খেলাঘরখেলাঘর

স্থির অড়িতের কথা

একখানা চুম্বককে লোহার তৈরী কোন কিছুর ( যেমন সেফটিপিন বা আলপিন) কাছে আনলে চুম্বক তাকে আকর্ষন করে, এটা তোমাদের সাধারন অভিজ্ঞতা। কিন্তু এটাকি জান যে কাগজের টুকরোকেও কোন কিছু দিয়ে আকর্ষিত করা যায়! দেখেছ কখনও ? দেখ নি ? তাহলে যা যা বলি করে দেখ, কি হয়। শীতের দিন হলে ভাল হয়, কেননা এই পরীক্ষা করতে গেলে শুকনো আবহাওয়া প্রয়োজন। কেন শুকনো আবহাওয়ার দরকার তা পরে বলছি।                                                           
একদিন মাথায় ভাল করে শ্যাম্পু কর, যাতে চুলে তেল না থাকে। আর চিরুনীটাকেও সাবান দিয়ে পরিষ্কার করে নাও।
এবার কাগজ ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে টেবিলের ওপর ছড়িয়ে দাও। চুল, চিরুনী সব শুকিয়ে গেলে ভাল করে মাথা আঁচড়ে চিরুনীটাকে কাগজ-টুকরোগুলোর কাছে নিয়ে যাও। কি দেখবে বল দেখি ? আলপিন যেমন চুম্বকের দিকে আকর্ষিত হয়, কাগজ টুকরোগুলোও তেমনি চিরুনীর দিকে ছুটে যাবে বা আকর্ষিত হবে। অথচ দেখ চিরুনীটাও চুম্বক হয়নি বা কাগজের টুকরোগুলোও আলপিন হয়ে যায় নি। অবাক ত' হলেই, না কি ?
অবাক করা আরও এক আধটা উপমা দিই তাহলে। একটা ছোট বেলুন ভাল করে ফুলিয়ে মুখটা বেঁধে নাও যাতে হাওয়া বেরিয়ে না যায়। এবার ঐ ফোলান বেলুনটা কোন নাইলন বা টেরিলিন কাপড়ে ভাল করে ঘসে নাও।দেয়ালে টানানো ক্যালেন্ডারের গায়ে বেলুনের ঘসা দিকটা ঠেকিয়ে হাত সরিয়ে নাও। দেখ অবাককান্ড, বেলুনটা পড়ে গেল না, ক্যালেন্ডারের গায়ে সেঁটেই রইল!
এমন উদাহরন অনেক দেওয়া যায়। ব্যাপারখানা  বুঝতে পারলে কিছু! এসব আসলে তড়িতের খেলা, যাকে ঠিক করে বললে বলতে হয় 'স্থির তড়িৎ' এর খেলা। স্থির তড়িৎ তাহলে  কি রকম ?
যখন কোন দু'টি বস্তুকে পরস্পর ঘসা হয় তখন স্থির বিদ্যুতের সৃষ্টি হয়, যেমন এখানে চুলের মধ্যে চিরুণী, কিংবা বেলুনকে নাইলন কাপড়ে ঘসা হল।
এমন ঘর্ষনে উৎপন্ন তড়িৎকে বলে 'স্থির বিদ্যুৎ', আর এই ব্যাপারকে বলে 'তড়িতাহিত করণ'। এখানে যেমন কাগজ আর চিরুণী দু'টিই তড়িতাহিত হয়ে স্থির বিদ্যুৎ উৎপন্ন করেছে।
আর দু'চারটে কথা বলে নি । তাহলেই সব বুঝতে পারবে।
তাপ সম্পর্কে বলার সময় বলেছিলাম দু' রকম পদার্থের কথা, যারা কিনা 'সুপরিবাহি' আর 'কুপরিবাহি'।
যারা তাপ পরিবহন করে তারা সুপরিবাহি আর যারা করে না  তারা কুপরিবাহি। তেমনি যারা তড়িৎ পরিবহন করে তারা 'পরিবাহী'(conductor) আর যারা তা পারে না তারা 'অপরিবাহী' (non-conductor)। সব চেনা ধাতু এবং অন্যান্য কিছু পদার্থ তড়িতের পরিবাহী। মানুষের দেহ কিন্তু এই পরিবাহীদের দলে, জলীয় বাষ্পও তাই। বেশীরভাগ অধাতু অপরিবাহী। ঐযে চিরুণীর কথা বললাম, সেটা কিন্তু অপরিবাহী। কাগজ, বেলুনও তাই।
যদি ঐ চিরুণীটা যা দিয়ে তৈরী সেই প্ল্যাস্টিক, পলিথিন বা সেলুলয়েডের না হয়ে পিতল বা আলুমিনিয়মের তৈরী হত (চুল কাটার সেলুনে যেমন থাকে), তাহলে কি কাগজকে টানত ? একেবারেই না। কারণটা কি জান ? কারণ হল, ধাতু পরিবাহী। চুলের সাথে  ধাতব চিরুণীর ঘসায় স্থির বিদ্যুৎ তৈরী হয় ঠিকই, কিন্তু সেই বিদ্যুৎ, পরিবাহী চিরুণী  আর তোমার শরীরের মাধ্যমে (শরীরও পরিবাহী) সোজা মাটিতে চলে যাবে, অর্থাৎ নিস্তড়িৎ হয়ে পড়বে। চিরুণী যদি তড়িৎ হারিয়েই ফেলে তাহলে আর আকর্ষণ করবে কি করে!
প্লাস্টিকের চিরুণী অপরিবাহী বলে আমাদের দেহের মাধ্যমে তড়িৎ মাটিতে যায় না, যেখানকার তড়িৎ সেখানেই থাকে। তাই ত' সে চিরুণীর মধ্যে থেকে কাগজের টুকরোকে আকর্ষন করে। তাই বলে কি ঐ তড়িৎ চিরকালই থেকে যাবে নাকি! মোটেই না। একটু পরেই চিরুণী নিস্তড়িৎ হয়ে যাবে, কেননা তড়িৎ বাতাসে থাকা জলীয় বাষ্পের মাধ্যমে বাতাসে চলে যায়। এই প্রক্রিয়াকে বলে 'তড়িৎ মোক্ষণ' হওয়া (leakage of electricity)। ঠিক এই কারণেই ক্যালেন্ডারের সাথে বেলুনও চিরকাল ঝুলে থাকবে না।
ধাতব চিরুণীর যদি একটা অপরিবাহী হাতল থাকে তাহলেই, মানুষের দেহের সাহায্যে তড়িৎ মোক্ষণ হবে না, তড়িৎ চিরুণীতেই থেকে যাবে। তবে একটু পরেই তা নিস্তড়িৎ হয়ে যাবে বাতাসে তড়িৎ মোক্ষনের জন্য। বাতাসে থাকা জলীয় বাষ্প এই মোক্ষনের জন্য দায়ী।
অপরিবাহী পদার্থকে আমরা অন্তরকও বলি। বাড়িতে যে বিদ্যুতের তারের সাহায্যে আলো জ্বালানো হয় (সুইচ আর বাল্বের মধ্যে তারের সংযোগ থাকে), সেই তার রবার, সুতো বা প্লাস্টিক জাতিয় অন্তরক দিয়ে মোড়া থাকে, যাতে অসাবধানে বৈদ্যুতিক তারে হাতের ছোঁয়া না লাগে। তারে হাত লাগলে 'শক' লাগে এটা নিশ্চয়ই বলে দিতে হবে না। রাস্তার পাশে যে বিদ্যুৎবাহী তার থাকে সেটা কিন্তু অন্তরক দিয়ে মোড়া থাকে না। তাহলে যে স্তম্ভগুলোর সাহায্যে তারকে একস্থান থেকে আর এক স্থানে নিয়ে যাওয়া হয়, সেগুলো ঐ তারের সংস্পর্শে বিদ্যুতবাহি হয়ে পড়ে। আর সেগুলোয় হঠাৎ ছোঁয়া লাগলে শক লেগে যেতে পারে। তাই লক্ষ্য করলে দেখতে পাবে যে এক ধরনের অন্তরক পর্সিলিনের বাটির সাহায্য নেওয়া হয়, যাতে তারের সাথে আলোকস্তম্ভের সংযোগ হয়ে না যায়। অবশ্য এভাবে খোলা পরিবাহী দিয়ে তড়িৎ পাঠালে একটা ক্ষতি হতে থাকে, অন্তরকবিহীন তার থেকে তড়িৎমোক্ষণ আটকানো যায় না।
এ ব্যাপারে উঁচু শ্রেণীতে উঠে আরও অনেক কিছু জানতে পারবে।
                              *       *       *       *       *       *

