার ভাল লাগে না কেন? তোমার জন্যে আমার ভারি চিন্তা হয়। এই রকম হলে তো তোমাকে আমি কোন কাজ দিতেপারব না!"

ছোট মেয়ে মাথা নিচু করে বলল, "আমি আমার বন্ধুদের মতন হতে চাই। সারা পৃথিবীতে আমার অনেক বন্ধু। তারা কী সুন্দর হেসে খেলে বেড়ায়। কই তাদের তো কেউ কিছু বলে না! আমি পৃথিবীর এদিক থেকে ওদিক যাই সব বাচ্চাদের সঙ্গে খেলি তাদের আনন্দ দিই সেটাই আমার ভাল লাগে। এই তো সেদিন একটা বাচ্চা মেয়ের সঙ্গে খেলছিলাম ওমা খেলতে খেলতেই তার একটা দাঁত ভেঙে পড়ে গেল। সে বেচারা ভয়ে কেঁদে ফেলল। আমি তখন ওর দাঁতটা নিয়ে ওকে আদর করে ভুলিয়ে তুললাম। ওর সব ব্যথা চলে গেল!"

পরি মাতা শুনে ভীষণ খুশি হয়ে বললেন, "আমি এতদিন খুব চিন্তায় ছিলাম যে তোমাকে কী দায়িত্ব দেব কিন্তু এখন আমি বুঝতে পেরে গেছি! তুমি এই ভাবেই সারা পৃথিবীর শিশুদের সঙ্গে খেলে বেড়াবে। যখন তাদের দুধের দাঁত ভাঙবে তখন তুমি তাদের কাছে গিয়ে সেটাকে একটা সুন্দর অভিজ্ঞতা করে দেবে। তাদের উপহার দেবে, আনন্দ দেবে, ব্যথা, কান্না ভুলিয়ে দেবে।"

সেই থেকেই টুথ ফেয়ারির জন্ম আর সে পশ্চিমের দেশের শিশুদের বেড়ে ওঠার একটা অঙ্গ হয়ে আছে।

এবার বলি দাঁতের মাজনের আবির্ভাবের কথা। যবে থেকে দাঁত আছে দাঁতের মাজনও আছে, শুধু তার রকম সকম বদলেছে এই যা।

টুথ ফেয়ারি আর দাঁতের মাজনের কথা
বিভিন্ন ব্র্যান্ড-এর টুথপেস্ট

ইতিহাসবিদরা বিশ্বাস করেন যে মিশরের অধিবাসীরাই সব থেকে প্রথম দাঁত পরিষ্কার করার জন্যে দাঁতের মাজন ব্যবহার করে খ্রীষ্টের জন্মের ৫০০০ বছর আগে! গ্রীক, চাইনিজ, রোমান এবং ভারতীয়রা আরো অনেক পরে যিশু খ্রীষ্টের জন্মের মাত্র ৫০০ বছর আগে থেকে মাজন ব্যবহার করতে শেখে। সেই যুগে লোকেদের দাঁত বা মুখ পরিষ্কার করার অনেক রকম প্রথা ছিল - যেমন মুখে গন্ধ হলে ছাগলের দুধ খাওয়া, ইঁদুর, শেয়াল, নেকড়ে, খরগোস ইত্যাদি জন্তুর খুলি বা খুর পুড়িয়ে সেই ছাই দিয়ে মাড়ি ঘষা! ডিমের খোসা পুড়িয়ে মাজন তৈরির কথাও শোনা গেছে। দাঁতে ব্যথা হলে কচ্ছপের রক্ত নাকি ছিল ভাল ওষুধ! গ্রীক আর রোমানরা একটু খসখসে ধরনের মাজন পছন্দ করতেন তাই তারা হাড় বা শামুকের খোলস গুঁড়ো করে মাজনে মেশাতেন। কিছু রোমান আবার মাজনকে সুগন্ধিত করার জন্যে নানা রকম গাছের ছাল তাতে মেশাতেন। চিন দেশের লোকজন মাজনে জিন্সেং, পুদিনা পাতা বা নুনও মেশাতেন বলে জানা গেছে। ১৮০০ শতাব্দীর আমেরিকান বা ব্রিটিশ রন্ধন প্রণালী ঘেঁটে দেখা গেছে তারা নাকি মাজন বানাতে পাউরুটি পোড়া, ড্রাগনের রক্ত (সেটা আসলে নানা রকম গাছের রস দিয়ে তৈরি এক রকম লাল রঙের আঠা এবং আগেকার দিনে ওষুধ, রঙ ইত্যাদি অনেক কিছুতে ব্যবহার হত), , দারুচিনি ইত্যাদি ব্যবহার করত! তবে আমেরিকানদের নাকি দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের আগে পর্যন্ত দাঁত মাজার অভ্যাস ছিল না মোটেই! যুদ্ধে যাওয়া সৈনিকরা সেই অভ্যাস তাদের সাথে নিয়ে আসার পর আমেরিকায় সবার দাঁত মাজার প্রথা চালু হয়!

