রোসালিন ইয়ালো বা রোসালিন সাসম্যান ইয়ালো। নামটা অনেকেই শোনেননি। কে তিনি? হুম , তিনি হলেন সদ্য একশ বছর পার করা মস্ত এক বিজ্ঞানী । মাদাম কুরির মত তাঁর নাম এখনো ঘরে ঘরে পৌঁছয়নি। তবে বিজ্ঞানের জগতে তাঁর অন্য এক নাম ব্রংক্সের মাদাম কুরি। জন্ম হয়েছিল আমেরিকার নিউইয়র্কের দক্ষিণ ব্রংক্স অঞ্চলে এক গরীব ইহুদী পরিবারে। অথচ তিনি সেই সব নারীদের অন্যতমা যারা কাচের দেয়াল ভেঙ্গে যুগান্তকারী আবিষ্কার করেছিলেন আর বহু মানুষের জীবনে সুস্থ হওয়ার চাবিকাঠি তুলে দিতে পেরেছিলেন।
আগেই বলেছি এ বছর তাঁর শতবর্ষ। রোসালিন যে বছরে জন্মান , তখনি বিজ্ঞানের ইতিহাসে ঘটে গেছে এক আশ্চর্য ঘটনা। ফ্রেড্রিক ব্যান্টিং ও চারলস বেস্ট নামে কানাডার দুই বিজ্ঞানী কুকুরের প্যানক্রিয়াসের রস থেকে আবিস্কার করেছেন এক অচেনা যৌগ, যার নাম ইনসুলিন। আর এটি দিয়ে কুকুরের ডায়াবেটিস সারানো যায়। ডায়াবেটিস এক বহু পুরোনো রোগ, কুকুর ছাড়া অনেক প্রাণী ও মানুষের জীবনের সীমারেখা কমিয়ে দেয়। এই ২০২১ সালে একশ বছর পার করা রোসালিনের জীবনের সঙ্গে একশ বছর আগেকার এ ঘটনার সম্পর্ক কি? সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল , পরিণত রোসালিনের জীবনে। ইনসুলিন নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে তিনি আবিষ্কার করেন এক আশ্চর্য ল্যাবরেটরি পদ্ধতি , যার জন্য সারা পৃথিবীতে বায়োমেডিক্যাল সায়েন্সের গবেষণায় ঘটে গেল এক যুগান্তকারী বিপ্লব। পদ্ধতির নাম রেডিও-ইমিউনো অ্যাসে বা আর আই এ । আর এ জন্য ১৯৭৭ সালে রোসালিনের সৌভাগ্য হয়েছিল নোবেল প্রাইজ পাওয়ার ।
মাদাম ক্যুরি
রোসালিনের জন্ম হয়েছিল এক গরীব ইহুদী পরিবারে। ছোট্ট মেয়েটি স্বপ্ন দেখেছিল, ডাক্তার হবে , অথবা কেমিস্ট্রি নিয়ে পড়বে। তার সাধারণ মা – বাবা মনে করেছিলেন সেকালের অন্যান্য শিক্ষিত ইহুদী মেয়েদের মত স্কুল কলেজের গন্ডি ডিঙিয়ে সে এলিমেন্টারি স্কুলের টিচার হোক । কিন্তু জেদী মেধাবী মেয়েটি ছোট থেকেই ঘোষণা করে দিয়েছে, বড় হলে সে বিজ্ঞানী হবে, বিয়ে করবে, আবার ছেলে – মেয়ের মা হবে। ছোটবেলায় অনেকেই অনেক স্বপ্ন দেখে । বড় হয়ে , সে সব কখন বাস্তবের রুক্ষতায় হারিয়ে যায়। এ মেয়েটি কিন্তু তার স্বপ্নের জন্য জারি রেখেছিল বিরাম-হীন ধৈর্য, অক্লান্ত শ্রম-ক্ষমতা , অসীম সাহস আর নিখাদ সততা। উচ্চাকাঙ্ক্ষার সিঁড়িতে পা রেখে কোথাও নিজেকে বিকিয়েও দেয়নি, কোথাও মাথাও নোয়ায়নি। রোসালিন ইয়ালোর জীবন তাই অবশ্যই পাঠ্য। সে নিজে মাদাম মারি কুরিকে তার রোল মডেল ভেবে নিয়েছিল। প্রতিভার পূর্ণতা না পাওয়ার জন্য, মেয়েরা অনেক সময় দুঃখ করে , তাদের ভাগ্যের কাছে অথবা কাছের