আমার পুজো
এখন এই মুহুর্তে মালিকের দাঁত খিঁচুনি থেকে রেহাই, নেই খদ্দেরের বকুনি। খসে যাওয়া কালচে ইঁটের দেওয়ালে ছোট্ট খুপরি জানালা। ওই জানালায় রাতের আকাশ, গাছ-গাছালি, দূরে ট্রেন লাইন, বাজার, ঘর-বাড়িগুলো দেখাটুকু এখন আমার স্বাধীনতা। হোটেলের এই জানালার পাশে খাবার টেবিলে পুরানো আলুর বস্তায় আমার রাতের বিছানা। তক্ষুনি রাতের শেষ বারোটা চল্লিশের ডাউন ট্রেনটা ক্লান্ত ধীরে ধীরে ঘ্যাটর ঘ্যাটর শব্দ তুলে চলে গেল না জানি কোন সে স্বপ্নের দেশে!
এদিকে পেছনে রান্নার ঠাকুর হরনাথ ঘড়ুই নাকে নস্যি নিয়ে শুয়ে পড়েছে অনেক্ষন। তার পাশের টেবিলটায় কালু আর পরাণ ঘুমিয়ে কাদা এতক্ষন। চোখ যায় জানালা দিয়ে দূরে স্টেশন লাগোয়া ছাতিম গাছটায়। ওর ছাতার মতো বাহারি চেহারার মধ্যে আস্ত একটা ল্যাম্প-পোস্ট আশ্রয় নিয়েছে নিশ্চিন্তে। তার হলদেটে লালচে্ ঝিমুনিধরা আলোয় ছাতিমের ঘুম হয়েছে সজাগ। তক্ষুনি একটা হাল্কা দখিনা হাওয়ায় ছাতিম ফুলের গন্ধে চারিদিক ভরে গেল। জানান দিল শরৎ এসেছে। পূজো আসছে। মনটা খারাপ হয়ে যায়।
খড়ের ছাউনি, মাটির দেওয়া্ মাঝে একটা বাঁশ বাখারির জানালা -- আমার স্বাধীন ঠিকানা। মা বোনকে নিয়ে একপাশে ঘুমোয়, পাশের চাটাইতে আমার নিশ্চিন্ত রূপকথার সজাগ বিছানা। একফালি চাঁদ আর একরাশ তারা নিয়ে নিঝুম আকাশটা জেগে থাকে সে সব রূপকথা শোনার জন্য। ঝিরঝিরে দখিনে হাওয়ায় দু'একটা মেঘ উড়ে যায় উত্তরের আকাশে। রূপোলি আকাশটা কালো আঁধারের ভয়াল রূপ নেয়। মেঘ সরে গেলে পরক্ষনে সে আবার জেগে ওঠে ধিরে। আর দিগন্ত বিস্তৃত ধানের ক্ষেতে কানায় কানায় ভরে থাকা কালো জলে শ্যাওলা, শাপলার গন্ধে আমেজ আনে। দূরে দুলিপাড়ায় ঢাকের তালিমের দ্রিমিম্ দ্রিমিম্ শব্দ এক ধানের ক্ষেত থেকে আন্য ধানের ক্ষেতে ছড়িয়ে যায় ধীর লয়ে...
পূজার আয়োজনের প্রস্তুতি! মনটা আনন্দে ভরে যায়।
এক আকাশ সোনালী রোদ মেখে সাদা পেঁজা তুলো মেঘগুলো এক আকাশ থেকে আন্য আকাশে মিলিয়ে যাচ্ছে নিমেষে। তাদের ছায়াগুলো সবুজ ঢেউ খেলানো ধানের ক্ষেতে খেলা করে এলোমেলো। ঝিলের জলে লাল শালুকে লাগে দুলুনি আর কালচে সবুজ পাতাগুলো হাওয়ায় উল্টে ছপাৎ ছপাৎ শব্দ করে আবার ভেসে থাকে কালো জলে। যেন ওদের খেলায় পেয়েছে এখন।
বন্ধুরা একে একে ঝাঁপিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে ঝিলের জলে। তবে আর দেরি কেন এক লাফে ঝপাং করে লাফিয়ে পড়া। তারপর সাঁতারে শালুক ফুলগুলো তুলে, এক ডুবে জলের নিচে পাঁক কাদার মধ্যে থেকে শালুকের মুল টেনে তুলে এনে পাড়ে জড়ো করা। ভেজা গায়ে শালুক ফুলের ডাঁটা চিবোতে চিবোতে মনে পড়ে ইস্কুলে যেতে হবে! সবাই এক সঙ্গে দৌড় দৌড়।
ততদিনে খেয়াঘাটে নতুন নতুন নৌকা ভিড়তে শুরু করেছে। হরেক রকমের জিনিষপত্র বোঝাই। মনিহারি, হাঁড়ি-কলসি, লোহা-লক্কড়, জামা-কাপড় আরো কত কি যে ! একে একে মালপত্র নামানো হচ্ছে। নিয়ে যাওয়া হচ্ছে বাজারের মধ্যে। বিকেলের সোনালী রোদে সে যেন এক স্বপ্নের মায়াময় পরিবেশ। এবার দৌড়ে ফিরতে হবে বাজারের দূর্গা মন্ডপে।চারদিকে সব সেজেগুজে তৈরী হচ্ছে, নতুন নতুন দোকান, রকমারী তাদের বাহার। ঝাঁ চকচকে সাজসজ্জা। চোখ ফেরানো দায়। মন্ডপের দিকে এগোতে গিয়ে দেখা যায় ডানদিকটায় একটা মস্ত বড় নাগরদোলা জমিয়ে বসেছে। ঘুর পাক খাইয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা চলছে। তাকে ছাড়িয়ে একটু দূরে একটা সার্কাসের দল তাঁবু পেতেছে! সামনের টিনের দেওয়ালের মাঝেমধ্যে ফাঁক ফোকর দিয়ে যেটুকু ভেতরের জগৎ দেখা যায়, তাই দেখতে অনেকের ভিড়।
পালিশ না করা লাল ইঁটের উঁচু মন্ডপ সাদা চুনের প্রলেপ দিয়ে বাইরের আস্তরনে নিজের আব্রুটুকু রক্ষা করছে। মন্ডপের মধ্যে পটিদার ঘনশ্যাম পাল দূর্গার মুর্তিতে নির্বিকারে হলদে-সাদা রং-এর প্রলেপ দিয়ে চলেছে। অবাক নয়নে চেয়ে থাকে উৎসুক ভিড়, কেমন করে যেন মাটির মুর্ত্তিটা জীবন্ত হয়ে উঠছে। বিশাল আকৃতির দূর্গার চালা মাটিতে ফেলে রাখা আছে। আঁকা আছে পৌরানিক কাহিনীর পটচিত্র। রয়েছে হর-পার্ব্বতীর যুগল মূর্ত্তি, রামের অকাল বোধন, হনুমানের পর্ব্বত হাতে উড্ডিয়মান দৃশ্য, রাম সীতা লক্ষণের বনবাস গমন, আরো আরো অনেক কিছু ! যেন পৌরানিক কাহিনীর চলমান চিত্রমালা।
মন্ডপের সামনে বিশাল চারদিক খোলা যাত্রার মঞ্চ তৈরী হচ্ছে। তার লাগোয়া বড় বড় খুঁটি পোঁতা হচ্ছে। কলকাতার নামী যাত্রাদল আসছে। দু'দিন হবে দুটো যাত্রাভিনয়--আষ্টমী ও নবমী।
বিজয়ায় হবে আতসবাজীর রঙ্গীন ফুলকির খেলা। হরেক রকমের বাজীর রকমারী কসরৎ আকাশ মাটি রাঙ্গিয়ে মন মাতিয়ে ব্যান্ড পার্টির বাজনার তালে তালে নাচতে নাচতে খেয়াঘটে হবে বিসর্জন। খেয়াঘাটে তখন মেলার চেহারা। এবার বাড়ি ফেরার পালা। জমানো এক টাকাটা দিয়ে একটা বাঁশি কিনে বাজাতে বাজাতে ফেরা। খুব-খুব ইচ্ছে করে যদি একটা বড় বাঁশের বাঁশি কিনতে পারা যেতো। দারুন লাগে বাজাতে। ওই যাত্রাদলের লোকগুলো কেমন বাজিয়ে মাৎ করে সে রকম বাজাতে ইচ্ছে করে। ইচ্ছে করে চলে যেতে যাত্রাদলে।
রাত্রে বাড়ি ফিরে মাটির ভান্ডারটা ঝাঁকিয়ে দেখা মেলে কয়েকটা পয়সা জমেছে। গোবিন্দ হালদারদের বাড়ির খড়ের আঁটি খেয়াঘাটে বজরায় বয়ে দিয়ে পয়সা যা জমেছে, এই দিয়ে যদি না হয় তবে মায়ের কাছে চাইতে হবে কিন্তু মা দেবে তো! পেছন ফিরতেই দেখা গেল মা শুকনো মুখে দাঁড়িয়ে। জিজ্ঞাসু চোখে তাকিয়ে থাকতে হয়। কিছু বলার আগে বলে -- "কলকাতা যাবি --ঝন্টা?" অবাক হয়ে চেয়ে থাকি। হঠাৎ মা কেন কলকাতা যাওয়ার কথা বলছে! মা আবার শুরু করে --"ওখানে আনন্দে থাকবি,দুবেলা পেটপুরে খেতে পাবি। বছরে দুবার পরনের জামা কাপড় পাবি। মজার শহর কলকাতা, ঘুরে ফিরে কতকিছু দেখতে পাবি -- জানতে পারবি, অবাক বনে যাবি।"
হঠাৎ একটা খোঁচা খেয়ে ঘুম ভেঙ্গে যায়। বাজারের কোলাহল, চেঁচামেচি, কলতলায় থালা বাসন ধোবার ঘ্যাড়ং ঘ্যাড়ং শব্দ, মাছের বাজারে হাঁকা হাঁকি, সব্জি বাজারে দরাদরি, রাস্তায় ভিড়ে আটকে থাকা অটোরিক্সা, ট্রাকের ইঞ্জিনের কর্কশ আওয়াজ, রিক্সাভ্যানের প্যাঁক প্যাঁক শব্দ, তক্ষুনি ভরপেটা বাদুড়ঝোলা ট্রেনটা বিকট শব্দ করে তীব্র গতীতে শহরের ভেতরে ঢুকে গেল। চেয়ে দেখি হরনাথ গায়ে গামছা দিয়ে মুখে নিমের দাঁতন চিবোতে চিবোতে খেঁকিয়ে মাৎ করছে --"হুই-নবাবপুত্তুর ওঠ। বেলা চড়ে গেল, এখনো বাবু বিছানা ছেড়ে উঠা হল না। ওরা
কখন উঠে কলতলায় খেটে মরছে আর উনি কোথাকার লাটসাহেবর নাতি এলেন ঘুম দিচ্ছেন? ওঠ - ওঠ হতচ্ছাড়া!"