আমরা যে রকম মাজন দেখতে অভ্যস্ত সেই রকম মাজন প্রথম তৈরি হয় ১৮০০ খ্রিষ্টাব্দে। পিবডি নামে এক দাঁতের ডাক্তার প্রথম সাবান দেওয়া একটা মাজন বানান। ১৮৫০এ তাতে চকখড়ি মেশান জন হ্যারিস বলে একজন। কলগেট প্রথম বেশি পরিমাণে মাজন তৈরি করে সবার জন্যে বাজারে নিয়ে আসে ১৮৭৩ সালে। তারপর ১৮৯২ সালে লন্ডনের এক ডাক্তার ওয়াশিংটন শেফিল্ড দাঁতের মাজনকে টিউবে ঢোকানর পরিকল্পনা করেন এবং ওনার তৈরি সেই টিউবের মাজনের নাম দেন 'ডাক্তার শেফিল্ডস ক্রিম ডেন্ট্রিফিস'। তারপরেই কলগেট সবার জন্যে সেই টিউব বানিয়ে ফেলে ১৮৯৬ সালে। মাজন থেকে সাবান বাদ দিয়ে অন্য দাঁত পরিষ্কার করার জন্যে অন্য জিনিস (সোডিয়াম লরাইল সালফেট) মিশিয়ে দেওয়া হয় মাত্র ১৯৪০ সালে।

বেশ কিছু বাচ্চাদের দাঁত পরীক্ষা করে আমেরিকার এক দাঁতের ডাক্তার উইলিয়াম এংলার দেখেন যে ফ্লোরাইড ব্যবহার করলে দাঁতে পোকা হয় না। সেই থেকে দাঁতের মাজনে ফ্লোরাইড মেশানো হয় ১৯৫০ সালে। এখনকার দাঁতের মাজনে তো প্রতিষেধক অনেক কিছু থাকে।

টুথ ফেয়ারি আর দাঁতের মাজনের কথা
মিসওয়াক গাছের ডালের দাঁতন

প্রথম টুথব্রাশ নাকি তৈরি হয়েছিল ৩৫০০ থেকে ৩০০০ খ্রিষ্ট পূর্বাব্দে তে। সেটা ছিল একটা গাছের ডাল মাত্র! তার একটা দিক চিবিয়ে চিবিয়ে ব্রাশের মতন করে ফেলা হয়েছিল। এই ধরনের দাঁতের ব্রাশ মিশরের ফারাওদের কবরে (৩০০০ খ্রী.পূ.) আর ব্যাবিলনে (৩৫০০ খ্রী.পূ.) পাওয়া গেছে। ইংরাজিতে এগুলোকে 'চিউস্টিক' বলা হয়। পাখির পালক, হাড়, সজারুর কাঁটা, গাছের ডাল ইত্যাদি দিয়ে বানানো 'চিউস্টিক' যেন কিছুটা টুথপিকের কাজই করত। গৌতম বুদ্ধ নাকি এই ধরনের 'চিউস্টিক' দিয়ে মুখ ও দাঁত পরিষ্কার করার কথা বলতেন নিজের শিষ্যদের। আয়ুর্বেদে তো নিমের কাঠিকে খুব ভাল দাঁতের ব্রাশ বলে সেটা সবাই জানে। চিন দেশের দাঁতের ব্রাশ তৈরি হত ঘোড়ার লেজ আর ষাঁড়ের হাড় দিয়ে! টুথব্রাশ কথাটা প্রথম ব্যবহার হয় ১৬৯০ সালে ইংল্যান্ডের অ্যান্থনি উডের আত্মজীবনীতে, তখনও কিন্তু এখনকার মতন টুথব্রাশ আবিষ্কারই হয়নি!

