সবুজ মনের রসদ
Ichchhamoti Logo
এক অন্যরকম মেয়ের গল্পঃ সরলাদেবী চৌধুরানী

আজ তোমাদের এক অন্যরকম মেয়ের গল্প বলব। ছোট বেলায় তার নাম ছিল সরলা ঘোষাল, অবশ্য আমরা তাঁকে বেশি চিনি তার বিবাহ পরবর্তী সরলা দেবী চৌধুরানী নামে।

সরলার মায়ের নাম স্বর্ণকুমারী দেবী । তিনি ছিলেন কলকাতার জোড়াসাঁকোর অভিজাত ঠাকুর পরিবারের বিদুষী কন্যা, রবীন্দ্রনাথের ন’দিদি। সাহিত্য-সেবা, দর্শন-চর্চা , সখী সমিতি গঠনেই সারাদিন ব্যস্ত থাকতেন। ছোট মেয়েকে দেখাশোনার সময় তাঁর মোটেই ছিলনা। সরলার নিজের কথায় ভাদ্রমাসের ললিতা সপ্তমী তিথিতে তার জন্ম, ইংরেজির ৯ই সেপ্টেম্বর , ১৮৭২ সাল, জোড়াসাঁকোর মামার বাড়িতে তেতলার এক রোদফাটা কাঠের ঘরে। বাবা জানকীনাথ ঘোষাল ছিলেন বিদ্বান , আইনবিদ , নদীয়ার জয়রামপুরের ( অধুনা বাঙলাাদেশের কুষ্টিয়ায়) বনেদী হিন্দু পরিবারের সন্তান । দৃঢ চরিত্রের এই মানুষটি ছিলেন দেশপ্রেমিক, কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক। জন্মের পর ঠাকুরবাড়ির ব্রাহ্মধর্মীয় পরিবেশে বড় হলেও পিতৃকুলের বনেদী হিন্দুয়ানিকেও উপেক্ষা করতে শেখেন নি। সরলার শৈশব কেটেছিল পরিচারিকার সান্নিধ্যে। মায়ের আদর ভালবাসা, স্নেহ স্পর্শের জন্য হৃদয় ব্যাকুল হলেও মায়ের সীমাহীন উদাসীনতা ছাড়া আর বিশেষ কিছু জোটেনি। পড়ে গিয়ে দাঁত ভেঙ্গে রক্তপাত হলেও মায়ের মনোযোগ পাননি। শুধু সরলার গান বাজনার কথা জেনে একটু নরম হয়েছিলেন। ছোটবেলা থেকেই সুরের মায়া সরলার মনের ভেতরে বেশ রাজকীয় ভাবেই বিরাজ করত। তাঁর নিজের কথায় ' আমি গানের বাতিকগ্রস্ত ছিলুম। যেখান সেখান থেকে নতুন নতুন গান ও গানের সুর কুড়তুম। রাস্তায় গান গেয়ে যাওয়া বাঙলাী বা হিন্দুস্থানী ভিখারীদের ডেকে ডেকে পয়সা দিয়ে তাদের কাছে তাদের গান শিখে নিতুম — যা কিছু শিখতুম তাই রবিমামাকে শোনাবার জন্য প্রাণ ব্যস্ত থাকত,- তাঁর মত সমজদার আর কেউ ছিলনা। যেমন আমি শোনাতুম অমনি অমনি তিনি সেই সুর ভেঙ্গে কখনো কখনো তার কথাগুলিরও কাছাকাছি দিয়ে গিয়ে এক একখানি নিজের গান রচনা করতেন। চুঁচড়োয় কর্তা দাদামশাই দেবেন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা করার সময় বোটের মাঝিরা এরকম অনেক সুর শুনিয়েছেন। কোন আলোতে প্রাণের প্রদীপ, যদি তোর ডাক শুনে কেউ , আমার সোনার বাঙ্গলা' প্রভৃতি অনেক গান সেই মাঝির কাছ থেকে আহরিত আমার সুরে বসান'।

বাড়ীর সব মেয়েদের মত সরলারও ছোটবেলায় পিয়ানো বাজাতে লিখেছিলেন। মায়ের হুকুমে তাকে রীতিমত নিয়ম করে সময় ধরে পিয়ানো শিখতে হয়েছে। বাড়িতে দিশী গান শেখা ছাড়াও মেমেদের কাছে ইউরোপীয় গান শেখায় উৎসাহ দিতেন তার রবিমামা। পিয়ানোয় চমৎকার সব Piece রচনা করতেন। এই সুবাদে রবীন্দ্রনাথের কয়েকটি গানে সুর দেন সরলা। ‘সকাতরে ঐ কাঁদিছে সকলে’ গানটার পিয়ানো রূপ শুনে তার রবিমামা খুশি হয়ে ভাগ্নীকে ‘নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ’র পিয়ানো রূপ দিতে বলেন। সে যুগে বাঙলাি পরিবারে সুফি গান কে আর শুনত? দাদামশাই দেবেন্দ্রনাথের অনুরোধে তাঁর প্রিয় হাফিজের একটি সুফী কবিতায় সুরারোপ করে তাঁকে মুগ্ধ ও বিস্মিত করেছেন , প্রতিদানে পেয়েছেন এক বহুমূল্য হীরে-চুনির জড়োয়া নেকলেস, গুণী দৌহিত্রীকে সম্মানিত করে সংষ্কৃতি অনুরাগী দাদামশাই তাকে শিরোপা দিয়ে বলেছেন , ' তুমি সরস্বতী'।

এক অন্যরকম মেয়ের গল্পঃ সরলাদেবী চৌধুরানী

তবে মা'কে কাছে না পাওয়ার বেদনা শৈশবে –কৈশোরে বড় কষ্ট দিত। মা যেন অগম্য রানীর মত দূরে দূরে থাকতেন, এই ঔদাসীন্য তিনি নাকি উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছিলেন তাঁর মা অর্থাৎ সরলার কর্তাদিদিমার কাছ থেকে। গৃহধাত্রী মঙ্গলা আর নীরস গৃহশিক্ষক সতীশবাবুর কঠোর শাসনে শৈশবের দিন কেটেছে। পরিণত জীবনে সে বিষয়টি স্মরণ করে স্মৃতিকথায় লিখেছেন , আমার মনে হত আমি যেন একটি অধিকন্তু অপ্রার্থিত মেয়ে। অত্যন্ত মেধাবী মেয়ে সরলাকে বেথুন স্কুলে ভর্তি করা হল। বয়স তখন সাড়ে সাত। মাত্র তেরো বছর বয়সে এন্ট্রান্স পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হল।