নিধু সর্দার
ভুবনগ্রাম
- বিস্তারিত
- লিখেছেন নিধু সর্দার
- ক্যাটfগরি: গল্প-স্বল্প
অতি কৌতুহলের ফল
বিশ্বদীপ মামা বলল অতি কৌতূহল ভলো নয়। অতি কৌতূহলের ফলও ভালো হয়না। আমরা বললাম, কেন? এ ব্যাপারে গল্পের ঝুলিতে কিছু গল্প রয়েছে নাকি? শুনি তাহলে। বিশ্বদীপ মামার গল্পের ঝুলি কখনো খালি হয় না। অতি কৌতূহল বিষয়ক একটা গল্প
ঝুলিতে রয়েছে দেখতে পাচ্ছি, তবে গল্পটা ঝুলিতে ঢুকে পড়েছে কিভাবে সেটা কিন্তু বলতে পারব না।
শোন তবে, এই আতি কৌতূহল দেখাতে গিয়ে একবার এক শীতের রাতে আমাকে দশ মাইল হেঁটে বাড়ি ফিরতে হয়েছিল।
বন্তু বলল, কেন? তখনো সাইকেল আবিষ্কার হয়নি? নাকি, চালাতে জানতে না?
মামা বলল, অত অধৈর্য্য হচ্ছিস কেন? আরে গল্পটা তো ঐ সাইকেল নিয়েই। এই যা, আগে ভাগেই বলে ফেলেছি। এতে কিন্তু গল্পের স্বাদ কমে যাবে।
তো যা বলছিলাম। বলে মামা একটু ডান ও বাম দিক দেখে নিল। এর অর্থ এখনো চা কিন্তু আসে নি। এটা বুঝতে পেরেই আমি ভেতরে চলে গেলাম।
অনেক সময় শোনা গল্পগুলোও মামা আবার নতুন করে শোনায়। কখনো এর গল্প ওর গল্পও নিজের বলে চালিয়ে দেয়। যাই হোক, গল্পগুলো শুনতে ভালই লাগে।
চায়ের কাপ হাতে নিয়ে মামা বলল, ফিরছিলাম নবগ্রাম থেকে। ওখানে দিদির বাড়ি থেকে বেরোতে একটু দেরি হয়ে গিয়েছিল। শীতের রাত, রাস্তা প্রায় নির্জন। তাই বেশ জোরেই সাইকেল চালাচ্ছিলাম। মাঝে প্রতাপপুর বলে একটা গ্রাম আছে। সেই গ্রামের এক ধারে বড় একটা ফুটবল মাঠ রয়েছে। মাঠটা বেশ সমতল ও বড়। আমারা অনেকবার এই মাঠে খেলা করে গেছি। এই মাঠের ধার ঘেঁষে রাস্তা। সেই রাস্তায় যেতে যেতে দেখি মাঠের একটা গোলপোষ্টের মাথায় কে একজন পা ঝুলিয়ে বসে রয়েছে। অল্প কুয়াশাও ছিল, তাই লোকটাকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল না। সাইকেলের
গতি কমিয়ে একটু দূরে সাইকেলটা একটা গাছে ঠেস দিয়ে দাঁড়ালাম। তারপর একটু করে এগিয়ে যেতে লাগলাম গোলপোষ্টের কাছে। ঐ যে কৌতূহল! আমাকে কৌতূহলে পেয়ে বসে। দিব্যি কাগজ-পেন নিয়ে লেখা-পড়া করছে। এ পাগল ছাড়া হয়না। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পাগলের পাগলামী দেখার কোন মানে হয় না।
হঠাৎ লোকটা বলে উঠল, যা ভাবছেন তা কিন্তু নয় স্যার। মুড়ির সঙ্গে মুড়কিকে গুলিয়ে ফেলবেন না যেন। এ হছে সাধনা। শীতের রাত্রে গোলপোস্টে না উঠলে এ সাধনা পূর্ণ হয় না। আপনি তো স্যার নবগ্রাম থেকে ফিরছেন? ঠিক কি না।
এরপর আর লোকটাকে পাগল বালে মনে হচ্ছে না। ত ছাড়া ও জানলই বা কি করে যে আমি নবগ্রাম থেকে ফিরছি।
আমার কৌতূহল আরো এক ধাপ বেড়ে গেল।
আমি বললাম, সাধনাটা কি জানতে পারি কি?
ও এবার বলল, এক মিনিট। এক মিনিট পরেই জানতে পারবেন। এই খাতায় লিখে দিচ্ছি। তবে মাটিতে দাঁড়িয়ে এটা পড়া যাবে না স্যার। হালকা চাঁদের আলো ও কুয়াশা মিলেমিশে যে পরিবেশ তৈরী হয় এটা সেখানেই পড়তে হবে। তাই কষ্ট করে গোলপোষ্টের মাথায় উঠে আসতে হবে।
কৌতুহল মেটাতে আমি রাজি হয়ে গেলাম। লোকটা গোলপোষ্ট ধরে সোজা নীচে নেমে এল।উঠুন স্যার, একটু কষ্ট হবে। বাহঃ, এই তো উঠতে পারছেন। উপরে পাইপের উপর খাতাটা ঝোলানো আছে। পড়ে চক্ষু সার্থক করুন।
চক্ষু সার্থক করাই বটে! খাতায় লেখা আছে, "আপনি এটা পড়ুন, আমি ততক্ষনে আপনার সাইকেলেটা নিয়ে একটু হাওয়া খেয়ে আসি। আর হ্যাঁ, অতি কৌতূহল ভালো নয়, এটা এবার বুঝলেন তো?
এই বলে বিশ্বদীপ মামা চা ও গল্প এক সঙ্গে শেষ করে উঠে দাঁড়াল। আসিরে, অন্যদিন আসবো।
তরুণ কুমার সরখেল
আমডিহা, পুরুলিয়া
- বিস্তারিত
- লিখেছেন তরুণ কুমার সরখেল
- ক্যাটfগরি: গল্প-স্বল্প
ভূতোর ভূত
নাম ছিল তার ভূতো।নামে যাই মনে হোক না কেন-- আসলে ভূতো ছিল বেশ বুদ্ধিমান।
সে দিন আমি ও খোকন দা রাস্তায় পায়চারী করছিলাম--এমনি সময় ভুতো এসে আমাদের সঙ্গে যোগ দিলো।কথায় কথায় আমি আমার ভূত দেখার কথা বললাম ওকে।ও ইন্টারেস্ট নিয়ে বলল,‘কোথায় দেখেছিস?’
বললাম,‘ওই তো শ্যামরাই পাড়ার পোড়ো বাড়িটায়’।খোকন দা মাঝখানে বলে উঠলো,‘কে জানে ভূত দেখেছে কি না!ও নাকি ছাগল ভূত দেখেছে ওখানে!’
