তাঁর পুরো নাম রোজালিন্ড এলসি ফ্র্যাঙ্কলিন। এ বছরে তাঁর জন্মের শতবর্ষ পূর্ণ হল। সারা পৃথিবীতে বেশ কিছু মানুষ বিশ্বাস করেন বিজ্ঞানের গবেষণার জগতে নারী বলেই তিনি তার প্রতিভার প্রার্থিত মর্যাদা পাননি। রামায়ণে লক্ষ্মণের স্ত্রী উর্মিলাকে রবীন্দ্রনাথ যেমন বলেছিলেন ‘কাব্যে উপেক্ষিতা’, রোজলিন্ডও নাকি তেমনই বিজ্ঞানে উপেক্ষিতা। কেন সে কথা বলা হয়, সেটি জানার আগে , আমরা বরং জেনে নিই তাঁর স্বল্পায়ু জীবনের কথা ।
এই পৃথিবীতে বেঁচে ছিলেন মাত্র সাঁইত্রিশ বছর আর কয়েক মাস। জন্মে ছিলেন আজ থেকে একশ বছর আগে, ১৯২০ সালে, লন্ডনের নটিংহিল অঞ্চলে ২৫শে জুলাই, এক সম্ভ্রান্ত ও ধনী ব্রিটিশ ইহুদী পরিবারে । বাবা এলিস আরথার ফ্র্যাঙ্কলিন ছিলেন ব্যাঙ্কের মালিক এবং কলেজের বিজ্ঞান শিক্ষক। বাবা মায়ের দ্বিতীয় সন্তান রোজালিন্ডের ছিল আরও তিন ভাই আর এক বোন। ছেলেবেলা থেকেই মেয়েটা বড্ড মেধাবী। অঙ্ক আর বিজ্ঞানের পাঠ চটপট ধরে ফেলতে পারে। তাকে প্রাথমিক ইস্কুলের পাঠ দেওয়ার পর ভর্তি করা হল যে স্কুলে তার নাম সেন্ট পলস স্কুল ফর গার্লস। সেটি সেই স্কুল, যেখানে মেয়েরা অঙ্ক আর বিজ্ঞান শিখতে পারে। স্কুলে সে নিয়মিত ভাল ফল করে। ভাষা শেখাতেও তার খুব মন, আর ভালবাসে খেলাধুলো, কিন্তু গানের বেলায় মেয়ের তেমন প্রতিভা দেখা গেলনা। সে না হোক, সে তো আর ভবিষ্যতে গায়িকা হবেনা। তার লক্ষ্য বড় হয়ে বিজ্ঞানী হওয়া। পনের বছর বয়সেই সে ঠিক করে ফেলল জীবনের সেই লক্ষ্য। বাবার এ ব্যাপারে মত নেই । বাবা নিজেও চেয়েছিলেন বিজ্ঞানী হতে। কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পটভূমিতে সে আশা অপূর্ণ রয়ে গেছে। তাছাড়া মেয়েদের বিজ্ঞানী হওয়া অত সোজা নয়। হয়ত তিনি ভেবেছিলেন , সবাই তো আর ম্যাডাম কুরী হতে পারে না। মেয়ে কিন্তু অদম্য। স্কুলের পাঠ ভাল ভাবে সাঙ্গ করে , ১৯৩৮ সালে স্কলারশিপ নিয়ে কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে নিওনহ্যাম কলেজে ভর্তি হলেন। সেখানে ন্যাচারাল সায়েন্সে ট্রাইপোস করলেন । ট্রাইপোস মানে, সে সময়ে কেম্ব্রিজে পড়তে হত তিনটি মূল বিষয়, বিজ্ঞানের ইতিহাস, বিজ্ঞানের দর্শন আর ফিজিক্স বা কেমিস্ট্রির মত কোন বিশেষ বিষয়। গ্র্যাজুয়েট হলেন ১৯৪১ সালে । আবার পেলেন রিসার্চ স্কলারশিপ। কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিজিক্যাল কেমিস্ট্রি ডিপার্টমেন্টে রোনাল্ড জর্জ নরিসের অধীনে কাজ শুরু করলেন। নরিস বিশিষ্ট বায়ো- ফিজিসিস্ট , পরে নোবেল প্রাইজ পেয়েছিলেন , কিন্তু