ঠাকুর পরিবারের সঙ্গে সম্পর্কিত মেয়েদের মধ্যে তিনিই প্রথম এই প্রতিযোগিতা মূলক পরীক্ষায় বসেছিলেন। এন্ট্রান্স পরীক্ষায় ইতিহাসে মেয়েদের মধ্যে সর্বোচ্চ নম্বর পেয়েছিলেন সরলা । ইতিহাসের প্রশ্নপত্রে মেকলের লেখা ‘লর্ড ক্লাইভ’ বইয়ের ওপর ক্লাইভের বাংলা বিজয় সম্বন্ধে একটা প্রশ্ন এসেছিল। মেকলের লেখায় বাঙালির ভীরু চরিত্রের উল্লেখ থাকায় তিনি সেটি তুলে ধরে তীব্র প্রতিবাদ করেছেন , এ ব্যাপারে তার নিজস্ব মতামত যুক্তি - তথ্য দিয়ে সাজিয়ে উত্তর লিখেছিলেন । বালিকা বয়েস থেকেই সরলা স্বাধীন চিন্তার পরিচয় দিয়েছিলেন। এরপর ক্রমে ক্রমে বেথুন কলেজ থেকে এফ এ , ইংরেজী সাহিত্য নিয়ে বি এ পাশ করলেন। বয়স তখন সতেরো। কলকাতা ইউনিভার্সিটিতে সে বছর মেয়েদের মধ্যে সব চেয়ে নম্বর পেয়ে 'পদ্মাবতী' পুরস্কার পেলেন। মেয়েদের মধ্যে এই পদক তিনিই প্রথম পেলেন। সংষ্কৃত তার অন্যতম প্রিয় বিষয়। সেই ভালবাসার টানে সে বিষয় নিয়ে এম এ পড়া শুরু করলেন , মাঝপথে পড়া ছেড়ে দিয়ে চাকরী করার বাসনা হল। নিজেকে বোঝালেন মেয়ে বলেই কি ঘরের কোণে লুকিয়ে বসে থাকতে হবে নাকি? দাদাদের মত সেও তো সম শিক্ষার অধিকার পেয়েছে। তাই চাকরি করে নিজের পায়ে সেই বা দাঁড়াবেনা কেন? চিরকাল সরলা জেদী আর খামখেয়ালি। এর আগে এন্ট্রান্স পাশ করার পর বায়না ধরে ছিল সে সায়েন্স নিয়ে পড়বে, ছেলেরা যদি পড়তে পারে মেয়েরা কেন পারবেনা? সে যুগের একমাত্র মেয়েদের কলেজ বেথুন কলেজে সায়েন্স নিয়ে পড়ার অনুমতি ছিলনা। তাতে কী হল? সরলা দুই দাদা জ্যোৎস্নানাথ ঘোষাল ও মামাতো দাদা সুধীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর সাহায্যে মহেন্দ্রলাল সরকার প্রতিষ্ঠিত অ্যাসোসিয়েশনে সান্ধ্য ফিজিক্স ক্লাসে যাওয়া শুরু করলেন, পড়েও ছিলেন বেশ কিছুদিন , প্রাথমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে রৌপ্য পদক লাভ ও হল। অবশ্য খুব বেশিদূর এগোতে পারেনি , কারণ তার মনের আসল তারগুলো তো অন্য সুরে বাঁধা। সরলার আরেক উল্লেখযোগ্য কৃতিত্ব সে যুগের মেয়ে হয়ে স্বাধীন ভাবে জীবিকা অর্জনের কথা ভাবা। কলকাতা থেকে অনেক দূরে অন্য প্রদেশে , মহীশূরের একটি স্কুলের শিক্ষিকা চাকরি করতে যাওয়ার আবদার ধরল। যোগাযোগ আগেই করে নিয়েছিলেন । দক্ষিণ 'ভারতী' ভ্রমণের সময় সরলার সঙ্গে দেখা হয়ে যায় মহীশূরের দেওয়ান নরসিংহ আয়েঙ্গারের। সরলার ব্যক্তিত্ব ও ভাষা ব্যুৎপত্তিতে মুগ্ধ হয়ে তিনি তাকে মহীশূরের মহারানী গার্লস কলেজে সুপারিনটেনডেন্টের পদে আহ্বান জানান। সরলা সাগ্রহে রাজী হলেন। বাধা এসেছিল অনেক । ঘরের মেয়ের অতদুরে চাকরি করতে যাওয়া নিয়ে অনেকে প্রশ্ন তুলেছিল। গ্রাহ্য করেননি কিছু কোনোদিন । যেটা করতে চেয়েছেন, সেটাই করেছেন। সরলার মত বিদুষী, গুণী মেয়েকে শিক্ষয়িত্রী হিসেবে পাওয়া স্কুলের পক্ষেও ভাগ্যের বিষয়। তখনো বাঙলাা প্রদেশে কেন , ভারতের অন্যান্য প্রদেশেও বেশির ভাগ ঘরের মেয়েই প্রকাশ্যে স্কুলে পড়তে যায়না, বাড়ি বসে বিয়ের দিন গোণে, সংসার ধর্ম পালন করার তালিম নেয়। । এমন একটা সময় সরলার এ কী রকম সৃষ্টিছাড়া আবদার ! অভিভাবকেরা বেঁকে বসলেন। সরলা এরকমই। তাই তিনি ইংরেজী সাহিত্য নিয়ে বি এ পাশ করার পর সংষ্কৃত পড়তে গেলেন , শিখলেন ফারসি ভাষাও । কিন্তু নতুন কিছু করার প্রবল বাসনা তাকে নিয়ত তাড়িয়ে বেড়ায়। অনাদরের পর্দা টাঙানো শৈশব পেরোতে পেরোতে তার মনে হয়তো মেয়েদের জন্য হাজার বিধি নিষেধের গন্ডী পেরনোর এক রকমের জেদ পেয়ে বসেছিল। বাস্তবিক পিতামহ জয়চন্দ্র ঘোষাল আর বড়মামা দ্বিজেন্দ্রনাথ ছাড়া আর কেউ তো তার জন্য তেমন স্নেহ দেখাননি!