--‘ছাগল ভূত!’ব্যঙ্গ করার মত টেনে টেনে বলে উঠলো ভূতো,‘মানুষ ভূত হলে হতেও পারে--কিন্তু জীবনে এই তোর মুখেই প্রথম শুনলাম ছাগল ভূত!’খোকনদাও ভূতোর দলে যোগ দিলো--ভূ্তোও সঙ্গে সঙ্গে অবিশ্বাসের হাসি হাসতে লাগলো।
আমার রাগ হল,ওদের দু জনের ওপর রাগ করে চুপ চাপ বাড়ির দিকে হাঁটা দিলাম।
--‘এই দেখো,রেগে গেলি কেন?’খোকনদা আমার কাছে এসে আমার হাত ধরে বলে উঠলো—‘তুই দু দিনের জন্যে আমাদের বাড়ি এসেছিস,এসব রাগ গোঁসা নিজেদের মধ্যে মানায়?’
ভুতো কাছে এসে খোকনদাকে বলল,‘ও তোমাদের বাড়ি এসেছে নাকি?’
--‘হ্যাঁ,আমার মাসির ছেলে,রানাঘাট থেকে এসেছে।’ভুতো আমার দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো,‘তাহলে ওই বাসে এসেছিস বোধ হয়--রানাঘাট টু কালনা ঘাট?’
--‘হ্যাঁ’,সংক্ষিপ্ত জবাব দিলাম।
ভূতো বলল,‘আমিও মামা বাড়ি যাই ওই বাসে--শান্তিপুরে আমার মামার বাড়ি’।
সামান্য সময় তিনজনেই চুপ চাপ হাঁটছিলাম।মাঝখানে ভূতোই বলে উঠলো,‘তবে হ্যাঁ,ওই পোড়ো বাড়িতে ভূত আছে ঠিকই!’ভূতো খোকনদার দিকে তাকিয়ে বলল,‘তুমি তো জানো দাদা,আমাদের বাড়ি কোথায়?’
--‘হ্যাঁ,হ্যাঁ,মানে ওই পোড়ো বাড়ির আশপাশে কোথাও—তাই তো?’খোকনদা বলে ওঠে।
--‘হ্যাঁ,মানে ওই ভাঙ্গাচোরা পোড়ো বাড়ির একটা বাড়ি আগে--ওই বাড়ির ঠিক উল্টো দিকে’,ভূতো কথাগুলি বলে একটু থামল,তারপর আবার শুরু করল,‘দেখো আমি ভূত বিশ্বাস করিনা--তবু তোমার ভাই--নাম যেন কি?’
--‘তপন’,খোকন দা বলে উঠলো।
--‘হ্যাঁ,তপন যখন বলেছে তখন তো ভূত ওকে দেখাতেই হবে’,এবার যেন ভূতোর ঠোঁটের কোণে হাসি ঝিলিক খেলে গেলো।
আমি এবার কৌতূহলী হয়ে বলে উঠলাম,‘সত্যি ভূত আছে?’
--‘তা জানি না,তবে তোমাদের আমি দেখাবো’,কেমন যেন হেঁয়ালির মত কথাগুলি বলে ওঠে ভূতো!
--‘দেখা তবে,কবে দেখাবি বল?’যেন আমার মুখের প্রশ্নটাই খোকনদা ভূতোকে বলে উঠলো।
ভূতো বললো,‘অমাবস্যা রাতেই দেখা যায়।সে দিন রাত ঘন কালো থাকে।ভূতেরা নিজেদের ছায়া বানিয়ে চলাফেরা করতে পারে।আর বেশী আলোতে ওদের দেখা যায় না--কারণ তখন ভূতেরা আলোর সঙ্গে মিশে থাকে,’কথা কটি বলে ভূতো আমার দিকে তাকিয়ে কেন যেন মুখ টিপে হাসল!
খোকন দা বলল,‘বাবা:,ভূতের সম্বন্ধে তুই তো অনেক কিছু জানিস?’
--‘হ্যাঁ,ওসব জানতে হয়’,বিজ্ঞের মত ভূতো জবাব দিলো।
বাড়ি গিয়ে খোকনদা দেখলাম পঞ্জিকাতে কিছু দেখবার চেষ্টা করছে!আমি ও নিয়ে মাথা ঘামালাম না,সোজা মাকে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,‘মা,অমাবস্যা কবে গো?’
মা আশ্চর্য হলেন,‘বললেন,তুই অমাবস্যার খোঁজ করছিস!ব্যাপার কি বলত?’
--‘এই,এমনি’,বলে সব কথা চেপে গেলাম।
মা বললেন,‘আগামী শনিবার অমাবস্যা থাকবে।’
খোঁজ নিয়ে খোকন দার কাছে পৌঁছে গেলাম।দেখি খোকনদা তখনও পঞ্জিকা ঘেঁটে চলেছে!
নিজেকে বুদ্ধিমান জাহির করার মত ভাব নিয়ে বলে উঠলাম,‘এই শনিবার অমাবস্যা।’
সঙ্গে সঙ্গে খোকনদা বলে উঠলো,‘তুই কি করে জানলি?’খোকন দা আমার দিকে তাকিয়ে আশ্চর্য হয়ে আমায় প্রশ্ন করে ওঠে।
--‘হ্যাঁ,মার কাছে শুনেছি’,ভণিতায় না গিয়ে বলে ফেলি।
দু দিন পরেই ভূতোর সঙ্গে ওদের বাড়ির সামনেই দেখা হয়ে গেলো।দেখলাম ভূতুড়ে বাড়িটা ওদের বাড়ির সামনের দিকে,ওদের বাড়ি থেকে তাকালে স্পষ্ট ও বাড়ি দেখা যায়!
ভয়ে ভয়ে বলে উঠলাম,‘রাতে তোদের ভয় লাগে না?’
--‘কিসের ভয়?’স্বাভাবিক ভাবে ভূতো বলে উঠলো।
--‘এই শনি বারে অমাবস্যা রে!কখন আসলে তুই ভূত দেখাতে পারবি বল?’খোকন দা ভূতোকে কথাগুলি বলল।ও যেন কিছু একটা চিন্তা করল,তারপর বলল,‘তা রাত দশটার পরে আয়!’
মনে মনে ভয় হচ্ছিল,বাবা:,রাত দশটার পরে এই ভূত বাড়ির পাশে আসতে পারব তো?
খোকনদা বলল,‘ঠিক আছে,আমরা তিনজন আসবো।আমরা দুজন,আর সঙ্গে বন্ধু রবিও থাকবে।আর ভূতো!তুই তো আছিসই।’
ভূতো তাড়াতাড়ি বলে উঠলো,‘না,না,না,আমি থাকতে পারব না,আমার ওই দিন ইমপরটেন্ট কাজ আছে।’
--‘তবে?আমি বলে উঠলাম,তবে আর কি করে ভূত দেখা হবে?’
--‘রাত এগারোটা বাজবে আর দেখবি ভূতেরা এসে যাবে--রাস্তায় দাঁড়িয়ে তোরা দেখতে পাবি’,ভূতো তার কথাগুলি বলে যায়।
--‘রাস্তা থেকেই দেখা যাবে!’খোকনদার আবার প্রশ্ন।
--‘হ্যাঁ,দেখবে পোড়ো বাড়ির দেওয়ালে বড় বড় ভূতের আকৃতি--নড়াচড়া করবে--ফিসফিস করে কথা বলবে,কিন্তু তোমরা কিছু শুনতে পাবে না!’
--‘আচ্ছা!’,হতবাক হয়ে কল্পনা করতে থাকলাম।এখনি যেন গায়ের লোমগুলি খাড়া হয়ে যাচ্ছে!
খোকনদা এবার আমার পিঠে হালকা চাপড় দিয়ে বলে উঠলো,‘তপন তা হলে পোড়ো বাড়ির ছাগল ভূত সত্যি হবেরে--যেটা তুই সে দিন দেখেছিলি!’