মানুষ হিসেবে অন্যরকম। রোজালিন্ডের মেধা লক্ষ্য করেও তাকে রিসার্চের কাজে তেমন দিশা দেখালেন না। কারণ মানুষটি চাইতেন না মেয়েরা এসব কাজ করুক। একটি বছর মনমরা হয়ে কাটালেন রোজালিন্ড । তারপর মনস্থির করে অন্য কাজে যোগ দিলেন । তখনও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়নি। রোজালিন্ড ব্রিটিশ কোল ইউটিলাইজেশন রিসার্চ আসোসিয়েশনের কাজে (BCURA) লাগলেন । শুরু হল কয়লা নিয়ে গবেষণা। কত মানুষ ভাবল , আরে, কয়লা নিয়ে আর কী কাজ হবে? কিন্তু রোজালিন্ড বিভিন্ন জায়গা থেকে যোগাড় করা কয়লার ঘনত্ব মাপলেন , পরীক্ষা করে দেখলেন , কয়লার মধ্যে কেমন ধরণের ছিদ্র আছে। এই সব নিয়ে কাজ করতে করতে কয়লা থেকে তৈরি হল গ্রাফাইটের সূক্ষ্ম পাত যা দিয়ে তৈরি হল গ্যাস- মাস্ক । যুদ্ধের বাজারে সেই মাস্ক ছিল সে কালের অন্যতম পারসোনাল প্রোটেক্টিভ ইকুইপমেন্ট । এই গবেষণার কাজ প্রকাশ পেল নামী বিজ্ঞানের পত্রিকা 'নেচার'-এ । তিন বছর পর ১৯৪৫ সালে পেলেন পি এইচ ডি ডিগ্রি। চোখে তখন নতুন সবপ্ন। চললেন প্যারিস । সেখানে এক বিখ্যাত ল্যাবরেটরিতে শিখলেন নতুন ধরণের এক প্রযুক্তি, এক্সস- রে- ক্রিস্টালোগ্রাফি। তার সাহায্যে কত রকমের কঠিন বা কেলাসাকার জিনিসের অন্তর্গঠনের পরিচয় পেতে লাগলেন । এই প্রযুক্তি শেখার সুবাদে জুটে গেল আরও তিন বছরের রিসার্চ ফেলোশিপ। এবারে লন্ডনের বিখ্যাত কিংস কলেজে। ১৯৫১ সালের জানুয়ারি মাসে দায়িত্ব পেলেন বায়োফিজিক্স বিভাগের অধিকর্তা জন র্যান্ডাল নামের বিজ্ঞানীর অধীনে প্রোটিন আর ফ্যাট জাতীয় জিনিসের গঠন নিয়ে গবেষণা করতে। কিন্তু মত বদলে র্যান্ডাল তাকে অন্য এক জৈব অণুর ওপর কাজ করার আদেশ করলেন । তার নাম ডি এন এ ( DNA)। ডি এন এ কী তা এখন সবাই জানে, সেকালে কিন্তু তেমন ভাবে জানা ছিলনা, যে এটি আমাদের জীব জগতের সব কোষের অন্যতম মূল উপাদান , এর গঠনেই লুকিয়ে আছে আমাদের বংশধারার গোপন সংকেত, আমাদের স্বভাব , আমাদের চেহারা , শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য। সে সময় ডি এন এ নিয়ে অনেকেই কাজ করে চলেছেন। লন্ডনের ক্যাভেন্ডিস- ল্যাবরেটরিতে জে ডি ওয়াটসন আর ফ্রান্সিস ক্রিক; কাজ করছেন আমেরিকায়, বিখ্যাত বিজ্ঞানী লিনাস পাউলিং , যিনি পরে দু'-দুবার নোবেল প্রাইজ পেয়েছিলেন। আর এই কিংস কলেজে-ই আগের বছর অর্থাৎ ১৯৫০ সাল থেকেই গবেষণা করছিলেন মরিস উইলকিন্স । রোজালিন্ডকে এই কাজে যুক্ত হতে দেখে উইলকিন্স মোটেই খুশি হলেন না। বরং প্রথম থেকেই দুজনের সম্পর্কে তিক্ততা শুরু হল। কিংস