খেলাঘরখেলাঘর

বর্ষার গপ্পো

কেমন আছ ইচ্ছামতীর বন্ধু? একটু দেরিতে হলেও হাঁসফাঁস গরমের শেষে এসেই গেছে বর্ষা। বর্ষা বললেই তোমার কি মনে আসে? ঝম্‌ঝম্‌ বৃষ্টি, রথ, খিচুড়ি আর ইলিশভাজা? উপ্‌স্‌, ভাবতেই জিভে হল! বর্ষা বলতে মনে আসে আমাদের প্রাণের ঠাকুর, রবি ঠাকুরকেও। 'হৃদয় আমার নাচেরে আজিকে...' বা 'গুরু গুরু গুরু গুরু ঘন মেঘ গরজে...' - বর্ষাবন্দনার অনবদ্য গীতি। আজ কলকাতা বা যেকোন শহরেই মাটির সঙ্গে, প্রকৃতির সঙ্গে নিবিড় হওয়ার সুযোগ তো ক্রমেই হারিয়ে যাচ্ছে ইঁট-কাঠ-পাথরের জঙ্গলে। তবু, ফ্ল্যাটবাড়ির ছোট্ট জানালা দিয়েও কালো মেঘের বুকে বিদ্যুতের খেলা দেখার সুযোগ কিন্তু ছেড় না।

আমার ছোটবেলা কেটেছে কলকাতাতেই। যখন মর্নিং স্কুলে পড়তাম, বর্ষায় বেশ মজা হত। ধর, সারা রাত মুষলধারে বৃষ্টির পর পথঘাট জলে থৈ থৈ। সকালে উঠে রেনকোট চাপিয়ে হাঁটুজল ভেঙে স্কুলে পৌঁছানোটা বেশ একটা অ্যাডভেঞ্চারের মত মজা ছিল। পড়া-টড়া তো সেদিন হবার প্রশ্নই নেই। অর্ধেক ছাত্র আসত না, অনেক মাস্টারমশাইও আসতেন না।অনেক সময়ে দুটো ক্লাসের ছেলেদের একটা ঘরে বসিয়ে স্যারেদের আদেশেই চলত গল্প বলা, ক্যুইজ কন্টেস্ট বা ছবি আঁকা। স্যারেদের মন মেজাজ সেদিন ভাল হয়ে যেত। স্কুলে গিয়েও সমস্ত পিরিয়ডগুলি ধরে ছুটির মজা। বরং খুব বেশি বৃষ্টির জন্য কখনো কখনো 'রেনি ডে'র ছুটি হয়ে গেলেই মনটা খারাপ হত।

বর্ষায় স্কুলের সবুজ ঘাসে ভরা মাঠ জলে ভরে উঠলে কোথা থেকে ছোট্ট ছোট্ট গেঁড়ি -গুগলি এসে যেত। বড়দের বকাবকির তোয়াক্কা না করে জলের বোতলে করে গুগলি ধরে এনে বাড়িতে একটা বড় বাটির মধ্যে জল ভরে ছেড়ে দিতাম। খাদ্য - পেয়ারা, জবা গাছের পাতা। তারা বেশ খোলোস থেকে লালচে শুঁড় বের করে গপাগপ পাতাগুলো খেয়ে নিত। আর মাঝে মধ্যেই বাটিটা তাদের সীমানা বুঝতে না পেরে ঘরের মধ্যে এদিক ওদিক দেশভ্রমণে বেড়িয়ে পড়ত শুম্বুকগতিতে।

গ্রামে বর্ষা দেখার সুযোগ মিলেছে বারকতক। আমাদের দেশের বাড়ি নদীয়া জেলার এক প্রত্যন্ত গ্রামে। সেখানে আষাঢ় মাসে বেশ বড় করে অম্বুবাচী মেলা হয়। অনেক দূর দূরান্তের লোক আসে। একটানা বৃষ্টিতে মাটির রাস্তা জলে কাদায় মাখামাখি হয়ে ভয়ানক পিছল হয়ে যায়। নানা রঙের আর চেহারার কুনোব্যাং, সোনাব্যাং, গেছোব্যাং, কোলাব্যাং মনের আনন্দে উঠোন-বারান্দা-বসার ঘর- শোবার ঘর-পড়ার ঘর-খাট-টেবিল-চেয়ার সব দখন করে নেয়। তাদের 'মত্ত দাদুরী' গণসঙ্গীতে কান ঝালাপালা! আমাদের মত নগন্য জীবকে তারা ধর্তব্যের মধ্যেই আনে না মোটেই।

একটা মজার কথা বলে শেষ করি। একবার দেখি- আমাদের গ্রামের বাড়ির পেছনের দিকে বাঁশঝাড়ে কিছু ডানপিটে ছেলেপুলে কই মাছ ধরেছে! পুকুরের জল ভর্তি হয়ে ডাঙায় ছাপিয়ে উঠতেই কইমাছগুলো কানে হেঁটে বিশ্বভ্রমণে বেড়িয়ে পড়েছিল। সে বেচারিদের যাত্রা বোধ হয় ওই বাঁশঝাড়ে এসেই থেমে যায়, কারণ কইমাছ ভাজা খাওয়ার সুযোগ ছেড়ে দেওয়ার মত নির্লোভ মুখ অন্তত ছেলেগুলোর ছিল না!

আজকের মত আমার বর্ষার গপ্পো এখানেই শেষ করি। ভাল থেকো আর প্রাণ ভরে বর্ষার আনন্দ উপভোগ কর।

 

জ্যোতির্ময় দালালের জন্ম ও পড়াশোনা কলকাতায়। ২০০৯ সাল থেকে আমেরিকার টেক্সাস প্রদেশে কলেজ ষ্টেশন শহরে 'টেক্সাস এ এন্ড এম' বিশ্ববিদ্যালয়ে ইণ্ডাস্ট্রিয়াল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ডক্টরেট-এর ছাত্র। এর আগে আই আই টি খড়্গপুর থেকে এম টেক এবং যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বি ই ডিগ্রী লাভ। আই টি ইণ্ডাস্ট্রিতে বছর চারেক কোডিং করে করে তিতিবিরক্ত হয়ে সেক্টর ফাইভকে দুচ্ছাই বলে পি এইচ ডি করতে পলায়ন। লেখালিখি ছাড়া শখ ভ্রমণ ও ফোটোগ্রাফি চর্চা ।