একটা বিরাট ঘন জঙ্গল ছিল। সেই জঙ্গলে একদিন আগুন লেগে গেল। রাতের আঁধার চিরে লকলকিয়ে উঠল লাল-হলুদ দাবানলের শিখা। জঙ্গলের যত প্রাণী - হাতি, বাঁদর,শেয়াল, পাখিরা- সবাই জঙ্গল ছেড়ে দূরে বেরিয়ে এল। চোখের সামনে তাদের বাসভূমি পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু তারা কীই বা করতে পারে?
সবাই হতাশ হয়ে, অসহায় ভাবে দেখে যাচ্ছে, এমন সময় এক পুঁচকে হামিংবার্ড বলে উঠল -,'নাহ , আমাকে কিছু একটা করতে হবে।' এই বলে সে পাশেই বয়ে যাওয়া একটা সরু খালের থেকে এক বিন্দু জল তুলে নিল তার চঞ্চুতে আর উড়ে গেল আগুনের দিকে। একটু পরেই সে ফিরে এল, আবার আরেক বিন্দু জল নিল, আর আগুনের ওপর ফেলে এল। এইভাবে সে যতটা তাড়াতাড়ি সম্ভব আসা যাওয়া করতে লাগল।
এদিকে হাতি, যে কিনা বিরাট শুঁড়ে অনেক বেশি জল ভরে নিতে পারে, হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে ভালুক, হরিণ সবাই হামিংবার্ডকে বলল, " তুমি কীই বা করতে পারবে? তুমি এইটুকু একটা পাখি, আর এই দাবানল কী ভয়ানক। আর তোমার তো এত ছোট্ট দুটো ডানা, আর একবারে তো এক বিন্দুর বেশি জলও নিতে পারছ না।"
কিন্তু সেই ছোট্ট হামিংবার্ড তাদের কথায় কান দিল না, আলোচনা করতেও বসল না। তার কাজ না থামিয়ে সে শুধু বলল, "আমার পক্ষে যা করা সম্ভব আমি সেটাই করছি।"আর আমি মনে করি, আমাদের প্রত্যেকের এটাই করা উচিত। আমাদের সবসময়ে এই হামিংবার্ড এর মত হওয়া উচিত। আমি খুবই সাধারণ হতে পারি, কিন্তু আমি কিছুতেই ওই অন্য প্রাণীদের মত চুপচাপ দাঁড়িয়ে এই পৃথিবীকে নষ্ট হয়ে যেতে দেখব না। আমি হব হামিংবার্ড এর মত , আমার পক্ষে যা করা সম্ভব আমি সেটাই করব।
পরিবেশবিদ অধ্যাপিকা ডঃ ওয়াঙ্গারি মুটা মাথাই ( ১ এপ্রিল, ১৯৪০ - ২৫ সেপ্টেম্বর, ২০১১) এই ইকুয়াডোরের কেচুয়া জনজাতির এই ছোট্ট নীতিকথাটিকে নিজের বেশিরভাগ বক্তৃতায় ব্যবহার করতেন। কেনিয়ার এক ছোট্ট গ্রামে, কৃষক পরিবারে বড় হয়ে ওঠা ওয়াঙ্গারি, ভেটেরিনারি অ্যানাটমি নিয়ে গবেষণা করেন এবং পূর্ব ও মধ্য আফ্রিকার প্রথম মহিলা যিনি পি এইচ ডি উপাধি লাভ করেন।
ডঃ ওয়াঙ্গারি মুটা মাথাই
১৯৭৭ সালে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন 'দ্য গ্রীন বেল্ট মুভমেন্ট' নামে এক বেসরকারি সমাজসেবী সংস্থা। এই সংস্থার মাধ্যমে, একটি সফল পদ্ধতির প্রয়োগে কেনিয়ার সাধারণ মানুষদের খাবার, জল আর জ্বালানি সমস্যার সমাধানের পথ দেখিয়েছিলেন তিনি। আর উপায়টা ছিল খুবই সহজ। রুক্ষ শুষ্ক কেনিয়ার দূর দূর অঞ্চলের মহিলাদের বলা হয়েছিল, নিজেদের এলাকার চেনা পরিচিত গাছের বীজ খুঁজে, সেই বীজ থেকে চারা তৈরি করে গাছ বড় করতে। বড় গাছ মাটির ক্ষয় কমায়, সঙ্গে সঙ্গে মাটির জলস্তর ও ধরে রাখে। গাছেদের থেকে ফুল, ফল, পাতা পাওয়া যায় খাওয়ার জন্য এবং ওষুধ তৈরি করার জন্য; গাছেদের শুকনো ডাল জ্বালানি হিসাবে কাজে লাগে, পচা পাতা থেকে সার তৈরি হয়। মাত্র একটা কাজ থেকে কতরকমের সুবিধা পাওয়া যেতে পারে! এইভাবে গাছ পোঁতার কাজে উৎসাহ দেওয়ার জন্য সমস্ত মহিলাদের অল্প অল্প পারিশ্রমিকও দেওয়া হয়। এর ফলে তাঁদের উপার্জন বাড়ে এবং তাঁদের জীবনযাপনের মান উন্নত হয়। 'দ্য গ্রীন বেল্ট মুভমেন্ট' -এর ওয়েবসাইটে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, ১৯৭৭ সাল থেকে এই সংস্থা কেনিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে ৫১ মিলিয়ন-এর ও বেশি গাছ লাগিয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে এই সংস্থা মহিলা ও শিশুদের জন্যেও নানারকমের কাজ করে থাকেন।
