একটা সুপ্রাচীন রাস্তা। যশোর রোড। কাগজে কলমে আরো পরিচিত ৩৫ নং জাতীয় সড়ক নামে। যুক্ত করেছে প্রতিবেশী দুই দেশ- ভারত ও বাংলাদেশকে।দুই দেশের ইতিহাস, বাণিজ্য, রাজনীতির নানা পালাবদলের সাক্ষী এই পথ। আর সাক্ষী ছিল/ আছে এই পথের দুইধারের সুপ্রাচীন সব গাছগুলি-বট, অশ্বত্থ, আম, শিরীষ, শিশু, মেহগনি-যাদের একেকজনের বয়স প্রায় ১৭৫ বছর। এই গাছগুলি শুধু এই ব্যস্ত পথে চলাচলকারি পথিকদেরকে ছায়া এবং শান্তিই দেয় নি; এই গাছগুলি তার সাথে সাথে ছিল অনেক পাখি, কাঠবিড়ালী, পোকামাকড়দের বাসস্থান।
গত কয়েক বছরে , উন্নয়নের অজুহাতে, রাস্তা সম্প্রসারণ করার জন্য , এবং আরো নানা কারণ দেখিয়ে এই রাস্তার দুই পাশের অজস্র গাছ কেটে ফেলা হয়েছে এবং হচ্ছে। পৃথিবীর অন্যান্য আধুনিক নগরগুলির মত, গাছপালা বাঁচিয়ে রেখে উন্নয়নের কথা ভাবতে পারছেন না আমাদের সরকার। আর এক আধটা নয়, প্রায় ৪০০০ গাছ কেটে ফেলার কথা ভাবা হচ্ছে। কিন্তু এই গাছগুলিকে কেটে ফেললে পরিবেশের ওপরে মারাত্মক প্রভাব পড়বে। যশোর রোডের দুইপাশের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে উষ্ণতা এবং বায়ুদুষণ বাড়বে, বাস্তুতন্ত্র নষ্ট হবে, বৃষ্টি কমে যাবে। বাসস্থান হারাবে অগুন্তি পশু-পাখির দল।তাই তাদের এই কাজকর্মের প্রতিবাদে সরব হয়েছেন একাধিক মানবাধিকার এবং পরিবেশ প্রেমী সংগঠন। সাথে যুক্ত হয়েছেন সাধারণ মানুষ। স্কুলে পড়া ছোট্ট ছোট্ট ভাই বোনেরাও বাদ নেই। গাছেরা যে আমাদের জীবনে কতটা জরুরী সে কথা যদি আজকের দিনে দাঁড়িয়ে আমরা ভুলে যেতে চাই, তাহলে তার থেকে বড় অন্যায়, বড় মূর্খামি আর কিছুই হবে না।
এই পুরো বিষয়টা আরো ভালো করে জানার জন্য এবং ইচ্ছামতীর যে সব বন্ধুরা এখনোও পুরোপুরি জানে না, তাদের সাথে ভাগ করে নেওয়ার জন্য, আমরা যোগাযোগ করি 'যশোর রোড গাছ বাঁচাও কমিটি' নামের এক সংগঠনের সাথে।তাঁরা সানন্দে আমাদের সাথে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ভাগ করে নিয়েছেন, যেগুলি শুধু যশোর রোডের সমস্যা বিষয়েই নয়; গাছপালা- পরিবেশ সম্পর্কে আমাদের সচেতনতা বাড়াতে সবসময়ে কাজে লাগবে।
