অনেক ছোটবেলায় ঘুমোতে যাওয়ার আগে মাঝে মাঝে এক অদ্ভূত শব্দ শুনতাম। আ-আ করে। বেশ ভয় করত। মা বলতেন, আরে ভয় পাওয়ার কি আছে? ও হচ্ছে দাঁড়কাক।
আমি বলতাম, কাক তো কা কা করে ডাকে। ও নিশ্চয়ই অন্য কিছু।
মা আবার বুঝিয়ে বলতেন, সে হচ্ছে পাতিকাক। দাঁড়কাকের রঙ ঘোর কালো। ঘাড়ের কাছে ছাই ছাই রঙটা নেই। আর দেখতেও বেশ বড় হয়।
হয়তো সেই কাকগুলো আমাকে ভয় দেখানোর জন্যই এমন করত। আমিও ঐ ডাক শুনলে কুঁকড়ে থাকতাম।
দাঁড়কাক
তারপর আস্তে আস্তে বড় হলাম। ভয়ও কেটে গেল। তারপর একদিন লক্ষ্য করলাম ঐ কাকগুলো আর ডাকছে না। আমি আস্তে আস্তে নিজের কাজ কর্মে, পড়াশোনায় ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। দাঁড়কাক ডাকল কি ডাকল না আমার ভারী বয়েই গেল। সে কত বছর আগের কথা। এখন খুব চেষ্টা করলেও ওদের ডাক একেবারেই আর শুনতে পাই না। তখনই প্রশ্নটা মাথায় আসে, ওরা কোথায় চলে গেল? জানতে পারলাম না। আমাদের বাড়ির পাশে আগে ছিল একটা বাড়ি, এখন হয়েছে গোটা পাঁচেক, তার ওপরে ফ্ল্যাট। পাড়ায় লোক বাড়ছে। দাঁড়কাকগুলো কোথায় গেল তা নিয়ে কারো মাথাব্যাথা নেই।
ছোটবেলায় আরো একটা পাখিকে দেখে বেশ ভয় করত - তা হল প্যাঁচা। মাঝে মাঝে আমাদের বাড়ির দক্ষিন দিকে ছাদের এক কোনে একটা প্যাঁচা এসে বসে থাকত। তখন বিজ্ঞান বইয়ে সবে সবে পড়েছি প্যাঁচার কথা। তিনরকম প্যাঁচা হয় – হুতোম প্যাঁচা, লক্ষী প্যাঁচা আর কালপ্যঁচা। আমাদের ছাদের কার্নিশে যে পাখিটা বসতো সেটা হয়তো লক্ষী প্যাঁচাই হবে কারন তার রঙ ছিল সাদা। কিন্তু তবু কোন কারনে পাখিটাকে দেখলেই ভয়ে হাড় হিম হয়ে যেত ভয়ে। তারপর একদিন প্যাঁচাটা চলে গেল। আমাদের বাড়ির দোতলা হল। ওর ছাতের কোনে বসে বসে ঝিমোনোর জায়গাটা দখল হয়ে গেল। অনেক পরে একদিন হঠাৎ মনে হল, আরে প্যাঁচাটা গেল কোথায়? ওকে কিন্তু আর কখনোই দেখা গেল না। শুধু ওকে কেন, আর কোন প্যাঁচাকেই আজকাল আর দেখতে পাই না।
পেঁচা
মাছরাঙা
গ্রামের দিকে মামার বাড়ি বেড়াতে গেলে দুপুরবেলায় শুনতে পেতাম ঘুঘুর ডাক। পুকুরের পাড়ে দেখতে পেতাম মাছরাঙা। মাঝে মাঝে টিয়া। এখন গ্রামের আদল আস্তে আস্তে বদলে যাচ্ছে। হারিয়ে যাচ্ছে অনেক চেনা পরিচিত পাখির হদিশ। ছোটবেলায় কিছু কিছু পাখিকে আকাশে অনেক উঁচুতে উড়তে দেখতে পেতাম। পড়েছিলাম ওরা হচ্ছে শিকারী পাখি – চিল, শকুন, ঈগল। চিল বা ঈগল কখনও খুব কাছ থেকে দেখিনি বটে, তবে শকুন দেখা যেত প্রচুরই। এখন আর দেখা যায় না। জানতে পারলাম কোন অদ্ভূত কারনে ভারতীয় শকুনরা আজ এক বিপন্ন প্রজাতিতে পরিনত হয়ে গেছে। তারা হারিয়ে যাচ্ছে একে একে।
