স্কটল্যান্ড জায়গাটা ভারী সুন্দর। এখানে ঝোপে ভরা পাহাড়চূড়াগুলি ঘন কুয়াশার চাদর মুড়ে বসে থাকে; সবুজ ফার্ণগাছগুলি মানুষের সমান লম্বা হয়ে নদীবহুল উপত্যকাগুলিকে ঢেকে রাখে। এরকম জায়গা পরীদের খুব প্রিয়, বেশ মানুষের চোখের আড়ালে গোপনে থাকা যায়। আর সত্যিই, সেজন্যই স্কটল্যান্ডের পার্বত্য প্রদেশগুলিতে পরীদের বেশ ভীড়। পরীরা কেউ দয়ালু, কেউ পরশ্রীকাতর, আর একদল আছে, যাদের স্কটরা ‘শী’ বলে ডাকে, তারা জ্ঞানী, বৃদ্ধ ও অনেক ক্ষমতার অধিকারী।
অনেকদিন আগে একবার দুজন শী মহিলা এইরকম পরিবেশে রাংচিতার বেড়া দেওয়া গ্রামের বাড়িগুলির আশে-পাশে ঘুরে বেড়াচ্ছিল। বড় বড় বাদাম গাছের তলায় তাদের লুকোচুরি খেলা বেশ জমে উঠেছিল। হঠাৎ কোথা থেকে একটা বাচ্চার কান্নার আওয়াজ শোনা গেল। খুঁজে পেতে দেখা গেল, একটা বড় গাছের তলায় ভাল করে পশমী শালে জড়ানো এক ছোট্ট মানবশিশু, শুয়ে শুয়ে চিৎকার করছে। ধারে পাশে কেউ নেই। তারা যখন বাচ্চাটিকে দেখার জন্য নিচু হয়েছে, বাচ্চাটি তাদের দেখে আনন্দে খিল্খিল্ করে হেসে উঠল।
পুঁচকে বাচ্চাটাকে দেখে পরী মেয়েরা তো একেবারে মোহিত হয়ে গেল। একজন বলল, “ধারে পাশে তো কাউকে দেখা যাচ্ছে না। বোধহয় বাচ্চাটাকে কেউ ফেলে দিয়ে গেছে।” আরেকজন বলল, “কেউ যখন দাবি করতে আসছে না, তখন ও আমাদেরই হল।” তারা চট্ করে বাচ্চাটাকে তুলে নিয়ে শী-দের দেশে চম্পট দিল।
একটু পরেই বাচ্চার মা, ধরো তার নাম কুসুম, এসে হাজির। সে রান্নাঘরের জন্য কিছু ডালপালা কুড়োবার জন্য সামান্য একটু দূরে গিয়েছিল। ফিরে এসে বাচ্চাকে না দেখে সব জায়গায় আতিপাঁতি করে খুঁজতে লাগল। কিন্তু কোথাও তাকে দেখতে পেল না। অন্ধকার নেমে এল; কাঁদতে কাঁদতে সে বাড়ি ফিরে এল। প্রতিবেশীদের সমস্ত ঘটনা জানালে পরদিন ভোর হতেই সকলে শিশুটিকে খুঁজতে তরুণী মায়ের সঙ্গে বেরোল। তারা ঝোপে ঝাড়ে, লম্বা ফার্ণের জঙ্গলে, সর্বত্র খুঁজল; চেনাশোনা সমস্ত পথিককে জিজ্ঞাসা করল। কিন্তু শিশুটি যেন একেবারে উবে গেল। এক সপ্তাহ ধরে দিন-রাত্রি এক করে খুঁজেও শিশুটির কোনো চিহ্ন পাওয়া গেলনা। ক্রমে সবাই আশা পরিত্যাগ করল; শুধু মায়ের মন তার হারাধনের আশায় অতন্দ্র হয়ে রইল।