এক অন্যরকম মেয়ের গল্পঃ সরলাদেবী চৌধুরানী

কুড়ি বছরের সুন্দরী সরলা যখন ১৯৯২ সালে একা একা মহীশূরে স্কুলের চাকরি করতে গেলেন, সে যুগের নিরিখে অভিজাত ঘরের অবিবাহিত যুবতী মেয়ের এই বৈপ্লবিক প্রচেষ্টায় বলা বাহুল্য অভিভাবকেরা অপ্রসন্ন হয়েছিলেন । তাঁদের সক্রোধ সম্মতি আদায় করে সরলা বাড়ি ছাড়লেন। আর সেই সুযোগে সেখান থেকে অজস্র সুর সংগ্রহ করে রবিমামার কাছে অঞ্জলি দিতে লাগলেন । সেই সুরে সুরে রবীন্দ্রনাথ সৃষ্টি করলেন অপূর্ব সব গান , আনন্দলোকে মঙ্গলালোকে, এস হে গৃহদেবতা, এ কি লাবণ্যে পূর্ণ প্রাণ, চিরবন্ধু চির নির্ঝর প্রভৃতি। মহীশূরে সুর সংগ্রহ আর স্বাধীন জীবন যাপনে ছেদ পড়ল অবশ্য এক বছরের মাথায়। অসুস্থ সরলা স্কুলের চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে কলকাতায় ফিরে এলেন । কিন্তু গান সংগ্রহের নেশা তাঁর সারাজীবনেই রয়ে গেল। অসামান্য এই সুর-সাধিকার অনুরাগী ছিলেন স্বয়ং বঙ্কিমচন্দ্র। গান ও সুর সংগ্রহ একটা সময়ে সরলার কাছে ছিল নেশা। বাংলার বাউল গান, মহীশূরে থাকতে দক্ষিণ ভারতের কর্ণাটকী সুর একটা খাতায় লিখে তিনি রবীন্দ্রনাথকে উপহার দেন এবং তার থেকে রবীন্দ্রনাথ অনেক গানে সুর দিয়েছিলেন। ‘বন্দেমাতরম’ এর সুরও মামা, ভাগ্নী দুজনে মিলে বসিয়েছিলেন। এছাড়াও নানা দেশাত্ববোধক গান সরলা লিখে সুর দিয়েছেন। তারই পরিণতিতে ১৯০১ সালের কংগ্রেস অধিবেশন শুরু হয় তাঁর নিজের লেখা , নিজের সুরের গান 'নমো হিন্দুস্থান' দিয়ে। সে গানে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ধর্ম নিরপেক্ষ এক রাষ্ট্রের মর্মবাণী ।

গাও সকল কন্ঠে সকল ভাষে নমো হিন্দুস্থান।/হরহরহর-জয় হিন্দুস্থান/ সৎশ্রী অকাল হিন্দুস্থান/ আল্লা হো আকবর –হিন্দুস্থান/ নমো হিন্দুস্থান ।

নিজে যেমন সুর খুঁজতেন , তেমনি নতুন নতুন গানের প্রতিভা আবিষ্কার করতেন । অমিয়া ঠাকুর ও ঢাকার রানু সোম (প্রতিভা বসু) কে আবিষ্কার করে রবীন্দ্রনাথের কাছে হাজির করেন সরলা।

বঙ্কিমচন্দ্রের আত্মীয়দের অনুরোধে সরলা তাঁর নাটকের গান 'সাধের তরণী' তে সুরারোপ করেন । গানের ব্যাপারে তাঁর প্রধান উৎসাহ দাতা ছিলেন তার রবিমামা। বারো বছর বয়সেই রবিমামার লেখা ব্রহ্মসঙ্গীত 'সকাতরে ঐ কাঁদিছে সকলে'র সুর সরলা দিয়েছিল পিয়ানোয়ে ব্যান্ড বাজানোর সুরে। পরে রবিমামার আরো বেশ কিছু দিশী গানকে ইউরোপীয় ঘরানার গানে বদলে দিয়েছিলেন , যেমন 'আমি চিনি গো চিনি', 'হে সুন্দর, বারেক ফিরাও' এরকম আরো কত।

সরলা শুধু রবিমামা বা বঙ্কিমচন্দ্রের গানে সুর যুগিয়েছেন তাই নয়, অন্যের কবিতা বা গান ছাড়াও সরলা নিজেও অনেক গান লিখেছেন , তাতে সুরারোপ করেছেন । গানের মাধ্যমে পরাধীন দেশের ভীরু , ঝিমিয়ে পড়া প্রজন্মকে উদ্দীপিত করতে চেয়েছেন । কিছু গানকে চিহ্নিত করেছেন 'ব্রহ্মসঙ্গীত' , আর 'যুদ্ধ সংগীত' নামে। একশটি পছন্দের গান নিয়ে গ্রন্থ প্রকাশ করেছেন 'শতগান'(১৯০০) শিরোনামে । বহু জনসভায় তাঁর কন্ঠে গানের প্রচুর চাহিদা ছিল। কংগ্রেসের অধিবেশনে এক সময় সরকার কর্তৃক নিষিদ্ধ 'বন্দেমাতরম' গান গেয়েও দেশবাসীকে উদবুদ্ধ করেছেন । গান তাঁর সারা জীবনে বহতা নদীর মত ভাললাগার কাজে সম্পৃক্ত হয়েছিল।

