পর্ব আট
সাগরপারের কথা তো অনেক হল। এবার বরং আমাদের দেশের কথা একটু ভেবে দেখা যাক। কি ভাবছিলাম আমরা সিনেমা নিয়ে? মজার কথা এই যে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের 'অপরাজিত' উপন্যাসে কিশোর অপু যখন জানতে চাইছিল, কলকাতা শহরে বায়োস্কোপ যেখানে দেখানো হয়, সেই জায়গাটা কোথায়, প্রায় সেই সময়েই কলকাতার এক বালক, যার নাম সত্যজিত রায়, প্রথম বাংলা বায়োস্কোপ দেখে। সে ছবি তার মন ভরায়নি। কিন্তু সেই গল্প পরে। আগে জেনে নিই, ভারতে প্রথম সিনেমা কবে কোথায় দেখানো হল।
একদিন জুলাই মাসে, বর্ষার এক ভেজা বিকেলে, বম্বের (এখনকার মুম্বই) সাহেব ও মেমসাহেবরা প্রথম লুমিয়ের ভাইদের তৈরি কয়েকটা ছবি দেখেন। সেই সন্ধ্যায় টিকিটের দাম ছিল অনেক - এক টাকা!!
প্রথম ছবি প্রদর্শনীর বিজ্ঞাপন
ওয়াটসন হোটেল, বম্বে (মুম্বই )তে যেখানে প্রথম ছবি দেখানো হয়েছিল
দর্শকেরা বেশ মজা পেয়েছিল। এই প্রদর্শনীর সফলতায় উতসাহ পেয়ে ধীরে ধীরে বম্বের নানা জায়গায় ছবি দেখানো শুরু হয়। শুধুমাত্র মহিলাদের জন্য থাকতো বিশেষ 'জেনানা শো' আর শ্রমজীবী মানুষদের জন্য সস্তায় বিশেষ প্রদর্শনী ব্যবস্থা- যেটাকে বলা হত 'চার-আনা-ওয়ালা শো'।
কলকাতায় সম্ভবতঃ প্রথম চলচ্চিত্র প্রদর্শনী হয় চৌরঙ্গীর রয়্যাল থিয়েটারে- ১৮৯৭ সালের ২০শে জানুয়ারি। স্টেটসম্যান পত্রিকার বিজ্ঞাপন থেকে এই তথ্য জানা গেছে। তবে ছায়াছবি আরো বেশি মর্যাদা পেতে শুরু করল যখন সেই সময়ের বিখ্যাত থিয়েটার, স্টার থিয়েটার, তাদের নাট্য প্রদর্শনীর ফাঁকে ফাঁকে এক রিলের ছবি দেখানো শুরু করল। স্টার এর প্রদর্শন যন্ত্রটির নাম ছিল 'বায়োস্কোপ'। সেই থেকেই বাঙালিদের মধ্যে 'সিনেমা'র বদলি শব্দ হয়ে গেছে 'বায়োস্কোপ'।
এভাবে যখন টুকরো টুকরো ছবি দেখানো হচ্ছে, তখন আবার ফাদার লাফো, কলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স্ কলেজে বিজ্ঞানের ক্লাস নিতে নিতে দেখাচ্ছেন ছোট ছোট শিক্ষামূলক ছবি। এভাবেই বাংলা ছবি একদিন খুঁজে পেল ভারতীয় ছায়াছবির সত্যিকারের পথিকৃত হীরালাল সেন কে।
তথ্য থেকে জানা যাচ্ছে, কলকাতায় ম্যাডান রা আর বম্বেতে আব্দুলআলি-ইউসুফআলি তাঁবু খাটিয়ে সার্কাসের মত করে ছবি দেখাচ্ছেন। কেমন ছিল এইসব ছবি? -ইউরোপ-আমেরিকার নানা দৃশ্য, যেমন রানীর অন্তিম যাত্রা, বা রাষ্ট্রপতি ম্যাকিনলের হত্যা- এইরকম সব ঘটনা। আমাদের দেশীয় লোকজনের কাছে এসব প্রায় ম্যাজিক মনে হত। তাদের ততটা ভালোও লাগত না।
এইরকম একই অভিজ্ঞতার বিবরণ দিয়েছেন আজকের দুনিয়ার সবচেয়ে নামী ঔপন্যাসিক গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ, তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস 'ওয়ান হাণ্ড্রেড ইয়ার্স অফ সলিটিউড' এ লাতিন আমেরিকায় প্রায় এক ই রকমের অভিজ্ঞতার বিবরণ দিচ্ছেন- একটা ছোট্ট হলদে ট্রেনে করে ছবি এল; মাকোন্দো নামের ছোট্ট শহরে লোকেরা প্রদর্শনীগুলিতে সিনেমাকে নেহাতই জাদু-ভেলকি ভেবে বিরক্তই হচ্ছিল; অবশেষে শহরের মেয়র তাদেরকে শান্ত করার জন্য বললেন- সিনেমা তেমন গুরুত্বপূর্ণ কিছু নয় যে তাই নিয়ে মাথা ঘামাতে হবে।