কলেজের পরিবেশ ক্রমশই রোজালিন্ডের কাছে খুব দুর্বিষহ হয়ে উঠছিল । কিন্তু কাজের প্রতি নিষ্ঠায় ফাঁকি ছিলনা। এক্সস- রে- ক্রিস্টালোগ্রাফির সাহায্যে , ছাত্র রেমন্ড গসলিং এর সহায়তায় খুব যত্ন করে ডি এন এ র প্রচুর ছবি তুললেন। স্বচ্ছ , পরিষ্কার ছবি না পাওয়া অবধি তার শান্তি নেই। অবশেষে পেলেন সেই প্রার্থিত ছবি, যার নাম বিজ্ঞানের ইতিহাসে ফোটো ৫১(Photo 51) বলে পরিচিত। সেই ছবির ওপর ভিত্তি করে ওয়াটসন ও ক্রিক ডি এন এ অণুর গঠন নিয়ে সোচ্চার হলেন — অনেকদিন ধরে যে কাজে মোটেই তারা সফল হতে পারেন নি। রোজালিন্ড ছিলেন সাবধানী বিজ্ঞানী, অত তাড়াতাড়ি গঠনের খুঁটিনাটি বিষয়ে নিশ্চিন্ত হতে পারছিলেন না। তাছাড়া তার অনুমতি না নিয়েই সে ছবি ওই দুই বিজ্ঞানীকে দেখিয়েছিলেন স্বয়ং উইলকিন্স। লিনাস পাউলিঙ্এর কাজ কিছুটা অবশ্য ভুল পথে চালিত হচ্ছিল কারণ তিনি নির্ভর করেছিলেন অপেক্ষাকৃত অস্পষ্ট এক্সস- রে - ক্রিস্টালোগ্রাফি জাত ছবির ওপর। তবে যে কাজ ওয়াটসন , ক্রিক ও উইলকিন্স এতদিন ধরে করে উঠতে পারেন নি , সেইটি সম্ভব হয়েছিল রোজালিন্ডের দুই বছরের পরিশ্রম লব্ধ গবেষণায়। ১৯৫৩ সালে নেচার পত্রিকার এপ্রিল সংখ্যায় ডি এন এ সম্পর্কে তিনটি প্রবন্ধ ছাপা হল। ওয়াটসন আর ক্রিক, রোজালিন্ড আর উইলকিন্স আর রোজালিন্ড ও গসলিং এর নামে কিন্তু ততদিনে রোজালিন্ডের সঙ্গে উইলকিন্স এমন কি র্যান্ডেলের সম্পর্কও তলানিতে থেকেছে। বিরক্ত রোজালিন্ড সেখানকার কাজে ইতি টানতে চান । সেখানেও বাধা। র্যান্ডেল বললেন , যেখানেই যাও, এখাকার গবেষণার সব অপ্রকাশিত রিপোর্ট , সব তথ্য রেখে যেতে হবে , আর ডি এন এ নিয়ে গবেষণা করা চলবেনা। তুমি বরং ওই কয়লার কাজেই ফিরে যাও।
যেমন দেখতে হয় টোব্যাকো মোজেইক ভাইরাস
রোজালিন্ডের মত সাহসী দৃপ্ত মনোভাবের মেয়ে সে প্রস্তাব কেন মেনে নিয়েছিলেন , সে কথা বিশেষ জানা যায়না, অনুমান করা যায় বিজ্ঞানের সাধনার স্বার্থে তো বটেই। ১৯৫৩ সালের মার্চ মাসের পর রোজালিন্ড কিংস কলেজের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে যোগ দিলেন বার্কবেক (Berkbeck) কলেজের এক্সস- রে- ক্রিস্টালোগ্রাফি ডিপার্টমেন্টে, বিজ্ঞানী জে ডি বারণেলের অধীনে। সে কলেজ কিংস কলেজের তুলনায় গুণমানে অনেক খাটো, রোজালিন্ডের ভাষায় রাজপ্রাসাদ থেকে বস্তির ঘরে, তা হোক, কিছুতেই দমে যান না লড়াকু মেয়েটি। শুরু করলেন কয়লা, গ্রাফাইটের গঠন নিয়ে আরো খুঁটিনাটি কাজ আর সেই সঙ্গে ভাইরাস এর গঠন নিয়ে গবেষণা। ভাইরাসের আবিষ্কার হয়েছে গত শতকের শেষে ,(১৮৯২-৯৭সালে)। সাধারণ মানুষ তথা বিজ্ঞানীরা বাস্তব অভিজ্ঞতায় জেনেছেন এরা কীভাবে ফসল নষ্ট করে, সে তামাক হোক আর শসা ,শালগম বা আলু হোক । তামাক পাতা ধ্বংস কারী টোব্যাকো মোসেইক ভাইরাস (Tobaco Mosaic Virus) এর কথা লোকে জানে , কেউ কেউ গবেষণাও করেছেন, কিন্তু তাদের ভেতর-বাইরের গঠনের কারিকুরি জানা যায়নি তেমন করে। ওয়াটসনও এক সময় এটি নিয়ে কাজ করেছেন । যাইহোক , রোজালিন্ডের নিঁখুত এক্সস- রে- ক্রিস্টালোগ্রাফির দরুন অনেক ধরণের উদ্ভিদ ভাইরাসের গঠন নিয়ে জানা গেল। এবার তিনি মন দিলেন প্রাণি ভাইরাস পোলিও নিয়ে গবেষণায়। তার জন্য আমেরিকা থেকে রিসার্চ -গ্র্যান্ট আনালেন । সে কাজে তাকে সাহায্য করতে এগিয়ে এলেন নবীন বিজ্ঞানী আরোন ক্লুগ (Aaron Klug), যিনি নিজেও পরে এই কাজের জন্য নোবেল প্রাইজ পেয়েছিলেন ১৯৮২ সালে কেমিস্ট্রিতে। নোবেল বক্তৃতা দিতে গিয়ে তিনি স্মরণ করলেন অসময়ে প্রয়াত সেই লড়াকু বিজ্ঞানী রোজালিন্ডের কথা। তিনি এও বললেন , বেঁচে থাকলে তিনিও এই পুরস্কারের দাবিদার হতেন। ক্লুগের ভাষণে বাস্তবতা ছিল, কারণ জীবিত অবস্থায় , রোজালিন্ড ছিলেন ভাইরাসের গঠন সম্পর্কে গবেষণায় প্রবাদ-প্রতিম ব্যক্তিত্ব ।১৯৫৩ থেকে ১৯৫৮ , পাঁচ বছরে রোজালিন্ড এই প্রতিষ্ঠান থেকে প্রায় সতেরোটি উল্লেখযোগ্য গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন । সারা পৃথিবীতে তিনি এ নিয়ে কত রকম আলোচনা, বক্তৃতা দিয়েছেন। সে কারণেই হয়ত , তাঁর সমাধি -ফলকে লেখা আছে , "বিজ্ঞানী, যার ভাইরাস সম্পর্কিত গবেষণায় এবং আবিষ্কারে সমস্ত মানব সমাজের দীর্ঘস্থায়ী উপকার ঘটে গেছে।''
নোবেল-পুরস্কার প্রাপ্তির ক্ষণে মঞ্চে দাঁড়িয়ে যে কৃতজ্ঞতা ক্লুগ দেখিয়েছিলেন , সেই রকম কিছু প্রশস্তি- সূচক বাক্য কাম্য ছিল ডি এন এ গবেষণার জন্য ১৯৬২ সালে তিন নোবেল প্রাইজ প্রাপকের কাছেও। কিন্তু তিন জনের একজনও এই কাজে তাঁকে কোন রকম স্বীকৃতি দেন নি। উলটে ছ’ বছর পরে নিজের আত্মজীবনী মুলক লেখা বই “ডি এন এ , ডবল হেলিক্স” এ ওয়াটসন লিখলেন রোজালিন্ড সম্পর্কে অনেক বিরূপ মন্তব্য। তার মূল কথা ছিল রোজালিন্ড ছিল আকর্ষণ এর অযোগ্য, প্রাচীন-পন্থী, কল্পনাহীন এক কর্মী, যে তার নিজের কাজের ফলাফলটুকুও বিশ্লেষণ করতে পারেনা। এই তির্যক মন্তব্যের প্রেক্ষিতে সরব হয়েছিলেন তাঁর বন্ধু ও জীবনীকার অ্যান সয়ার( Anne Soyer)। ১৯৭৫ সালে লেখা এই জীবনী বইতে তিনি প্রশ্ন করেছেন কেন রোজালিন্ডকে এই পুরুষতান্ত্রিক বিজ্ঞানী মহলের অন্যায়ের শিকার হতে হল? একই প্রশ্ন তুলেছিলেন ২০০২ সালে লেখিকা ব্রেন্ডা ম্যাডক্স , তাঁর লেখা রোজালিন্ডের জীবনীতে। ব্রেন্ডা তাঁকে “ডার্ক লেডি অফ ডি এন এ “বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি ডি এন এ গবেষণার ইতিহাসে অন্ধকারে বিস্মৃত, কয়লা নিয়ে কাজের পাশাপাশি তাঁর জীবনের এই অধ্যায়টি বড়ই মলিনতায় ঢেকে দিয়েছে সহ-বিজ্ঞানীরা । রোজালিন্ড সব অপমান সহ্য করেও তাঁর স্বল্পায়ু জীবনে এ বিষয়ে কখনো প্রশ্ন তোলেন নি। নারীবাদি পরিচয়ে পরিচিত হওয়ার বাসনা রাখেন নি। আসলে মানুষটি সারাজীবনে গবেষণা করতে চেয়েছেন , মগ্ন থেকেছেন সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্মতর সাধনায়। ১৯৫৬ সালে জানা গেল তিনি ওভারি বা ডিম্বাশয়ের ক্যান্সারে আক্রান্ত। তিন তিনটে বড় অপারেশন হল , তারপর চলল কেমোথেরাপি। তিনি কিন্তু ভেঙ্গে পড়েন নি। তখনও গবেষণার জন্য আর্থিক সাহায্য যোগাড় করতে ব্যস্ত। অসম সাহস ভরে কাজ করে গেছেন সেই মারণ রোগকে উপেক্ষা করে, যেন জীবন তার কাছে হঠাৎ থেমে যাওয়ার কোন সিগ্ন্যাল পাঠায়নি। খুব ইচ্ছে ছিল ৪০ বছর বয়স হওয়ার আগেই যেন রয়াল সোসাইটিতে সদস্য পদ পেতে পারেন । কিন্তু বিধাতা তাঁর জন্য জীবনে চল্লিশটি বছর বরাদ্দ করেন নি। অবশ্য ঈশ্বরে তাঁর বিশ্বাস ছিলনা। মারণ ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়েও সে বিশ্বাসে টোল খায়নি। ধর্মভীরু , উৎকন্ঠিত জননীকে বরং এই বলে সান্ত্বনা দিয়েছেন যে , এই বিশ্বে কোন ঈশ্বর যদি থেকেও থাকেন , তাঁর এত সময় নেই, এত অজস্র প্রাণের খুঁটিনাটি কথা ভাবার জন্য। তবে নিজেদের অকিঞ্চিৎকর বলে মনে করে নিজেদের ওপর বিশ্বাস হারানো ঠিক নয়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কিছুকাল পরে প্রস্তাবিত হয় প্রথম আন্তর্জাতিক মেলা হবে যার নাম দেওয়া হল এক্সপো ৫৮। সেখানে টোবাকো মোস্যাইক ভাইরাসের একটি ৫ ফুট উঁচু মডেল করার দায়িত্ব তাঁকে দেওয়া হল। টেনিস বল আর বাইসাইকেলের প্লাস্টিক-হ্যান্ড-গ্রীপের সহযোগে তৈরি হল সে মডেল। আর সেটি জনসমক্ষে প্রদর্শনের জন্য নিয়ে আসা হল ১৭ই এপ্রিল ১৯৫৮, তাঁর মারা যাওয়ার ঠিক একদিন পর। মারা যাওয়ার দিনও তাঁর লেকচার দেওয়ার কথা ছিল ফ্যারাডে সোসাইটির কনফারেন্সে । তাঁর কাছে প্রতিদিনের জীবন –যাপন আর বিজ্ঞানের সাধনা আলাদা কিছু ছিলনা। মনে প্রাণে বিশ্বাস করতেন কাজের মাধ্যমেই মানব জাতির উন্নয়ন ঘটানো সম্ভব।