সঙ্গীত ছাড়াও সরলার সাহিত্যের রুচি তৈরি করে দিয়েছিলেন তার রবিমামা। রবিমামার প্রেরণায় সাহিত্য পাঠের দীক্ষা তাঁকে প্রস্তুত করেছিল পারিবারিক পত্রিকা 'ভারতী'-এর দায়িত্ব নিতে। বি এ পাশ করার পর দু তিন বছর 'ভারতী' পত্রিকার সঙ্গে বিশেষ ভাবে যুক্ত হলেন। প্রায় বালিকা বেলা থেকেই 'বালক', 'সখা’ ও 'ভারতী’ পত্রিকায় রচনা প্রকাশ করে সরলার সাহিত্যিক জীবনের যাত্রা শুরু হয়েছিল । লিখেছেন অসংখ্য গান , কবিতা, গল্প, উপন্যাস , রম্য রচনা, সাহিত্য সমালোচনা, অনুবাদ এবং স্মৃতিকথা। সংষ্কৃতের ছাত্রী সরলা অসাধারণ নিষ্ঠায় সংষ্কৃত কাব্যসাহিত্যের সমালোচনা-মূলক প্রবন্ধ লিখলেন। তাঁর লেখা পড়ে স্বয়ং বঙ্কিমচন্দ্র অবধি উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেন । সরলার বাঙলা রচনার বৈশিষ্ট্য ছিল সংষ্কৃত ভাষার বাহুল্য। যখন এলেন পত্রিকা সম্পাদনার কাজে, মনে প্রাণে চাননি 'ভারতী’ শুধু ঠাকুর বাড়ির পত্রিকা হয়ে থাকুক। খুঁজে খুঁজে প্রতিভাময় লেখকদের সুযোগ করে দিলেন। তার সার্থক উদাহরণ শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। অনামা লেখকের বড়দিদি উপন্যাসটি তিনিই প্রথম 'ভারতী'-এর পাতায় স্থান দিয়ে বাঙলার পাঠকের কাছে এক অপার সম্ভাবনাময় লেখককে হাজির করলেন । তাড়না করে করে রবি মামাকে দিয়ে লিখিয়ে নিলেন প্রহসনধর্মী লেখা 'চিরকুমার সভা'। শুধু কি বাঙলা লেখা? অন্য ভাষাভাষী লেখকের লেখার অনুবাদ করে সম্পাদক সরলা প্রকাশ করতে লাগলেন 'ভারতী'-এর বিভিন্ন সংখ্যায় । সে তালিকায় পড়ল মহাত্মা গান্ধী, মহাদেব গোবিন্দ রানাডে, সিস্টার নিবেদিতা প্রমুখের লেখা। লেখকদের বিশেষ সাম্মানিক দেওয়ার প্রথা তিনিই প্রথম শুরু করেন । সাহিত্য আর সঙ্গীতের ভেতর দিয়েই সরলা তার স্বদেশ হিতৈষণার পথ খুঁজে পেয়েছিলেন । অবশ্য এই কাজে তার হৃদয় অনেক আগে থেকেই প্রস্তুত ছিল। তেরো বছর বয়সে জ্ঞানদানন্দিনী সম্পাদিত 'বালক' পত্রিকায় ‘দুর্ভিক্ষ’ শিরোনামের একটি রচনা লেখেন । সে সময় বাঁকুড়া, বীরভুম, বর্ধমানে মানুষ খরার জন্য অন্নকষ্টে ছিল। ছোটদের উদ্দেশে বালিকা সরলা লিখেছিল, ' ভাই তোমরা প্রায় রোজই পয়সা লইয়া কত রকম খেলনা কিনিয়া থাক। কত ঘুড়ি, মার্বেল , ব্যাটবল, পুতুল, ঘটিবাটি প্রভৃতি কতই কেনো । ওই সকল জিনিষ কিনিতে তোমাদের যত ব্যয় হয়, তাহার অর্ধেক যদি দরিদ্রদের দান করো, তাহা হইলে কত সৎ ব্যয় হয় '। ছোটদের কাছে বিশেষ ভাবে আরো বললেন, বিদেশের এক সাহেব পরিবারের কথা। ১৮৭৩ সালে বাঙলাা- বিহারে প্রবল দুর্ভিক্ষ দেখা দিলে তারা চা-য়ে চিনি না খেয়ে সেই পয়সা ত্রাণ তহবিলে দান করত। বিদেশের ছোটদের মত আমাদের দেশের ছোটদের এরকম কাজে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হওয়া উচিত। বেথুন স্কুলের পরিবেশে বুদ্ধিদীপ্ত সহপাঠী আর বয়সে বড় স্কুলের উঁচুক্লাশের দিদিদের সান্নিধ্যে এসে মনের মধ্যে জাতীয়তাবোধের উন্মেষ ঘটে। ইলবার্ট বিলের আন্দোলনে স্কুলের উঁচু ক্লাশের দিদি কামিনী সেন , অবলা দাসের প্রেরণায় আস্তিনে বেঁধেছিলেন কালো ফিতে। সেই বয়সে সরলা অনুভব করেছিলেন পরাধীন দেশের মানুষ হওয়ার বেদনা। স্কুলের আবহাওয়ায় স্বদেশ প্রেমের প্রথম কুঁড়িটি জেগে উঠেছিল বলেই হয়ত নতুন মামা জ্যোতিরিন্দ্রনাথকে আবদার করে বলেছিলেন , সাহেবি সার্কাসের বদলে দেশি সার্কাস দেখাতে। সমবয়সী মামাত ভাই বোন পরিচ্ছন্ন পরিবেশে সাহেবি সার্কাস দেখতে চাইলে সরলা দৃঢ ভাবে জানিয়েছিল, ' হলই বা একটু নোঙরা। কত কষ্ট করে বাঙ্গালীরা নিজেদের একটা কিছু গড়ে তুলছে, তাদের দেখবনা?' সরলার এই জাতীয়তা বোধে শুধু স্কুল নয়, মা বাবার অবদান ও কম ছিলনা। বাবা ও মা দুজনেই ছিলেন ভারতীয় কংগ্রেসের সদস্য। সরলা কিন্তু সরাসরি প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে এলেন মহীশূরের মহারাণী গার্লস স্কুলের চাকরি সেরে কলকাতায় ফিরে। তাই দেখা গেল, প্রবল মানসিক শক্তিতে এক বঙ্গ নারী দেশের যুবশক্তিকে নতুন তেজে , প্রত্যয়ে জাগিয়ে তুললেন । তেইশ বছরের সরলা নতুন পরিচয় তৈরি করতে শুরু করলেন ।

