খেলাঘরখেলাঘর

গরম ঠাণ্ডা নিয়ে দু'চার কথা


কেমন আছ তুমি ? গরম কাল তো এশে গেছে, কিন্তু এইবার গরম চলে যাওয়ার আগে হটাত করে আবার ঠাণ্ডা ফিরে এসেছিল। আর এখনও, প্রায়শঃই কালবৈশাখী হচ্ছে বলে মাঝে মাঝেই বেশ গরম কমে যাচ্ছে, তাই না?

আজ এই গরম ঠান্ডা নিয়েই একটু বলি।

ক'দিন পরেই তো বিকেলে খেলা ধুলো করে দৌড়ে এসেই ফ্রিজ খুলে ঠান্ডা জল ঢক ঢক করে বোতল থেকেই গলায় ঢালবে।
খুব তেষ্টা পায় কিনা এই সময়টা!

এরকম ঠান্ডা জল খাওয়াটা কিন্ত মোটেই ভাল না। কেন, জানতে চাও ? মাকে জিজ্ঞেস কর।

আমরা যখন ছোট ছিলাম তখন ত' সবার বাড়িতে এখনকার মত ফ্রিজ ছিল না, আমাদের বাড়িতেও ছিল না। কিন্তু খেলা ধুলো করে এসে তাহলে আমরা কি ঠান্ডা জল পেতাম না ? খুব পেতাম! কিন্তু কি করে বলত ? সাধারনত তখন দৌড়তাম টিউবওয়েল বা নলকূপের দিকে, পেট পুরে ঠান্ডা জল খেতাম। কিন্তু সেটা না থাকলে কি হত বল দেখি ?                              

গরম কালে সব বাড়িতেই  থাকত মাটির কুঁজো। এতে জল রাখলে কিছুক্ষণের মধ্যেই জল খুব ঠান্ডা হয়ে যেত।

এখনও, যেখানে বিদ্যুত আসে নি, ফ্রিজ চলে না (বা যাদের বাড়িতে ফ্রিজ নেই)-- সেখানে কুঁজোর জলই ত ভরসা। সবাই তো ওই জলই খায়।

যারা কুঁজোর কথা জান না তারা 'মাটির' কুঁজোর নাম শুনে নাক শিঁটকচ্ছো নাকি ? কিন্তু এটা কি জান যে আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষই এরকম মাটির পাত্রে রাখা জলই খায়।

কিন্তু মাটির পাত্রে রাখা জল ঠান্ডা হয় কি করে। সেই কথাটাই বলব এখন।

এর আগে কোন সময় বলেছিলাম যে আমাদের শরীর থেকে ঘাম বেরিয়ে যাবার সময় সঙ্গে করে তাপ নিয়ে যায়, মনে আছে কি ? নেই ? ঠিক আছে, আবার বলছি।

যখন খুব গরম পড়ে, তখন আমাদের খুব অস্বস্তি হয়। কারণ আমাদের শরীরের বাইরের তাপমাত্রা তখন বেশী থাকে আর সেই  তাপ আমাদের শরীর ঢুকে পড়তে চায়। কেন বল দেখি ?

এটাও আগে বলেছি। সেটা হল তাপ সব সময় বেশী তাপমাত্রা থেকে কম তাপমাত্রার দিকে যেতে চায়।

কিন্তু প্রকৃতি দেবী আমাদের এই শারীরিক আস্বস্তি কাটাবার খুব সুন্দর ব্যাবস্থা করে দিয়েছেন। গরম গা-সওয়া না হলেই ঘাম হতে শুরু হয়, যত গরম পড়ে ঘামও তত বাড়ে। শরীরের বাইরে এসে ঐ ঘাম বাষ্প হয়ে বাতাসে মিশে যায়। কিন্তু বাষ্প হওয়ার জন্য যে তাপ চাই সেটা আসে কোত্থেকে ? আমাদের শরীর থেকে ছাড়া আর কোথা থেকেই বা আসবে ! ব্যস !আমাদের গরম শরীরও আস্তে আস্তে ঠান্ডা হয়ে যাবে। তাড়াতাড়ি ঠান্ডা হতে চাইলে যেখানে হাওয়া আছে সেখানে, আর না হয় পাখার তলায় বসতে হবে!