--‘তবে?তোমরা তো কিছুতেই আমার কথা বিশ্বাস করতে চাও নি’,আমি যেন নিজের বিশ্বাস ফিরে পাচ্ছিলাম।
শনিবার সন্ধ্যে থেকেই আমরা মনে মনে রোমাঞ্চিত হতে লাগলাম।বারবার ঘড়ির দিকে নজর রাখতে লাগলাম।কথা ছিল রাতে খেয়ে দেয়ে সোজা শোয়ার ঘরে ঢুকে যাবো।আমি আর খোকনদা রাতে এক ঘরে শুই।রাত সাড়ে দশটা হবে কি আমরা দাদা-ভাই বের হবো ভূত দেখার অভিযানে।আগে থেকে কথা ছিল যে রবি আমাদের সঙ্গে যাবে।পোড়ো বাড়িতে যাবার সময় মাঝ পথ থেকে ওকে সঙ্গে নিয়ে নেওয়া হবে।ও ঠিক রাত সাড়ে দশটা থেকে নিজেদের বাড়ির দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আমাদের জন্যে অপেক্ষা করতে থাকবে।
রাত সাড়ে দশটা বাজলো,আর দেরী করা যায় না--ধীরে ধীরে আমরা দরজা খুলে পা টিপে টিপে রাস্তায় এসে নামলাম। বাড়ির কেউ জানবার কথা নয়।আমরা জানি এসব কথা জানাজানি হলে সবাই আমাদের ভূত দর্শনে বাধার সৃষ্টি করবে।তাই আমাদের চারজন বাদে পঞ্চম ব্যক্তিকে এ কথা জানানো যাবে না।
রাস্তার লাইট পোস্টের টিমটিমে আলোগুলি জ্বলছিল।আলোগুলি অনেক চেষ্টাতেও যেন রাস্তা আলোকিত করতে পারছিল না।আকাশে চাঁদ মামার চিহ্ন নেই।আর থাকবেই বা কি করে--আজ অমাবস্যা,তার ওপর শনিবার!ভূত বিশ্বাসী লোকেরা বলে যে ভূত প্রেতদের জাগরণ নাকি এই দিনেই হয়!
নিজের ছায়া দেখেই ভয় পাচ্ছিলাম।ভয়ে খোকনদার এক হাত ধরে রাখলাম।দাদাকেও ভয়ে অনেক সংকুচিত মনে হল।রাস্তা ভালো দেখা যাচ্ছিল না।দু লাইট পোস্টের মাঝখানটায় জাগায় জাগায় অন্ধকার দানা বেঁধে রয়েছে।
--‘দাঁড়া’,খোকন দা বলে উঠলো,‘রবি আসবে’।ডাকার প্রয়োজন হল না,রবি ঘর থেকে বেরিয়ে এলো।আর বেশী দূর না--তবে ভূতুড়ে বাড়ির সামনের লাইট পোস্টের বাল্ব জ্বলছিল না।এত অন্ধকার যে রাস্তা পর্যন্ত দেখা যাচ্ছিল না।তিন জনে ভূতুড়ে বাড়ির সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম।সবার হাত সবাই ধরে আছি।সবার গায়ে সবার গা ঘেঁষে আছে।সামনে অন্ধকার,বাড়ি ঘর কিছুই দেখা যাচ্ছিল না।কেবল ভূত বাড়ির সীমারেখায় এক অনুজ্জ্বল আলো ছায়ার সরল রেখার মত ঘিরে ছিল।চিহ্নিত বাড়ির সীমানা যেন মানচিত্রের মত আমাদের চোখের সামনে ভেসে আছে!
রবি ফিস ফিস,চাপা স্বরে বলে উঠলো,‘লাঠি,টর্চ সঙ্গে আনতে হতো না?’
--‘না,ভূতো মানা করেছে--ও সব হাতে থাকলে নাকি ওরা দেখা দেয় না’,খোকনদার গলার স্বর মনে হল হাওয়ায় ভেসে আসছিল।
কয়েক মিনিট পরের কথা—হঠাৎ দেখি সাদা সাদা ছবির মত কতগুলি ছায়া এসে পড়ল ভূতুড়ে বাড়ির দেওয়ালে!আর একি!বিরাট এক কঙ্কাল নেচে উঠলো!তার মধ্যেই দেওয়াল ধরে লোকেরা ছুটে কোথায় চলে গেলো!শব্দ নেই--তবু মনে হল ভূতেরা কিছু বলে চলেছে।সাদা ছায়াগুলি প্রকাণ্ড বড় বড়--পনের বিশ হাত লম্বা লম্বা—ভূতের মত দু মিনিট ঘুরে বেড়াল।
ইতিমধ্যে আমার পা কাঁপতে শুরু করেছে--চার দিকে অন্ধকার দেখছিলাম।খোকনদাকে জড়িয়ে ধরে কিছু যেন বলতে চেষ্টা করলাম।পারলাম না। জ্ঞান ফিরতে দেখি আমার ওপর অনেকগুলি মাথা ঝুঁকে আছে!ভূতোকে দেখে আমি,‘ভূত’,বলে চীত্কার করে উঠলাম!
--‘না,না,কিচ্ছু না,ভূত বলে কিছু আছে নাকি!ভয় পেও না তুমি’,বয়স্ক একজন আমায় কথাগুলি বলছিল।
--‘কেমন লাগছে এখন?’খোকনদা আমায় বলে উঠলো।
নিজেকে সামলে নিলাম,বললাম,‘ঠিক আছি’।
এক বয়স্কা মহিলা এক গ্লাস দুধ এনে আমার সামনে ধরে বললেন,‘নাও বাবা!এটুকু খেয়ে নাও।খুব দুর্বল তুমি!’
জানতে পারলাম ভূতোদের বাড়িতে আমি।এতক্ষণ ভূতোর মা,বাবা আমার সঙ্গে কথা বলছিলেন।দুধ খেয়ে অনেকটা সুস্থ হলাম।খোকনদাকে বললাম,‘চলো বাড়ি যাই।’
--‘যেতে পারবি তো?’ভূতো তির্যক হেসে বলে উঠলো,আর ‘ভূত দেখবি না?’
--‘না,না’,যেন অস্ফুট চীৎকার বেরিয়ে এলো আমার মুখ থেকে।
হাসল ভূতো,তারপর ওর পকেট থেকে একটা মোবাইল বের করে বলল,‘দেখ আবার আমি ভূত দেখাচ্ছি।’ও মোবাইলের প্রজেক্টর সেট করে ভিডিওর মত চালিয়ে দিল।আর আমাদের সামনে ভূতোদের ঘরের দেওয়ালে ভেসে উঠলো সেই কঙ্কাল,সেই ভূতগুলি--যেগুলি আমরা পোড়ো বাড়ির দেওয়ালে দেখে ছিলাম।এবার প্রথমটা ভয়ে থমকে গিয়েছিলাম,সঙ্গে সঙ্গে ভূতো বলে উঠলো,‘সিনেমা যেমন দেখিস আমি আমাদের ব্যালকনি থেকে তোদের এমনি করে ভূত দেখাচ্ছিলাম রে!এই মোবাইলে প্রজেক্টর সিস্টেম লাগানো আছে—প্রজেক্টর হল সিনেমা দেখানোর মেশিন।
রবি,তৎক্ষণাৎ বলে উঠলো,আচ্ছা--সেই জন্যে আমি ওই সময় তোদের ব্যালকনি থেকে টর্চের মত কিছু জ্বলে থাকতে দেখে ছিলাম!