এক অন্যরকম মেয়ের গল্পঃ সরলাদেবী চৌধুরানী

এক বছরের মহীশূর বাস সরলাকে এক অভিনব জীবনের স্বাদ চিনিয়েছিল। সেখানকার হিন্দুদের জগত যেমন একদিকে অতীত-আশ্রয়ী কাব্য আর চিত্রের জগতে মুগ্ধতা তৈরি করতে পেরেছে, তেমনি চলার পথে , ভোজপুরি , মারাঠী , পাঞ্জাবী যুবকদের বল , শক্তি তাকে ভাবিয়েছে , বাঙ্গালিরা এত ভীরু কেন? তাদের মন থেকে ভীরুতা দূর করতে হবে, শারীরিক কসরতের মাধ্যমে বলশালী করে তুলতে হবে। 'ভারতী' পত্রিকার মাধ্যমে 'বিলিতি ঘুষি বনাম দিশী কিল' এই শিরোনামে প্রবন্ধ লিখে পাঠকদের আমন্ত্রণ করলেন পথে ঘাটে গোরা সৈনিক বা সিভিলিয়ানদের কাছে অপমানিত হলে তার প্রতিকারের জন্য আদালতের দ্বারোস্থ না হয়ে নিজের ক্ষমতায় প্রতিকার নেওয়ার ইতিবৃত্ত লিখে জানাতে। দলে দলে স্কুল কলেজের ছেলেরা তার সঙ্গে দেখা করতে লাগল। তাদের কয়েকজনকে বেছে নিয়ে গঠন করলেন এক অন্তরঙ্গ দল, ভারতের মানচিত্র ছুঁইয়ে তাদের দিয়ে শপথ করালেন দেশের জন্য আত্মনিবেদন করতে , হাতে বেঁধে দিলেন সেই নিবেদনের স্মারক-স্বরূপ এক রাখি, ঠিক যেমন সম্রাট হুমায়ুন রাজপুত কন্যার হাত থেকে রাখি গ্রহণ করে তার বিপদে রক্ষা করার শপথ করেছিলেন । কয়েক বছর পরে এই সংস্কৃতিকে অনুসরণ করে রবীন্দ্রনাথের নেতৃত্বে বঙ্গ-ভঙ্গের দিনে লাল সুতোর রাখি-বন্ধন সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছিল। শৈশবে সরলা তার রবিমামার গান গাইতেন , ' একী অন্ধকার এ ভারতভুমি — এ দীনতা পাপ এ দুঃখ ঘুচাও , ললাটের কলংক মুছাও মুছাও/ নহিলে এ দেশ থাকেনা । বড় হয়ে বুঝলেন বাঙলাির প্রধান কলংক তার কাপুরুষতা। বিদেশী শিক্ষাবিদের লেখা থেকেও প্রত্যয় আর দৃঢ হল, ' Not practising Physical Education is a crime, against yourself and those who depend on you'. সেটি দূর করতে হলে তাদের অস্ত্র চালনা শেখানো দরকার। বাঙলাি যুবকদের সাহস দিয়ে বললেন , ক্ষমা করা অক্ষমের ধর্ম নয়। তোমরা আগে বলশালী হও, ক্ষমা করার অধিকারি হও, তোমার চেয়ে যে হীন বল তাকে দয়া করতে পারো , ক্ষমা করতে পার, তার আগে ক্ষমা করা মানে কাপুরুষতা। শুধু কি মৌখিক উপদেশ? বাঙালি যুবকদের মধ্যে যারা গভর্নমেন্টের দাসত্ব না করে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর স্বপ্ন দেখছিল, গঠন করেছিল 'সুহৃদ সমিতি' নামে এক স্বদেশিয়ানায় উদবুদ্ধ দল , যার জন্য তারা জমিতে চাষ আবাদ করতে চায়—তাদের জন্য সরলা নিজের অর্থে জমি , কৃষিকাজের সহায়ক জিনিস-পত্র কিনে দিলেন । এক সময় সাহিত্য ও সঙ্গীতের চেয়ে সরলার কাছে প্রধান হয়ে ওঠে স্বদেশ প্রেম । ঠাকুর পরিবারের কোন নারী দূরে থাক, সরলার আগে কোন পুরুষকেও তাঁর মত চরমপন্থী রাজনীতিকে আশ্রয় করতে দেখা যায়নি। ১৮৯৫ সাল থেকেই 'ভারতী' পত্রিকায় বিভিন্ন উদ্দীপক রচনা প্রকাশের মাধ্যমে বাঙালি যুবমানসকে প্রেরণা দিয়েছেন । 'ভারতী'তে ১৩০৬ সালে প্রকাশিত ‘আহিতাগ্নিকা’ শিরোনামের কবিতাটি এই প্রসঙ্গে উল্লেখের দাবি রাখে। নিজের লেখালেখির মত 'ভারতী'-এর সম্পাদক সরলারও যথেষ্ট নিজস্বতা ছিল। নিজে লেখকদের সাম্মানিক দেওয়ার প্রথা শুরু করলেও কখনো কখনো তাঁর এও মনে হয়েছে লেখার জন্য লেখকদের কোনও বিশেষ সম্মান-দক্ষিণা থাকা উচিত নয়। সরস্বতীর বাণিজ্য দিয়ে লক্ষ্মীলাভের চেষ্টা করা অরুচিকর। এ নিয়ে তাঁর সংঘাতও বেধেছিল খোদ রবীন্দ্রনাথের সঙ্গেই।

জাতীয়তাবোধ সরলাকে যে ভাবে সক্রিয় রেখেছিল, তার ফলশ্রুতি দেখা যায় তাঁর জাতীয় উৎসব পালনের প্রচেষ্টায়। অস্ত্রচালনা কে কেন্দ্র করে কোন উৎসব হবেনা কেন? মহরমের দিন মুসলমানেরা পথে পথে অস্ত্রচালনার প্রদর্শনী করে, তার জন্য বছরভর চর্চা করে। পঞ্জিকার পাতায় চোখ রেখে আবিষ্কার করলেন আমাদের দেশে দুর্গা পুজার অষ্টমীর দিন বীরাষ্টমী ব্রত পালনের বিধান রয়েছে। এই ব্রত আর কিছুই নয় বাঙালি মায়ের বীরমাতা হবার আকাঙ্ক্ষাকে সজীব করে তোলা। মাতা পুত্রের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় দেশকে গৌরবের পথে নিয়ে যাওয়ার সাধনাই ছিল দূর অতীতে ধর্মোৎসবের অংগ। সরলা প্রচলন করলেন আধুনিক বীরাষ্টমী উৎসবের । মহাষ্টমীর দিন কলকাতার সব ক্লাবে আমন্ত্রণ পাঠালেন বিভিন্ন খেলাধূলার প্রতিযোগিতায় যোগদানের । লাঠি ও ছোরা খেলা, মুষ্টিযুদ্ধ ছিল প্রতিযোগিতার বিষয় , পুরস্কৃত করলেন ‘বীরাষ্টমী পদক’ দিয়ে, সেই সঙ্গে লাঠি, ছোরা, দস্তানাও উপহার দিলেন । পরবর্তী কালে শহরে শুধু নয়, গ্রামাঞ্চলেও প্রতিযোগিতা শুরু হল, সাঁতারের , বা যে কোন রকম বলবীর্য প্রদর্শনের । সেই সঙ্গে ছেলেরা উপহার পেল মায়ের হাতের রাখি। বাঙালি যুবকদের দেহমনে বলিষ্ঠ করার লক্ষ্যে সূচনা করলেন আরেক রকমের বীরপূজা, মহারাষ্ট্রের শিবাজী উৎসবের অনুকরণে ‘প্রতাপাদিত্য উৎসব’ । বাঙলার হিন্দু জমিদার প্রতাপাদিত্য মোগল সম্রাটের সঙ্গে একক ভাবে যুদ্ধ করেছেন , সেই সাহস ভীরু বাঙ্গালির মধ্যে সংক্রমিত করতে চেয়েছেন । লাঠি খেলা , ছোরা খেলা শেখাতে উৎসাহ দিয়েছেন । আবার অন্যরকম বিষয় , বিশেষত বাঙলার নিজস্ব সংস্কৃতির চর্চাও তাঁর কাছে ছিল বহুপ্রার্থিত । সূচনা করলেন বসন্ত পঞ্চমী উৎসবের, পৌষ-পার্বণের দিনে পিঠে-পুলি খাওয়ার ব্যবস্থা, নবান্ন উৎসব। এরই মধ্যে ছুটে গেছেন হিমালয়ের কোলে মায়াবতী আশ্রমে শাস্ত্র পাঠ ও অধ্যাত্ম সাধনায় । স্বামী বিবেকানন্দ একবার সিস্টার নিবেদিতাকে জানিয়েছিলেন সরলার এডুকেশন পারফেক্ট । এইরকম এডুকেশন ভারতের সব মেয়ের হওয়া দরকার। বস্তুত বিবেকানন্দ চেয়েছিলেন সরলাও তাঁর সঙ্গে পাশ্চাত্যের দেশগুলিতে গিয়ে হিন্দু ধর্ম সম্বন্ধে প্রচার করে আসুক । সরলা রাজী হতে পারেন নি। পারিবারিক ব্রাহ্ম পরিবেশের সংষ্কার, আত্মজনের বাধায় সেই আহবান নিষ্ফল হয়ে যায়। ঠাকুরবাড়ির মেয়েরা শিল্প, সাহিত্যের নানা দিকে তখন নিজেদের মেলে ধরলেও, সক্রিয় রাজনীতিতে তাদের দেখা যেত না। সরলাই প্রথম অভিজাত পরিবারের নারী যিনি স্বদেশীয়ানায় উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন ১৯০৫ বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের বহু আগে। ভীরু বাঙালি যুবকদের একত্রিত করে তাদের মধ্যে সাহসিকতা ও তেজস্বিতা যুগিয়েছেন । স্বদেশী জিনিস দিয়ে পূর্ণ বিপণি লক্ষ্মীর ভাণ্ডার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন । সেখানে সব জেলার তৈরি হস্তশিল্প সামগ্রী বিক্রয় করা হত। এই হস্তশিল্পের কাজে নিয়োগ করেছেন দুঃস্থ বিধবা মহিলাদের। সরলা স্বদেশী-জিনিস ব্যবহার করেও যথেষ্ট ফ্যাশন দুরস্ত করে তুলেছিলেন নিজেকে , পরিচিত মানুষকে।

