খেলাঘরখেলাঘর

আমার পুজো

এখন এই মুহুর্তে মালিকের দাঁত খিঁচুনি থেকে রেহাই, নেই  খদ্দেরের বকুনি। খসে যাওয়া কালচে ইঁটের দেওয়ালে ছোট্ট খুপরি জানালা। ওই জানালায় রাতের আকাশ, গাছ-গাছালি, দূরে ট্রেন লাইন, বাজার, ঘর-বাড়িগুলো দেখাটুকু এখন আমার স্বাধীনতা। হোটেলের এই জানালার পাশে খাবার টেবিলে পুরানো আলুর বস্তায় আমার রাতের বিছানা। তক্ষুনি রাতের শেষ বারোটা চল্লিশের ডাউন ট্রেনটা ক্লান্ত ধীরে ধীরে ঘ্যাটর ঘ্যাটর  শব্দ তুলে চলে গেল না জানি কোন সে স্বপ্নের দেশে!
এদিকে পেছনে রান্নার ঠাকুর হরনাথ ঘড়ুই নাকে নস্যি নিয়ে শুয়ে পড়েছে অনেক্ষন। তার পাশের টেবিলটায় কালু আর পরাণ ঘুমিয়ে কাদা এতক্ষন। চোখ যায় জানালা দিয়ে দূরে স্টেশন লাগোয়া ছাতিম গাছটায়। ওর ছাতার মতো বাহারি চেহারার মধ্যে আস্ত একটা ল্যাম্প-পোস্ট আশ্রয় নিয়েছে নিশ্চিন্তে। তার হলদেটে লালচে্ ঝিমুনিধরা আলোয় ছাতিমের ঘুম হয়েছে সজাগ। তক্ষুনি একটা হাল্কা দখিনা হাওয়ায় ছাতিম ফুলের গন্ধে চারিদিক ভরে গেল। জানান দিল শরৎ এসেছে। পূজো আসছে। মনটা খারাপ হয়ে যায়।
খড়ের ছাউনি, মাটির দেওয়া্‌ মাঝে একটা বাঁশ বাখারির জানালা -- আমার স্বাধীন ঠিকানা। মা বোনকে নিয়ে একপাশে ঘুমোয়, পাশের চাটাইতে আমার নিশ্চিন্ত রূপকথার সজাগ বিছানা। একফালি চাঁদ আর একরাশ তারা নিয়ে নিঝুম আকাশটা জেগে থাকে সে সব রূপকথা শোনার জন্য। ঝিরঝিরে দখিনে হাওয়ায় দু'একটা মেঘ উড়ে যায় উত্তরের আকাশে। রূপোলি আকাশটা কালো আঁধারের ভয়াল রূপ নেয়। মেঘ সরে গেলে পরক্ষনে সে আবার জেগে ওঠে ধিরে। আর দিগন্ত বিস্তৃত ধানের ক্ষেতে কানায় কানায় ভরে থাকা কালো জলে শ্যাওলা, শাপলার গন্ধে আমেজ আনে। দূরে দুলিপাড়ায় ঢাকের তালিমের দ্রিমিম্ দ্রিমিম্ শব্দ এক ধানের ক্ষেত থেকে আন্য ধানের ক্ষেতে ছড়িয়ে যায় ধীর লয়ে...
পূজার আয়োজনের প্রস্তুতি! মনটা আনন্দে ভরে যায়।
এক আকাশ সোনালী রোদ মেখে সাদা পেঁজা তুলো মেঘগুলো এক আকাশ থেকে আন্য আকাশে মিলিয়ে যাচ্ছে নিমেষে। তাদের ছায়াগুলো সবুজ ঢেউ খেলানো ধানের ক্ষেতে খেলা করে এলোমেলো। ঝিলের জলে লাল শালুকে লাগে দুলুনি আর কালচে সবুজ পাতাগুলো হাওয়ায় উল্টে ছপাৎ ছপাৎ শব্দ করে আবার ভেসে থাকে কালো জলে। যেন ওদের খেলায় পেয়েছে এখন।
বন্ধুরা একে একে ঝাঁপিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে ঝিলের জলে। তবে আর দেরি কেন এক লাফে ঝপাং করে লাফিয়ে পড়া। তারপর সাঁতারে শালুক ফুলগুলো তুলে, এক ডুবে জলের নিচে পাঁক কাদার মধ্যে থেকে শালুকের মুল টেনে তুলে এনে পাড়ে জড়ো করা। ভেজা গায়ে শালুক ফুলের ডাঁটা চিবোতে চিবোতে মনে পড়ে ইস্কুলে যেতে হবে! সবাই এক সঙ্গে দৌড় দৌড়।