ভূতোর ভূতের রহস্য উদ্ঘাটিত হল।আমরা চুপি চুপি ঘরে ফিরে ঘুমের কোলে ঢলে গেলাম।
তাপসকিরণ রায়
জবলপুর, মধ্যপ্রদেশ
- বিস্তারিত
- লিখেছেন তাপস কিরণ রায়
- ক্যাটfগরি: গল্প-স্বল্প
মেডেল নিলেন না নন্দপিসি
দেবীপুরের নন্দপিসি এক স্যাম্পেল। দেবীপুর জায়গাটাকে এই একবিংশ শতাব্দীতেও মোটামুটি গণ্ডগ্রামই বলা চলে। তবে ইদানীং সেখানেও লেগেছে আধুনিকতার ছোঁয়া। এখানে-সেখানে পাকা বাড়ি। কাঁচা রাস্তার মাঝে মাঝে কিছু বাঁধানো সড়ক – সাইকেল, রিকশা ও ভ্যান রিকশার পাশাপাশি তাই এসে গেছে বাস, অটো, এমনকি দু-চারখান চারচাকা। বিজলি এসেছে, তবে অল্প কিছু ঘরেই। যেখানে নেই, সেখানেও অবশ্য পালে-পার্বণে সিনেমা-টিনেমা দেখার জন্য আসে ভাড়া করা জেনারেটার।
এসবের মধ্যে নন্দপিসি অর্থাৎ নন্দরাণী চৌধুরানি যেন একশো বছর আগেকার বাংলার থেকে কেটে বসানো এক জগদম্বা বা ক্ষেমঙ্করী। ছেলে, বুড়ো, জোয়ান সবারই তিনি ‘পিসি’। তাঁর দাদাশ্বশুর ডাকসাইটে জমিদার দেবীপ্রসন্ন চৌধুরির নামেই নাকি এ গাঁয়ের নাম। শ্বশুর মুকুন্দনারায়ণও ছিলেন খুব দাপুটে। মুকুন্দের দুই ছেলে উমাশঙ্কর ও কিরণশঙ্কর লেখাপড়া শিখে চাকরির জন্য কলকাতা পারি দেন। কিরণ বাপের অমতেও শেষ অবধি সেখানে পরিবার নিয়ে যান। কিন্তু বড়ছেলে উমার স্ত্রী নন্দ শ্বশুরের ভিটে ছেড়ে নড়তে রাজি হন না, ফলে উমারও শনি-রবি ও ছুটিছাটায় গ্রাম-শহর যাতায়াত থেকে রেহাই মেলে না। সঙ্গহীন মুকুন্দ পুত্রবধূ নন্দকে মেয়ের মতো স্নেহ করতেন। ছেলেদের আশা ছেড়ে নন্দকেই তিনি জমিদারি দেখাশোনা ও আনুষঙ্গিক বিভিন্ন কাজ শিখিয়েছিলেন। লোকে বলে সেই জন্যেই নাকি পিসির চলনে-বলনে খানিকটা পুরুষালি ভাব।
সে অবশ্য শোনা কথা। তারপর ইচ্ছামতী দিয়ে অনেক জল গড়িয়ে গেছে। ইতিমধ্যে পিসির শ্বশুর-শাশুড়ী ও স্বামী গত হয়েছেন। ছেলে-মেয়েরাও শহরে প্রতিষ্ঠিত। তাদের অনেক চেষ্টা সত্ত্বেও পিসি এখনো একা এই দেবীপুরেই পড়ে আছেন, শ্বশুরের ভিটে আগলে। এবং এভাবেই শেষ দিন অবধি থাকবেন বলে ঘোষণাও করেছেন। ছেলেমেয়েরা অগত্যা মাঝেমাঝে মা’কে দেখে যায়, কৌশলে কিছু সাহায্য করারও চেষ্টা করে। কৌশলেই, কারণ জমিদারি কবে চলে গেলেও পিসির মটমটে আত্মসম্মান। নাতি-নাতনির হাত দিয়ে কিছু পাঠালে অবশ্য তিনি প্রাণে ধরে ফেরাতে পারেন না আর এই চালাকিটা ছেলেমেয়েরা শিখে নিয়েছে।
অবশ্য তেমন কিছু দরকারও হয় না। জমিদারি গিয়েও বাড়ির লাগোয়া কিছু বাগান, খেত, ফলের গাছ আছে – সেসবে যা ফলে তাতে পিসির অনাড়ম্বর জীবনযাত্রার রসদ অনায়াসে জুটে যায়। বাড়িতে বসে গাছের ফলপাকড় পাহারা দেওয়া এখন পিসির অন্যতম কাজ। এ ব্যাপারে তিনি দারোগার মতোই কড়া। মাঝে মাঝে ঘরে বসে হাঁক পাড়েন, “অ্যাই, কে রে? পালা বলছি, নইলে দাঁড়া বন্দুক বের করছি –”
ফল সংগ্রহে ইচ্ছুক ছেলেমেয়েরা কখনো ভয় পায়, কখনো খিলখিলিয়ে হাসে, “বাপ রে, ভয়েই ম’লুম – পিসি বন্দুক চালাবে!” পিসির ঘরে অবিশ্যি সত্যিই তাঁর শ্বশুরের আমলের একটা দোনলা বন্দুক টাঙানো। সেটা মাঝেমধ্যে সাফসুতরোও হয়। তবে পিসির যতই পাহারাওয়ালা-সুলভ জাঁদরেল চেহারা ও ব্যক্তিত্ব থাকুক না কেন সে বন্দুক চালাচ্ছে ভাবলেই –
হাঁকে কাজ না হলে পিসি অগত্যা “কোন লক্ষ্মীছাড়ার দল রে!” বলতে বলতে আসরে নামেন। এবার কাজ হয় – বালখিল্যের দল ছুট লাগায়। কিছু দুঃসাহসী অবশ্য অত সহজে পিটটান দিতে রাজি হয় না। তখন শুরু হয় সম্মুখসমর এবং বলা বাহুল্য, পিসিই শেষ হাসি হাসেন। একবার নাকি তিনি কাকে গাছে উঠে ঠ্যাং ধ’রে টেনে নামিয়েছিলেন।
কিন্তু নিক না দু'টো ফল? তুমি নিজে আর ক'টা খাও, শেষ অব্দি তো সেই বিলিয়েই দাও? না, সে চলবে না। চেয়ে নাও, ঠিক আছে। কিন্তু চুরি – অধম্মকে প্রশ্রয় দেওয়া চলে? লোকে অবিশ্যি বলে, তা নয়। আসলে কেউ চুরি করে নিয়ে গেলে পিসির আঁতে ঘা লাগে।
তা, ছেলেমেয়েদেরও কি প্রেস্টিজ নেই? কোন মুখে গিয়ে তারা পিসির কাছে হাত পেতে দাঁড়াবে? আর চুরি করা ফলের স্বাদ কি কখনো চেয়ে নেওয়া জিনিসে পাওয়া যায়? সুতরাং ঠাণ্ডা লড়াই চলতেই থাকে। তবু এই বালখিল্যদের নিয়েই পিসির জীবন। পালে-পার্বণে তাদের পিঠে-পুলি, নাড়ু-মোওয়া না খাওয়ানো অবধি তাঁর শান্তি হয় না।
পারতপক্ষে পিসি বাড়ি ছেড়ে নড়েন না। মাঝে মাঝে কয়েক কিলোমিটার দূরে ব্যাঙ্কে যান, তখন রিকশা বা ভ্যান রিকশা নেন। কিন্তু অটোরিক্সা, বাস কদাপি নয়। কলের গাড়িকে তাঁর ঘোর অবিশ্বাস – তারা যে কখন মানুষের ঘাড়ে চাপবে বা যাত্রীকে উলটে দেবে, তার নাকি কোনো ঠিক নেই। একদিন মধুর ভ্যান রিকশায় উঠে দেখেন সেখানে মোটর লাগানো। "চল তোকে পুলিশে দিই" বলে তার ঘাড় এমন জোরে ধরেছিলেন যে সে বেচারা মাপ-টাপ চেয়ে দু'দিনের মধ্যেই আবার ওসব খুলে ফেলবে বলে নাকে খৎ দিয়ে তবে রেহাই পায়।
হাসপাতাল-ডাক্তারখানা? ওসব পিসির লাগে বলে কেউ শোনেনি। বয়েস সত্তর না আশির কোঠায় কে জানে – কিন্তু তাঁর দাঁত একটাও পড়েনি, চুল দু-একগাছার বেশি পাকেনি। চশমা ছাড়াই ব্যাঙ্ক ও বিষয়সম্পত্তি সংক্রান্ত সব দরকারি কাগজপত্তর নিজেই দেখাশোনা করতে পারেন।
তা, বিষয়-সম্পত্তি যখন আছে, থানা-পুলিশ নেই? না, তেমন দরকারও ওখানে বড় একটা হয় না। গ্রামের লোকেরা সাদা-সরল। মাথা গরমে কিছু ঝগড়া-বিবাদ হলে সে তারা মাথা ঠাণ্ডা হলে আবার নিজেরাই সালিশি করে নেয়। আর লোকের পেটে ভাত থাকলেও সোনা-দানা বড় একটা নেই। তাই চোর-ডাকাত পণ্ডশ্রম বুঝে সেদিক ঘেঁষে না।
অন্ততঃ ঘেঁষতো না। কিন্তু তারপর একদিন মুখুজ্জেরা গ্রামে এলেন।