এই তেজস্বিনী সরলা তাই গড়পড়তা মেয়েদের মত বিয়ের মত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাপ্রবাহে অনেক কাল ধরে নিজেকে যুক্ত করেন নি। মা স্বর্ণকুমারীও চেয়েছিলেন মেয়ে বরং কুমারী থেকেই দেশের কাজ করুক। আর দাদামশাই দেবেন্দ্রনাথ প্রস্তাব করেছিলেন , সরলা যদি অঙ্গীকার করে জীবনে কখনো বিয়ে করবেনা, তাহলে আমি তার তলোয়ারের সংগে বিয়ে দিই। তেত্রিশ পেরিয়ে ১৯০৫ সালের ৪ অক্টোবর দিদি হিরন্ময়ী দেবীর মধ্যস্থতায় পাঞ্জাবের উগ্রপন্থী জাতীয়তাবাদী নেতা, আইনজীবি, সাংবাদিক রামভূজ দত্ত চৌধুরী কে স্বামী হিসেবে বরণ করে নিলেন । দুজনের রাজনৈতিক দর্শন মোটের ওপর একই রকমের ছিল। বিয়ের পর লাহোরে এলেন , সেখানে বহুবিধ সমাজকল্যাণ মূলক কাজে আত্মনিয়োজিত করলেন । 'ভারতী স্ত্রী মহামন্ডল’ প্রতিষ্ঠা করে সেখানকার নারীর স্বাধিকার অর্জনের জন্য বিভিন্ন রকমের কাজ করতে লাগলেন । অন্তঃপুরের মেয়েদের লেখাপড়া শেখাতেন। লাহোরে প্রায় পাঁচশ জন বাঙালি যুবককে সংগ্রহ করে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ সভার আয়োজন করেন । রামভূজ সম্পাদনা করতেন উর্দু সাপ্তাহিক পত্রিকা 'হিন্দুস্থান'। রাওলাট অ্যাক্টের বিরুদ্ধে পত্রিকায় প্রকাশিত চরম পন্থী মতবাদ ব্রিটিশ সরকারকে ক্রুদ্ধ করল, পরিণামে পত্রিকা বন্ধ হওয়ার উপক্রম হল। নির্ভীক সরলা পত্রিকার সম্পাদক ও মুদ্রাকরের দায়িত্ব নিলেন । পত্রিকার ইংরেজি সংস্করণ ও প্রকাশ করতে লাগলেন সরলা। এর পরে ১৯১৯ সালে জালিয়ানওয়ালা বাগের নির্মম হত্যাকান্ডের পর রাজদ্রোহের অভিযোগে রামভূজ কারাবরণ করলেন । ইতিমধ্যে সরলার মনোজগতে বিশেষ পরিবর্তন এল। সক্রিয় রাজনীতির বদলে তিনি গান্ধীজি নির্দেশিত পথই অনুসরণ করলেন । খাদি আন্দোলন , সত্যাগ্রহের আদর্শে সরলার জীবনদর্শনে আমূল পালাবদল হতে লাগল।

১৯২৩ সালে স্বামী রামভূজ দত্ত চৌধুরীর মৃত্যুর পর অল্প কিছুদিনের অবসর নিয়ে একান্ন বছরের সরলা আবার নতুন উদ্যমে জীবনের বিশাল কর্মযজ্ঞে ফিরে এলেন । নারী শিক্ষা, নারীর অধিকার তাঁর কাজে প্রাধান্য পেল। কিন্তু রাজনীতির আঙ্গিনায় আর নিজেকে জড়ালেন না। এক সময় উগ্র সশস্ত্র বিপ্লবের সমর্থক সরলা, গান্ধীজির অহিংস নীতিতে বিশ্বাসী হয়ে ওঠেন। পরে এই নীতি তাকে নিরাশ করেছিল। রাজনীতিতেই উৎসাহ হারান। সেখান থেকে থেকে স্বেচ্ছাবসর নিয়ে মেতে উঠলেন সাহিত্য সেবা আর সমাজ-সেবার কাজে। কলকাতায় 'ভারতী স্ত্রী মহামন্ডল’-এর শাখার কাজ , 'ভারতী’ পত্রিকার সম্পাদনায় ব্যস্ত হয়ে পড়লেন । ১৯২৪ থেকে ১৯২৬ পর্যন্ত 'ভারতী'র সম্পাদক ছিলেন, সে সময়ে বিভিন্ন বিষয়ে চিন্তা উদ্রেককারী প্রবন্ধ লিখতে লাগলেন। ১৯৩০ সালে অন্তঃপুরে শিক্ষাদানের বদলে মেয়েদের প্রকাশ্যে শিক্ষা দেওয়ার জন্য প্রবেশিকা স্তর পর্যন্ত পড়ানোর ব্যবস্থা ও চারুকলা শিক্ষার জন্য একটি শিক্ষাসদন গঠন করলেন । গঠিত হল একটি ছাত্রী নিবাসও । পরে এই সঙ্গে খুলে দিলেন একটি শিশু সংরক্ষণ কেন্দ্র। এই সব কাজ পরিচালনার জন্য সরলা দেবী নিজে নেতৃত্ব দিলেন একটি অধ্যক্ষ সভার মারফত।

