ভারতে নভেম্বরের ১৪ তারিখ পালন করা হয় 'শিশু দিবস'। কিন্তু তার পরে পরেই, ২০ নভেম্বর দিনটি 'আন্তর্জাতিক শিশু দিবস' রূপে পরিচিত। আবার বাংলাদেশে শিশু দিবস পালন করা হয় ১৭ মার্চ। ইন্টারনেটে খুঁজলে দেখা যাবে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বছরের বিভিন্ন সময়ে শিশু দিবস পালিত হয়। চলো চট করে জেনে নিই, কেন এমন হয় ! অল্প একটু উল্টে দেখি ইতিহাসের পাতা।
বাঁ দিকে ইগল্যান্টাইন জেব , ডান দিকে তাঁর সংস্থার লোগো
১৯১৪ থেকে ১৯১৯ সাল পর্যন্ত চলে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। এই যুদ্ধ চলাকালীন এবং যুদ্ধের পরেও, ইউরোপের বিভিন্ন দেশে, বিশেষ করে জার্মানি, অস্ট্রিয়া, হাঙ্গারিতে — শিশুরা খুব কষ্টে পড়ে। এইসব দেশের শিশুদের সাহায্য করার জন্য , ব্রিটিশ সমাজ সংস্কারক ইগল্যান্টাইন জেব (Eglantyne Jebb) ১৯১৯ সালে 'Save the Children Fund' নামে এক তহবিল গড়ে তোলেন। এই তহবিলে সাধারণ মানুষের থেকে প্রচুর অনুদান জমা পড়ে যা দিয়ে ইউরোপের বিভিন্ন দেশের শিশুদের নানাভাবে সাহায্য করা হয়। এই সাফল্যের পরে, ১৯২০ সালে, ইগল্যান্টাইন আর তাঁর বোন ডোরথি মিলে জেনেভাতে স্থাপন করেন 'International Save the Children Union' । এই সংস্থা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নিপীড়িত শিশুদের সাহায্য করার জন্য কাজ করতে থাকে।
৯৮ বছর আগে প্রণীত প্রথম ডিক্লেরেশন
১৯২৩-২৪ সালের মধ্যে, ইগল্যান্টাইন জেব নিজের মত করে, সারা দুনিয়ার ছোট্ট ছোট্ট ছেলেমেয়েদের কথা ভেবে লিখে ফেলেন 'Declaration of the Rights of the Child' — শিশুদের অধিকার বিষয়ক ঘোষণা বা বিবৃতি, যেটি অনেক সময়ে 'জেনেভা ডিক্লারেশন অফ দ্য রাইটস অফ দ্য চাইল্ড' নামেও পরিচিত। বিশ্বের প্রথম মানবাধিকার সংক্রান্ত দলিল রূপে পরিচিত এই বিবৃতিতে লেখা থাকে বিশ্বের সব দেশের শিশুদের অধিকার কী কী হওয়া উচিত এবং কেমনভাবে সব দেশের বড়দের সেই দিকে খেয়াল রাখা দরকার।
১৯২৪ সালে, 'সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ' বা 'League of Nations' এই ঘোষনাটিকে আন্তর্জাতিকভাবে মান্যতা দেয়।
কিন্তু ২০ নভেম্বর কেন বিশ্বজনীন শিশু দিবস বা Universal Children's Day রূপে পালন করা হয়? জাতিসঙ্ঘ ১৯৫৪ সালের ২০ নভেম্বর তারিখটিকে স্থির করে 'ইউনিভারসাল চিল্ড্রেন্স ডে' রূপে। পরে ১৯৫৯ সালে জাতিসঙ্ঘের সাধারণ পরিষদে, ইগল্যান্টাইন জেব প্রণীত প্রথম ঘোষণাপত্রটির অনুসরণে, আরও কিছু শর্ত মিলিয়ে তৈরি হয় আধুনিক এক শিশু অধিকার ঘোষণাপত্র। পৃথিবীর অনেক দেশেই শুধুমাত্র এই দিনটিকেই শিশুদের জন্য পালন করা হয়। কোনো কোনো দেশ আলাদা আলাদা তারিখে পালন করে। আবার অনেক দেশ পালন করে 'আন্তর্জাতিক শিশু দিবস' ( International Children's Day), যা পালিত হয় ১ জুন তারিখে। ১৯৫০ সাল থেকে পৃথিবীর বেশ কিছু দেশে এই দিনটিকেই ছোটদের জন্য চিহ্নিত করা হয়েছে।