মূল সমস্যায় আসার আগে যশোর রোড আর তার দুইপাশের গাছগুলির ইতিহাস সম্পর্কে একটু জেনে নিই। বিভিন্ন সূত্র অনুযায়ী, ১৮৪০ খ্রীষ্টাব্দে জমিদার/ রাজা কালী পোদ্দার তাঁর মা যশোধা দেবীর গঙ্গাস্নানের ইচ্ছাপূরণের জন্য যশোরের বকচরা থেকে কলকাতার কালীঘাট পর্যন্ত এই রাস্তা নির্মাণ শুরু করেন। মূল রাস্তাটির অস্ত্বিত্ব আরো অনেক আগে থেকেই ছিল। শেরশাহের সময়কালে পূর্ববাংলার সোনারগাঁও থেকে পাঞ্জাব পর্যন্ত বিস্তৃত এই পথের নাম ছিল 'সড়ক-ই-আজম'। তবে সেই সময়ে এই প্রাচীন রাস্তাটির অবস্থা খুবই খারাপ ছিল। কালী পোদ্দার সেই রাস্তাটিকেই সারিয়ে নতুন সড়ক তৈরি করেন। দুই লক্ষ আটান্ন হাজার কড়ি খরচ হয়েছিল রাস্তা নির্মাণের জন্য। নতুন রাস্তাটির নাম হয় যশোর রোড, যদিও রাস্তাটি দীর্ঘদিন অবধি কালীবাবুর রাস্তা নামে পরিচিত ছিল। কিন্তু এত দীর্ঘপথে ছিল না কোন ছায়া। তাই ধনবাদ কালী পোদ্দার সেই সমস্যার সমাধান করলেন বিদেশ থেকে হাজার হাজার রেইন ট্রি আনিয়ে। এই গাছগুলি খুব দ্রুত বাড়ে, ছায়া দেয়, বৃষ্টি নামাতে সাহায্য করে। সাথে লাগানো হল আরো অনেক দিশি গাছও। এইভাবে মাত্র কয়েক বছরের মধ্যে মায়ের স্বপ্ন পূরণ করে সেই ছায়ায় ঢাকা পথে রাজা কালী পোদ্দার মা'কে কলকাতায় গঙ্গাস্নান করাতে নিয়ে আসেন।
এইখানেই শেষ নয়। গত শতাব্দীতে এই যশোর রোডই দেখেছে দেশভাগের পর উদবাস্তুদের স্রোত। তারপরে দেখেশে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়ে পাক হানাদারদের হাত থেকে বেঁচে পালিয়ে আসা অসহায় মানুষের ঢল। আবার এই পথ দিয়েই ভারতীয় সেনারা গিয়ে বাংলাদেশকে মুক্ত হতে সাহায্য করে। এইভাবেই প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে লক্ষ কোটি মানুষের জীবনের যাবতীয় ওঠা-পড়ার সাক্ষী হয়ে থেকে গেছে যশোর রোডের নির্বাক গাছের দল।
যশোর রোড গাছ বাঁচাও কমিটির দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, '২০১৫ সালের জুলাই মাসে একটি ইংরেজী দৈনিকে প্রকাশিত সংবাদ 'NH-35 Widening may cost 4000 trees' নজরে আসার পর থেকে বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন, পরিবেশ প্রেমীদের সংগঠন বৃক্ষ নিধনের বিরুদ্ধে সরব হয়। বিভিন্ন সরকারি দপ্তরে চিঠি দিয়ে বিস্তারিত তথ্য জানতে চাওয়া হয়। তাছাড়া 'তথ্য জানার অধিকার ২০০৫ আইন' অনুসারে একাধিকবার তথ্য জানতে চাওয়া হয়। কিন্তু কোনও উত্তর পাওয়া যায়নি। চলতে থাকে বারাসাত থেকে বনগাঁ পর্যন্ত প্রচার। পুস্তিকা প্রকাশ করা, পথসভা, লিফলেট বিলি ইত্যাদি চালু থাকে। এর মধ্যে ফেব্রুয়ারি ২০১৭, বনগাঁয় ১নং রেলগেট অঞ্চলে গাছকাটা শুরু হয়ে যায়। সঙ্গে সঙ্গেই একটি মানবাধিকার সংগঠন হাইকোর্টে জনস্বার্থ মামলা দায়ের করে। প্রধান বিচারপতি নিশিথা মাত্রে-র এজলাসে মামলাটি বিচারাধীন