সরলার জীবন পর্যালোচনা করলে দেখা যায় তিনি একই সংগে হৃদয়বৃত্তি আর বুদ্ধিবৃত্তিকে শাণ দিয়ে চলেছেন । একের পর এক সাহিত্য সৃষ্টি করছেন , কবিতা , গান , গল্প, প্রবন্ধ; গান গাইছেন, অভিনয় করছেন; দেশের যুব সম্প্রদায়কে উদ্বুদ্ধ করে চলেছেন শারীরিক শিক্ষায়, বীর উৎসবের মাধ্যমে; অন্যদিকে তাঁর বিশ্লেষণধর্মী মন বারে বারেই প্রচলিত পুরুষ নির্দেশিত ধ্যান ধারণা রূপায়নে প্রশ্ন চিহ্ন এঁকে দিয়েছেন।

১৯২৫ সালের এক বক্তৃতায় সমালোচনা করে বলেছিলেন অসহযোগ আন্দোলনের কর্মসূচিতে দেশের যুবশক্তিকে যুদ্ধ করার জন্য যথাযথ প্রশিক্ষণ দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়নি। আইন অমান্য আন্দোলনের পর কুমিল্লাতে নারীদের জনসভায় (কনফারেন্সে) ১৯৩১ সালে ভারতীয় কংগ্রেসে নারীদের রাজনৈতিক অধিকারের সমালোচনা করে বলেছিলেন , এই কংগ্রেস, মেয়েদের আইন ভাঙ্গার সময় কাজে লাগায় , নীতি প্রণয়নের সময় নয়। মেয়েদের জন্য পৃথক কংগ্রেস গঠনের প্রয়োজন হয়ে পড়েছে, কারণ নারীর সমস্যা নিয়ে পুরুষদের কোন মাথা ব্যথা নেই। । দুঃখের বিষয় সরলার রাজনৈতিক ভূমিকা নিয়ে আমাদের দেশের ইতিহাসবিদেরা তাঁকে বিশেষ কিছু গরিমা দেননি।

১৯১০ সালে সরলা দেবী স্থাপন করেছিলেন ‘ভারতী স্ত্রী মহামণ্ডল’ নামে মেয়েদের প্রথম সর্বভারতীয় সংগঠন, যার শাখা-প্রশাখা ছড়িয়ে ছিল করাচি থেকে কানপুর হয়ে কলকাতা পর্যন্ত। সেই সাংগঠনিক আন্তর্জাল বিধ্বস্ত পঞ্জাবের অজস্র মেয়েকে সহায়তা দিয়েছিল। কলকাতায় এই 'ভারতী স্ত্রী মহামন্ডল’ বৌবাজারের অধ্যাপক পত্নী কৃষ্ণভাবিনী দাসের চেষ্টায় একটি সমাজহিতৈষী প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়। এর মাধ্যমে কুমারী, বিধবা , অনাথা মেয়েরা শিক্ষিত হয়েছে, শিল্প শিক্ষা পেয়েছে। লাহোর থেকে কলকাতায় ফিরে সরলা এর পূর্ণ দায়িত্ব গ্রহণ করেন ।

সারাজীবন তাঁর কলম চলেছে অক্লান্ত ভাবে। নিজের পত্রিকা 'ভারতী’, ‘মাসিক বসুমতী’, ‘প্রবাসী’ ‘মডার্ন রিভিউ’, ‘হিন্দুস্তান’-এ লিখেছেন এবং ‘দেশ’ পত্রিকায় ধারাবাহিক ভাবে বেরিয়েছিল তাঁর আত্মজীবনী ‘জীবনের ঝরাপাতা’। সাহিত্যচর্চার পাশাপাশি পত্রিকা সম্পাদনার ক্ষেত্রেও সরলাদেবী একটি বিশেষ নাম । স্বামী রামভূজ রাজরোষে গ্রেপ্তার হলে হিন্দুস্তান পত্রিকার সম্পাদনার দায়িত্ব তিনি গ্রহণ করেন এবং এর ইংরেজি সংস্করণও প্রকাশ করেন। দিদি হিরণ্ময়ী দেবীর সঙ্গে যুগ্মভাবে তিনি দীর্ঘকাল 'ভারতী' পত্রিকাও সম্পাদনা করেন। মায়ের সম্পাদিত 'ভারতী' পত্রিকার সঙ্গে সরলা ও দিদি হিরন্ময়ী জুড়ে ছিলেন সেই বালিকা বয়েস থেকে। তারপর এল পত্রিকা সম্পাদনার দায়িত্ব। 'ভারতী' যে শুধুই ঠাকুরবাড়ির পত্রিকা হয়ে থাকেনি তার কৃতিত্ব সরলার। 'ভারতী’ তাঁর এতটাই ভালবাসার জায়গা ছিল যে পরে পঞ্জাবে চলে গেলেও তার সম্পাদনা ও পরিচালনের জন্যে তিনি কলকাতায় ছুটে আসতেন। সরলাদেবী রচিত ১০০টি দেশাত্মবোধক গানের একটি সংকলন গ্রন্থ ‘শতগান’ ১৯০০ সালে প্রকাশিত হয়। এছাড়া তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ: 'বাঙালির পিতৃধন’ (১৯০৩), 'ভারতী-স্ত্রী-মহামন্ডল’ (১৯১১), ‘জীবনের ঝরাপাতা’ (আত্মজীবনী, ১৯৪৫), ‘বেদবাণী’ (১১ খন্ড), ‘শিবরাত্রি পূজা’ ইত্যাদি।

এক অন্যরকম মেয়ের গল্পঃ সরলাদেবী চৌধুরানী

বিবেকানন্দ ভবিষ্যতবাণী করেছিলেন সরলা অনেক দূর যাবে। প্রথর মেধা, বুদ্ধি , ব্যক্তিত্ব নিয়ে ডানা ঝাপটে সরলা অনেক দূরেই গিয়েছিলেন । এক অভিজাত পারিবারিক বেষ্টনীতে জন্ম নিয়ে , প্রতিপালিত হয়েও সেই পারিবারিক সীমারেখার বাইরে গিয়ে স্বকীয় পরিচিতি তৈরি করেছিলেন সাহিত্যে, সুর সাধনায় , সক্রিয় রাজনীতির বৃত্তে। বার বার নিজেকে ভেঙ্গেছেন আর গড়েছেন , ব্যতিক্রমী এই নারী কোনদিন হার মানতে চাননি। তাঁর প্রখর ব্যক্তিত্ব সহ্য করার মত ক্ষমতা ছিলনা বিখ্যাত মাতুল রবীন্দ্রনাথের অথবা একদা প্রিয় রাজনীতিক মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীর।

