১৯১৪ সাল। জানুয়ারি মাস। ক্যালিফোর্নিয়ার কিস্টোন স্টুডিও মালিক ম্যাক সেনেট সেদিন শ্যুটিং করছেন 'মেব্ল্স্ স্ট্রেঞ্জ প্রেডিকামেণ্টস' নামের একটি ছবির। কিন্তু নির্বাক এই ছবিতে যতটা মজা থাকা উচিত, ততটা ঠিক যেন জমছে না। তাঁর কোম্পানিতে তখন সদ্য যোগ দিয়েছেন এক তরুণ অভিনেতা, চার্লস চ্যাপলিন। চ্যাপলিনকে ডেকে সেনেট নির্দেশ দিলেন, একটু হাস্যকর সাজগোজ করে এসে কিছু মজাদার অভিনয় করতে, যাতে গল্পটা বেশ জমে যায়।

চ্যাপলিন পরে নিজের আত্মজীবনীতে লিখেছিলেন, সাজঘরের দিকে এগিয়ে যাওয়ার পথে একটু ভাবনা চিন্তা করতেই তাঁর মাথায় এসে গেছিল সেই ছবির প্রয়োজন অনুযায়ী 'হাস্যকর' চরিত্রের সাজঃ পরণে ঢিলেঢালা প্যান্টস্, বড় মাপের জুতো, একটা ছড়ি আর একটা ছোট্ট ডার্বি টুপি। সবকিছু হবে বিপরীত- বড় প্যান্টস্ , তাই তার সাথে চাপা কোট, ছোট্ট টুপির সাথে বড় মাপের জুতো। তখন চ্যাপলিনের বয়স মোটে চব্বিশ, তাই নাকের নিচে লাগালেন ছোট ব্রাশের মত গোঁফ - বয়স যাতে একটু বেশি লাগে, কিন্তু মুখের ভাবভঙ্গী পরিষ্কার দেখতে পাওয়া যায়।
তিনি আরোও লিখেছিলেন, "পোষাক আর মেকআপ আমাকে সেই মানুষটিকে অনুভব কররে সাহায্য করল। আমি তাকে চিনতে শুরু করলাম, আর যতক্ষণে আমি স্টেজে গিয়ে পৌঁছালাম, ততক্ষণে তার পুরোপুরি জন্ম হয়ে গেছে" -আর, এইভাবেই জন্ম নিল বিশ্বের সবথেকে জনপ্রিয় চরিত্রগুলির মধ্যে একজন - সেই ট্র্যাম্প বা ভবঘুরে। শ্যুটিং সফলভাবে শেষ হল। কোম্পানীর মালিক ম্যাক সেনেট এবং ছবির নির্দেশক তথা নায়িকা মেব্ল্ নরম্যান্ড খুবই খুশি হলেন।

'কিড্স অটো রেসেস অ্যাট ভেনিস' ছবিতে প্রথম দেখা দিল ট্র্যাম্প
যদিও 'মেব্ল্স্ স্ট্রেঞ্জ প্রেডিকামেণ্টস' ছবিটি আগে তৈরি হয়েছিল, কিন্তু সিনেমার দর্শকদের সামনে সেই ট্র্যাম্প বা ভবঘুরে প্রথম দেখা দিল অন্য একটি ছবিতে, যে ছবিটি বাজারে মুক্তি পায় 'মেব্ল্স্ স্ট্রেঞ্জ প্রেডিকামেণ্টস' মুক্তির মাত্র দুদিন আগে। সেটিও কিস্টোনের-ই ছবি, সেটির নাম 'কিড্স্ অটো রেসেস এ্যাট ভেনিস'; ছবিটি মুক্তি পায় ১৯১৪ সালের ৭ই ফেব্রুয়ারি। সেই ছবিতে দেখা যায়, ছোট ছেলেদের গাড়ি চালানোর প্রতিযোগিতা হচ্ছে, এবং মুভি ক্যামেরায় সেই রেসের ঘটনাক্রম ধরে রাখা হচ্ছে। ভীড়ের মধ্যে থেকে এই অদ্ভূত চরিত্রটি অতি উৎসাহে মাঝে মাঝেই ক্যামেরার সামনে এসে পড়ছে। তাকে তখন গিয়ে ক্যামেরার সামনে থেকে সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। মুশকিল হল এই যে, প্রথম দুই-একবারের পরেই , সে বুঝে গেল যে ক্যামেরার সামনে গিয়ে দাঁড়ালে ক্যামেরাম্যান খুব বিরক্ত হচ্ছেন ! ছবির শেষের দিকের পুরোটাই হচ্ছে সেই মজাদার মানুষটির নানারকমের ফন্দীর কাছে ক্যামেরাম্যান এবং তাঁর সঙ্গীর নাস্তানাবুদ হওয়ার গল্প।

