আচ্ছা, সেদিন তুমি যখন বাবার কাছে বকুনি খেয়ে মুখ গোমড়া করে বসে ছিলে, তখন কি মা তোমাকে আদর করে গাল টিপে বলেছেন -'গোমড়াথেরিয়াম' বা দিদি তোমাকে আরো রাগিয়ে দিয়ে বলেছে 'রামগড়ুরের ছানা' ? বলেনি? আচ্ছা, সে নাহয় নাই বা বলল, কিন্তু তুমি এখন কি ভাবছ - গোমড়াথেরিয়াম মানে কি? আরে, গোমড়াথেরিয়াম হল এমন এক প্রানী, যে কিনা সব সময় মুখ গোমড়া করে থাকে! তার খবর আমরা জানতেই পারতাম না, যদি না প্রফেসর হেঁশোরাম হুঁশিয়ার তাঁর ডায়রিতে তার সম্পর্কে লিখে রাখতেন। আর প্রফেসর হুঁশিয়ার সম্পর্কেই বা জানলাম কি করে? - তারঁ সম্পর্কে আমাদের জানালেন তিনি, যিনি আমাদের সাথে আরো পরিচয় করালেন সব নানারকম মজাদার চরিত্রের - হাঁসজারু, বকচ্ছপ, কাঠবুড়ো, কুমড়োপটাশ, কাক্কেশ্বর কুচকুচে, ন্যাড়া আর অবশ্যই সেই খুব দুষ্টু ছেলে দাশুর। তুমি এদের কাউকে কাউকে , বা সবাইকেই হয়ত চেন। যদি চেন, তাহলে তো জানই এদের স্রষ্টার নাম। আর যদি নিতান্তই না জান, তাহলে, বলি, এইসব অদ্ভূত নামের চরিত্রগুলির সৃষ্টিকর্তা ছিলেন -সুকুমার রায়। তিনি, উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরির বড়ছেলে, সত্যজিত রায়ের বাবা, লীলা মজুমদারের বড়দাদা।
সুকুমার ছিলেন ছয় ভাই বোনের মধ্যে মেজ। তার আগে ছিলেন তার দিদি সুখলতা। ছোটবেলায়, ছয় ভাই বোনের মধ্যে সুকুমার, যার ডাক নাম ছিল তাতা, সে ছিল সবথেকে হই হুল্লোড়ে। সব ভাই বোনেদের নিয়ে নানারকম মজার মজার খেলা আবিষ্কার করত সে। তার বাবা উপেন্দ্রকিশোর ছিলেন ভারতীয় মুদ্রনশিল্পের জনক। তাদের বাড়ি থেক প্রকাশিত হত ছোটদের জন্য রঙিন মাসিক পত্রিকা - সন্দেশ। বড় হওয়ার পরে, বাবার ইচ্ছায়, সুকুমার বিলেত যান মুদ্রনশিল্প এবং ফটোগ্রাফি নিয়ে পড়াশোনা করতে। সেখান থেকে ফিরে এসে তিনি ইউ রায় অ্যান্ড সন্স এর কাজকর্ম দেখতে শুরু করেন।
এই সব কিছুর মধ্যেই চলতে থাকে লেখালিখি। সুকুমার শুধু মজার মজার কবিতা ও গল্প লিখতেন না, তার সাথে সাথে আবার সব মজাদার চরিত্রগুলির ছবিও আঁকতেন। সেইসব কবিতা গুলি সেইসব মজাদার ছবির সাথে ছাপা হত।
এই সব মজাদার, উদ্ভট, আজগুবি, অসম্ভব কবিতাগুলিকে একসাথে করেই প্রকাশ করা হয়েছিল 'আবোল তাবোল'। 'আবোল তাবোল' যদি এখনও না পড়ে থাকো, তাহলে শিগগির পড়ে ফেল।