মানুষ রোজালিন্ড ছিলেন সাধারণ ভাবে হাসি খুশি, আমুদে, ভ্রমণ- প্রিয়। রাজনীতির খবরাখবরে তাঁকে উদাসীন থাকতে দেখা যায়নি। তাঁর দয়ালু মনের কথা জেনেছেন অনেকেই , মৃত্যুর আগেই নিজের সম্পত্তির অনেকটাই মানুষের সেবায় , বিজ্ঞানের গবেষণার জন্য বরাদ্দ করে গেছেন। তবে এর বিপরীতে অনেক মানুষ আবার তাঁর ব্যবহারের রুক্ষতার কথা সোচ্চারে বলেছেন । আসলে খাড়া মেরুদন্ডের মানুষ রোজালিন্ড ভয়ানক রকমের স্পষ্টবক্তা কিংবা ঠোঁটকাটা ছিলেন।
বিজ্ঞানী রোজালিন্ড বেঁচে থাকতে বহু সহ- বিজ্ঞানীর উপেক্ষা পেয়েছেন, কিংস কলেজ তাঁর দীর্ঘ শ্রমের, তাঁর যান্ত্রিক প্রকৌশলের সুফল ভোগ করে এক রকম তাড়িয়েই দিয়েছে। কিন্তু মৃত্যুর পর তাঁর মহিমা উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হয়ে উঠেছে। কত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান , গবেষণাগার, মেডেল , ফেলোশিপে তাঁর নাম জড়িয়ে আছে।
শতবর্ষ উপলক্ষ্যে ফোটোগ্রাফ ৫১-এর ছবি সহ প্রকাশিত নতুন ৫০ পেনি মুদ্রা
এ মুহূর্তে সারা পৃথিবী এক অতিমারির কবলে। সেই মারণ ব্যাধির উৎসে রয়েছে এক ভাইরাস, SARS –COV 2 । আণবিক স্তরে ভাইরাস গবেষণার অগ্র-পথিক রোজালিন্ডের সহকারি, এবং তাদের পরবর্তী প্রজন্মের গবেষকদের চেষ্টায় এই SARS –COV 2 ভাইরাস নিয়ে অনুসন্ধান, টীকাকরণের চেষ্টা চলেছে। এখানেও রোজালিন্ডকে উপেক্ষিত করে রাখা যায়নি, তাঁকে বারবার স্মরণ করতেই হয়েছে। এ বছরে তাঁর জন্মের শতবর্ষ উপলক্ষ্যে ব্রিটিশ রয়াল মিন্ট তাঁর স্মরণে একটি ৫০ পেনির মুদ্রা প্রচলন করলেন , যার মধ্যে খোদাই করা আছে সেই বিখ্যাত Photo 51.। বিজ্ঞানী মহলে মাত্র দুজন এই স্মরণ- মুদ্রা সম্মানের অধিকারী হয়েছেন । প্রথম জনের নাম স্টিফেন হকিং।
১৯৬২ সালের ফিজিওলজি ও মেডিসিন বিভাগে নোবেল পুরস্কার প্রাপকদের তালিকায় রোজালিন্ড ছিলেন না। থাকা সম্ভব ছিলনা। তাঁর মৃত্যু হয়েছে চার বছর আগে-ই । ফ্রান্সিস ক্রিক আর মরিস উইলকিন্স ইতিমধ্যে ২০০৪ সালে প্রয়াত। এখনো বেঁচে আছেন ৯২ বছরের জেমস ডি ওয়াটসন , যিনি ২০১৪ সালে তাঁর নোবেল পদকটি আমেরিকায় নিলামে ৪.১ মিলিয়ন ডলারে বিক্রি করে দিয়েছেন , আর জিনগত কারণে কৃষ্ণাংগদের নিম্নমেধার উল্লেখ করে সারা পৃথিবীর মানুষের বিরাগ ভাজন হয়েছেন।
এমন ভয়ঙ্কর অখ্যাতি রোজালিন্ডকে স্পর্শ করতে পারেনি । শুধু মাটির পৃথিবীতে নয়, দূর মহাকাশেও একটি গ্রহাণু ( asteroid) উৎসর্গীকৃত হয়েছে তাঁর-ই নামে। নাম তার Rosfranklin. আর সেটি তাঁর মৃত্যুর ৩৯ বছর পরে, ১৯৯৭ সালে।
নারীর মেধা সর্বদা বিফলে যায়না। হয়ত পরিচিতি আসতে একটু দেরি হয় এই যা।
ছবিঃ উইকিপিডিয়া, পিক্সাবে এবং ওয়েস্টমিন্সটারকালেকশন