এডনা পারভেয়ান্স এর সাথে জুটি বেঁধে 'ট্র্যাম্প' চরিত্রে চার্লি চ্যাপলিন অনেকগুলি ছবিতে অভিনয় করেন
প্রথম ছবি সফল হওয়ার পরেই এই ভবঘুরেকে মুখ্য চরিত্র করে তৈরি হয় অসংখ্যা ছোট এবং পরে বেশ কয়েকটি পূর্ণ দৈর্ঘের ছবি।নির্বাক ছায়াছবি দুনিয়ার সফল বহু অভিনেতা-অভিনেত্রী - এড্না পারভেয়ান্স, মেরি পিকফোর্ড, ডগলাস ফেয়ারব্যাঙ্কস- নিয়মিত এই সব ছবিতে অভিনয় করেন। ভবঘুরে এই চরিত্রটি চার্লিি চ্যাপলিনকে এনে দেয় সাফল্য, খ্যাতি, আর বিশ্বের সব প্রান্তের মানুষের সম্মান আর ভালবাসা।
একশো বছর কেটে গেছে। ছায়াছবির দুনিয়ায় কতই না বদল হয়েছে। কিন্তু চ্যাপলিনের এই ট্র্যাম্পই আজও একমাত্র আন্তর্জাতিক নায়ক, যার জনপ্রিয়তা কিন্তু একফোঁটাও কমেনি। তার প্রথম আবির্ভাবে সে ঠিক যতটা সবার মন কেড়ে নিয়েছিল, আজও সেইভাবেই সে ছোট-বড় -সবার মন কেড়ে নেয়।তার মজাদার কান্ডকারখানা দেখে আমরা হেসে গড়াগড়ি যাই, ফন্দী এঁটে মন্দ লোকেদের সে যখন জব্দ করে তখন আমরা বেজায় মজা পাই, আবার তার ছোট ছোট দুঃখে আমাদের প্রাণ ফেটে যায়, তার জলভরা চোখের দিকে তাকিয়ে আমাদের চোখের কোণে জল চিকচিক করে ওঠে, গলার কাছে জমে আসে কষ্টের দলা।

'দ্য ট্র্যাম্প' ছবির একটি দৃশ্য
শিশুর মত সরল, দিলদরিয়া এই চরিত্রটিকে চ্যাপলিন কোন নাম দেন নি। কোন কোন ছবিতে তাকে 'চার্লি' বলা হলেও, বেশিরভাগ ছবিতেই তার কোন নাম নেই। সে যে সব ছবিতেই ভবঘুরের চরিত্রে অভিনয় করেছে এমনও নয়। যে সব ছবিতে সে ভবঘুরে, সেখানেও দেখা যায়, সে কিন্তু ভদ্রসমাজের সব আদবকায়দাগুলো মেনে চলতে চেষ্টা চালিয়ে যায়। আবার প্রয়োজন পড়লেই গল্পের অন্যান্য চরিত্রদের, বিশেষতঃ যারা সামাজিকভাবে ক্ষমতাশালী, যেমন পুলিশ, তাদেরকে বোকা বানিয়ে নিজের কাজ হাসিল করে নিতে তার বেশি সময় লাগে না।
চার্লি চ্যাপলিনের আত্মজীবনী এবং তাঁর ছবিগুলির ওপর পরববর্তী কালে যে সমস্ত গবেষণা বা ভাবনা-চিন্তা হয়েছে, সেইসব কিছু খুঁটিয়ে পড়লে বোঝা যায়, কিভাবে ও কেন এই সাধারণ ভবঘুরে মানুষটি পৃথিবীর সব দর্শকের কাছে এত প্রিয় হয়ে উঠেছিল। যদি তুমি সময় নিয়ে সেইসব আলোচনা পড়, তাহলে বুঝতে পারবে, যে সময়ের সাথে সাথে ভবঘুরে চরিত্রটিকে নিয়ে তৈরি ছবিগুলির দৈর্ঘ্য যত বড় হতে থাকে, সেই সব ছবিতে তত বেশি করে দেখা যায় চ্যাপলিনের জীবনদর্শনের প্রতিফলন - ক্রমাগত শিল্পোন্নত, যন্ত্রনির্ভর হতে থাকা বিশ্বের খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষদের দুঃখ, সমস্যা, যন্ত্রণা, এবং তারই সাথে মিশে থাকা সুন্দর ভবিষ্যতের আশা,স্বপ্ন এবং স্বপ্নভঙ্গ-এই সব টুকরো টুকরো ছবি দিয়েই তৈরি হয় একেকটি মাস্টারপিস - 'দ্য ইমিগ্রান্ট' (১৯১৭), 'আ ডগ্স্ লাইফ' (১৯১৮), 'দ্য কিড' (১৯২১), 'দ্য গোল্ড রাশ' (১৯২৫), 'দ্য সার্কাস' (১৯২৮), 'সিটি লাইট্স্' (১৯৩১), 'মডার্ন টাইম্স্' (১৯৩৬) ।