সবাই যখন হাল ছেড়ে দিয়েছে, কুসুম ঠিক করল তাকে একাই যেতে হবে বাচ্চার খোঁজে; প্রয়োজন হলে পৃথিবীর শেষ প্রান্তে সে যাবে। কোথাও, কখনও সে খুঁজে পাবেই তার জীবনের একমাত্র অবলম্বনকে। এ পৃথিবীতে সে ছাড়া আর কে আছে মায়ের, স্বামীও তো পৃথিবী ছেড়ে চলে গেল। গ্রাম থেকে শহরে, তার থেকেও দূরে দূরান্তরে শুরু হল বেচারী মেয়েটির একা পথ চলা, জনে জনে জিজ্ঞাসা করা; কিন্তু কেউই হারিয়ে যাওয়া শিশুটির কথা বলতে পারল না।
শেষ পর্যন্ত সে এসে পৌঁছাল ভবঘুরে বেদেদের শিবিরে। সে জানত এইসব লোকেরা দেশ-দেশান্তর ব্যাপকভাবে ঘুরে বেড়ায়। তাই হয়ত জানতেও পারে, এই আশায় তাদের জিজ্ঞাসা করল তার হারিয়ে যাওয়া শিশুর সংবাদ। কিন্তু তাদের কাছেও তো এর জবাব নেই। তবে এই দয়ালু লোকগুলি যখন তার কাহিনী শুনল, তাদের কুসুমের জন্য খুবই দুঃখ হল। তাই তারা যখন উত্তর দিকে যাত্রা করল, তখন তাকেও সেই বেদেদলের সঙ্গে নিয়ে গেল। আশা, তাদের দলের অন্য একটি শিবিরে যে এক অতি প্রাচীন বৃদ্ধা থাকেন, যাঁর কাছে পৃথিবীর সব জ্ঞান গচ্ছিত রয়েছে, তিনি যদি কোনো হদিস দিতে পারেন।
অনেকদিন ধরে চলে বেদের দল উত্তরের শিবিরে পৌঁছাল। মেয়েটিও আশায় বুক বেঁধে এল সেই প্রাচীনার সঙ্গে দেখা করতে। লক্লকে আগুনের পাশে এক বৃদ্ধা গুঁড়িসুড়ি মেরে বসেছিলেন। বয়সের ভারে তাঁর শরীরটা কুঁচকে গিয়েছিল, চামড়া হলুদ হয়ে আঁকিবুকি রেখায় পুরোন ভূর্জপত্রের মত দেখাচ্ছিল। কিন্তু মেয়েটি কাঁদ্তে কাঁদ্তে যখন তার ইতিহাস শোনাচ্ছিল, তখন তাঁর বলিরেখা ভরা মুখে চোখদুটি বুদ্ধিতে উজ্জ্বল হয়ে ঝক্ঝক্ করছিল।
সব কথা শুনে তিনি দীর্ঘক্ষণ চুপ করে রইলেন। মেয়েটির মনে হতে লাগল, হয় তিনি ঘুমিয়ে পড়েছেন নয়তো বহুবিলম্বিত মৃত্যু অবশেষে তাঁর কাছে এসে পৌঁছেছে। শেষপর্যন্ত তাঁর নীরবতা ভাঙ্গল, মনে হল যেন বহুদূর থেকে তাঁর কন্ঠ ভেসে এল।
“বেচারা খুকুমনি, তোমার বাচ্চাকে শী-পরীরা চুরি করে নিয়ে গেছে নিজেদের দেশে। সেখানে যারা একবার যায়, তারা প্রায়শই আর ফিরে আসে না। তাকে পাবার আশা ত্যাগ করো।”
চিৎকার করে কেঁদে কুসুম বলে উঠল, “আমার প্রাণ থাকতে আমি তার খোঁজ করা ছাড়ব না। আমি জানি, শী-রা খুব শক্তিশালী। কিন্তু আপনার কাছেও তো আছে বহু বছরের সঞ্চিত জ্ঞান। তাদের বিরুদ্ধে লড়বার জন্য আমায় কিছু জাদুশক্তি দিন না?”
