সত্যজিৎ রায় নানা প্রসঙ্গে নানাভাবে বলেছেন যে চলচ্চিত্র যদিবা তাঁর কাছে দূরের জিনিষ হয়, সাহিত্য তাঁর রক্তেই আছে। এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই যে পিতামহ উপেন্দ্রকিশোর, জনক সুকুমার, পিসিমা লীলা মজুমদার বা সুখলতা রাও-দের হাত ধরেই সাহিত্য এসে সত্যজিতের মনের দরজায় কড়া নাড়ে। এখানেও একটি বিচিত্র গতিপথ খেয়াল করা যায়। উপেন্দ্রকিশোর সত্যিকারের ছোটদের কথা ভেবেছিলেন, যে কারণে লিখেছিলেন 'টুনটুনির বই' ; সুকুমার ভেবেছিলেন বালকদের কথা, পাগলা দাশুদের কথা, আর সত্যজিৎ ভাবলেন বয়ঃসন্ধির কিশোরদের কথা। যুগ পালটে গেছে। দেশে স্বাধীন হয়েছে। কলকারখানা শহর বেড়ে যাচ্ছে। সুতরাং সত্যজিত অন্যান্য অনেক কিছুর সঙ্গে গোয়েন্দা গল্পেরও চর্চা করলেন। আর সেই গল্প ছবিতেও এল।
সত্যজিৎ -এর গোয়েন্দা গল্প স্ত্রী ভূমিকা বর্জিত। পুরুষের জগৎ। কিন্তু নানাভাবে বোঝা যায় দৃশ্যের সৌন্দর্য অপরাধকেও ছেড়ে যায় না। এই গোয়েন্দাগল্পগুলিতে চোখ বোলালেই বোঝা যায় যে যিনি লিখছেন তাঁর চোখ আছে। জায়গার কি নিপুণ বর্ণনা, সে দার্জিলিং- গ্যাংটকই হোক, বা কাশী কিংবা জয়শলমীরই হোক। টুরিস্ট ব্যুরোর বইকে আমরা ফেলে দিতে পারি, কিন্তু সত্যজিতের আঁচড়ে যে রাজস্থান, তাকে পাত্তা না দেওয়ার যো নেই। ছোটরা আর তাদের বাবা মায়েরা মেনেও নিয়েছেন সে কথা। যে কারণে 'সোনার কেল্লা' আর 'জয় বাবা ফেলুনাথ' এত জনপ্রিয়।
সোনার কেল্লা ছবির পোস্টার
আসলে সত্যজিৎ রায় গল্পটাই যে অন্য ভাবে বলেন। খুব যে তদন্ত আছে তা নয়, বরং আমরা খেয়াল করি ফেলুদা ও তোপসের দিকে তাঁর ঝোঁক অনেক বেশি। মগনলাল মেঘরাজ আর সোনার কেল্লার দুষ্টু লোকেদের খুঁজে বের করার জন্য খুব বেশি পরিশ্রম করে না ফেলুদা। শুধু ব্যবহার করে 'মগজাস্ত্র'। আর অসাধারণ হয়ে আমাদের কাছে জেগে থাকেন আরেকজন - জটায়ু সন্তোষ দত্ত। কি দারুণ লাগে জটায়ু যখন ময়ূর দেখে ন্যাশ্নাল বার্ড বলেন, বা যখন তাঁকে ব্যায়াম করতে দেখি 'জয় বাবা ফেলুনাথ' -এ । ছোটদের জানান না দিয়েই জটায়ু হয়ে ওঠেন বাংলার গোয়েন্দা গল্পের এক জীবন্ত সমালোচনা।'সাহারায় সীতাহরণ' তো তাঁরই লেখা!
জয় বাবা ফেলুনাথ- এর পোস্টার
আমরা যে এত খুশি হই তার কারণ এইসব গল্পে খুব হাড় হিম করা মারামারি নেই। বুনোট তেমন প্যাঁচালো নয়।কিন্তু কি সুন্দরভাবে সত্যজিতের সাথে ট্রেনে, বা গাড়িতে বা পায়ে হেঁটে, 'সোনার কেল্লা' দেখতে দেখতে আমাদের রাজপুতানা বেড়ানো হয়ে যায়। উটের পিঠে চড়ার মজা, উটের দৌড় আর ট্রেনের দৌড়, বারানসীর গঙ্গার ঘাট বা ছোরা খেলা, সবই আমরা দেখে ফেলি ঘন্টা দেড়েকের মধ্যে।
আর কিছু তো জোর করে চাপিয়ে দেওয়া নেই। সত্যজিৎ রায়ের কোন ভানই নেই যে তিনি সবার আগে পৌঁছে অপরাধী খুঁজে দেবেন। আমরা অনেক সময়ে প্রথম থেকেই জানি কোন লোকটা খারাপ। তবু গল্পটা এত ভাল যে আমরা গল্পেই মজে থাকি। এ প্রায় আলফ্রেড হিচ্ককের ছবির মত, যেখানে খোঁজাটা ওজনদার, বরং দেখাতেই আনন্দ। সত্যজিৎ রায়, একমাত্র সত্যজিৎ রায়ই আমাদের বারো- তেরো বছরের দুঃখটা বুঝেছিলেন --- যে আমরা একটা গল্প শুনতে বা দেখতে চাই, সে আমাদের সাথে বাবা মা থাকুন আর নাই থাকুন...গল্পটা আমাদের যেন বড় ভাবে !