'আ ডগ্স্ লাইফ' ছবির একটি দৃশ্য
২০১৪ সালের পুরোটা জুড়েই পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় চার্লি চ্যাপলিনের ছবিগুলিকে আবার প্রদর্শনের মাধ্যমে, এবং নানা আলোচনার মধ্যে দিয়ে পালন করা হচ্ছে আমাদের প্রিয় ভবঘুরে চরিত্রটির একশো বছরের জন্মদিন। বিভিন্ন পত্র- পত্রিকায় এবং ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এইসব আলোচনা পড়ে আমরা জানতে পারছি, কিভাবে এই ভবঘুরে চরিত্রটি একটু একটু করে পরিবর্তিত হয়েছে। একদম প্রথম দিকে কিস্টোন স্টুডিওতে তৈরি ছোট ছোট ছবিগুলির মধ্যে এই মজাদার চরিত্রটি মোটেও বেকার, আশ্রয়হীন, ভবঘুরে ছিলনা। বরং প্রথম দিকের বেশির ভাগ ছবিতেই দেখা গেছে সে কিছু না কিছু একটা কাজ করে, অনেক ছবিতে তার স্ত্রী-পুত্রও আছে, আর সে অনেক সময়েই অন্য লোকজনকে ইচ্ছে করে বোকা বানায় নিজের কিছু সুবিধা হবে বলে। এখানে একটা কথা, চার্লি চ্যাপলিন - নামটা বললেই আমরা তাঁর সাথে এই ট্র্যাম্প চেহারাটিকে মিলিয়ে নিই, কিন্তু মনে রাখলে ভাল হয় যে চ্যাপলিনের সমস্ত ছবিতে কিন্তু এই ভবঘুরে চরিত্রটি নায়ক নয়। চার্লি চ্যাপলিন আরো অসংখ্য ছবিতে নানা ধরণের চরিত্রে, এমনকি ছোট্ট পার্শ্বচরিত্রেও অভিনয় করেছেন। এই ছবিগুলির বেশিরভাগ গল্প তাঁর লেখা, নির্দেশনা এবং প্রযোজনায় তৈরি হয়েছিল।
ট্র্যাম্প এর যে বৈশিষ্টগুলো আমাদের টানে - নিজে যথেষ্ট দুঃখ কষ্টের মধ্যে থাকা সত্বেও অন্য মানুষের প্রতি দরদ,অন্যের দুঃখে বেশি দুঃখী হওয়া- সেই সমস্ত বৈশিষ্ট প্রথম দেখা যায় ১৯১৫ সালে এসেনে স্টুডিওস থেকে প্রকাশ পাওয়া 'দ্য ট্র্যাম্প' ছবিতে। আমরা যদি এই সময়ের বিশ্ব-ইতিহাসের দিকে তাকাই, তাহলে বুঝতে পারব, কিভাবে সেই মূহুর্তের রাজনৈতিক- সামাজিক পরিস্থিতি এবং চ্যাপলিনের নিজের পেশাগত অবস্থান ছবিগুলিতেও ছাপ ফেলে, এবং ট্র্যাম্প-এর চরিত্রেও বদল আনে।
১৯১৪ সালের মাঝামাঝি শুরু হয়েছে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। সেই যুদ্ধ চলে চার বছর ধরে । এই যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে পৃথিবীর অনেক দেশ, রাজনৈতিক ও সামাজিক নানারকমের পালাবদল ঘটে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ যখন শুরু হয়, তখন আমেরিকা সেই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে চায় নি বরং নিরপেক্ষ থাকতে চেয়েছিল। আমেরিকার সাধারণ মানুষেরাও সেটাই চেয়েছিলেন। এই যুদ্ধে বৃটেন জার্মানির বিপক্ষে ছিল, বৃটেনের সাথে আমেরিকার বড় বড় বাণিজ্যিক লেনদেন চলত।