মানুষদের অযথা দোষা্রোপ করে। রোসালিন কিন্তু তা ভাবেননি। নিজের মধ্যে পালন করেছিল এক বিচিত্র নারীবাদ , যা তাকে বারে বারে শিখিয়েছে , মেয়েরা নিজেকে আগে সম্মান করতে শিখুক, তবেই তো অন্যেরা তাকে দাম দেবে। তাঁর যুক্তি ছিল, মেয়েরা , ছেলেদের থেকে একটাই ব্যাপারে আলাদা, তাদের মা হতে হয়। , তবে সে চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করা যায় সময়ের সদ- ব্যবহার করে।
গত শতকে ১৯৭৭ সালে রোসালিন ইয়ালো আর তার সহযোগী গবেষক ড সলোমন বারসন একসাথে যে আবিষ্কার করেছিলেন তার নাম, Radioimmunoassay। সেই পদ্ধতিতে বিভিন্ন রকমের জৈব -রাসায়নিক পদার্থ , যেমন হরমোন, এনজাইম , কিংবা ওষুধ, রোগ জীবাণু যেমন ব্যাক্টেরিয়া, ভাইরাস ইত্যাদির উপস্থিতি অথবা তাদের পরিমাণ খুব কম মাত্রায় থাকলেও পরিমাপ সম্ভব হয়েছে (ন্যানোগ্রাম বা একগ্রামের শতলক্ষভাগের একভাগ , বা আরো কম মাত্রায়)। সনাক্ত করা গেছে বিভিন্ন হরমোনের আধিক্য বা অভাব জনিত ব্যাধি কিংবা বিভিন্ন ধরণের ক্যান্সারকে। রেডিও –ইমিউনো-অ্যাসের (RIA) উপকারিতা ভাইরাস –ব্যাক্টেরিয়ার অস্তিত্ব খোঁজার সীমা ছাড়িয়ে অপরাধ মূলক কাজের সুত্রে, আদালত সম্বন্ধীয় বিষয়ে, মাদক জাতীয় বস্তুর মাত্রা নির্ণয়ে সাহায্য করেছে। একথা ঠিক, প্রযুক্তির আধুনিকীকরণ প্রতি নিয়ত হয়ে চলেছে। এই শতকের প্রথম দিকেও RIA প্রয়োজনীয়তা থাকলেও গত এক দশকে আরো নতুন প্রযুক্তি যেমন এলাইসা, কেমিলুমিনিসেন্স পদ্ধতির ব্যবহার বেশি লক্ষ্য করা যাচ্ছে হরমোন , রোগ জীবাণু ইত্যাদির উপস্থিতি বা তাদের পরিমাণ জানার কাজে। তা বলে রোসালিনের আবিষ্কৃত প্রযুক্তি RIA তার মূল্য হারায়নি, কারণ এ বিষয়ে সেটি প্রথম মৌলিক গবেষণা। পরবর্তী আধুনিক প্রকৌশলগুলি তাঁর ( এবং সলোমন বারসনের) প্রতিষ্ঠিত মূল ধারণা অবলম্বন করে, সময়ের দাবি মেনে সামান্য কিছু অদল –বদল করে চলেছে । সে তালিকায় ইদানিং কালের কোভিড -১৯ সনাক্তকরণের জন্য র্যাপিড অ্যান্টিজেন টেস্ট বা RAT এর নাম করা যায়।
কলেজে পড়ার সময় ১৯৩৯ সালের জানুয়ারি মাসে , নোবেল লরিয়েট এনরিকো ফারমির বক্তৃতা থেকে রোসালিন জানলেন সদ্য আবিষ্কৃত নিউক্লিয়ার –ফিশন বা পদার্থের পরমাণুর ভেতর অবস্থানকারী নিউক্লিয়াসের ভাঙন থেকে প্রাপ্ত অপার শক্তির কথা। এই আবিষ্কারের ফলে অবশ্য পৃথিবীতে ভয় –ধ্বংসের ঘটনা ঘটেছিল , আবার রোগের পরীক্ষার জন্য রেডিও- আইসোটোপ পাওয়া সহজ –সাধ্য হয়েছিল। সম্ভব হয়েছিল আর কিছু শান্তিপূর্ণ প্রয়োগের ক্ষেত্রেও।
