প্রতিবার ভাবি এ কিসের টান? এ কিসের মায়া ? কেন এই অমোঘ হাতছানি পাহাড়ের ? কিসের ইন্দ্রজালে বশ করেছে পাহাড় আমাদের? আমরা জ্ঞানপাপীর মত বুঝি সেই অমোঘ আকর্ষণের কথা । জানি সেই পথশ্রম কি ভয়ঙ্কর । তবুও নিশির ডাকের মত ছুটে চলি সেই সর্বনাশিনী পথমায়ায় ।একবার হাসি পাহাড়ি বনফুলের যৌবনগন্ধ নিতে নিতে আবার কেঁদে ফেলি পথের দুর্গমতা দেখে ।
ভোর ভোর গুপ্তকাশী থেকে তুঙ্গনাথের পথে বেরিয়ে পড়লাম । অনেকটা দুর্গম পথ পথ গাড়িতে যেতে হবে । তারপর শুরু হবে পায়ে হাঁটা দুর্গমতর পথ । সাতপাঁচ ভাবি আবার মনে ভয় মিশ্রিত আনন্দও উঁকি দেয় ।
পথ চলা শুরু হল বেশ আনন্দের সঙ্গে । চোপতায় থামা তারপর হাঁটার শুরু । চোপতা থেকে ৩৫০০ ফুট উঠতে হবে চড়াই পথ বেয়ে !
তুঙ্গনাথের পথ
পাথরের বাঁধানো ধাপকাটা পথ কিন্তু শুরু থেকেই চড়াই । কেদারনাথে পথ খুব বিপদ সঙ্কুল যার একপাশে খাদ আর অন্যদিকে পাহাড়ের গা। কিন্তু শুরু থেকে শেষ অবধি অতটা চড়াই নয় । তুঙ্গনাথের পথ শুরু থেকেই চড়াই ফলে কিছুদূর গিয়েই মনে হয় আর পারবনা পৌঁছতে, দম ফুরিয়ে যায় । অক্সিজেন কম পড়ছে বোধ হয় । ফুসফুস আর টানতে পারছেনা । যেমন করেই হোক আমাকে পৌঁছতে হবেই । পৃথ্বীশ আমার কষ্ট দেখলেই বলছে বসে নাও, জিরিয়ে নাও । তাড়ার তো কিছু নেই । ছোট ছোট স্টেপ ফেল । মরুতীর্থ হিংলাজ সিনেমার সেই দৃশ্য ভাসছে চোখের সামনে "পথের ক্লান্তি ভুলে..."
বল গো ঠাকুর কবে তোমার দেখা পাব ?
একটু জল খাচ্ছি আবার হাঁটছি । দূর থেকে তুঙ্গনাথের মন্দিরের বিশাল ঘন্টার আওয়াজ ভেসে আসছে । বুঝলাম কাছাকাছি এসে পড়েছি । মনের জোরে শেষমেশ পৌঁছলাম তুঙ্গনাথ ১২৫০০ ফুট উচ্চতায় । বেশ হাড় কাঁপানো ঠান্ডা ওপরে । মেঘলা আকাশ। রোদের প্রখরতা এক্কেবারে নেই । দু এক ফোঁটা বৃষ্টিও ঝরল গায়ে । তবে ওপরে পৌঁছে মন্দিরের বিশাল হলুদ ধ্বজা দেখতে পেয়ে মনে বড় আনন্দ হল । at last the goal is achieved! মন্দিরচত্বরে যত্রতত্র তুষারপাত হয়েছে । দর্শন দিলেন তুঙ্গনাথ স্বয়ং ।
তুঙ্গনাথ
তুঙ্গনাথ থেকে নীচে নেমে এসে চোপতায় এসে দুপুরের খাবার সারলাম আগুণ গরম টোম্যাটো স্যুপ আর ভেজ-ম্যাগি দিয়ে । সেই মূহূর্তে গরম খাবারের খুব প্রয়োজন ছিল । অনেকটা ক্লান্তি লাঘব হল । গাড়িতে ফিরে এসে আবার পথ চলা । এবারের গন্তব্যস্থল উখীমঠ । উখীমঠ রুদ্রপ্রয়াগ থেকে মাত্র ৪১ কিমি দূরে । পাহাড়ের ওপর ১৩১১ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত ছোট্ট শহর । উখীমঠের সংস্কৃত নাম ঊষামঠ । পুরাকালে বানাসুরের রাজধানী ছিল এটি ।
