সবুজ মনের রসদ
Ichchhamoti Logo
 বিদ্যাসাগর আর তাঁর কালের মেয়েদের শিক্ষা

আজ  থেকে প্রায় একশ চুয়াল্লিশ বছর আগে মায়াসুন্দরী নামের এক বাঙালি  মহিলা  'বঙ্গমহিলা' পত্রিকায়  সখেদে   লিখেছিলেন  , " আমরা রীতিমত লেখাপড়া শিখিতে পাই না, ...পিতামাতা কন্যাদিগকে বিদ্যালয়ে প্রেরণ করেন বটে, কিন্তু সে রূপ বিদ্যালয়ে দেওয়া আর না দেওয়া দুই   সমান- বিবাহও হইল, লেখাপড়ায় জলাঞ্জলি হইল। ...আমরা যদি বিদ্যাশিক্ষা করিতে না পারিলাম , তবে আমাদের জীবনে অল্পই সুখ"। এই ছিল  সংক্ষেপে সেকালের  মেয়েদের শিক্ষার ব্যাপারে সমাজ চিত্র। এই  লেখার সময় ১৮৬৯ সাল।  

বাংলায় মেয়েদের লেখা পড়ার চর্চা যদিও শুরু হয়েছে  উনিশ শতকের প্রথমার্ধে  খৃষ্টান মিশনারী ও কিছু উদারমনা সমাজ নেতাদের বদান্যতায়, কিন্তু তার ব্যাপ্তি তেমন কিছু ঘটেনি।   বাংলার মাটিতে  মেয়েদের শিক্ষা- বিস্তারে বিশেষ ভাবে এগিয়ে এসেছিলেন পন্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর এবং জন এলিয়ট  ড্রিঙ্ক ওয়াটার বেথুন। ১৮৪৯ সালে  বেথুনের উদ্যোগে  কলকাতার হেদুয়া অঞ্চলে মেয়েদের জন্য স্কুল খোলা হল। ১৮৫০ সালে স্কুলের  অনারারি সেক্রেটারি পদে নিযুক্ত হলেন বিদ্যাসাগর । বেথুনের অকাল মৃত্যুর পর , বিদ্যাসাগর,  বেথুনের  এই বড় ভালোবাসার স্কুলের বেশ অনেকটা  দায়িত্ব নেন। তখন সমাজে তাঁর নামে কত ব্যাঙ্গ বিদ্রুপের জোয়ার এল। ছড়া বেরোল," ডুববে  নৌকো বিদ্যের এই সাগরে" ।  সেদিনের  পুরুষ প্রধান সমাজে মেয়েরা পড়তে চাইলেও অভিভাবকেরা তেমন করে সাড়া দেননি।   সমাজের ধর্মীয় ব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত  গণ্য মান্য লোকেরা বেশ সুচারু ভাবে অভিভাবকদের বোঝালেন, শিক্ষার সঙ্গে অকাল বৈধব্য কিংবা   নৈতিক অধঃপতন সরাসরি যুক্ত । সমসাময়িক এক পন্ডিত রামনারায়ণ  তর্করত্ন মজা করে বলেছিলেন, "...বাপ রে  বাপ! মেয়েছেলেকে লেখা পড়া শেখালে কি আর রক্ষা আছে। এক "আনো" শিখিয়েই রক্ষা নাই। চাল আনো , ডাল আনো, কাপড় আনো করে অস্থির করে , অন্য অক্ষর গুলো শেখালে কি আর রক্ষা আছেংলা