একটা মজার খেলা দিয়ে লেখাটা শেষ করি।
টেবিলের ওপর দু'খানা বই ১০-১২ সেমি দুরে রাখ। সে দু'খানা যেন ২ সেমির মত উঁচু হয়। এর ওপর একখানা কাঁচের প্লেট রাখ। তবে তার আগে টেবিলের ওপর বই দু'খানার মাঝখানে কিছু কাগজের টুকরো, থার্মোকলের ছোট ছোট বল, সুতোর টুকরো---এই সব রাখতে হবে। এবার নাইলন বা টেরিলিন কাপড় দিয়ে কাঁচের ওপরটা ঘষতে থাক। (সিল্ক বা পশমের সোয়েটার দিয়েও ঘষতে পার, তাতেও হবে)।বন্ধুদের সামনে
এটা কর, দেখ না কেমন মজা হয়। ওরা দারুণ অবাক হয়ে যাবে। কি হবে বলতে পার ? টেবিলে ছড়ানো ঐ সব জিনিষগুলো ঝট পট উঠে কাঁচের গায়ে সেঁটে যাবে, একেবারে ম্যাজিকের মত।
কেন হল তার কারণটা ত আগেই বলেছি।

      
সন্তোষ কুমার রায়
অ্যাটলাস মোড়, দক্ষিণ ২৪ পরগনা

সন্তোষ কুমার রায় অবসরপ্রাপ্ত প্রধানশিক্ষক। বিষয় পদার্থবিজ্ঞান। শৈশব ও কৈশোর যথাক্রমে বাংলাদেশে এবং কলকাতায় কাটলেও, কর্মজীবন কেটেছে বাংলা বিহার সীমান্তের হিন্দুস্থান কেব্‌ল্‌স্‌ শিল্পনগরীতে। শিল্পনগরী থেকে প্রকাশিত বিভিন্ন পত্রিকায় ছোটদের এবং বড়দের জন্য বিজ্ঞানভিত্তিক লেখা লিখেছেন বহুবছর। বর্তমানে ইচ্ছামতীর পরশমণি বিভাগে নিয়মিত লেখা ছাড়াও তিনি একটি গ্রুপ ব্লগের সদস্য রূপে লেখালিখি করেন ।