তবে তারিখ যেটাই হোক বা নাম যাই হোক, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে শিশু দিবস পালন করার লক্ষ্য আসলে একটাই - ছোটদের জন্য সুন্দর এক পৃথিবী গড়ে তোলা। এটা নিশ্চিত করা যে প্রত্যেকটি শিশু যেন সুস্থভাবে, লেখাপড়া শিখে বড় হয়ে উঠতে পারে; ক্ষুধার্ত শিশু যেন খাবার পায়; অসুস্থ শিশু যেন যত্ন পায়; পিছিয়ে পড়া শিশু যেন এগিয়ে আসার সাহায্য পায়; অপরাধী হয়ে যাওয়া শিশু যেন স্বাভাবিক জীবন ফিরে পায়; অনাথ শিশু যেন আশ্রয় পায়; সবরকমের বিপদে শিশুরা যেন সবার আগে সাহায্য পায়; শিশুরা যেন শ্রমিক না হয়ে পড়ে; শিশুরা যেন বড় হয়ে নিজে রোজগার করার উপযুক্ত হয়ে ওঠে; শিশুরা যেন একে অপরকে ভালোবাসতে আর সাহায্য করতে শেখে।
ভারতে শিশু দিবস পালন করা হয় ১৪ নভেম্বর। এই দিনটি ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর জন্মদিন। নেহরু ছোটদের খুব ভালোবাসতেন এবং 'চাচা নেহরু' নামে পরিচিত ছিলেন।
প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশে শিশু দিবস পালন করা হয় ১৬ মে। এই দিনটি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের জন্মদিন।
পূবের প্রতিবেশী মায়ান্মারের শিশু দিবস পালিত হয় ১৩ ফেব্রুয়ারি। এই তারিখটি সে দেশের বিপ্লবী এবং রাজনৈতিক নেতা অং সান এর জন্মদিন। আধুনিক মায়ানমারের জনক রূপে পরিচিত অং সান নিজের দেশের স্বাধীনতার জন্য জাপান এবং ব্রিটেনের সঙ্গে যুদ্ধ করেছিলেন। মনে করা হয় এইভাবে তিনি মায়ানমারের শিশুদের উন্নত জীবন দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। তাই তাঁর জন্মদিনটিকেই এদেশে শিশু দিবস রূপে পালন করা হয়।
উত্তরের প্রতিবেশী দেশে নেপালে শিশু দিবস পালিত হয় নেপালি ক্যালেন্ডারের ভাদ্র মাসের ২৯ তারিখে। দক্ষিণের প্রতিবেশী শ্রী লংকাতে শিশু দিবস পালন করা হয় ১ অক্টোবর। তবে এই তারিখগুলিকেই বেছে নেওয়ার পেছনে কোনো বিশেষ কারণ জানা যায় না। পশ্চিমের প্রতিবেশী দেশ পাকিস্তান বিশ্বজনীন শিশু দিবস পালন করে ২০ নভেম্বর।
অন্যদিকে ইংল্যান্ডে শিশু দিবস পালন করা হয় গ্রীষ্মকালে, মে মাসের কোনো এক দিন, যাতে বাচ্চারা বাইরে বেরিয়ে দিনটি আনন্দে কাটাতে পারে। নভেম্বর মাসের ঠান্ডায় কাঁপতে কাঁপতে বাইরে হইচই করা অত সহজ নয় যে।
আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে জাতীয় শিশু দিবস পালন করা হয় প্রতিবছর জুন মাসের দ্বিতীয় রবিবারে।
অস্ট্রেলিয়াতে প্রতি বছর অক্টোবর মাসের চতুর্থ বুধবারে পালন করা হয় ইউনিভার্সাল চিলড্রেন্স ডে।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের শিশুদের জন্য নানারকম দরকারি এবং ভালো কাজ করা হয়। আবার অনেক দেশেই যতটা করা দরকার ততটা করা হয় না। দেশে সরকার থেকে শুরু করে বাড়ির বড়রা অবধি সব বড়রা কোন কোন কাজ করলে ছোটরা খুব খুশি হবে, তুমি খুশি হবে, সেটা লিখে পাঠাতে পারো ইচ্ছামতীকে। তোমার পাঠানো চিঠি/ নিবন্ধ আমরা প্রকাশ করব 'ইচ্ছেমতন' বিভাগে।
জেনেভা ডিক্লেরেশন এর ছবিঃ টুইটার
অন্যান্য ছবিঃপিক্সাবে