মুখুজ্জেরা মুম্বই না বেঙ্গালুরু কোথায় যেন থাকেন। সেখানে তাঁদের চাকরি, ব্যবসা – সব মিলিয়ে দারুণ রবরবা। দেবীপুরে নন্দপিসিদের ভিটের পাশে তাদের পৈতৃক ভিটে খালিই পড়ে থাকে। হঠাৎ এক ছেলের খেয়াল হলো – গরমে বাচ্চাদের স্কুল-কলেজে যখন লম্বা ছুটি, তখন এখানে এসে তারা মাসখানেক সপরিবারে থেকে যাবে। বেশ অন্যরকমের একটা অভিজ্ঞতা হবে। আর – মেজ ছেলে ফিল্ম লাইনের সাথে যুক্ত – তার মাথায় আছে, জায়গাটা যদি পছন্দ হয় তো বাড়িটাকে সিনেমার শ্যুটিংয়ের কাজেও লাগানো যেতে পারে।
সুতরাং দেবীপুর সরগরম। বাড়িঘর রঙ হলো, ঝোপ-জঙ্গল সাফ-সুতরো। বিজলির জন্য বসলো পেল্লায় এক জেনারেটার। তারপর নির্ধারিত দিনে ল্যাণ্ডাবাচ্চাদের হাঁ-করা চোখের সামনে পেটভর্তি মাল নিয়ে ঢুকলো একটা লরি আর তার পেছন পেছন একটা ঝাঁ-চকচক চারচাকা। লরিকে অবশ্য ভেতর পর্যন্ত আনা গেলো না। সুতরাং অনেক হুলুস্থুলু করেই শেষ অব্দি মুখুজ্জে পরিবার তাঁদের আদিভূমিতে অধিষ্ঠিত হলো। তাদের মেয়েদের গা ভরা গয়না, পুরুষদেরও হাতে আংটি, গলায় চেন। আর বাচ্চা ছেলেমেয়েরা নব্য বারমুদা-স্ল্যাকস শোভিত। তাদের হাতে হাতে মোবাইল।
তাদের দিকে, বিশেষ করে ‘কলের গাড়ি’টার দিকে গভীর সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকিয়ে পিসি বিড়বিড় করেন, “ঘোর অনাছিষ্টি, ঘোর অনাছিষ্টি! এবার একটা বিপুয্যয় না হয়ে যায় না!” কে তাকে বোঝাবে, এসব আধুনিকতা শহরে কেন, গাঁয়ে-গঞ্জেও আজকাল জলভাত।
খোলা মাঠ, বিশুদ্ধ বাতাস আর অবারিত আলো দেখে ছোটদের তো খুশি ধরে না। বেশ কিছুক্ষণ পাড়ায় এলোমেলো ছুটোছুটি করে বেড়ালো। কয়েকজন সাহস করে পিসির দোরেও উঁকি মারলো। পিসির ‘মুড’ এতক্ষণে কিছুটা ঠিক হলো। হাতছানি দিয়ে ডাকলেন, কাছে এলে হাতে নাড়ু-পাটালি তুলে দিলেন। “নাইস হোম-মেড চকলেট!” মুখে দিয়ে কলকল করতে করতে বাচ্চারা আবার চরায় বেরোলো।
তাদের আনন্দ অবশ্য কিছুক্ষণের মধ্যেই মিইয়ে গেলো, যখন দেখলো যে মোবাইলে টাওয়ার লাগছে না। অনেক খোঁজ-ভিজের পর পাড়ার গজু বললো, “বাছারা, এই অজ পাড়াগাঁয় ওসব পেরাইভেট-সম্রাট (স্মার্ট?) ফোন কাজে লাগবেনি। তাচ্চেয়ে ঐ চাকাগাড়িতে করে চাকুলি বাজারে গিয়ে পানুদার দোকান থেকে সস্তার চিনা মাল কিনে তাতে সরকারি (বি-এস-এন-এল?) কাড ভরো।” কিছু দ্বিধার পর মুখুজ্জে বাপরা তাই করলেন আর ফলে অন্ততঃ ‘কভি-হাঁ-কভি-না’ গোছের সিগন্যাল জুটতে লাগলো।
এরপর ভালোয়-মন্দে তাদের দিন কাটতে লাগলো। প্রাথমিক উত্তেজনা থিতিয়ে গেলে গাঁয়ের লোকেদেরও মুখুজ্জেদের উপস্থিতিটা গা-সওয়া হয়ে গেলো। কিন্তু আরো কেউ ব্যাপারটা লক্ষ করছিলো।
নিশুতি রাত। পাড়া অনেকক্ষণ ঘুমিয়ে পড়েছে। এমনকি নিশাচর মুখুজ্জেরাও মোটামুটি বিছানায়। এমন সময় তাদের দরজায় প্রবল ধাক্কা, সাথে বাজখাঁই গলার আওয়াজ, “এ্যাই, ভালোয় ভালোয় দরজা খুলে দে, নইলে –”
প্রাথমিক ভ্যাবাচাকা ভাব কেটে গেলে পর বোঝা গেলো – বাড়িতে ডাকাত পড়েছে। তারপর হৈ-চৈ, কান্নাকাটি, প্রবল বিশৃঙ্খলা। সোরগোলে আশেপাশের বাড়িঘরেও আলো জ্বলে উঠলো, কিন্তু ব্যাপার মালুম হবার সাথে সাথে সেসব টুপ করে নিভিয়ে যে যার ঘরের দোর এঁটে কাঁপতে লাগলো।
ঘুম ভেঙেছে পিসিরও। কী হয়েছে বুঝতে তাঁর অবশ্য দেরি হয়নি। এককালে জমিদার বাড়ির বৌ ছিলেন, এসব ঘটনা তিনি অনেক দেখেছেন। ভাবনা-চিন্তার পর গোছগাছ করতে অবশ্য একটু সময় লাগলো, কিন্তু তারপর তিনি নির্দ্বিধায় বাইরে এসে দাঁড়ালেন। ডাকাতরা ততক্ষণে চরমপত্র দিয়েছে – ভালোয় ভালোয় দরজা খুলে না দিলে তারা ভেঙে ঢুকে সবাইকে কচুকাটা করবে, নয়তো বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেবে। এমন সময় পিসি তাদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে গলা তুলে চেঁচিয়ে বললেন, “কী ভেবেছিস হতচ্ছাড়ারা – নন্দ বামনি বেঁচে থাকতে পাড়ায় অনাচার করবি? সময় থাকতে পালা, নইলে দেখেছিস –”
ডাকাতরা ঘুরে দাঁড়ালো। মশালের আলোয় চোখে পড়লো – তাদের দিকে বন্দুক তাক করে দাঁড়িয়ে আছে পিসি। ডাকাত সর্দার তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বললো, “তুমি বাড়ি গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ো ঠাকরুণ – তোমার সাথে আমাদের কোনো কাজিয়া নেই। তবে বন্দুক-টন্দুক খুব খতরনাক চিজ, ওসব নিয়ে আনাড়িদের খেলা কত্তি নেই।” তারপরই তারা আবার মুখুজ্জেদের সদরে লাগালো বেপরোয়া লাথি।
দুম! – পিসির বন্দুক গর্জে উঠেছে আর সাথে সাথে ডাকাত সর্দার আর্তনাদ করে বসে পড়েছে – তার ডান হাঁটুটা গেছে! “আনাড়ির মার!” – কাতরাতে কাতরাতে বলতে যাচ্ছে, এমন সময় গর্জে উঠলো পিসির বন্দুকের দ্বিতীয় নল আর এবার ডাকাতের অ্যাসিস্ট্যান্ট কুপোকাৎ। এই আচমকা বিপর্যয়ে ডাকাত দল মুহূর্তে বিশৃঙ্খল আর পিসি সেই সুযোগে অভিজ্ঞ হাতে বন্দুক আবার ‘লোড’ করে নিয়েছেন। আর এক রাউণ্ড গুলি ছোটার পর ডাকাতদের সাহস উধাও – গণ্ডগ্রামে এসে ফাঁকা ময়দানে গোল দেবে ভেবেছিলো, বন্দুকের সাথে লড়তে হবে ভেবে তৈরি হয়ে আসেনি। আহত সাথীদের ছেড়েই এবার বাকিরা পিটটান দেবার রাস্তা খুঁজতে লাগলো। কিন্তু সেখানেও বিশেষ সুবিধে হলো না।
জেলার ডেপুটি এস-পি মালবিকা দাস যেন কোন মুখুজ্জে বৌয়ের ক্লাস ফ্রেণ্ড। তার নম্বরটা জানা ছিলো, কপাল ভালো এই সঙ্কটের মুহূর্তে লাইনটাও লেগে গেলো। পুলিশ সাধারণতঃ রামধনুর মতো – ঝড়বৃষ্টির পর উদয় হয়। কিন্তু ‘বিগ বস’ মালবিকার তাড়ায় অন্যথায় জগদ্দল স্থানীয় থানা মুহূর্তে তটস্থ হয়ে উঠলো আর ঘটনার কিছুক্ষণের মধ্যেই ও-সি সদলবলে অকুস্থলে হাজির হলেন। গোটা তিনেক জখম ডাকাত ছাড়াও আরো ক’টা ধরা পড়লো। দু-চারটে অন্ধকারে গা ঢাকা দিয়ে পালালো বটে, কিন্তু সঙ্গীদের জেরায় নাম ফাঁস হয়ে যাবার পর এখন তারাও ধরা পড়ার অপেক্ষায়।