রয়েছে। আদালত সরকার পক্ষকে গাছ কেটে ফেললে পরিবেশের উপর কি প্রভাব পড়বে জানাতে বলে। কিন্তু সরকার পক্ষ এই সংক্রান্ত কোনও নথি দেখাতে পারেনি। আদালত পরিবেশের উপর প্রভাব সংক্রান্ত রিপোর্ট জমা দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে। পরবর্তী শুনানির দিন ধার্য হয়েছিল ২৮ এপ্রিল ২০১৭ এবং সেই শুনানিতে হাইকোর্ট সাত দিনের জন্য গাছ কাটা বন্ধ রাখার নির্দেশ দেন। গত ৫ই মে ২০১৭ পুনরায় শুনানি হয় ও সাত দিনের জন্য গাছ কাটা বন্ধ রাখার নির্দেশ দেন।এছাড়াও যশোর রোড গাছ বাঁচাও কমিটিরপক্ষ থেকে একটি মামলা করা হয় এবং তা বিচারাধীন।'
বিচারব্যবস্থার ওপর সম্পূর্ণ ভরসা রেখেই এই উদ্যোগের সাথে জড়িত বিভিন্ন সংগঠনগুলি গাছ কাটার প্রতিবাদে নানারকমের কর্মকান্ড চালিয়ে যাচ্ছেন উৎসাহ ভরে। আগামি ১১ই মে, কলকাতা প্রেস ক্লাবে এই বিষয়ে আলোচনা করার জন্য মিলিত হচ্ছেন অনেক মানুষ। সেখানে পশ্চিমবঙ্গের অন্যান্য অঞ্চল থেকেও নানা সংগঠনের মানুষেরা যোগ দেবেন। অন্যদিকে, বড়দের সাথে সাথে গাছকাটার প্রতিবাদে পা মেলাতে মিছিলে হাঁটতে এগিয়ে এসেছে ছোট্ট ছোট্ট ছেলে-মেয়েরা।
আর আমরা যারা দূরে বসে আছি, ইন্টারনেটের বিভিন্ন সংবাদভিত্তিক ওয়েবসাইট বা ফেসবুক থেকে খোঁজ পাচ্ছি এই লড়াইয়ের, তারা কীভাবে সাহায্য করতে পারে আমাদের বন্ধুদের? এ বিষয়ে সবথেকে সহজ এবং প্রথম ধাপ হল, যশোর রোডে যথেচ্ছ গাছ কাটার প্রতিবাদে তৈরি হওয়া একটি অনলাইন পিটিশনে সই করা। আমরা জেনেছি, এই অনলাইন পিটিশনের মূল্য কিন্তু আদালতের কাছে কম নয়। তাই যদি তুমি মনে মনে যশোর রোডের গাছগুলির পাশে থাকতে চাও, তাহলে এখনি সই করে ফেল এই লিঙ্কে গিয়েঃ
Save Trees On Jessore Road
সাথে তোমার বন্ধু এবং পরিচিতদের মধ্যেও ছড়িয়ে দাও এই অনলাইন পিটিশনের খবর।
এছাড়াও, এই পুরো লড়াইয়ের বিষয়ে বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়া থেকে নিয়মিত খবর পেতে সাহায্য করবে এই হ্যাশট্যাগঃ #savejessoretrees
আদালতের বিচারের রায় কী হবে সেটা আমরা কেউ জানিনা। শুধু এটুকু জানি- গাছেদের স্বার্থে, প্রকৃতির স্বার্থে, পৃথিবীর স্বার্থে, নিজেদের স্বার্থে এই লড়াইটা চালিয়ে যাওয়া খুব জরুরী।
এই প্রতিবেদনের যাবতীয় তথ্য এবং ছবি পেয়েছি যশোর রোড গাছ বাঁচাও কমিটির তরফে সাইফুল ইসলাম খানের থেকে।
কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ দেবাশীষ রায়চৌধুরি, জয়া মিত্র, বিভিন্ন ওয়েবসাইট