চার্লি চ্যাপলিন নিজে তখন কাজের সূত্রে আমেরিকার বাসিন্দা হয়ে গেছেন। ১৯১৪ সালের শুরুর দিকে ট্র্যাম্পের আবির্ভাবের পর থেকে বছর খানেকের মধ্যেই তিনি হয়ে উঠেছেন যথেষ্ট সফল, ধনী এবং বিশ্ববিখ্যাত। কিন্তু তিনি তো আসলে ছিলেন বৃটেনের নাগরিক। তাই যুদ্ধ চলাকালীন ১৯১৬ সালে বৃটিশ সংবাদমাধ্যমগুলি লিখতে শুরু করে যে চ্যাপলিনের উচিত বৃটেনে ফিরে এসে যুদ্ধে যোগদান করা, যদিও তখনো সে দেশে যুদ্ধের প্রয়োজনে সেনাবাহিনীতে যোগদান করা বাধ্যতামূলক করা হয়নি। চ্যাপলিন নিজের রোজগারের অনেকটা অংশ যুদ্ধে সাহায্যের জন্য দেশে পাঠাতে থাকেন। কিন্তু তাঁকে নিয়ে তা সত্বেও সমালোচনার শেষ ছিল না। যুদ্ধে যোগদান না করার জন্য তাঁকে বিদ্রুপ করে সাদা পালক * পাঠানো হতে থাকে। চার্লি চ্যাপলিনের কাছে এ ছিল এক বিরাট চ্যালেঞ্জ- একদিকে তাঁর সৃষ্ট গরীব, বেকার, ভবঘুরে চরিত্রটি হয়ে উঠেছিল বিশ্বের সবথেকে জনপ্রিয় চরিত্র; অন্যদিকে তিনি নিজেও ছিলেন খ্যাতির সাথে সাফল্যের চূড়ায়। এই দুই বিপরীতের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করার জন্যই ধীরে ধীরে ছোট্ট ভবঘুরেটির চরিত্রের মধ্যে পরিবর্তন আসে- সেই সময়ের অন্যান্য সিনেমার ভবঘুরে চরিত্রগুলির মত সে শুধুমাত্র চুরি বা মারামারি করে না, অথবা নিছক মজার জন্য কাউকে হেনস্থা করে না; তার মধ্যে দেখা দেয় সমবেদনা এবং সহানুভূতির মত লক্ষণগুলি। আর যুদ্ধবিধ্বস্ত পৃথিবীর সাধারণ মানুষের ভালবাসা তার প্রতি বাড়তেই থাকে।

'শোল্ডার আর্ম্স্' ছবির পোস্টার
কিন্তু বৃটিশ সংবাদমাধ্যমগুলি যদিও চ্যাপলিনের সাথে বিরূপ ব্যবহার করেছিল, যাঁরা আসলে যুদ্ধে গেছিলেন, তাঁরা কিন্তু চ্যাপলিনের ওপরে রেগে ছিলেন না। সেই সময়ে আমেরিকার বিভিন্ন হাসপাতালের ঘরগুলির ছাদে প্রোজেক্ট করে চ্যাপলিনের ছবি দেখানো হত, যাতে যুদ্ধে আহত সৈনিকেরা, শারিরীক কষ্টের মধ্যেও, বিছানায় শোয়া অবস্থাতেই একটু আনন্দ পেতে পারেন । এমনও জানা গেছে যে বৃটিশ সৈন্যরা কোন এক সময়ে 'ট্র্যাম্প'-এর একটা বড় কাট-আউট নিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে নিজেদের পরিখার ওপর দিয়ে দাঁড় করিয়ে দিত, যাতে জার্মান সৈন্যরা হাসতে হাসতে পেটে খিল ধরে মরে যায়। ১৯১৭ সালে জার্মানির ওপর ক্ষুব্ধ হয়ে আমেরিকা নিজেই বৃটেনের পক্ষে থেকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। সেই সময়ে চ্যাপলিন নিজে সেনাবাহিনীতে নাম লেখাতে যান। কিন্তু তাঁর ওজন ও উচ্চতা কম ছিল বলে সেনাবাহিনীতে তাঁকে নেওয়া হয়নি।