মেয়েরা  তখন ঢাকা ঘোড়ার গাড়ি করে স্কুলে যায়।  সে গাড়ির গায়ে বিদ্যাসাগরের নির্দেশে লেখা হল মহানির্বাণ তন্ত্রের এক শ্লোকাংশ-'কন্যাপ্যেবং  পালনীয়া শিক্ষণীয়াতিযত্নতঃ', অর্থাৎ, কন্যাকেও শিক্ষা ও  অতি যত্ন সহকারে পালন করা দরকার। ধর্ম বা শাস্ত্রের দোহাই না দিলে তো লোককে বোঝানো যাবেনা।  ছেলেদের মত বাড়ির মেয়েদেরও লেখা পড়া শেখাতে হবে।  বেথুনের স্কুলে ভর্তি   হল পন্ডিত মদন মোহন তর্কালঙ্কারের দুই মেয়ে। কিন্তু  তাও লোকের মুখ বন্ধ হয়না । তারা বলাবলি করে "এইবার কলির বাকি যা ছিল, হয়ে গেল! ছুঁড়িগুলো কেতাব ধরলে আর কিছু বাকি থাকবেনা" ।  কিসের ভয় পেয়েছিলেন তাঁরা?  মনের ভেতর আলো পড়লে তাদের চিন্তা, যুক্তিবোধ, নিজস্বতা গড়ে উঠবে , তাদের আর ক্রীতদাসীর অধম করে রাখা যাবেনা?  সে কথা জানতেন সংস্কৃত পন্ডিত , আর আজীবন নারী দরদী বিদ্যাসাগর। তাই তাঁকে  অত সহজে দমিয়ে রাখা যায়নি । তিনি  যে মনে প্রাণে বিশ্বাস  করতেন অন্দর মহলের অন্ধকার থেকে মেয়েদের উদার আলো ভরা আকাশের তলায় টেনে না আনলে কোনো সমাজেরই উত্তরণ হবেনা। বেথুন মারা যাওয়ার পর স্কুলের আর্থিক দায়িত্ব পরবর্তী কালে সরকার নেয় । এই স্কুলে তখন পড়ার অধিকার পেত শিক্ষিত  হিন্দু, ভদ্র পরিবারের  মেয়েরা। তারা পড়ত পাটিগণিত, ভুগোল, পদার্থবিজ্ঞান, সূচীকর্ম , বাংলা এবং ইচ্ছে করলে ইংরেজি ভাষা।  

 সে সময়ে বাংলার ছোটলাট  হয়ে এলেন নারী শিক্ষা অনুরাগী হ্যালিডে সাহেব। বিদ্যাসাগরের ভীষণ ভাল বন্ধু। ১৮৫৭ সালের  প্রথম  থেকেই তিনি এই ব্যাপারে বড়ই উৎসাহী। বিদ্যাসাগরও  তাই চান। তাঁর তত্ত্বাবধানে ওই বছরেই  বর্ধমানের জৌ গ্রামে একটি মেয়েদের স্কুল তৈরি হল। বিদ্যাসাগর হিসেব করে রিপোর্ট দিলেন  স্কুলের জন্য একজন হেড মাস্টার, একজন অ্যাসিস্ট্যান্ট হেড মাস্টার, একটি পরিচারিকা আর সামান্য দৈনন্দিন খরচের জন্য প্রয়োজন যথাক্রমে পঁচিশ, পনেরো, দুই এবং পাঁচ টাকা।  মাসিক সর্বমোট খরচ সাতচল্লিশ টাকা। সুরাহা কিছুটা হল। মাসিক বত্রিশ টাকা সরকার এই স্কুলের  জন্য মঞ্জুর করলেন। প্রস্তাবিত হিসেবের থেকে পনেরো টাকা কম পেলেও উৎসাহী বিদ্যাসাগর ভাবলেন, সরকারের অনুমোদন যখন জুটে গেছে, তখন আর কিছু স্কুল খোলা যেতে পারে।  তাই প্রবল পরিশ্রম ও উদ্যোগে ভর করে ১৮৫৭ সালের ২৪শে নভেম্বর থেকে ১৮৫৮ সালের ১৫ই মে পর্যন্ত সময়ে ৩৫টি স্কুল স্থাপন করলেন চারটি জেলায়। হুগলী জেলায় কুড়িটি, বর্ধমানে এগারোটি, মেদিনীপুরে তিনটি এবং নদিয়ায় একটি।  এই  পঁয়ত্রিশটি স্কুলের  ব্যবস্থাপনার জন্য মাসিক খরচ প্রয়োজন  আটশো পঁয়তাল্লিশ টাকা। সরকারের কাছে এর জন্য আর্থিক সহায়তার আবেদন করলেন বিদ্যাসাগর।

 কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল এই বিষয়ে সরকারের কোন আগ্রহ নেই, আর বিদ্যাসাগর নিজেও নাকি এই ব্যাপারে সরকারের কাছে অগ্রিম অনুমোদন প্রার্থনা করেন নি। সমস্যা আবার  শুধু এক মাসের নয়। গত এক বছর ধরে  যে সব স্কুল চলছে, তার শিক্ষকেরা কেউ মাস মাইনে পান নি। ১৮৫৮ সালের জুন মাস অবধি তাদের পাওনা দাঁড়াল  সাড়ে তিন হাজার টাকা। বিদ্যাসাগর সে কালের শিক্ষা অধিকর্তা বা ডি পি আই কে চিঠি লিখলেন, সবিস্তারে তাঁর মহতী উদ্দেশ্যের কথা জানালেন।  তাছাড়া প্রথম স্কুল স্থাপনের পর তাঁর অনুমতি  ছিল, এবং আর্থিক সহায়তা দেওয়ার বিষয়টি সরকার তো  মঞ্জুর করেছিল। শিক্ষা অধিকর্তা সে কথা জানালেন ছোটলাট তথা বাংলার গভরনারকে। তিনি বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করার জন্য ভারত সরকারকে অনুরোধ করলেন। ভারত সরকারের যুক্তি খুব স্পষ্ট । কেন আগাম অনুমতি না নিয়ে বিদ্যাসাগর এমন কাজে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। ন্যায় শাস্ত্রে পন্ডিত  বিদ্যাসাগরের কাছেও যুক্তি মজুত। তিনিও ডি পি আই কে লিখে জানালেন,  কেন ? প্রতিটি স্কুল তৈরির পর ঠিক পরের মাসে  আমি তো সরকারি দপ্তরে রিপোর্ট পাঠিয়েছি।   তখন কেন আমায় বাধা দেওয়া হয়নি? মানছি এই ব্যাপারে কোন লিখিত নির্দেশ দেওয়া হয়নি। কিন্তু  স্কুল গড়তে বারণ করার নির্দেশও  তো দেওয়া হয়নি। তাই আমার মনে হয়েছে  নারী শিক্ষার বিস্তারের ব্যাপারে সরকারের সম্মতি আছে। অনেক  চিঠি পত্র চাপান উতোর চলল। ফল কিছুই হলনা। সেই বিপুল দায়ভার বিদ্যাসাগরের ঘাড়েই পড়ল।  তারপর নতুন শিক্ষা অধিকর্তা গরডন ইয়ঙ্গের সঙ্গে তাঁর বনিবনা হচ্ছেনা, স্কুল ইন্সপেক্টরের  পদটি খালি হলে বিদ্যাসাগর আশা করেছিলেন বন্ধু ছোটলাট হ্যালিডে সাহেব তাঁকে এই পদের জন্য উপযুক্ত বলে বিবেচনা করবেন।  কিন্তু সরকার সে ভার তাঁকে দিলেন না। আহত, অপমানিত বিদ্যাসাগর পাঁচশো  টাকা মাস মাইনের সরকারি চাকরি  থেকে  ইস্তফা দিলেন ১৮৫৮ সালে। কিন্তু নারী  শিক্ষা প্রসারের কাজ থেকে নিজেকে কিছুতেই বিযুক্ত করতে পারলেন না। তিনি তখন একটি 'নারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ভান্ডার' খুললেন। বিদ্যাসাগরের শুভানুধ্যায়ী সমাজের কিছু গণ্যমান্য ব্যক্তি নিয়মিত চাঁদা দিয়ে এই মৃতপ্রায় স্কুল গুলিকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা  করতে লাগলেন।  এই নিয়ে 'হিন্দু পেট্রিয়ট' পত্রিকায় লেখালেখি হল। সরকার একটু নড়েচড়ে বসল। তাই দেখা যাচ্ছে  পরবর্তী সময়ে সরকারি কলেজ থেকে অবসর নেওয়া এই নারীশিক্ষা দরদী মানুষটি  বারে বারে সরকারের কাছে  স্কুল করার জন্য আর্থিক সহায়তা  প্রার্থনা করে চলেছেন এবং আশ্চর্যের কথা সেই প্রার্থনা মঞ্জুর  হয়ে চলেছে। ১৮৫৯ সাল থেকে ১৮৬২ সাল পর্যন্ত সময়ে এই ভাবে তাঁর ব্যক্তিত্বকে কাজে লাগিয়ে  বেশ কয়েকটি স্কুলের প্রতিষ্ঠার জন্য আর্থিক অনুদান আদায় করেছেন।
 