পাখার তলায় বসলে গা জুড়োয় এটা ত আমরা সবাই জানি। আর খেলা ধুলার শেষে মাঠে বসে হাওয়া খেতে কেমন মজা সেটাও ত জানাই আছে! তাই কিনা, বল ? আমাদের
গায়ের চামড়ায় প্রচুর সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম ছিদ্র আছে। ঐ পথে শরীর থেকে ঘাম বার হয়। এই ছিদ্রগুলোর নাম হল 'লোমকূপ'। এটা বোধ হয় জান। ঐ সব পথ যাতে বন্ধ না হয় তার দিকে খেয়াল রাখা দরকার।বেশী প্রসাধনের জিনিষ ব্যবহার না করাই ভাল। এই সব বেশী ব্যবহার করে লোমকূপগুলো বন্ধ করে দাও যদি, তাহলে ঘাম কি করে শরীরের বাইরে আসবে আর আমরা ঠান্ডাই বা হব কি করে!

কোন কোন প্রাণীর শরীরে লোমকূপ নেই। এমন প্রাণী কোনটা হতে পারে বল দেখি! কুকুর এমন একটা প্রাণী। এদের শরীর লোমকূপ বিহীন। তাহলে এরা ঠান্ডা হয় কি করে ? লক্ষ্য
করলে দেখতে পাবে গরম কালে এরা জিভ বার করে হাঁপাতে থাকে। জিভের লালা বাষ্প হয়ে উড়ে যাবার সময় শরীর থেকে তাপ নিয়ে চলে যায় আর এতে শরীর ঠান্ডা হয়।

কিন্তু আমরা ত কুঁজোর কথা বলছিলাম। এবার তার কথা বলি। কুঁজো তৈরী হয় মাটি দিয়ে। বেলে মাটি হলে আরও ভাল হয়। এই কুঁজোর গায়ে খুব সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম ছিদ্র থাকে অসংখ্য। এতে জল রাখলে ঐ সব ছিদ্র পথে জল বাইরে বেরিয়ে আসে। খালি কুঁজোয় জল রাখলে যে জল বেরিয়ে আসে সেটা একটু খেয়াল করলেই বুঝতে পারবে। কুঁজোর বাইরের দিকটা ভিজে যায় ভেতরে জল থাকলে। এখন ওই জল বাইরে এসেই বাষ্প হওয়ার ফিকির খোঁজে। এবং শেষ পর্যন্ত বাষ্প হয় উবে যেতে থাকে। এতে কি হয়
বুঝতেই পারছ। ঠিক আমাদের শরীরের যেমন হয় ঠিক তেমনই হয় এক্ষেত্রেও। বাইরের জল বাষ্প হওয়ার সময় ভেতরের জল থেকে তাপ সংগ্রহ করে বা  তাপ শোষন করে। ফলে কুঁজোর জল ক্রমশঃ ঠান্ডা হতে থাকে আর শেষ পর্যন্ত বেশ ভাল মত ঠান্ডা হয়ে যায়।

এই জল খেলে ফ্রিজের জল আর ভাল লাগবে না, এটা হলফ করে বলতে পারি।

এই ধরনের তাপকে বলে 'লীনতাপ', মানে লুকিয়ে থাকা তাপ। লীনতাপের অনেক উদাহরণ আছে যা আমাদের দৈনন্দিন জীবনে দেখতে পাই।

বড় হয়ে যখন উঁচু শ্রেণীতে পড়বে তখন এ বিষয়ে আরও অনেক কিছু জানতে পারবে।

আর একটা কথা বলি। ফ্রিজের জল যে ঠান্ডা হয়, তার সাথে কিন্তু এই লীনতাপের কোনও সম্পর্ক নেই।

পেতল বা কাঁসার কলসীতে জল রাখলে কিন্তু মোটেই ঠান্ডা হবে না। কেন বল দেখি! কি করে হবে, ওদের গায়ে ত ছোট বা বড়-- কোনও ছিদ্রই নেই। ধাতু নিরেট হয় কিনা।

সুতরাং জল বাইরে আসবেই বা কি করে, আর ঠান্ডাই বা হবে কিভাবে!


সন্তোষ কুমার রায়
কোদালিয়া
দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা

 

সন্তোষ কুমার রায় অবসরপ্রাপ্ত প্রধানশিক্ষক। বিষয় পদার্থবিজ্ঞান। শৈশব ও কৈশোর যথাক্রমে বাংলাদেশে এবং কলকাতায় কাটলেও, কর্মজীবন কেটেছে বাংলা বিহার সীমান্তের হিন্দুস্থান কেব্‌ল্‌স্‌ শিল্পনগরীতে। শিল্পনগরী থেকে প্রকাশিত বিভিন্ন পত্রিকায় ছোটদের এবং বড়দের জন্য বিজ্ঞানভিত্তিক লেখা লিখেছেন বহুবছর। বর্তমানে ইচ্ছামতীর পরশমণি বিভাগে নিয়মিত লেখা ছাড়াও তিনি একটি গ্রুপ ব্লগের সদস্য রূপে লেখালিখি করেন ।