প্রথমে বলছিলাম পাখিদের কথা। প্রশ্নটা কিন্তু শুধু পাখিদের নিয়ে নয় - সমস্ত প্রজাতিকে নিয়ে। আমাদের এই পৃথিবীতে প্রানের উৎপত্তি আজ থেকে প্রায় পৌনে চারশ কোটি বছর আগে। অথচ আজকের পৃথিবীতে টিকে আছে সেই সমস্ত প্রজাতির অতি সামান্য কিছু অংশ। এই অবলুপ্তির জন্য একদিক থেকে দায়ী প্রকৃতির নিয়ম। আজ থেকে প্রায় সাত কোটি বছর আগে একটি উল্কার সাথে সংঘর্ষে জলবায়ুর প্রভূত পরিবর্তন ঘটে। পৃথিবীর বুক থেকে হারিয়ে যায় ডাইনোসরেরা। কিন্তু প্রকৃতির নিয়ম একতরফা নয়। একদিকে যেমন পুরনো, অক্ষম প্রজাতিরা হারিয়ে গেছে; অন্যদিকে তেমন উন্নত প্রানীরা জন্ম নিয়েছে। বিবর্তন ঘটেছে সকলের। তারপর একদিন দেখা গেল একটি নতুন বুদ্ধিমান জীবকে –মানুষ। সে প্রায় আজ থেকে প্রায় দেড় লক্ষ্ বছর আগের কথা। প্রাথমিকভাবে দ্রুত হারিয়ে গেল আকারে বড় অন্যান্য স্তন্যপায়ী প্রানীরা। যেমন ম্যামথ, বড় দাঁতাল বাঘ। তারপর থেকে এক এক করে একটি প্রজাতি হারিয়ে যাচ্ছে মানুষের আগ্রাসনের শিকার হয়ে। মানুষ কেড়ে নিচ্ছে তাদের খাদ্য, আশ্রয় ও অস্তিত্ব।
শিশু লোরিস
তোমাকে বলি এই উপমহাদেশের কিছু বিরল প্রজাতির কথা। আমাদের দেশের বাঘ, সাধারন ভালুক, ভারতীয় গন্ডার, গাঙ্গেয় ডলফিন তো ইতিমধ্যেই স্থান পেয়েছে বিপন্ন প্রজাতির মধ্যে। হিমালয়ের পার্বত্য অঞ্চল থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে তুষারচিতা, পান্ডা, টাকিন; যেমন হারিয়ে যাচ্ছে চীনের রেড পান্ডা, ব্যাকট্রিয়ান ক্যামেল (ঊট), জার্বোয়া বা শ্রীলঙ্কার লোরিস। ছোট্ট লোরিসের একটা ছবি দিলাম। ওদের বাসস্থান জঙ্গল ক্রমশ ছোট হয়ে আসছে শ্রীলঙ্কায়। কোথাও বিপুল পরিমানে কাঠের চাহিদা, কখনও বা পশমের চাহিদা।
রেড পান্ডা
তুমি কি কখনো ভেবে দেখার চেষ্টা করেছ যে এই পৃথিবীতে কত রকমের জীবজন্তু আছে? সংখ্যাটা অনেক, এত বেশি যে আমরা নিজেরাও ঠিক করে জানি না। অথচ কতরকম প্রানীকে আমাদের চারপাশে দেখতে পাই? প্রায় হাতে গোনা। যদিও চিড়িয়াখানায় গেলে আরো অনেক রকম জন্তু জানোয়ারের দেখা মেলে, তবু তারা তো আদপে খাঁচার বাসিন্দা নয়। এই পৃথিবীটা যতটা আমাদের, ততটা তো ওদেরও। ওদের কারো থাকার জন্য চাই মরুভূমি, কারো চাই বরফের গুহা, কারো ঘন জঙ্গল। তোমার যদি নিজের বাড়িতে বাবা-মার সাথে থাকতে ভাল লাগে তবে ওদেরই বা ভাল লাগবে না কেন? কিন্তু যত পৃথিবীতে জনসংখ্যা বাড়ছে তত ওদের বাসস্থান কমে আসছে। কমে আসছে খাবারের সংস্থান। প্রকৃতি এই অনিয়ম কতদিন সহ্য করবে আমরা জানি না। কোন প্রানীই একা বেঁচে থাকতে পারে না। সকলে একসাথে নিজের দায়িত্ত্ব পালন করলে তবেই পরিবেশের ভারসাম্য বজায় থাকবে। এই চেতনা আমাদের জাগিয়ে তুলতে হবে নিজেদের মধ্যেই। শুধু সংরক্ষনের মাধ্যমেই আমরা বিপন্ন প্রজাতিগুলিকে বাঁচিয়ে রাখতে পারব না। ওদের বেঁচে থাকার আমাদের ভালবাসার নিতান্ত প্রয়োজন।
অভ্র পাল
কলকাতা
ছবিঃ
বিভিন্ন ওয়েবসাইট