উত্তেজিত রোসালিন স্থির করলেন , ফিজিক্স নিয়েই তার ভাগ্য গড়বেন। ১৯৪১ সালে রোসালিন বি এ পাশ করলেন ফিজিক্স ( এবং কেমিস্ট্রি) নিয়ে । বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে তার মাস্টার অফ সায়েন্স পড়ার আবেদন কারণ না দেখিয়ে ফিরিয়ে নিল। একটাই মাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের অফিস থেকে বলা হল , সে একে মহিলা , তার ওপর ইহুদী, তাই কোন ক্ষেত্রেই আবেদন গ্রহণ করা যাবেনা। এই সব প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ করার জন্য রোসালিন নিজেকে প্রস্তুত রেখেছিলেন। পরবর্তী জীবনে এই বৈষম্য প্রসঙ্গে তিনি বলেছিলেন , এমন সমস্যা আমায় তেমন বিব্রত করতে পারেনি, আমি তো বুঝেই ছিলাম , এই বৈষম্যের সমস্যা আসলে বৈষম্যের নিজ বৈশিষ্ট্যের জন্য নয়, বরং যারা এর শিকার হয় , তারা নিজেদের দ্বিতীয় শ্রেণির মানুষ ভাবে।
সে সময়, হঠাত তার ভাগ্য ফিরে গেল। ইউনিভার্সিটি অফ ইলিনয় তাকে চিঠি দিয়ে জানাল তারা তাকে গ্রাজুয়েট ফিজিক্স প্রোগ্রামে স্থান দিতে রাজী। পড়ার জন্য টাকা লাগবেনা , আর মাসে সত্তর ডলার করে স্টাইপেন্ড পাবেন টিচিং আসিস্ট্যান্সশিপের জন্য। আসলে তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণে ইউনিভার্সিটিতে সিট খালি হয়েছে, ছাত্রেরা গেছে যুদ্ধের কাজে। ১৯৪২ সালে ইলিনয় ইউনিভার্সিটি থেকে এম এস পাশ করলেন। এবার গবেষণার জগতে পা রাখা চাই ।তেজস্ক্রিয়তা বা রেডিও-আক্টিভিটির প্রথম পাঠ তিনি পেয়েছিলেন কলেজ জীবনে 'মাদাম মারি কুরির’ রেডিও-অ্যাক্টিভিটির গবেষণা ঘেরা জীবনী পড়ে । গবেষণা শুরু হল খ্যাতনামা নিউক্লিয়র ফিজিসিস্ট মরিস গোল্ডহেবারের( Maurice Goldhaber) অধীনে। তাঁর সান্নিধ্যে এসে রোসালিন শিখলেন তেজস্ক্রিয় পদার্থের পরিমাণ নির্ণয় করার জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রের নির্মাণ কৌশল। পি এইচ ডির কাজ শেষ করে স্থির করলেন মেডিক্যাল ফিজিক্স নিয়ে আরও কাজ করবেন । মাদাম কুরি , আইরিন (Irene Curie) ও জোলিয়েট (Jean Frederich Joliot) তার চোখে অন্য আলো জ্বেলে দিয়েছে। এর মধ্যে রোসালিন পড়ে ফেলেছেন , ১৯৪৩ সালের নোবেল -লরিয়েট হাঙ্গারির ইহুদী বিজ্ঞানী রেডিও-কেমিস্ট জর্জ ডি হেভেসের (George de Hevesy )লেখা বই । তিনি নোবেল প্রাইজ পেয়েছিলেন রাসায়নিক বিক্রিয়ায়, বিশেষত প্রাণিদেহে রেডিও-আইসোটোপের ব্যবহার নিয়ে । কিছু যোগাযগের ভিত্তিতে ব্রঙ্কসের ভেটারানস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (VA) হাসপাতালের রেডিও-আইসোটোপ সার্ভিস বিভাগে একটি পদ পেলেন রোসালিন। ১৯৪৭ সালের ডিসেম্বরের এক হিমেল, তুষার-ঝড় ঘেরা দিনে চাকরি শুরু হল, ছোট্ট একটি অফিস তাকে দেওয়া হল। আর করিৎকর্মা রোসালিন দারোয়ানদের জন্য নির্দিষ্ট একটি শৌচাগারকে নিজের ভাবনা ও বুদ্ধিকে কাজে