খেলাঘরখেলাঘর

পাপাঙ্গুল আর অনিফিশ-২

পাপাঙ্গুলের সাথে গল্প করতে করতে ফুরফুরে হাওয়ায় কখন যে অনিফিশ ঘুমিয়ে পড়েছিল তার নিজেরও মনে নেই। সকাল বেলার প্রথম মিষ্টি আলো যখন এসে পরল তার মুখে, সে তার ছোট্ট পাখনা দুটো নেড়ে একটা খুব বড় আড়মোরা ভেঙ্গে তাকালো চারিদিকে। বাঃ! কি সুন্দর, শান্ত নীল জল। তার মাঝখানে একটু দুরেই একটা ছোট্ট সবুজ দ্বিপ। আর যেখানে সবুজ দ্বিপের সাথে নীল সমুদ্রের জল মিশেছে সেখানে খুব সুন্দর একটা সাদা ফেনার রেখা। জলের উপরটাও যে এত সুন্দর অনিফিশ তা আগে জানতই না। সূর্যের সোনালি আলো জলের মধ্যে পরে খুব সুন্দর খেলা করছে। অনিফিশের সব মনখারাপ যেন এক নিমেষে কোথায় পালিয়ে গেছে। মুখ ফিরিয়ে দেখল পাপাঙ্গুলের মুখটাও কেমন হাসি-হাসি।
“গুড মর্নিং পাপাঙ্গুল।”
পাপাঙ্গুল বলল “ওই দেখ আমাদের সবুজ পাহাড়, আমার দেশ। এখুনি আমরা পৌঁছে যাব ওখানে। আজ অনেক বছর পরে, ফিরছি আবার ঘরে।”
অনিফিশ তার চোখদুটো বড়বড় করে বলল – “সত্যি?”
পাপাঙ্গুলের ছাকনি শেষে এসে পৌঁছল পশ্চিম সাগরের তিরে, সবুজ পাহাড়ের গায়ে। এক লাফে পাপাঙ্গুল নেমে পরল জলের কাছে, তারপর, তার সেই ছাকনি-নাওটাকে তিরের কাছে এনে শক্ত করে বাঁধল দড়ি দিয়ে একটা গাছের সাথে। পাপাঙ্গুলের মনের মধ্যে একরাশ আনন্দ। ঘরে ফেরার সুখ যেন লেগে আছে তার চোখে-মুখে। রাত জাগার ক্লান্তিতে সে এতটুকুও দমেনি। এমন রাত তো সে আগে কতই জেগেছে। তবে তার কালকের রাত জাগা যেন সেসব রাতের থেকে আলাদা। কাল সে একটা নতুন বন্ধু পেয়েছে। আর তার সাথে সে অনেক বছর পরে অনেক কথা বলেছে – প্রানের কথা, মনের কথা, সুখদুঃখের কথা যা এতকাল ধরে জমে ছিল তার মনে। হটাৎ পাপাঙ্গুলের মনে পরল, কই অনিফিশের কোনও সাড়াশব্দ পাওয়া যাচ্ছে না। ছাকনির মধ্যে উঁকি মেরে দেখল ছাকনি ফাঁকা! “অনিফিশ...!!” সে ছাকনির মধ্যে নেই। হটাৎ ধক করে উঠল পাপাঙ্গুলের বুক। অনিফিশ কি তাকে না বলেই চলে গেল নাকি? কিন্তু কেন? ভয়ে ভয়ে চারিদিকে তাকাল পাপাঙ্গুল। কোথাও নেই অনিফিশ, কোথায় গেল সে? পাপাঙ্গুল যখন নিজের মনে ঘরে ফেরার অনুভূতি ভাগ করে নিচ্ছিল নিজেরই সাথে, সে সময় কি অনিফিশ ছাকনি থেকে অন্য কোথাও চলে গেছে সমুদ্রে? একটু সময় পাপাঙ্গুল যতটুকু দেখেছে তাতে সে বেশ ভালোই বুঝেছে অনিফিশ ভীষণ মুডি আর অভিমানী একটা গোল্ড ফিশ। তার মুডটা ভীষণ সাঁতরে বেড়ায় তারই মত। সে কি হটাৎ করে...?
এসব ভাবছে পাপাঙ্গুল এমন সময় দেখে তার পিঠে কি যেন একটা সুরসুর করছে। হাত বারিয়ে দেখে - ওমা! এ কে? এতো তার ছোট্ট অনিফিশ। পাপাঙ্গুল হাত বাড়িয়ে তাকে কাছে টেনে বলল – “কোথায় গেছিলে তুমি ছাকনি ছেড়ে?”
“এই নীল জল দেখে আর লোভ সামলাতে পারছিলাম না, টুপ করে একটা ছোট্ট সাঁতার কেটে নিলাম।” – হাসি হাসি মুখ করে বলল অনিফিশ। অনিফিশ তো আবার জল দেখলে নিজেকে ঠিক রাখতে পারে না। হাজার হোক, সে তো গোল্ডফিশ, সাঁতার কাটাই তার সখ।
