(গত সংখ্যার পর)
জ্যঁ রেনোঁয়া তরুণ সত্যজিৎ রায়কে শিখিয়েছিলেন প্রকৃতির গোপন রহস্য কিভাবে ছবিতে তুলে ধরতে হয়। যাকে আমরা বলি বাস্তব, তারও অঞ্চল বিশেষে এক ধরণের নিজস্ব ছাপ থাকে। পুদভকিন ও চেরকাসভের কাছে তরুণ ঋত্বিক ঘটক হয়ত খেটে খাওয়া জীবন ও সাধারণ মানুষের জয়বার্তা কিভাবে সিনেমার পর্দায় লেখা যায়, তাও জেনেছিলেন। তবু ১৯৫২ সালে যখন স্বাধীন ভারতের প্রথম চলচ্চিত্র উতসবে ইতালির দুটি ছবি দেখানো হল, তখন শুধু কলকাতায়ই নয়, সারা দেশেই ছবি নিয়ে যাঁরা ভাবেন, তাঁরা অবাক হয়ে গেলেন। প্রথম ছবিটি ছিল 'বাইসাইকেল থিভ্স্', পরিচালক ভিত্তোরিও দি সিকা। দ্বিতীয় ছবিটি ছিল 'রোম- ওপেন সিটি, পরিচালক ছিলেন রবার্তো রসেলিনি। কি এমন অভিনব ছিল এই ছবিদুটিতে?
'বাইসাইকেল থিভ্স্' ছবির পোস্টার
'ওপেন সিটি রোম' ছবির পোস্টার
আসলে, রোজ যে জীবনকে দেখতে পাই, তাকেই যদি বিশ্বাস করি, সে দিয়েও যে গল্প বলা যেতে পারে এটা আমরা আগে কখনো জানতাম না। এটা কিন্তু খুব ভারি বা কঠিন কথা নয়। 'বাইসাইকেল থিভ্স্ 'এ একজন মানুষের সাইকেল চুরি হয়ে গেল; 'রোম-ওপেন সিটি' তে বিয়ের দিন একটি অল্পবয়সী মেয়ের হবু বরকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেল রাজনীতি করার অপরাধে। জীবনের এইসব টুকরো টুকরো ঘটনা কোন নায়ক নায়িকা ছাড়াই দেখা যায়, সাধারণ মানুষের রোজনামচাও যে বানানো নাটকীয় ঘনঘটার চাইতে কম নয়, এটা আমরা বুঝতে পারলাম। আর বুঝতে পারলাম বলেই, সত্যজিৎ রায় আমাদের মধ্যে থেকে সাহসী হয়ে বানিয়ে ফেললেন 'পথের পাঁচালী' । বাংলা ছবি তো বটেই, ভারতীয় ছবির চেহারাটাও 'পথের পাঁচালী' পালটে দিল।
এতদিন পরে যদি প্রশ্ন করি, 'পথের পাঁচালী' কেন এতবড় সাফল্য ছিল, তাহলে দেখব, এই হল প্রথম চলচ্চিত্র, যা বড় বড় ঘটনা বা পেশাদার অভিনেতা ছাড়াই জীবনকে দেখেছিল। এই ' দেখা' কথাটা আমাদের আলোচনায় খুব জরুরী। কেননা 'পথের পাঁচালী'তে পুরোটাই প্রায় দেখার সৌন্দর্য। আলো এসে পড়লে সামান্য কচুপাতাও কিভাবে কথা বলে ওঠে, সাদা কাশবনের মধ্যে ছুটোছুটি করে আমাদের দুটি কালো ভাইবোন। এই যে অসামান্য মুগ্ধতা, 'পথের পাঁচালী' কিন্তু পুরোটাই তাই।
অপু আর দুর্গা ছুটছে রেলগাড়ি দেখতে
কোন বড় সমুদ্র, পাহাড় বা রাজধানী নেই তাতে। সুন্দর নায়ক নেই, সুন্দরী নায়িকা নেই, নাচ নেই, গান নেই, কথাও অল্প, মূল চরিত্র তো মাত্র পাঁচজন। তবু একটি বালকের নিষ্পাপ চোখের মধ্যে দিয়ে সত্যজিৎ বাংলার একটি ছোট্ট গ্রামকে দেখেন। সে দেখায় পাপ নেই; পূণ্য নেই; মৃত্যু থাকলেও শোক নেই। কেননা শিশু শুধু বিস্ময়ের মধ্যে দিয়ে সময়ের পারাপার জানতে পারে। একটু সাহস করে আমি বলতেই পারি - 'পথের পাঁচালী'তে যেদিন সকালবেলা প্রথম অপু চোখ মেলল, ভারতীয় ছবিরও যেন সেদিন প্রথম চোখ ফুটল। সাহিত্য যেমন শব্দ দিয়ে লিখতে হয়, ছায়াছবি তেমন নয়। তাকে ছবি সাজিয়ে, 'ইমেজ' দিয়ে বলতে হয়, এই কথাটা প্রমাণ করতে পেরেছিলেন বলেই সত্যজিৎ রায়কে আমরা আধুনিক বাংলা ছবির প্রাণ পুরুষ বলে থাকি।
অপু
তারপরে তো একে একে নানা জয়ের মালা এল। সত্যজিৎ রায় যেমন পঞ্চাশ দশক জুড়ে অপুকে নিয়েই তৈরি করলেন তিনটি ছবি, সাথে জলসাঘর, পরশ পাথর ও অভিযান, তেমনই আরেক দিকে , বিরাট মাপের উচ্চতার ছবি নিয়ে দেখা দিলেন সত্যজিতেরই মত আরেক বড় প্রতিভা- ঋত্বিক ঘটক। ক্যামেরাকে স্টুডিওর বাইরে বার করে এনে সাধারণ মানুষের, মাঝি-মাল্লার জীবনযাত্রার কি সুন্দর ছবিই না তুলেছিলেন রাজেন তরফদার। একে একে মনে পড়বে সেযুগের স্মরনীয় ছবি। সেখানে খুব নামজাদা নায়ক নায়িকা নেই, আজকের মত দামী নামী জায়গার দৃশ্য নেই। হাড় হিম করা মারামারিও নেই। তবু 'পলাতক' বা 'হেডমাস্টার' জাতীয় ছবিগুলি মানুষের মন কেড়েছিল।
উত্তমকুমার
এর পাশাপাশি তৈরি হচ্ছিল অন্য এক ধরণের শহুরে রূপকথা - নায়ক উত্তমকুমারকে নিয়ে নানারকমের রোমান্টিক ছবি। যে সব ছবিগুলি এখনো একই রকম ভাবে জনপ্রিয়।
আমরা এরপর সত্যজিৎ রায়, ঋত্বিক ঘটক, মৃণাল সেন, রাজেন তরফদার - যাঁরা আমাদের সিনেমা শিল্পের ভিত গড়ে দিলেন, তাঁদের নিয়ে কথা বলব। আর আরেকটা পুরো অধ্যায় জুড়ে ঝলমল করতে থাকবেন উত্তমকুমার ও সুচিত্রা সেন।
(এরপর আগামি সংখ্যায়)