ডঃ ওয়াঙ্গারি মাথাই- এর এই সহজ সমাধান ক্রমে ক্রমে কেনিয়ার আশেপাশে অন্যান্য দেশগুলিও প্রয়োগ করতে শুরু করে। তিনি শুধুই একজন সফল পরিবেশবিদ ছিলেন না, একই সঙ্গে তিনি মানবাধিকার এবং গণতন্ত্র নিয়েও কাজ করে গেছেন। তাঁর কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি একাধিক পুরস্কারে সম্মানিত হন, যার মধ্যে অন্যতম ছিল ২০০৪ সালে পাওয়া নোবেল শান্তি পুরস্কার।
চুয়াল্লিশ বছর আগে ডঃ মাথাই যে পথ দেখিয়েছিলেন, সেই পথেই হাঁটার ডাক আবার নতুন করে এইবছর দিয়েছে রাষ্ট্রসঙ্ঘ। ২০২১ থেকে ২০৩০ -এই দশ বছরকে রাষ্ট্রসংঘ ঘোষণা করেছে 'United Nations decade on Ecosystem Restoration' - বাস্তুতন্ত্র পুনরুদ্ধারের এক দশক । এই এক দশকে রাষ্ট্রসঙ্ঘের উদ্দেশ্য- আমরা নির্বিচারে যে সমস্ত বাস্তুতন্ত্রকে নষ্ট করে ফেলেছি, সেগুলিকে দ্রুত আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করতে হবে। সেটা হতে পারে প্রচুর গাছ লাগিয়ে, হতে পারে সমুদ্রের জল থেকে প্লাস্টিক আর ময়লা সরিয়ে, বা নিজেদের শহরকে আরোও সবুজ করে। বাস্তুতন্ত্রকে আবার অবস্থায় ফিরিয়ে নিয়ে যেতে পারলে সঙ্গে সঙ্গে কমবে দারিদ্র্য এবং বিভিন্ন প্রজাতির গণবিলুপ্তিও রোধ করা সম্ভব হবে।
গত বছর থেকে অতিমারির কারণে কাজ এবং বাসস্থান হারিয়েছেন বহু মানুষ। থমকে গেছে পরিবেশকে সারিয়ে তুলছিল এমন নানা কাজকর্ম। অন্যদিকে করোনা মোকাবিলায় ব্যবহার করা মাস্ক, পি পি ই, গ্লাভস্ এই সমস্ত আবার বাড়িয়ে তুলছে প্লাস্টিক আবর্জনার পরিমাণ। আমরা সবাই যদি এখন থেকেই সচেতন না হই, তাহলে আমাদের ঘিরে থাকা পরিবেশের এবং পৃথিবীর অবস্থা আরও খারাপ হয়ে যাবে।
পৃথিবীর ১১৫ টি দেশজুড়ে দশ বছর ধরে চলবে এই কাজ। লক্ষ্য থাকবে সবুজ ফিরিয়ে আনা, পৃথিবীকে শীতল করা। আমাদের প্রতিবেশী পাকিস্তান এই বছরের বিশ্ব পরিবেশ দিবসের অফিশিয়াল হোস্ট বা মূল আয়োজক। রাষ্ট্রসঙ্ঘের ভাবনার সঙ্গে তাল মিলিয়ে পাকিস্তান ঠিক করেছে, নিজেদের দেশের তারা আনবে 10 Billion Tree Tsunami - দেশের বিবিন্ন রুদ্ধ , শুষ্ক অঞ্চল এবং জীর্ণ বাস্তুতন্ত্রগুলিকে মেরামত করবে ১০ বিলিয়ন গাছ লাগিয়ে । পৃথিবীর অন্যান্য দেশে কীরকমের সব কাজ হচ্ছে জানার জন্য খুঁজে দেখো #GenerationRestoration ।
সঙ্গে মনে রাখতে হবে এই উদ্দেশ্যের মূল সুর বা ট্যাগলাইনঃ Reimagine. Recreate. Restoreকোনো জিনিষ একটু পুরনো হয়ে গেলেই বাতিল না করে দিয়ে সেগুলিকে পুনর্ব্যবহার করার অভ্যাস, নষ্ট হয়ে যাওয়া জিনিষকে অল্প সারিয়ে অন্য কাজে ব্যবহার করার অভ্যাস ফিরিয়ে আনতে হবে, অকারণে জিনিষ নষ্ট করা চলবে না। আর এই অভ্যাস করতে হবে ছোট থেকে বড় প্রত্যেককে।
হতে পারি আমরা একেক জন ঠিক ওই ছোট্ট হামিংবার্ডের মত, খুব সাধারণ, এই বিরাট সমস্যার সামনে আমাদের প্রত্যেকের ক্ষমতা খুব ছোট, কিন্তু সবাই মিলে চেষ্টা করে দেখাই যাক না, একটু একটু করে নিজেদের পৃথিবীকে বদলে দিতে পারি কি না।
ছবিঃ পিক্সাবে, উইকিপিডিয়া, ইউ এন ই পি