পাপাঙ্গুল আর অনিফিশ তারপর একসাথে চলতে শুরু করল সেই সবুজ পথ ধরে। সেই আগের মতই আছে পাপাঙ্গুলের দেশ। রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে একেকটা জায়গা আসে, আর পাপাঙ্গুল অনিফিশকে দেখিয়ে বলে এক এক মোড়ের, এক এক বাঁকের গল্প। অনিফিশ তো জলের লোক, সে কখন ডাঙার গল্প শোনেইনি। তাই সে সেসব গল্প শুনে ভারী মজা পায়। অনিফিশ তার ছোট্ট মাথাটা নাড়িয়ে পাখনা নেড়ে অনেক প্রশ্ন করে – “পাপাঙ্গুল এটা কি গাছ? ওটা কি? এটাকে কি বলে?”
হটাৎ একটা জায়গায় এসে পাপাঙ্গুল থমকে দাঁড়াল। পাপাঙ্গুলের সেই হাসি-হাসি মুখটায় একনিমেষে আঁধার নেমে এল। অনিফিশ অবাক হয়ে জিগ্যেস করল – “কি হয়েছে পাপাঙ্গুল?”
“এখানেই এখানেই ছিল আমাদের ঘর। সেই ঝরের রাত্রে ঘর ভেঙ্গে গেছে, আর কেউ কোথাও নেই।” পাপাঙ্গুলের চোখদুটো জলে ভরে উঠল। অনিফিশ পাপাঙ্গুলের হাতের উপর হাত রাখল, মুখে কিছু বলল না। কিছুক্ষন সেখানে চুপটি করে দাঁড়িয়ে থাকল তারা দুজনে।
এমন সময় হটাৎ চারিদিকে কিছু লোকজনের গলার আওয়াজ পেয়ে পাপাঙ্গুল আর অনিফিশের ঘোর ভাঙল। দেখে তাদের দুজনকে ঘিরে বেশ কিছু সবুজ চুলের লোকজন জড়ো হয়েছে। যাদের দেখলেই বোঝা যায় এরা পাপাঙ্গুলের মতই আরও সব লোক এই দেশেরই। অনিফিশ একটু থতমত খেয়ে গেল। আসলে এমন ধরনের প্রানি তো আগে কখনও দেখেনি, সে তো জলের মাঝেই থেকেছে চিরটাকাল। তার তো শুধু সমুদ্রের ওই মাছগুলোই বন্ধু ছিল। দুয়েকটা অন্য বন্ধু ছিল বটে, তবে কি, অনিফিশকে তার মা ভীষণ শাসন করে রাখতেন। তাদের সাথে তেমন বিশেষ বন্ধুত্ব ছিল না। একসাথে এদের দেখে সে কিছুটা গুটিয়ে গেল। একটু ভয়ে সে পাপাঙ্গুলের গা ঘেঁষে দাঁড়াল।
ভিড়ের মধ্যে থেকে একটা বুড়ো দাদু এসে পাপাঙ্গুলের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষণ। তারপর মাথা নেড়ে বলল – “পাপাঙ্গুল পাপাঙ্গুল!”
পাপাঙ্গুলের মুখটা হাসিতে ভরে উঠল। সে তাকে জড়িয়ে ধরে বলল – “ছটপটি দাদু, আমি তোমাদের পাপাঙ্গুল।”
চারিদিক থেকে আনন্দের উল্লাসের ঢেউ বইতে শুরু করল। “পাপাঙ্গুল, পাপাঙ্গুল।” তারা হাত-পা নেড়ে নানা ভাবে জানিয়ে দিল তাদের ভালোবাসা। এতো ভালোবাসা উচ্ছ্বাস দেখে পাপাঙ্গুলের দুচোখ আনন্দের কান্নায় ভিজে গেল। অনিফিশও তাই দেখে বেজায় খুশী হল। পাপাঙ্গুল তাদের দিকে ফিরে বলল – “এই আমার বন্ধু অনিফিশ। আজ থেকে এ আমাদের অতিথি হল।” অনিফিশ তাই শুনে খুব লজ্জা পেয়ে আরও একটু পাপাঙ্গুলের গা ঘেঁষে দাঁড়াল। কিছু ছোট্ট ছোট্ট বাচ্ছা “নীল মাথাতে সবুজ রঙের চুল”, তারা সব্বাই মিলে অনিফিশের কাছে এসে তার পাখনায়-গায়ে হাত বুলিয়ে আদর করে দিল। অনিফিশ বেজায় খুশী হয়ে খিলখিল করে হেসে উঠল। সবাই মিলে অনিফিশকে দেখে গেয়ে উঠল –
“আহা আলঙ্গুশ, আজ আমাদের মেজাজ বড় খুশ, আহা আলঙ্গুশ”
এই বলে সবাই মিলে পাপাঙ্গুল আর অনিফিশকে নিয়ে চলে গেল, সেই সবুজ দেশে, সবুজ গাঁয়ের মাঝে...     

 

লেখা ও ছবিঃ
অনন্যা দত্ত
কলকাতা