দীপাবলীর পর যখন কেদারনাথ মন্দির বন্ধ হয়ে যায় তখন বিগ্রহ নিয়ে স্বয়ং পুরোহিত মশাই বা রাওয়াল উখীমঠে এসে আশ্রয় নেন ছ'মাসের জন্য । দেখলাম সেই মন্দির আর পুরোহিতের থাকবার আশ্রম । পাহাড়ের ওপর থেকে একফালি নীলচে রংয়ের মন্দাকিনী চোখে পড়ে যার একপাশে গুপ্তকাশী আর অন্যপাশে উখীমঠ । খুব শান্ত নিসর্গ । সূর্যাস্তের কাছাকাছি আমরা তখন । তুঙ্গনাথের পথশ্রমের ক্লান্তি ভুলে এখানে এসে বসে একটু জিরেন হল। কাছেই আছে দেওরিয়া তাল বা লেকটি ।
উখীমঠ
এবার হোটেলে ফিরে এসে মুখ হাত-পা ধুয়ে গরম চা খেয়ে একটু বিশ্রাম নিয়ে লিখতে বসে গেলাম আমার রোজনামচা । মনে একটু খচখচানি এই যে হরিদ্বারের পর আর নেট কানেকশান পাওয়া গেলনা বলে । যাইহোক রাতের খাওয়া সেরে নিলাম যথারীতি গরম রুটি, ডাল আর সবজি দিয়ে ।
পরদিন ভোরে চা-জলখাবার, স্নান সেরে নিয়ে আবার বেরিয়ে পড়া উত্তরকাশীর উদ্দেশ্যে । এইটি হোল সবচেয়ে দীর্ঘতম জার্ণি । সকাল ৭টায় যাত্রা শুরু হল গুপ্তকাশী থেকে। একে একে পেরোলো ভিরী, তিলওয়াড়া । তেহরী বাইপাস করে ঘনশালী । পথে পড়ল লাস্তার নদী । সূর্যপ্রয়াগে লাস্তার নদী মিলিত হয়েছে মন্দাকিনীর সাথে । এখানে সকলে সূর্যের তর্পণ করতে আসে ।
কবীরের দোঁহায় বলে " পাথর পূজে হর মিলে ম্যায় পূজে পাহাড় তাতে ওয়াচাকে বলি ইস খায় সংসার "
ঘনশালী বাজার এল বেলা বারোটা নাগাদ । ধনতেরস আর দীপাবলীর বাজার রমরমিয়ে চলছে । সেদিন ছিল ভূতচতুর্দশী । রংচং দিয়ে নানারকম মিষ্টি, শুকনো ফল আর আতসবাজির মহা পসরা । ভীলগঙ্গার ওপর ছোট্ট সেতু পেরোলাম । তারপর বালগঙ্গা । চানিয়ালি, প্রেমনগর সিলওয়াড়া হয়ে তেহরী । কেমুন্ডা খাল পেরোলাম । সেখান থেকে উত্তরকাশী আরো ৬৩ কিলোমিটার । বিকেল তিনটেয় পৌঁছলাম উত্তরকাশী । ভাগিরথীর তীরে বারাণসীর মত পুরোণো, ঘিঞ্জি শহর কিন্তু নদীর এতই কাছে যে হোটেলে ঢুকে নদীর নীল জল দেখতে পেয়ে মনে হল, আপাততঃ অলিগলি, ঘিঞ্জি, কোলাহল, বাজার এই কয়েকটা শব্দ না হয় বাদ থাক আমার অভিধান থেকে । এতগুলো শহরের মধ্যে উত্তরকাশীতে এসে আবার কোন এক ভালোলাগায় আবিষ্ট হলাম । সাদামাটা হোটেল কিন্তু খাটে শুয়ে হিমালয় আর তার কোল জুড়ে ভাগিরথীর নীল জল আর সাদা ফেনিল জলরাশির কুলকুচি ।
নীল ভাগিরথী সাদা ঘাগরার কুঁচি লুটিয়ে নেচে নেচে চলেছে উত্তরকাশীর এমাথা থেকে ওমাথা । নদীর ধার দিয়ে দিয়ে কত পুরোণো মন্দির আর সাধুবাবাদের আশ্রম । ঠিক যেন পুরোণো কাশীবিশ্বনাথের বেনারস । সেখানেও গঙ্গার ধার দিয়ে অসংখ্য মন্দির আর আশ্রম । উত্তরকাশীতে একবার তেত্রিশকোটি দেবদেবীদের ভেট হয়েছিল বিশ্বনাথ মন্দিরে । তার কারণ হল দেবতা আর অসুরদের যুদ্ধ যখন শেষ হচ্ছিলনা তখন মাদুর্গা এখানে একটি বিশালাকায় ত্রিশূল প্রোথিত করে এই দেবভূমির ঘাঁটি আগলে ছিলেন । এই হল উত্তরকাশী । সেই শক্তিমাতার ত্রিশূল এখনো অক্ষত । তাকে কনিষ্ঠ অঙ্গুলি দিয়ে হেলানো যায় কিন্তু হাতে করে সর্বশক্তি প্রয়োগ করে বিন্দুমাত্র নাড়ানো যায়না । মহাদেব নাকি এই বিশাল অষ্টধাতুর ত্রিশূল দিয়ে বকাসুর বধ করেছিলেন ।