ভারতবর্ষের মানুষেরও একই অভিজ্ঞতা হল। তারপর এখানেও ধীরে ধীরে আমাদের নিজস্ব নিসর্গ চিত্র বা সামাজিক উতসবের ছবি তোলা শুরু হল। পশ্চিম ভারতে এরকম মানুষ ছিলেন হরিশ্চন্দ্র সখারাম ভাটওয়াডেকর। আর পূর্ব ভারতে হীরালাল সেন।
ভারতীয় জীবনযাত্রা দেখিয়ে প্রথম দিকের মজাদার ছবি
কলকাতায় যখন মনুমেন্ট ময়দানের একটু দক্ষিণে তাঁবু ফেলে ফরাসি পাতে কোম্পানি ছবি দেখাতে এল, প্রায় তখন থেকেই মূলতঃ পূর্ববঙ্গীয় এই যুবক নানা ধনীগৃহে ও বাগান বাড়িতে এইসব ছবি দেখাতেন। 'দ্য বেঙ্গলি' নামে খবরের কাগজের বিজ্ঞাপন আমাদের জানাচ্ছে যে অমরেন্দ্রনাথ দত্তের ক্লাসিক থিয়েটারে, নাটক প্রদর্শনীর বিরতিতে কিছু চমকপ্রদ চিত্র প্রদর্শিত হবে, যেমন- ভ্রমর, আলিবাবা, দোল লীলা ইত্যাদি; বিজ্ঞাপনের তারিখ ১৯০১ সালের ২রা ফেব্রুয়ারি।
আলিবাবা
বিল্বমঙ্গল ছবির বিজ্ঞাপন
সালুঙ্কে - প্রথম পুরুষ অভিনেতা যিনি নায়িকার ভূমিকায় অভিনয় করেন
হীরালাল ও হরিশচন্দ্র দুজনেই দিল্লি- দরবার, রাজা সপ্তম এডওয়ার্ডের রাজ্যাভিষেক এই জাতীয় কিছু তথ্যচিত্র বানিয়েছিলেন। দুঃখের বিষয়, ১৯১৭ সালে এক ভয়াবহ অগ্নিকান্ডে হীরালাল সেনের সমস্ত ছবি ছাই হয়ে যায়। তার মাত্র দুদিন বাদেই স্বয়ং হীরালাল সেন নিজেও চিরবিদায় নেন। হারিয়ে গেল বাংলা সিনেমার আদিপর্বের ইতিহাস।
যে মানুষটি বাংলা সিনেমা তৈরি করা ও দেখানোর পুরো ব্যবস্থাটাই সাজিয়ে তোলেন, তিনি নিজে কিন্তু মোটেই বাঙালি নন-পার্শী ছিলেন। তার নাম ছিল জামশেদজি ফ্রানজি ম্যাডান। মধ্য কলকাতার চাঁদনি অঞ্চলে তাঁর নামে একটা রাস্তা আছে। তাঁর এলফিনস্টোন বায়োস্কোপ কোম্পানি হীরালালের মৃত্যুর বছরই প্রথম বাংলা কাহিনীচিত্র বানায়- সে ছবির নাম ' সত্যবাদী রাজা হরিশচন্দ্র'।
রাজা হরিশ্চন্দ্র ছবির বিজ্ঞাপন
শুধু বানায় না, দেখানোরও ব্যবস্থা করে। অবশ্য বোম্বে শহরে ইতিমধ্যেই এক মারাঠী ব্রাহ্মণ ভারতবর্ষের প্রথম কাহিনীচিত্র 'রাজা হরিশচন্দ্র' বানিয়ে ফেলেছেন। রবীন্দ্রনাথ নোবেল পুরষ্কার পেলেন ১৯১৩ সালে। আর ভারতীয় সিনেমার প্রথম দর্শকরা সেই একই বছরে বড় পর্দার সামনে বসে চোখ বড় বড় করে দেখল কিভাবে রাজা হরিশচন্দ্র ধর্মের জন্য সব ত্যাগ করলেন। এইসব নিয়ে আরো নানা গল্প হবে আগামি সংখ্যায়।
(ক্রমশঃ )
সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়
অধ্যাপক, চলচ্চিত্র বিদ্যা বিভাগ,
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়
ছবি নেওয়া হয়েছে এই বইগুলি থেকেঃ
বেঙ্গলি ফিল্ম ডিরেক্টরি, নন্দন
সো মেনি সিনেমাস -বি ডি গর্গ
ফিল্ম ইন্ডিয়া লুকিং ব্যাক ১৮৯৬-১৯৬০, দ্য ডিরেক্টরেট অফ ফিল্ম ফেস্টিভ্যালস্, নিউ দিল্লি