দুঃখিতভাবে মাথা নেড়ে বৃদ্ধা বললেন, “শী-দের বিরুদ্ধে আমার কোন জাদুশক্তিই কাজে লাগবে না। তবে একটা মাত্র উপায় আছে, যার দ্বারা তুমি তোমার সন্তানকে ফিরে পেতে পার।”
সবাই উৎসুক হয়ে উঠল। তারপর বৃদ্ধা বেদেনী সেই মেয়েটিকে শী-দের কথা বললেন। খুব শীঘ্রই শী-দের দেশে এক বিরাট সম্মেলন হবে। দেশের প্রতিটি কোন থেকে সেখানে পরীরা জমায়েত হবে পরবর্তী একশ বছরের জন্য তাদের নেতা নির্বাচনের জন্য। এসব শুনে বিভ্রান্ত মেয়েটি বলে উঠল, “কিন্তু এর সঙ্গে আমার বা আমার বাচ্চার সম্পর্ক কি?”
“ধৈর্য ধরো মা, শী-দের একটা দুর্বলতার কথা তোমায় বলি শোনো। কোনো মানুষ কিন্তু এখবর জানে না,” খল্খল্ করে হেসে বৃদ্ধা বললেন, “শী-দের সমস্ত বিষয়ে জ্ঞান ও ক্ষমতা থাকলেও তারা নিজেদের জন্য কিছুই তৈরী করতে পারেনা। তাই কোনো কিছু পেতে গেলে তারা হয় সেটা ভিক্ষা করে পায় বা চুরি করে। এই পরীগুলো খুব দাম্ভিক আর তারা খালি সেই সব জিনিষ পেতে চায় যেটা পৃথিবীতে আর কারো কাছে নেই। যদি তুমি এই পৃথিবীতে তেমন কিছু পাও তবে সেটার বদলে তুমি বাচ্চাকে ফিরে পাবার চেষ্টা করতে পার।”
দুঃখী মেয়েটি করুণ মিনতি করে বলে উঠল, “হে প্রজ্ঞাময়ী, দয়া করে আমাকে বলুন, কোথায় পাবো এমন জিনিষ। আর জিনিষটা যদি বা পাই, কিভাবে সেদেশে পৌঁছাব?”
“বাছারে, সেটা তো আমি বললে হবে না। এই অসামান্য জিনিষটা কোথায় পাবে, তা তোমাকেই ঠিক করতে হবে। এছাড়াও শী-দের দেশে ঢুকবার রাস্তা জানতে গেলেও এইরকমই আরেকটা অনবদ্য বস্তু উৎকোচ হিসেবে দিতে হবে তোমাকে। তবে এখানে আমি তোমায় একটু সাহায্য করতে পারি। যাত্রাপথে তোমার যে কোনো রকম বিপদ থেকে রক্ষার উপায় আমি করব” – এই বলে বৃদ্ধা বেদেনী মেয়েটির মাথায় হাত রেখে আশীর্বাদ করলেন। এভাবেই তিনি তাকে এমন এক জাদু রক্ষাকবচ দিলেন যেটা তাকে জল, স্থল, আগুন বা বাতাস থেকে আসা যেকোন বিপদ থেকে বাঁচাবে।
এবার বেদের দল যে যার পথে রওনা হয়ে গেল। কুসুম একা একটি মেয়ে, এক সন্তানহারা মা, আকাশের তলায় বসে ভাঙা শিবিরের অগ্নিকুন্ডের দিকে তাকিয়ে ভাবতে বসল এবার তার কি করণীয়। দুটো জিনিষ তার চাই – একটি তাকে দেবে পরীর দেশে ঢুকবার পথের সন্ধান, আর দ্বিতীয়টি তাকে এনে দেবে হারানো সন্তানকে। কত অদ্ভুত জিনিষের কথা তার মনে পড়ল, যেগুলির কথা সে আগে শুনেছিল। তার মধ্যে দুটির কথা তার মনে এল, যেগুলিকে সত্যিই দুর্লভ বলা যায়; একটি