ততদিনে খেয়াঘাটে নতুন নতুন নৌকা ভিড়তে শুরু করেছে। হরেক রকমের  জিনিষপত্র বোঝাই। মনিহারি, হাঁড়ি-কলসি, লোহা-লক্কড়, জামা-কাপড় আরো কত কি যে ! একে একে মালপত্র নামানো হচ্ছে। নিয়ে যাওয়া হচ্ছে বাজারের মধ্যে। বিকেলের সোনালী রোদে সে যেন এক স্বপ্নের মায়াময় পরিবেশ। এবার দৌড়ে ফিরতে হবে বাজারের দূর্গা মন্ডপে।চারদিকে সব সেজেগুজে তৈরী হচ্ছে, নতুন নতুন দোকান, রকমারী তাদের বাহার। ঝাঁ চকচকে সাজসজ্জা। চোখ ফেরানো দায়। মন্ডপের দিকে এগোতে গিয়ে দেখা যায় ডানদিকটায় একটা মস্ত বড় নাগরদোলা জমিয়ে বসেছে। ঘুর পাক খাইয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা চলছে। তাকে ছাড়িয়ে একটু দূরে একটা সার্কাসের দল তাঁবু পেতেছে! সামনের টিনের দেওয়ালের মাঝেমধ্যে ফাঁক ফোকর দিয়ে যেটুকু ভেতরের জগৎ দেখা যায়, তাই দেখতে অনেকের ভিড়। 
পালিশ না করা লাল ইঁটের উঁচু মন্ডপ সাদা চুনের প্রলেপ দিয়ে বাইরের আস্তরনে নিজের আব্রুটুকু রক্ষা করছে। মন্ডপের মধ্যে পটিদার ঘনশ্যাম পাল দূর্গার মুর্তিতে নির্বিকারে হলদে-সাদা রং-এর প্রলেপ দিয়ে চলেছে। অবাক নয়নে চেয়ে থাকে উৎসুক ভিড়, কেমন করে যেন মাটির মুর্ত্তিটা জীবন্ত হয়ে উঠছে। বিশাল আকৃতির দূর্গার চালা মাটিতে ফেলে রাখা আছে। আঁকা আছে পৌরানিক কাহিনীর পটচিত্র। রয়েছে হর-পার্ব্বতীর যুগল মূর্ত্তি, রামের অকাল বোধন, হনুমানের পর্ব্বত হাতে উড্ডিয়মান দৃশ্য, রাম সীতা লক্ষণের বনবাস গমন, আরো আরো অনেক কিছু ! যেন পৌরানিক কাহিনীর চলমান চিত্রমালা।
মন্ডপের সামনে বিশাল চারদিক খোলা যাত্রার মঞ্চ তৈরী হচ্ছে। তার লাগোয়া বড় বড় খুঁটি পোঁতা হচ্ছে। কলকাতার  নামী যাত্রাদল আসছে। দু'দিন হবে দুটো যাত্রাভিনয়--আষ্টমী ও নবমী।
বিজয়ায় হবে আতসবাজীর রঙ্গীন ফুলকির খেলা। হরেক রকমের বাজীর রকমারী কসরৎ আকাশ মাটি রাঙ্গিয়ে মন মাতিয়ে ব্যান্ড পার্টির বাজনার তালে তালে নাচতে নাচতে খেয়াঘটে হবে বিসর্জন। খেয়াঘাটে তখন মেলার চেহারা। এবার বাড়ি ফেরার পালা। জমানো এক টাকাটা দিয়ে একটা বাঁশি কিনে বাজাতে বাজাতে ফেরা। খুব-খুব ইচ্ছে করে যদি একটা বড় বাঁশের বাঁশি কিনতে পারা যেতো। দারুন লাগে বাজাতে। ওই যাত্রাদলের লোকগুলো কেমন বাজিয়ে মাৎ করে সে রকম বাজাতে ইচ্ছে করে। ইচ্ছে করে চলে যেতে যাত্রাদলে।
রাত্রে বাড়ি ফিরে মাটির ভান্ডারটা ঝাঁকিয়ে দেখা মেলে কয়েকটা পয়সা জমেছে। গোবিন্দ হালদারদের বাড়ির খড়ের আঁটি খেয়াঘাটে বজরায় বয়ে দিয়ে পয়সা যা জমেছে, এই দিয়ে যদি না হয় তবে মায়ের কাছে চাইতে হবে কিন্তু মা দেবে তো! পেছন ফিরতেই দেখা গেল মা শুকনো মুখে দাঁড়িয়ে। জিজ্ঞাসু চোখে তাকিয়ে থাকতে হয়। কিছু বলার আগে বলে -- "কলকাতা যাবি --ঝন্টা?" অবাক হয়ে চেয়ে থাকি। হঠাৎ মা কেন কলকাতা যাওয়ার কথা বলছে! মা আবার শুরু করে --"ওখানে আনন্দে থাকবি,দুবেলা পেটপুরে খেতে পাবি। বছরে দুবার পরনের জামা কাপড় পাবি। মজার শহর কলকাতা, ঘুরে ফিরে কতকিছু দেখতে পাবি  -- জানতে পারবি, অবাক বনে যাবি।"