ঠাকুরবাড়ির এক বধূ জানিয়েছিলেন , সরলাদেবী সমর্থ পায়ে চলাফেরা করতেন , জোরে কথা বলতেন , জোরে হাসতেন। তাই রবীন্দ্রনাথ ভাইঝি ইন্দিরাকে অনেক বেশি পছন্দ করতেন , ততটা পছন্দ সরলাকে করতে পারেন নি। সরলাও তার রবিমামাকে সাহিত্য, সাঙ্গীতিক প্রতিভার জন্য শ্রদ্ধা করলেও তাঁর বিচার –বিবেচনায় অনেক সময় ক্ষুব্ধ হয়েছেন , প্রতিবাদ করেছেন। কেন তার রবিমামা জোড়াসাঁকোর মাঘোৎসব বোলপুরে সরিয়ে নিয়ে গেলেন , কেন মহর্ষি ভবনের অধিকার রবীন্দ্রনাথের হল, সে সব নিয়ে তিনি বারে বারে প্রশ্ন তুলেছেন ।

১৯৩৫ সাল থেকে সরলার মনোজগতে এক ব্যাপক পরিবর্তন আসে। আচার্য শ্রীমৎ বিজয়কৃষ্ণ দেবশর্মার সঙ্গে পরিচিত হন । তাঁর সংস্কৃত শাস্ত্র ব্যাখায় মুগ্ধ হয়ে তাঁকে গুরুপদে বরণ করে নেন। শাস্ত্রপাঠ, শাস্ত্র ব্যাখায় নিভৃতে তাঁর দিন কাটে। গান্ধী নির্দেশিত সীতা, দময়ন্তী, দ্রৌপদীর মত শুদ্ধ , আত্মসংযমী জননেত্রী হওয়ার বাসনা ত্যাগ করে জীবনের অন্য অর্থ খুঁজে নিলেন ।

জীবনের শেষের আট বছর দেখতে পাওয়া যায় অন্য এক সরলাকে । যিনি এক সময় কূপমন্ডুক মেয়েদের আকাশে ডানা মেলার সাহস দেখিয়েছিলেন, নির্জীব, আত্মবিস্মৃত বাঙালিকে আত্মইতিহাস অনুসন্ধানে উদবুদ্ধ করেছেন, সেই সরলা হঠাতই যেন পৃথিবী থেকে মুছে গেল। তবে জীবনের এই পর্বেই লিখেছিলেন তাঁর স্মৃতি কথা- ‘জীবনের ঝরাপাতা’ । সেই পাতা ঝরানোর কাহিনীতে নিজের জীবনের উজ্জ্বল দিনগুলিকেই ফিরিয়ে এনেছেন , আর প্রবল নিরাসক্তিতে বর্জন করেছেন জীবনের রিক্ত দিনের কথা। বলেন নি কিভাবে অনন্য নারী প্রতিভা ক্ষমতাশালী পুরুষের চাতুরীতে বিলীয়মান হয়ে যায় !

ভারতের স্বাধীন পতাকা দেখার সৌভাগ্য সরলার হয়নি, কিন্তু জীবদ্দশাতেই দেখে গেছেন তাঁর দেখান পথ ধরে দেশমাতৃকার সেবায় জীবন নিবেদন করেছেন কত প্রীতিলতা, কল্পনা, বীণা, লীলা আরো কত শত অনাম্নী অঙ্গনা। সরলা বেঁচে আছেন এদের সবার জীবনের আলোকদাত্রী হয়ে ।

১৯৪৩ সালে মৃত্যুর দু বছর আগে ‘নারী মন্দির’ শিরোনামের এক প্রবন্ধে সরলা লিখেছিলেন , ' মনুর সময় হইতে আরম্ভ করিয়া অদ্যাবধি ঘরে বাহিরে যাহা কিছু অধিকার নারী পাইয়াছেন, তাহা কেবল পুরুষদের আরাম ও সুবিধাকল্পে, নারীর দিক ভাবিয়া নহে। ছবিটা যদি সিংহের আঁকা হইত, সিংহ যেমন এক রকম করিয়া আঁকিত, তেমনই ধর্ম শাস্ত্র রচনা নারীর হাতে পড়িলে শ্লোক কয়টা পুরুষকে উলটা পড়িতে হইত। লোকযাত্রা যেমন পুরুষের, তেমনই মেয়েরো। কিন্তু শাস্ত্রের ব্যবহারগুলি সব পুরুষের একার গড়া, মেয়েদের ভোট বা সম্মতি লইয়া গঠিত হয় নাই। '

সরলার এই স্বাধীন সত্ত্বা চিনিয়ে দেয় সে কালে বাঙালি মেয়ের পরিচয় কত যুক্তিযুক্ত ভাবে প্রতিষ্ঠা করার জন্য তাঁর আন্তরিক চেষ্টা ছিল। 


সহায়ক গ্রন্থঃ
১। জীবনের ঝরাপাতা, সরলাদেবী চৌধুরানী, দেজ পাব্লিশিং, কলকাতা , ২০০৯
২। ঠাকুর বাড়ির অন্দর মহল , চিত্রা দেব , আনন্দ, কলকাতা ২০১০
৩। সরলাদেবী চৌধুরানী রচনা সংকলন, সম্পাদনা শংকর কুমার চক্রবরতী, দেজ পাব্লিশিং, কলকাতা , ২০১১।
৪। লস্ট লেটারস অ্যান্ড ফেমিনিস্ট হিস্ট্রিঃ দ্য পলিটিক্যাল ফ্রেন্ডশিপ অফ মোহন দাস কে গান্ধী অ্যান্ড সরলা দেবী চৌধুরানী, জেরাল্ডিন ফোরবস, ওরিয়েন্ট ব্ল্যাকসোয়ান , ২০২০

গত দুই দশক ধরে মূলতঃ ছোটগল্প এবং বিজ্ঞানভিত্তিক নিবন্ধ লেখেন।

আমরা, ভারতের জনগণ, ভারতকে একটি সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, সাধারণতন্ত্র রূপে গড়ে তুলতে সত্যনিষ্ঠার সঙ্গে শপথগ্রহণ করছি এবং তার সকল নাগরিক যাতে : সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ন্যায়বিচার; চিন্তা,মতপ্রকাশ, বিশ্বাস, ধর্ম এবং উপাসনার স্বাধীনতা; সামাজিক প্রতিষ্ঠা অর্জন ও সুযোগের সমতা প্রতিষ্ঠা করতে পারে এবং তাদের সকলের মধ্যে ব্যক্তি-সম্ভ্রম ও জাতীয় ঐক্য এবং সংহতি সুনিশ্চিত করে সৌভ্রাতৃত্ব গড়ে তুলতে; আমাদের গণপরিষদে, আজ,১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর, এতদ্দ্বারা এই সংবিধান গ্রহণ করছি, বিধিবদ্ধ করছি এবং নিজেদের অর্পণ করছি।

ফেসবুকে ইচ্ছামতীর বন্ধুরা