স্ত্রী শিক্ষা নিয়ে নিজে এত উদ্যোগ নিলেও নিজের ঘরের মেয়েদের শিক্ষিত করতে পারেন নি বিদ্যাসাগর। না স্ত্রীকে না তাঁর চার মেয়েকে।  বিদ্যাসাগরের সমসাময়িক শিবচন্দ্র দেব , প্যারিচরণ মিত্রেরা নিজেদের স্ত্রীদের শিক্ষিত করতে পেরেছিলেন । দীনময়ী দেবী ছিলেন স্বচ্ছল ঘরের মেয়ে, শৈশবে স্কুলে কিছুদিন পড়েও ছিলেন। কিন্তু বিদ্বান স্বামীর কাছে পাঠের দীক্ষা পাওয়ার সৌভাগ্য তাঁর হয়নি। বিদ্যাসাগরের  তথাকথিত উদারমনা  পিতা মাতা সে সৌজন্য কুলবধূর  জন্য দেখাতে পারেন নি।  তাদের চার নাতনির জন্য? সেখানেও সংশয় থেকেই যায় ।  এখানে বিদ্যাসাগরের নিশ্চিত কিছুটা পরাজয়। নিজের পিতা মাতার অকৃপণ উদার সহযোগিতা এই   ব্যাপারে না পেয়ে পারিবারিক সংস্কারের মত জটিল গূঢ বিষয়ে তিনি  নিজেকে আর জড়াতে চাননি, সম্ভবত সময়ও পান নি।  আসলে তাঁর চরিত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট ছিল এই যে মতের সংঘর্ষ হলে  তিনি সহ্য করতে পারতেন না। কিন্তু তাহলে বিধবা বিবাহের কাজে এত রকম বিরুদ্ধ মত উপেক্ষা করে কেন  এবং কীভাবে এগিয়েছিলেন ?  উত্তরটা ভাল করে খোঁজার দিন  কিন্তু  এখন এসেছে।


ছবিঃ পার্থ মুখার্জি

গত দুই দশক ধরে মূলতঃ ছোটগল্প এবং বিজ্ঞানভিত্তিক নিবন্ধ লেখেন।

আমরা, ভারতের জনগণ, ভারতকে একটি সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, সাধারণতন্ত্র রূপে গড়ে তুলতে সত্যনিষ্ঠার সঙ্গে শপথগ্রহণ করছি এবং তার সকল নাগরিক যাতে : সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ন্যায়বিচার; চিন্তা,মতপ্রকাশ, বিশ্বাস, ধর্ম এবং উপাসনার স্বাধীনতা; সামাজিক প্রতিষ্ঠা অর্জন ও সুযোগের সমতা প্রতিষ্ঠা করতে পারে এবং তাদের সকলের মধ্যে ব্যক্তি-সম্ভ্রম ও জাতীয় ঐক্য এবং সংহতি সুনিশ্চিত করে সৌভ্রাতৃত্ব গড়ে তুলতে; আমাদের গণপরিষদে, আজ,১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর, এতদ্দ্বারা এই সংবিধান গ্রহণ করছি, বিধিবদ্ধ করছি এবং নিজেদের অর্পণ করছি।

ফেসবুকে ইচ্ছামতীর বন্ধুরা