নেক্টান-এর সাদা ঢিলে কোট আর অন্যটি রাড-এর সোনালী তারযুক্ত বীণা। কিন্তু তার মত এক সামান্য কৃশকায় মেয়ে কিভাবে এসব দুর্লভ বস্তু জোগাড় করবে যাতে এত ক্ষমতাশালী পরীরাও তাকে হিংসা করবে? তারপর তার মনে এল তার বাচ্চার কথা। ওঃ, সে যে সোনা-রূপোর থেকেও দামী! কুসুম আবার শক্ত হল আর দৃঢ়ভাবে কাজে এগোল।
প্রথমে সে এল সমুদ্রের তীরে। সেখানে খাড়াই পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে নরম পালকের জন্য বিখ্যাত আইডার হাঁসদের বাস। পাথরগুলো জল লেগে লেগে ধারালো হয়ে গেছে। সেই পাথর ধরে উঠে সে খুঁজে ফিরল হাঁসেদের বুক থেকে ঝরে পড়া কোমল সাদা পালকগুলি। কতবার তার পা কেটে রক্তাক্ত হয়ে গেল, সাগরের ঢেউ তার পোষাক বারবার ভিজিয়ে দিল, সে ভ্রূক্ষেপও করল না। সূর্যের তাপে সে ক্লান্ত হল না, বৃষ্টি তাকে দমাতে পারল না। সমুদ্রের ঝড়ও তার কাছে মৃদুভাবে বয়ে গেল। বেদেনীর জাদু তাকে বিপদ থেকে রক্ষা করছে, এই ভাবনাটা তাকে সাহস দিল।
অবশেষে তার প্রয়োজনীয় হাঁসের পালক জোগাড় হল। এবার কুসুম তা দিয়ে এমন একখানা কোট বানালো যেটা গরম কালের আকাশে ভেসে যাওয়া মেঘের মত নরম আর সাদা। সেই সুন্দর কোটের পাড় ধরে সে নিজের সোনালী লম্বা চুল দিয়ে ফুল, ফল, পাতাভরা নক্সা তৈরী করে দিল। কোটটাকে ফুলগাছের ঝোপের ভিতর লুকিয়ে রেখে এবার সে দ্বিতীয় কাজ শুরু করল। সমুদ্রের তীর বরাবর খুঁজে খুঁজে সে জোগাড় করল কতগুলি সামুদ্রিক প্রাণীর হাড়। সূর্যের কড়া রোদে সেগুলির নিজের রং জ্বলে সাদা হয়ে গেছে, সমুদ্রের তীব্র জলোচ্ছ্বাসে তাদের গা হয়ে গেছে মসৃণ। এখন তাদের দেখলে মনে হয় হাতির দাঁত। নানা কসরৎ করে সেগুলি দিয়ে সে প্রথমে তৈরী করল একটা বীণার কাঠামো। তাতে আবার নিজের সোনালী চুল দিয়ে তার বেঁধে দিল শক্ত করে। এবার সে তাতে এত চমৎকার করে সুর বাঁধল যে সে সুর শুনে আকাশ থেকে পাখিরা নেমে এল, বনের পশু খাওয়া ভুলে মুখ তুলে সুর শুনতে লাগল।
কাঁধে সেই ঢিলে নরম কোট আর হাতে সোনালী তারের বীণা নিয়ে শী পরীদের দেশের দিকে কুসুম রওনা হল। দিনের আলোয়, চাঁদের আলোয় সে পথ চলতে লাগল। খোলা উঁচু রাস্তা, ছায়াঢাকা নিচু পথ পার হয়ে গেল সে; শেষ পর্যন্ত এসে পৌঁছাল লক্ষ্যের দরজায়। সিংহদরজার পাশে লুকিয়ে থেকে সে সমাগত শী-দের খেয়াল করতে লাগল। সে অবাক হয়ে লক্ষ্য করল যে তারা সকলেই দেখতে একরকম; ছোটোখাটো চেহারা, কালো চোখ আর চুল, একদম সাধারণ মানুষের মত। শুধু অন্যান্য পরীদের মত তাদেরও কান লম্বা আর ছুঁচলো। আর ওঃ, তাদের চোখগুলো হেলে পড়া আর বাদামের আকারের।