পরদিন থেকে দেবীপুর লোকে লোকারণ্য – ফিলিম-তোলা ভ্যান গাড়ি, খোঁচাদাড়ি ক্যামেরাম্যান আর বক্তিয়ার খান মিডিয়া-দিদিদের ভীড়ে ভীড়ে ছয়লাপ। ডাকাত-তাড়ানো নন্দ পিসি মুহূর্তে ‘ফোক হীরোয়িন’। দুর্গাবতী, ঝাঁসীর রাণী, আরো কত উপমা কাগজে কাগজে ঘুরছে। মাইকওয়ালারা দল বেঁধে ‘স্পট ইন্টারভ্যু’র জন্য পিসিকে উত্যক্ত করে চলেছে। দু-চারটে নমুনা – “আপনার বন্দুক চালনায় শিক্ষাগুরু কে? “আমার ঈশ্বর শ্বশুরমশাই। নামটা তো বলতে পারবো না, পাড়ার থেকে জেনে নেবেন।” “কিন্তু অতদিনের পুরোনো বন্দুক চালু অবস্থায় ছিলো, তা কি ডাকাতির সম্ভাবনা ভেবে?” “তা কেন! আমার ঘরে তো কত পুরোনো জিনিসই পড়ে থাকে – খাট-পালঙ্ক, বাসনপত্তর, পুজোর সরঞ্জাম। আমি কি কোনোটায় এক কণা ধুলো জমতে দিই?” “আপনার প্রাণে ভয়ডর নেই? “তাই কি হয়, মানুষের শরীল তো! তবে শোনো বাছা, কোনো রক্তমাংসের প্রাণীকে এই নন্দ বামনি ডরায় না।” “মানে, আপনি কি ঐ অন্ধকারে ছায়া ছায়া যারা আসে তেনাদের কথা বলছেন?” “পাগল হয়েছো! মানুষকে যে ডরায় না সে ভিরমি খাবে ছায়া দেখে! ছায়ার কী খ্যামতা? ওরা তো দুই দাবড়ি দিলেই পালায়।” “তবে?” এই ‘তবে’টা অর্থাৎ লৌহমানবী নন্দরাণী চৌধুরাণী তবে কিসে ডরান, সেটা কিন্তু অনেক জেরাতেও বের করা গেলো না।
কিছুদিন পর আবার তোলপাড় – সাহসিকতার জন্য যেসব মহিলা রাজ্যপালের মেডেল পাচ্ছেন, এ বছর তার মধ্যে রয়েছেন পিসি! দেবীপুরে আবার হৈ-হুল্লোড়, সবাই আবার এসে পিসিকে অভিনন্দন জানাচ্ছে। পিসিও প্রথম প্রথম খুব খুশি। কিন্তু তাঁর উজ্জ্বল মুখে দুশ্চিন্তার ছায়া পড়লো, যখন শুনলেন যে মেডেল নিতে সেই কলকেতায় যেতে হবে।
“সে তো নাকি অনেক দূর – কত রেলগাড়ি-বাসগাড়ি করে যেতে হয়।” চিন্তিতমুখে পিসি বললেন।
“অত ভাবছো কেন – দেবীপুর থেকে কলকাতা তো কত লোক এখন ডেলি-প্যাসেঞ্জারি করছে। আমরা তোমাকে ঠিক নিয়ে যাবো” তাঁকে আশ্বস্ত করার চেষ্টায় বলে পিসির ছেলে আদিত্য।
তবে সেটুকু সংশয়ও দূর করে দিলো মুখুজ্জেবাড়ির মেজ ছেলে অনুপ। বাড়িটায় ফিল্মি শ্যুটিং করার ইচ্ছে তার মাথার থেকে যায়নি, বরং পিসির সাহসিকতার ফলে অকুস্থলে মিডিয়ার আনাগোনা জায়গাটার বেশ ‘প্রোমো’ করে দিয়েছে। তাই সে কিছুদিন পর আবার দেবীপুর এলো।
“এই সামান্য ব্যাপার নিয়ে আপনারা মোটেই মাথা ঘামাবেন না।” কৃতজ্ঞতায় গদগদ অনুপ বলে, “পিসি শুধু গ্রামের সম্মানই নন। আমাদের পরিবারের কাছে তো তিনি রক্ষাকর্ত্রী দুর্গা! ওনাকে আমি গাড়ি করে নিয়ে যাবো। আদিত্যদাও নয় সঙ্গে থাকবেন।”
ব্যস, এভাবে বিষয়টার ফয়সালা হবার পর পিসির কোনো ওজর-আপত্তিই টিঁকলো না। ঠিক হলো, নির্দিষ্ট দিনে অর্থাৎ সামনের রোববার বেলা দু’টো নাগাদ সবাই অনুপের গাড়িতে রওনা দেবেন।
রোববার। যথারীতি বারোটার মধ্যে পিসির সামান্য মধ্যাহ্নের আহার শেষ হয়েছে। তিনি একটু বাগানে গেছেন কেচে দেওয়া কাপড়টা আনতে। বাইরে অপেক্ষা করছে মুখুজ্জেদের ফুল দিয়ে সাজানো গাড়ি, তাতে রঙীন কাগজ সেঁটে লেখা “জয়তু বিরাঙ্গনা শ্রীমতি নন্দরানি চৌধুরানি।” ড্রাইভার আর অনুপ রেডি। আদিত্য উত্তেজিতভাবে ঘড়ি দেখছে আর অপেক্ষা করছে মা ফিরে এলেই তারা রওনা দেবে। কিন্তু পিসি আর আসেন না।
“দাদা, একটু দেখুন না – এরপর দেরি হয়ে যাবে। পথে জ্যাম থাকলে –” একসময় অনুপ বলে।
আদিত্য গলা চড়িয়ে ডাকে “মা” – কোনো সাড়া নেই। সে অগত্যা বাগানের পথে পা বাড়ায়। সেখানে গিয়ে দেখে, পিসি নেই! কিছুক্ষণ ডাকাডাকির পর আদিত্য সোরগোল জুড়ে দেয়, লোকজন ছুটে আসে।
এ কি ভোজবাজী নাকি? পিসি গেলেন কোথায়? চারদিক তো অভ্যর্থনাকারী মানুষের ভীড়ে ভীড়াক্কার, তার মধ্য দিয়ে কোথাও গেলে নিশ্চয়ই চোখে পড়তো? “বাবা গো, পিসিকে ডাকাতে নিয়ে গেছে!” কে যেন ডুকরে ওঠে। “দুর বেঅকুফ, আমাদের এতজনের চোখের সামনে দিয়ে?” আরেকজন তাকে ধমক দেয়। এমন সময় কয়েকটি বাচ্চা হৈ-হৈ ক’রে ওঠে, “ঐ তো – ঐ যে পিসি!”
পিসি সজনে গাছের মগডালে বসে। কিছুতেই তাঁকে নামানো যাবে না। এক একবার সুসজ্জিত গাড়িটার দিকে তাকান আর ভয়ে বিস্ফারিত চোখে গাছের ডাল আরো শক্ত ক’রে আঁকড়ে ধরেন।
“ওরে, ওই সব্বোনেশে গাড়ি – ওতে একবার চড়লে আর রক্ষে আছে! মেটেলের লোভে কি জল-জিয়ন্ত পেরানডা বিসজ্জন দেবো নাকি! ঘোড়া থাকলে কথা ছিলো, টগবগিয়ে চলে যেতাম। কিন্তু ঐ কলের গাড়ি – বাপ রে!”
ঐ মগডালে ওঠে সাধ্যি কার! সুতরাং নীচের থেকেই চলতে থাকে লাগাতার কাকুতি-মিনতি।
কাজেই তোমরা যাঁরা সেদিনের অনুষ্ঠানের টেলিকাস্ট দেখেছো, হয়তো লক্ষ করেছো যে অসমসাহসিকা নন্দরাণী চৌধুরানির অনুপস্থিতিতে তাঁর পুত্র আদিত্য চৌধুরী রাজ্যপালের কাছ থেকে মেডেল নিচ্ছেন। ঘোড়া আর চটজলদি কোথায় পাওয়া যাবে – তাই পিসির ‘নিরাপদ যাত্রার’ ব্যবস্থা এযাত্রায় আর করা গেলো না।
অনিরুদ্ধ সেন
থানে, মহারাষ্ট্র
- বিস্তারিত
- লিখেছেন অনিরুদ্ধ সেন
- ক্যাটfগরি: গল্প-স্বল্প
পাপাঙ্গুল আর অনিফিশ -পর্ব ২
পাপাঙ্গুলের সাথে গল্প করতে করতে ফুরফুরে হাওয়ায় কখন যে অনিফিশ ঘুমিয়ে পড়েছিল তার নিজেরও মনে নেই। সকাল বেলার প্রথম মিষ্টি আলো যখন এসে পরল তার মুখে, সে তার ছোট্ট পাখনা দুটো নেড়ে একটা খুব বড় আড়মোরা ভেঙ্গে তাকালো চারিদিকে। বাঃ! কি সুন্দর, শান্ত নীল জল। তার মাঝখানে একটু দুরেই একটা ছোট্ট সবুজ দ্বিপ। আর যেখানে সবুজ দ্বিপের সাথে নীল সমুদ্রের জল মিশেছে সেখানে খুব সুন্দর একটা সাদা ফেনার রেখা। জলের উপরটাও যে এত সুন্দর অনিফিশ তা আগে জানতই না। সূর্যের সোনালি আলো জলের মধ্যে পরে খুব সুন্দর খেলা করছে। অনিফিশের সব মনখারাপ যেন এক নিমেষে কোথায় পালিয়ে গেছে। মুখ ফিরিয়ে দেখল পাপাঙ্গুলের মুখটাও কেমন হাসি-হাসি।
“গুড মর্নিং পাপাঙ্গুল।”
পাপাঙ্গুল বলল “ওই দেখ আমাদের সবুজ পাহাড়, আমার দেশ। এখুনি আমরা পৌঁছে যাব ওখানে। আজ অনেক বছর পরে, ফিরছি আবার ঘরে।”
অনিফিশ তার চোখদুটো বড়বড় করে বলল – “সত্যি?”