১৯১৮ সালে ট্র্যাম্পকে নায়ক বানিয়ে চ্যাপলিন তৈরি করে যুদ্ধের পটভূমিকায় ছবি 'শোল্ডার আর্মস্'। এই ছবিতে দেখা যায়, ট্র্যাম্প যুদ্ধে যোগদান করে ফ্রান্সে চলে গেছে। সেই সময়ে যদিও প্রথম বিশ্বযুদ্ধ প্রায় শেষের মুখে, এবং প্রথম বিশ্বযুদ্ধের মত একটা সংবেদনশীল বিষয় নিয়ে ছবিটি তৈরি করা এক দুঃসাহসিক কাজ ছিল, কিন্তু সাধারণ মানুষ ট্র্যাম্পকে যুদ্ধক্ষেত্রে দেখতে পেয়ে খুবই খুশি হয়েছিলেন।

'সিটি লাইট্স্' ছবির একটি দৃশ্য
১৯৩১ সালে তৈরি সিটি লাইট্স্ ছবিটিকে বলা হয়ে চ্যাপলিনের তৈরি অন্যতম সেরা ছবি। এই ছবিতে আরেকবার ট্র্যাম্পই নায়ক। এই ছবি যখন তৈরি হয়, তার দুয়েক বছর আগে হলিউডে সিনেমায় শব্দ সংযোজনা করা শুরু হয়ে গেছে। কিন্তু চ্যাপলিন নিজের ছবিতে শব্দ ব্যবহার করতে চান নি। তিনি জানতেন, তাঁর ট্র্যাম্প চরিত্রটিকে কোন গলার স্বর বা ভাষা দেওয়া ঠিক হবে না। তার নিজস্ব কোন ভাষা বা গলার স্বর নেই বলেই সে সারা বিশ্বের সর্বত্র সমান জনপ্রিয়। প্যান্টোমাইম ঘরানায় অভিনয়ের গতি এবং মেজাজ তার নিজস্ব বৈশিষ্ট। সেই ছোট্ট ভবঘুরে যদি হঠাৎ ইংরেজিতে কথা বলতে শুরু করে, তাহলে সে আন্তর্জাতিক দর্শকদের মধ্যে একটা বিরাট অংশের ভালবাসা হারাবে। তাছাড়া সে ঠিক কিভাবে কথা বলবে? তার গলার আওয়াজ কিরকম হবে- সেটাও তো ভাবার ছিল- কারণ প্রতিটি দর্শক তো তার নিজের মত করে চরিত্রটির গলার আওয়াজ মনে মনে কল্পনা করে নিয়েছে। তাকে তিনি মাত্র একটা গলার আওয়াজ, একটা ভাষা দেন কি করে?
'সিটি লাইট্স্' ছবিতে তাই নেপথ্য সঙ্গীত এবং আরো দুই-একটি শব্দের ব্যবহার থাকলেও চ্যাপলিন কোন সংলাপ ব্যবহার করেন নি। বরং তিনি সারা দুনিয়াকে চমকে দিলেন পুরো ছবির নেপথ্য সঙ্গীত সৃষ্টি করে।
'সিটি লাইট্স্' এর টাইটেল কার্ডেই শেষ দেখা যায় 'এ ট্র্যাম্প' বলে ভবঘুরে চরিত্রটির ভূমিকায় চার্লি চ্যাপলিনের নাম। কিন্তু ট্র্যাম্পকে একেবারে শেষবারের মত দেখা যায় ১৯৩৬ সালে তৈরি 'মডার্ন টাইম্স্ ' ছবিতে। সেখানে তার পরিচয় একজন কারখানার শ্রমিক। এই ছবি যখন তৈরি হচ্ছে, সেই মূহুর্তে ট্র্যাম্পের প্রথম আবির্ভাবের সময়কে পেছনে ফেলে দুনিয়া এগিয়ে গেছে আরো দুই দশক। আর তিন বছর পরেই শুরু হবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। তার জীবন শুধু আর আধুনিক যুগের গরীব মানুষদের সমস্যায় ভরা নয়। কুড়ি বছরের তফাতে সে দেখেছে আমেরিকার ভয়াবহ মন্দার বাজার, বেকারত্বের সমস্যা, আর দেখেছে কিভাবে যন্ত্রনির্ভর শিল্পব্যবস্থা এসে ক্রমশঃ কেড়ে নিচ্ছে মানুষের কাজ। চ্যাপলিন নিজেও এই বিষয়ে খুব চিন্তিত ছিলেন। সেই সময়ে বিশ্বের নানা দেশ ঘুরে দেখে তিনি মন্তব্য করেন- যন্ত্র মানুষের কাজে লাগা উচিত। মানুষের জীবনে দুঃখ এনে দিয়ে তার কাছ থেজে কাজ কেড়ে নেওয়া যন্ত্রের পক্ষে উচিত নয়।