সমস্ত পরীরা দু’তিনজনের ছোটো ছোটো দলে ভাগ হয়ে ঢুকে গেল। কুসুম ভাবছে কি করা যায়; হঠাৎ দেখল একটা মেয়েপরী একা তাড়াতাড়ি আসছে কারণ তার দেরী হয়ে গেছে। কুসুম দেখল এই সুযোগ। সে চট্পট্ কোটটা পরে সেটাকে এমন ভাবে ছড়িয়ে দিল যে দিনের আলোয় কোটটার সমস্ত শুভ্রতা আর সোনালী সৌন্দর্য উদ্ভাসিত হয়ে উঠল। এইভাবে সে সোজা পরীমেয়েটির সামনে তার পথ আটকে দাঁড়াল।
বাধা পেয়ে পরী রেগে গিয়ে বলল, “একি, তোমার মত একটা নশ্বর মেয়ে এখানে কি করছে?” তারপর তার চোখ পড়ল সেই কোটটার উপর, যেটা জড়িয়ে মেয়েটিকে লাগছে অপরূপা সৌন্দর্যময়ী। মনে মনে সে তারিফ না করে পারল না। তার হেলে পড়া চোখ লোভে আর ঈর্ষায় চক্চক্ করে উঠল। কোটটা সে তক্ষুনি নিজের করে পেতে চাইল। “এই কোটটার জন্যে কত দাম চাও?” সে জিজ্ঞাসা করল।
কুসুম বলল, “এটা বিক্রির জন্যে নয়।”
“মাটির উপর কোটটা বিছিয়ে দাও, আমি এটাকে সোনার টুকরো দিয়ে ঢেকে দেব। সব তোমার, বদলে কোটটা আমার।”
“পৃথিবীর সব সোনা দিলেও এটি কিনতে পারবে না,” কুসুমের দৃঢ়স্বর শোনা গেল, “তবে এটারও একটা দাম আছে।”
“যে দামই হোক না কেন, আমি দেব,” পরী বলল। কুসুমের নড়াচড়ার সঙ্গে সঙ্গে কোটটির নরম ভাঁজগুলি নড়ছিল আর তার থেকে যে দ্যুতি ঠিকরে পড়ছিল তা দেখে পরীর চোখের সীমাহীন লোভ আর বাঁধ মানছিল না।
এবার কুসুম তার আসল কথাটা প্রকাশ করল, “আমি তোমায় এই কোটটা দিতে পারি, যদি তুমি আমাকে ভিতরে নিয়ে যাও।”
ব্যগ্রভাবে পরী বলল, “তবে ওটা আমায় দাও!”
কুসুম জানতো যে শী-রা প্রতারক হয়। তাই সে বলল, “না, এখনই নয়। আগে তুমি আমায় ভিতরে নিয়ে যাও, তারপর এটা তোমার হবে।” পরীর আর তর সয় না। সে খপ্ করে কুসুমের হাত ধরে দৌড় দিল। ভালভাবে ভিতরে ঢুকে কুসুম কোটটা তাকে দিয়ে দিল।
ভিতরে ঢুকে কুসুম দেখল সেই সমাবেশের একদম সামনে একটা সিংহাসনের উপর শী-দের নতুন রাজা বসে রয়েছেন। সে পরীদের মধ্যে দিয়ে ঠেলেঠুলে রাজার সামনে এগোতে চেষ্টা করল। পরীরা তাদের মধ্যে এরকম একজন মানুষকে দেখে এতই হতবাক হয়ে গেছিল যে তারা তাকে কিছুই বলতে পারল না। কুসুম সামনে এসে তার বীণাটা রাজাকে দেখাবার জন্যে তুলে ধরল। রাজা জিজ্ঞাসা করলেন, “তোমার হাতে ওটা কি, মানুষ?”