টুথ ফেয়ারি আর দাঁতের মাজনের কথা
নিমের দাঁতন ভারতীয় উপমহাদেশে খুবই জনপ্রিয়

উইলিয়াম অ্যাডিস বলে এক ব্রিটিশ ভদ্রলোকের হঠাৎ খেয়াল হয় যে কাপড়ের টুকরো দিয়ে কয়লার গুঁড়ো দাঁতে ঘষতে তাঁর আর একদম ভাল লাগছে না। তিনি তাই এক জন্তুর কয়েক ইঞ্চি লম্বা একটা হাড় নিয়ে তাতে বেশ কয়েকটা ফুটো করেন। তারপর আরেক জন্তুর লোম নিয়ে সেগুলোকে ওই হাড়ের ফুটো দিয়ে ঢুকিয়ে আঠা দিয়ে এক দিকে লাগিয়ে দেন। সেই ছিল প্রথম টুথব্রাশ আর সালটা ছিল ১৭৮০।

টুথ ফেয়ারি আর দাঁতের মাজনের কথা
সম্রাট নেপোলিয়নের টুথব্রাশ

১৮০০ খ্রিষ্টাব্দ থেকে লোকে দাঁতের মাজন আর ব্রাশ এক সাথে ব্যবহার করছে বলে জানা যায়। প্রথম প্রথম কম দামের টুথব্রাশ তৈরি হত শুয়োরের লোম দিয়ে আর দামিগুলো হত ব্যাজারের (নেউলের মতন এক প্রাণী) লোমের। নেপোলিয়ান বোনাপার্ট (১৭৬৯-১৮২১) ঘোড়ার লোমের ব্রাশ দিয়ে দাঁত মাজতেন। তবে পশুদের লোম আর হাড় দিয়ে বানানো জিনিস স্বাস্থ্যের পক্ষে খুব একটা ভাল ছিল না। তাতে ব্যাক্টিরিয়া ধরে যেত এবং শুকোতেও অসুবিধা হত তাই ১৯৩৮ সালে ডুপন্ট কম্পানি নাইলনের সুতো আর সেলুলয়েড হ্যান্ডেল দেওয়া ব্রাশ বাজারে নিয়ে আসে।"

লেখাটা পড়ার পর নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ যে সে যে যুগেই জন্মাও না কেন দাঁত মাজতেই হত! আগে যে সব জিনিস লোকে ব্যবহার করত তার থেকে এখনকার মাজন আর ব্রাশ তো অনেক অনেক ভাল! তাই তুমি সব ভাল ছেলে-মেয়েদের মতন ঘুম থেকে উঠেই মাজন আর টুথব্রাশ নিয়ে বাথরুমে দাঁত মেজে নিও, কেমন?


ছবিঃ উইকিপিডিয়া

অনন্যা দাশ কর্মসূত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করেন। নেশা বই পড়া আর গল্প লেখা। শিশুদের জন্যে সামাজিক গল্প ও কিশোরদের জন্যে রহস্য গল্প লিখতে ভালবাসেন। বাংলাতে প্রকাশিত অধিকাংশ শিশু কিশোর পত্রিকাতেই লিখেছেন কোন না কোন সময়ে।

আমরা, ভারতের জনগণ, ভারতকে একটি সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, সাধারণতন্ত্র রূপে গড়ে তুলতে সত্যনিষ্ঠার সঙ্গে শপথগ্রহণ করছি এবং তার সকল নাগরিক যাতে : সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ন্যায়বিচার; চিন্তা,মতপ্রকাশ, বিশ্বাস, ধর্ম এবং উপাসনার স্বাধীনতা; সামাজিক প্রতিষ্ঠা অর্জন ও সুযোগের সমতা প্রতিষ্ঠা করতে পারে এবং তাদের সকলের মধ্যে ব্যক্তি-সম্ভ্রম ও জাতীয় ঐক্য এবং সংহতি সুনিশ্চিত করে সৌভ্রাতৃত্ব গড়ে তুলতে; আমাদের গণপরিষদে, আজ,১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর, এতদ্দ্বারা এই সংবিধান গ্রহণ করছি, বিধিবদ্ধ করছি এবং নিজেদের অর্পণ করছি।

ফেসবুকে ইচ্ছামতীর বন্ধুরা