হঠাৎ একটা খোঁচা খেয়ে ঘুম ভেঙ্গে যায়। বাজারের কোলাহল, চেঁচামেচি, কলতলায় থালা বাসন ধোবার ঘ্যাড়ং ঘ্যাড়ং শব্দ, মাছের বাজারে হাঁকা হাঁকি, সব্জি বাজারে দরাদরি, রাস্তায় ভিড়ে আটকে থাকা অটোরিক্সা, ট্রাকের ইঞ্জিনের কর্কশ আওয়াজ, রিক্সাভ্যানের প্যাঁক প্যাঁক শব্দ, তক্ষুনি ভরপেটা বাদুড়ঝোলা ট্রেনটা বিকট শব্দ  করে তীব্র গতীতে শহরের ভেতরে ঢুকে গেল। চেয়ে দেখি হরনাথ গায়ে গামছা দিয়ে মুখে নিমের দাঁতন চিবোতে চিবোতে খেঁকিয়ে মাৎ করছে --"হুই-নবাবপুত্তুর ওঠ। বেলা চড়ে গেল, এখনো বাবু বিছানা ছেড়ে উঠা হল না। ওরা
কখন উঠে কলতলায় খেটে মরছে আর উনি কোথাকার লাটসাহেবর নাতি এলেন ঘুম দিচ্ছেন? ওঠ - ওঠ হতচ্ছাড়া!"
 
নিধু সর্দার
ভুবনগ্রাম

 

কাগজে-কলমে গ্রাফিক ডিজাইনার। কিন্তু সে কাজ ছাড়াও ইনি নানা কাজ করেন - মাঝেমধ্যে ইচ্ছামতীর জন্য ছবি আঁকেন, মাঝেমধ্যে ভাল ভাল গল্প লেখেন, আর প্রয়োজন হলেই চাঁদের বুড়িকে নানারকমের সাদাকালো-একঘেয়ে-বিরক্তিকর কাজকর্ম (যেগুলি একটা ব-অ-ড় ওয়েবসাইট চালাতে গেলে করতেই হয়)-সেইসব করতে সাহায্য করেন।