পাপাঙ্গুলের ছাকনি শেষে এসে পৌঁছল পশ্চিম সাগরের তিরে, সবুজ পাহাড়ের গায়ে। এক লাফে পাপাঙ্গুল নেমে পরল জলের কাছে, তারপর, তার সেই ছাকনি-নাওটাকে তিরের কাছে এনে শক্ত করে বাঁধল দড়ি দিয়ে একটা গাছের সাথে। পাপাঙ্গুলের মনের মধ্যে একরাশ আনন্দ। ঘরে ফেরার সুখ যেন লেগে আছে তার চোখে-মুখে। রাত জাগার ক্লান্তিতে সে এতটুকুও দমেনি। এমন রাত তো সে আগে কতই জেগেছে। তবে তার কালকের রাত জাগা যেন সেসব রাতের থেকে আলাদা। কাল সে একটা নতুন বন্ধু পেয়েছে। আর তার সাথে সে অনেক বছর পরে অনেক কথা বলেছে – প্রানের কথা, মনের কথা, সুখদুঃখের কথা যা এতকাল ধরে জমে ছিল তার মনে। হটাৎ পাপাঙ্গুলের মনে পরল, কই অনিফিশের কোনও সাড়াশব্দ পাওয়া যাচ্ছে না। ছাকনির মধ্যে উঁকি মেরে দেখল ছাকনি ফাঁকা! “অনিফিশ...!!” সে ছাকনির মধ্যে নেই। হটাৎ ধক করে উঠল পাপাঙ্গুলের বুক। অনিফিশ কি তাকে না বলেই চলে গেল নাকি? কিন্তু কেন? ভয়ে ভয়ে চারিদিকে তাকাল পাপাঙ্গুল। কোথাও নেই অনিফিশ, কোথায় গেল সে? পাপাঙ্গুল যখন নিজের মনে ঘরে ফেরার অনুভূতি ভাগ করে নিচ্ছিল নিজেরই সাথে, সে সময় কি অনিফিশ ছাকনি থেকে অন্য কোথাও চলে গেছে সমুদ্রে? একটু সময় পাপাঙ্গুল যতটুকু দেখেছে তাতে সে বেশ ভালোই বুঝেছে অনিফিশ ভীষণ মুডি আর অভিমানী একটা গোল্ড ফিশ। তার মুডটা ভীষণ সাঁতরে বেড়ায় তারই মত। সে কি হটাৎ করে...?
এসব ভাবছে পাপাঙ্গুল এমন সময় দেখে তার পিঠে কি যেন একটা সুরসুর করছে। হাত বারিয়ে দেখে - ওমা! এ কে? এতো তার ছোট্ট অনিফিশ। পাপাঙ্গুল হাত বাড়িয়ে তাকে কাছে টেনে বলল – “কোথায় গেছিলে তুমি ছাকনি ছেড়ে?”
“এই নীল জল দেখে আর লোভ সামলাতে পারছিলাম না, টুপ করে একটা ছোট্ট সাঁতার কেটে নিলাম।” – হাসি হাসি মুখ করে বলল অনিফিশ। অনিফিশ তো আবার জল দেখলে নিজেকে ঠিক রাখতে পারে না। হাজার হোক, সে তো গোল্ডফিশ, সাঁতার কাটাই তার সখ।
পাপাঙ্গুল আর অনিফিশ তারপর একসাথে চলতে শুরু করল সেই সবুজ পথ ধরে। সেই আগের মতই আছে পাপাঙ্গুলের দেশ। রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে একেকটা জায়গা আসে, আর পাপাঙ্গুল অনিফিশকে দেখিয়ে বলে এক এক মোড়ের, এক এক বাঁকের গল্প। অনিফিশ তো জলের লোক, সে কখন ডাঙার গল্প শোনেইনি। তাই সে সেসব গল্প শুনে ভারী মজা পায়। অনিফিশ তার ছোট্ট মাথাটা নাড়িয়ে পাখনা নেড়ে অনেক প্রশ্ন করে – “পাপাঙ্গুল এটা কি গাছ? ওটা কি? এটাকে কি বলে?”
হটাৎ একটা জায়গায় এসে পাপাঙ্গুল থমকে দাঁড়াল। পাপাঙ্গুলের সেই হাসি-হাসি মুখটায় একনিমেষে আঁধার নেমে এল। অনিফিশ অবাক হয়ে জিগ্যেস করল – “কি হয়েছে পাপাঙ্গুল?”
“এখানেই এখানেই ছিল আমাদের ঘর। সেই ঝরের রাত্রে ঘর ভেঙ্গে গেছে, আর কেউ কোথাও নেই।” পাপাঙ্গুলের চোখদুটো জলে ভরে উঠল। অনিফিশ পাপাঙ্গুলের হাতের উপর হাত রাখল, মুখে কিছু বলল না। কিছুক্ষন সেখানে চুপটি করে দাঁড়িয়ে থাকল তারা দুজনে।
এমন সময় হটাৎ চারিদিকে কিছু লোকজনের গলার আওয়াজ পেয়ে পাপাঙ্গুল আর অনিফিশের ঘোর ভাঙল। দেখে তাদের দুজনকে ঘিরে বেশ কিছু সবুজ চুলের লোকজন জড়ো হয়েছে। যাদের দেখলেই বোঝা যায় এরা পাপাঙ্গুলের মতই আরও সব লোক এই দেশেরই। অনিফিশ একটু থতমত খেয়ে গেল। আসলে এমন ধরনের প্রানি তো আগে কখনও দেখেনি, সে তো জলের মাঝেই থেকেছে চিরটাকাল। তার তো শুধু সমুদ্রের ওই মাছগুলোই বন্ধু ছিল। দুয়েকটা অন্য বন্ধু ছিল বটে, তবে কি, অনিফিশকে তার মা ভীষণ শাসন করে রাখতেন। তাদের সাথে তেমন বিশেষ বন্ধুত্ব ছিল না। একসাথে এদের দেখে সে কিছুটা গুটিয়ে গেল। একটু ভয়ে সে পাপাঙ্গুলের গা ঘেঁষে দাঁড়াল।
ভিড়ের মধ্যে থেকে একটা বুড়ো দাদু এসে পাপাঙ্গুলের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষণ। তারপর মাথা নেড়ে বলল – “পাপাঙ্গুল পাপাঙ্গুল!”
পাপাঙ্গুলের মুখটা হাসিতে ভরে উঠল। সে তাকে জড়িয়ে ধরে বলল – “ছটপটি দাদু, আমি তোমাদের পাপাঙ্গুল।”
চারিদিক থেকে আনন্দের উল্লাসের ঢেউ বইতে শুরু করল। “পাপাঙ্গুল, পাপাঙ্গুল।” তারা হাত-পা নেড়ে নানা ভাবে জানিয়ে দিল তাদের ভালোবাসা। এতো ভালোবাসা উচ্ছ্বাস দেখে পাপাঙ্গুলের দুচোখ আনন্দের কান্নায় ভিজে গেল। অনিফিশও তাই দেখে বেজায় খুশী হল। পাপাঙ্গুল তাদের দিকে ফিরে বলল – “এই আমার বন্ধু অনিফিশ। আজ থেকে এ আমাদের অতিথি হল।” অনিফিশ তাই শুনে খুব লজ্জা পেয়ে আরও একটু পাপাঙ্গুলের গা ঘেঁষে দাঁড়াল। কিছু ছোট্ট ছোট্ট বাচ্ছা “নীল মাথাতে সবুজ রঙের চুল”, তারা সব্বাই মিলে অনিফিশের কাছে এসে তার পাখনায়-গায়ে হাত বুলিয়ে আদর করে দিল। অনিফিশ বেজায় খুশী হয়ে খিলখিল করে হেসে উঠল। সবাই মিলে অনিফিশকে দেখে গেয়ে উঠল –
“আহা আলঙ্গুশ, আজ আমাদের মেজাজ বড় খুশ, আহা আলঙ্গুশ”
এই বলে সবাই মিলে পাপাঙ্গুল আর অনিফিশকে নিয়ে চলে গেল, সেই সবুজ দেশে, সবুজ গাঁয়ের মাঝে...
লেখা ও ছবিঃ
অনন্যা দত্ত
কলকাতা
- বিস্তারিত
- লিখেছেন অনন্যা দত্ত
- ক্যাটfগরি: গল্প-স্বল্প