'মডার্ন টাইম্স্' এর পোস্টার
এইসব ভাবনা চিন্তাকেই কমেডির মোড়কে পুরে ১৯৩৬ সালে তৈরি হল 'মডার্ন টাইম্স্'। যান্ত্রিক সভ্যতার নানা সমস্যা- বেকারি, দারিদ্র্য, ধর্মঘট, আন্দোলনকারী, রাজনীতি ও অর্থনীতির হরেক সমস্যাগুলির মাঝখানে, মডার্ন টাইম্স্ এর সেই ছোট্ট চেহারার কারখানা শ্রমিককে দেখা গেল যন্ত্রের সাথে অমানুষিক লড়াই করতে। কারখানার মালিক সময়কে আরো বেশি কাজে লাগানোর জন্য নিয়ে এলেন আরেক যন্ত্র, যেটি নিজেই শ্রমিককে খাইয়ে দেবে, তাকে আর দুপুরের খাওয়ার জন্য আলাদা করে কর্মবিরতি দিতে হবে না। সেই যন্ত্র পরীক্ষা করে দেখার জন্য বেছে নেওয়া হল সাদাসিধে সেই শ্রমিককে। তারপরে সে সাঁড়াশির মত যন্ত্রের কবলে পড়ে বেচারা যত নাকাল হল, সেসব দেখে আমরা খুব হাসি ঠিকই, কিন্তু মনে মনে তার অসহায় জীবনের কথা ভেবে কষ্টও পাই।
'সিটি লাইট্স্'-এর মত 'মডার্ন টাইম্স্'-এও চ্যাপলিন নিজেই ছবির সঙ্গীত এবং শব্দ পরিকল্পনা করেন। এই ছবিতেই ট্র্যাম্পকে শেষবারের মত দেখা যায়, আর একমাত্র এই ছবিতেই ট্র্যাম্পের মুখে খানিক্ষণের জন্য চ্যাপলিনের গলা শোনা যায়, যখন সে একটা রেস্তোরাঁতে বানিয়ে বানিয়ে একটা গান করে।
এই ছবির শেষ দৃশ্যে দেখা যায়, ট্র্যাম্প এবং তার সঙ্গিনী হাতে হাত ধরে হাঁটা দেয় দূর দিগন্তের দিকে। "আমরা ঠিক চালিয়ে নেব..."- এই বিশ্বাসে বুক বেঁধে এই দুই বাঁধনহারা প্রাণ পাড়ি দেয় অজানার উদ্দেশ্যে।

'দ্য কিড' ছবির একটি দৃশ্য
একশো বছর পেরিয়ে গেছে, কিন্তু তার পথচলা আজও শেষ হয়নি। সেই ছোট্ট ভবঘুরে আজও হেঁটে চলেছে, আর সাদা-কালো সিনেমার পর্দার থেকে হাত বাড়িয়ে মাঝে মধ্যেই মুছিয়ে দিচ্ছে কারো চোখের জল, নানারকমের হাবভাব করে কারোর গোমড়া মুখে এনে দিচ্ছে হাসি, অথবা কারোর মনখারাপ হলে চুপচাপ পাশে বসে থেকে ভাগ করে নিচ্ছে তার মনের গভীরে লুকিয়ে থাকা কষ্ট। শুধুমাত্র তার চোখের ভাষা, মুখের হাসি আর নানারকমের কর্মকান্ডের মধ্যে দিয়ে, একটাও কথা না বলে, সে হয়ে উঠেছিল সারা পৃথিবীর সব বয়সী মানুষের কাছের বন্ধু। সেই বন্ধুত্ব আজও আছে অটুট।
(সাদা পালক* - অষ্টাদশ শতকের পর থেকে, যারা যুদ্ধে যেতে ভয় পেত, তাদের বিদ্রুপ করার জন্য বৃটেনে সাদা পালক ব্যবহার দেওয়া হত।)
(চার্লি চ্যাপলিনের বেশিরভাগ ছবিই ইউটিউবে বিনামূল্যে দেখতে পাওয়া যায়। তাই হাতে সময় থাকলে নতুন করে আরেকবার বন্ধুত্ব করে নিতে পারো আমাদের সবার প্রিয় ভবঘুরে বন্ধুর সাথে। )
ছবিঃ উইকিপিডিয়া