মা-দূর্গার ত্রিশূল
মহাদেব মন্দির ছাড়াও এখানে রয়েছে পরশুরাম, লর্ড একাদশ রুদ্র এবং কালীর মন্দির । ভাগিরথীর তীরে রয়েছে অগণিত আশ্রম ও ঘাট । ভাগিরথীর জলের তখন পড়েছে সূর্যাস্তের রং । ভূত চতুর্দশী তিথি সেদিন । কিছু পরেই নিশ্ছিদ্র আঁধারে ঢেকে যাবে নদীর তীর । সাধুবাবারা গঞ্জিকা সেবনের তোড়জোড় করছেন তখন । মন্দিরে বাজছে সন্ধ্যারতির ঘন্টা । আমি যেন বিস্ময়ে হতবাক হয়ে চেয়ে রইলাম নদীর দিকে । নুড়ি পাথরের ওপর দিয়ে কলকল ধ্বনিতে বয়ে চলেছে ভাগিরথী আপনমনে । এই জায়গাটিতে গেলাম । নদীর ধারে বড়ই মনোরম স্থান । আর মন্দিরের পাশ দিয়ে পায়ে হেঁটে সিঁড়ি দিয়ে নেমে গেলে পড়বে এক একটি ঘাট । আমরা কেদারঘাটে গেলাম ও জলে পা ডোবালাম । এটি একটি শ্মশান ও বটে । প্রাকৃতিক দৃশ্য , নদীর শব্দ মিলে মিশে একাকার এখানে । ঘাট থেকে আমাদের কালীঘাটের মন্দিরের মত সরুগলি দিয়ে দিয়ে বাজারে এলাম । ধনতেরসে ধাতুজ দ্রব্য কেনে আধুনিক ভারতবর্ষের সকল মানুষ । বাঙালীদের মধ্যেও অবাঙালি এই প্রথা চালু হয়ে গেছে । তাই আমিও ব্যাতিক্রমী হলাম না । দেবভূমির এই পবিত্র স্থানে পুণ্যতোয়া ভাগিরথীর তীরে এক বাসনের দোকান থেকে কিনে ফেললাম পছন্দের তামার দ্রব্যাদি । রকমারী ঘটি আর কমন্ডলু । আমার ধনতেরসের লক্ষ্মী আগমনী হোল । কৃষ্ণা চতুর্দশীর ছমছমে অন্ধকার তখন । আমার মাথায় ঝিমঝিম করছে হিমালয়ের নেশা । আর হিমালয়ের মাথার নীচে জোনাকীর মত আলোর বসতি ফুটফুট করে জ্বলছে । থিকথিকে সেই আলোর বাসা । উত্তরকাশীর অলিগলি, উত্তরকাশীর ব্যস্ত শহরতলী । মোম কিনে এনে হোটেলের ঘরে এসে চৌদ্দপ্রদীপের নেমকম্ম সমাধা করলাম । কি সুন্দর একটা শহর । কাশী বেনারসের গন্ধ রয়েছে যেন । অথচ আরেকটু যেন ছিমছাম ।
জটাজুটসমাযুক্তাং নগাধিরাজ হিমালয় আর তার থেকে নেমে এসেছে অগণিত স্রোতস্বিনী । দেবাদিদেব মহাদেবের আনন্দধারা গড়িয়ে পড়েছে সেই স্রোতস্বিনীর কমন্ডলু থেকে । হরের দুয়ারে কিম্বা হরির দ্বারে । যেখানেই হোক আমার চোখ সার্থক করেছে দেবভূমির আকাশের নীলরং, কিন্তু তবু ভরিল না চিত্ত ! বাতাসে বরফগলা পুণ্যতোয়া নদীদের কলকলানি এখনো লেগে রয়ে গেল দুকানে । কিসের জন্য এই কৃচ্ছসাধন? কেন রসাতল সমতলী জীবনযাপন, দীপাবলীর ভোগবিলাস ? শুধুই কি আত্মতৃপ্তি না কি দেবলোকে দার্শনিক হবার লোভ সংবরণ করতে না পারা ? অফুরান জীবনের পথের ধারে রেখে এলাম সেই নুড়িপাথরগুলোকে । হাওয়ায় উড়িয়ে দিলাম ভালোলাগার রেশটুকুনি । পাহাড়চূড়োর কত না জানা কথাকাহিনীরা তখন ভীড় করেছে আমার মাথায় ।
কাছেই দেখি মহানগরের সেই ভীড় রাজপথ ।
লেখা ও ছবিঃ
ইন্দিরা মুখার্জি
কলকাতা