“একটা বীণা, রাজা,” কুসুম উত্তর দিল। “কিন্তু এরকম বীণা আপনার কাছে তো নেই-ই, আগে কেউ চোখেও দেখেনি।” এই বলে সে সেই সোনালী তারে টান দিল। তাতে সেই বীণা থেকে এমন সুন্দর সুর সৃষ্টি হল যে সভায় প্রশংসার এক হিল্লোল বয়ে গেল।
সুর থেমে গেলে রাজা দাঁড়িয়ে উঠে হাত প্রসারিত করে বললেন, “বীণাটা আমায় দাও।”
কুসুম বলল, “কক্ষনো নয়। এই বীণাটা আমি নিজের হাতে তৈরী করেছি। আমার নিজের সোনালী চুল দিয়ে এর তার বাঁধা হয়েছে। সমস্ত পৃথিবীতে এই জিনিষ আর দ্বিতীয়টি নেই।”
শী রাজা তাচ্ছিল্যের ভঙ্গীতে বললেন, “যদিও আমি নিশ্চিত যে এটা তোমার দাবিমত বিস্ময়করও নয় বা অদ্বিতীয়ও নয়, তবু আমার এটা ভাল লেগেছে। তাই কতো দাম চাও বল।”
“মনে হয় এটা আমি বিক্রি করব না।”
রাজা হিসেবে শী-নেতা যে দূরত্ব বজায় রেখেছিলেন, সীমাহীন লোভের বশে তিনি সেটাকে পেরিয়ে গেলেন। চিৎকার করে বললেন, “তোমার যা খুশী চাও, আমি তোমায় সব দেব। কিন্তু বীণাটা আমার চাই।”
কুসুম এখন রাজাকে তার হাতের মধ্যে পেয়ে গেছে। একটুও উত্তেজিত না হয়ে সে ধীরে ধীরে বলল, “আমার সন্তানকে তোমার শী-পরীরা চুরি করে নিয়ে এসেছে। তাকে ফেরৎ চাই।”
কিন্তু এই দাম দিতে রাজা চান না। তাই তিনি বড় বড় থলি ভর্তি করে সোনা আনতে হুকুম করলেন। সব সোনা কুসুমের পায়ের কাছে উজাড় করে ঢেলে দিয়ে বললেন, “এগুলি দিয়ে তুমি পৃথিবীতে সবচেয়ে ধনী হয়ে উঠবে। সব সোনা নিয়ে যাও আর বীণাটা আমায় দাও।”
দৃঢ়ভাবে কিন্তু ধীরে আবার মায়ের জবাব ফিরে এল, “আমি শুধু আমার শিশুকেই ফিরে পেতে চাই।”
এবার রাজা সেই সোনার সঙ্গে আরও মণি-মুক্তা, হীরা-জহরৎ এনে দিলেন। তার আলোকের ছটায় যে কোনো মহিলারই হৃদয় আহ্লাদে পূর্ণ হবে। কিন্তু কুসুম, আমাদের সন্তানহারা মা, সেসব ফিরেও দেখল না। সে তার দাবিতেই অটল হয়ে রইল।
কোনো কিছুতেই তাকে টলানো গেল না দেখে রাজা শেষ পর্যন্ত শিশুটিকে আনার হুকুম দিলেন। কিন্তু তাকে তিনি তক্ষুনি মায়ের হাতে দিলেন না। দাবি করলেন, আগে বীণা চাই তবে তিনি শিশুকে ফেরৎ দেবেন। কিন্তু কুসুম তো পরীদের স্বভাব জানে। তাই সে কিছুতেই বীণাটি হাতছাড়া করল না। সে কেবলই বলতে লাগল, “আগে শিশুটিকে নিরাপদে ফেরৎ দিন।”
আর কোনো গত্যন্তর নেই দেখে রাজা শিশুকে মায়ের হাতে তুলে দিলেন, বদলে পেলেন সেই বীণা। এতক্ষণে রাজার মনে শান্তি এল। মনের আনন্দে তিনি বীণাটি বাজাতে লাগলেন। বীণার সুমধুর সুরে সমস্ত পরীজনতা এত মোহিত হয়ে গেল যে কুসুম কখন তার বাচ্চাকে কোলে নিয়ে বেরিয়ে গেল, কেউ খেয়ালই করল না।
হয়তো এখনও শী পরীরা সেখানেই আছে, আর সেই সুমধুর সুর শুনছে। সেই সুর কি বলছে জানো? সুর গাইছে এক মায়ের ভালোবাসার কথা, যে তার বাচ্চার জন্য সর্বস্ব পণ করেছিল।
গল্পের উৎসঃ
স্কটল্যান্ডের উপকথা – মে ব্রডলী-র, “ফেয়ারী টেল্স্ অ্যান্ড লেজেন্ড্স্ অফ দ্য ওয়ার্ল্ড”
ভাবানুবাদঃ
শুক্তি দত্ত
কলকাতা