আরেকটা মজার বই হল হ-য-ব-র-ল। হ-য-ব-র-ল এর মত আজগুবি কিন্তু মজাদার গল্প আর দুটো হয়না। এই গল্পে নানারকম পাখি এবং পশুরা কথা বলে, এবং নানারকমের অসম্ভব ঘটনা ঘটায়। এই বইয়ের বিভিন্ন চরিত্র গুলির মধ্যে কাক্কেশ্বর কুচকুচে ব্যা-করণ সিং বি এ, খাদ্যবিশারদ , ন্যাড়া, হিজিবিজবিজ - এদের নাম তো করতেই হয়।
পাগলা দাশুর গল্প পড়েছ কি? যদি না পড়ে থাক, তাহলে আর দেরি না করে পড়ে ফেল। দাশু এক খুব মজাদার চরিত্র। সে ইশকুলে এমন এমন সব কান্ড ঘটায়, যে হেডস্যার পর্যন্ত মাঝে মাঝে ভেবে পান না দাশুকে বকবেন কি ছেড়ে দেবেন! কেউ কেউ বলে, দাশুটা একটা পাগল ছেলে; কেউ বলে, না, ও আসলে একটা দুষ্টূ ছেলে; এদিকে তাই বলে ভেব না, দাশুর মাথায় বুদ্ধি নেই; দাশু কিন্তু মাঝে মধ্যে পড়াশোনাটাও বেশ মন দিয়ে করে। পাগলা দাশু পড়ার পর দেখবে, দাশুকে খুব চেনা চেনা লাগছে। কেন বলতো? কারন, ভাল করে ভাবলেই বুঝতে পারবে, তোমার ক্লাসের কোন একটা বন্ধুর সংগে দাশুর ভারি মিল! কোন বন্ধুটা, সেটা অবশ্য তোমাকে খুঁজে নিতে হবে।
ছোটদের মধ্যে তিনি বিলিয়েছিলেন অনাবিল হাসি আর স্ফূর্তির খোরাক। তাই বলে ভেব না, খালি হাসি-মজার গল্পই লিখতেন তিনি। দেশ বিদেশের নানারকমের আবিষ্কারের গল্প, মনিষিদের গল্প, রূপকথার গল্প, সরস ভাষায় ছোটদের জন্য লিখতেন তিনি। শুধু ছোটরা কেন, বড়রাও পেত তাদের ভাগের হাসির খোরাক। তাঁর বন্ধুদের নিয়ে তিনি প্রথমে গঠন করেছিলেন 'ননসেন্স ক্লাব' , এবং পরে 'মন্ডা ক্লাব'; সেই দলের সদস্যরা সোমবার (অর্থাৎ মনডে) একসঙ্গে দেখা করতেন, দেশ-সাহিত্য-সমাজ-শিল্প- এইসব বিষয়ে নানা রকম গুরুত্বপূর্ন আলোচনা করতেন আর প্রচুর হই-হুল্লোড় খাওয়া দাওয়া করতেন। এই সংগঠন গুলিতে যোগ দিয়েছিলেন সেই সময়ের প্রচুর বিখ্যাত মানুষ।
এত আনন্দ যিনি অকাতরে বিলিয়েছিলেন, আমাদের সেই মনের মানুষটি কিন্তু আমাদের ছেড়ে চলে যান খুব অল্প বয়সে। সেই সময়ে কালাজ্বর নামে এক অসুখ হত, যার কোন ওষুধ তখনও আবিষ্কার হয়নি। সেই কালাজ্বরের প্রকোপে, মাত্র ৩৯ বছর বয়সে, আঁকতে আঁকতে, লিখতে লিখতে, গল্প বলতে বলতে, আশেপাশের সব মানুষকে ছেড়ে চলে যান সুকুমার রায়। কিন্তু আমাদের জন্য রেখে গেছেন মন ভাল করা গল্প-কবিতা-নাটকের এক বিশাল ভাণ্ডার। তোমার - আমার সবার জন্য।
মহাশ্বেতা রায়
কলকাতা
ছবিঃ
উইকিপিডিয়া