লাগিয়ে করে তুললেন তার ল্যাবরেটরি। রেডিও-আইসোটোপ দিয়ে বায়োমেডিক্যাল সায়েন্সে গবেষণা করতে চান অথচ তিনি বায়োলজির কিছু জানেন না। ছোট ছোট প্রজেক্টে কাজ শুরু করলেন । তার যন্ত্র-বিজ্ঞান বিষয়ে প্রকৌশলের ধারণাকে কাজে লাগিয়ে তেজস্ক্রিয়তা সনাক্তকরণের যন্ত্রের নকশা, পরিকল্পনা নিজে করলেন , তৈরি করলেন কার্যকরী যন্ত্র তথা রেডিয়েশন –ডিটেক্টার। বিপজ্জনক এবং মহার্ঘ রেডিয়াম , যা মুলত ক্যান্সার নিরাময়ে ব্যবহার করা হোত, তার পরিবর্তে রোসালিন খুঁজছিলেন মানুষের শরীরে এই রেডিও-আইসোটোপ প্রয়োগ করার জন্য একটি নিরাপদ পদ্ধতি। দু- তিন বছরের মধ্যে তাঁর আটটি মৌলিক গবেষণাপত্র প্রকাশিত হল।
কিন্তু শুধু যন্ত্র তৈরি করলেই হবেনা। মেডিক্যাল ফিজিক্স নিয়ে কাজ করতে হলে মানুষের শরীর সম্বন্ধে ভাল রকম ধারণা থাকতে হবে। এটি একটি আন্তঃশৃংখলিত বিষয়, একাধিক বিষয় জানতে হবে। রোসালিন শুরু করলেন চিকিৎসা-শাস্ত্র সম্পর্কে বইপত্র পড়া, কিন্তু একজন যোগ্য গবেষণার সঙ্গী যে চাই, যাকে তিনি ফিজিক্স শেখাতে পারবেন , আর বিনিময়ে নিজে শিখবেন মেডিসিন সম্পর্কে অজস্র তথ্য। এই সময়ে তাঁর কাজে সাহায্য করতে এলেন ডঃ সলোমন বারসন। দুবছরের মধ্যেই তাঁদের কাজের সম্পর্ক ভীষণ মজবুত হয়ে উঠল আর তারপর অসাধারণ বন্ধুতায় তাদের সম্পর্ক বাইশ বছর স্থায়ী হয়েছিল.। বারসন তাঁর জানার পরিধি চট করে বাড়িয়ে নিতেন , আর রোসালিন কাজ করতেন খুব দ্রুত অথচ নিখুঁত যুক্তি মেনে । রোসালিন ও বারসনের যৌথ গবেষণা শুরু হয়েছিল , পারস্পরিক কুশলী জ্ঞানের ওপর ভিত্তি করে। । তাদের প্রথম প্রোজেক্টটি ছিল ফসফরাস ও পটাশিয়াম এর রেডিও- আইসোটোপ ব্যবহার করে নিখুঁত ভাবে শরীরের ভেতরে রক্তের আয়তন মাপা। কিন্তু পরে তাঁরা প্রচলিত পদ্ধতির তুলনায় আয়োডিনের রেডিও- আইসোটোপকে কাজে লাগিয়ে অনেক নিখুঁত ভাবে রক্তের আয়তন মাপতে পেরেছিলেন । কিন্তু বিজ্ঞানে তাঁদের প্রথম বিশেষ অবদান ছিল , পরীক্ষার মাধ্যমে দেখানো কী করে রেডিও-অ্যাকটিভ আয়োডিন , রক্তের গ্লোবিউলিন ও অন্যান্য সিরাম প্রোটিনের সঙ্গে জোট বেঁধে সারা দেহে ছড়িয়ে পড়ে, পরে দেহ থেকে অপসারিত হয় । সিরাম প্রোটিন নিয়ে কাজের পাশাপাশি, তাঁরা দেখলেন কিভাবে থাইরয়েড গ্রন্থি আর কিডনি রক্ত থেকে আয়োডিন ধীরে ধীরে তাড়িয়ে দিতে পারে। একটি পদ্ধতির উদ্ভাবন তাঁরা করলেন যাতে একক সময়ে থাইরয়েড গ্রন্থি থেকে অপসৃত আয়োডিনের পরিমাণ নির্ণয় করা যায়।( থাইরয়েড গ্রন্থি আয়োডিনের সাহায্যে থাইরক্সিন বা সমজাতীয় হরমোন তৈরি করে)। তারা শিরার ভেতর দিয়ে আয়োডিনের রেডিও-আইসোটোপ (I-131) শরীরে প্রবেশ করিয়ে দেখলেন থাইরয়েড গ্রন্থি কিভাবে রক্ত থেকে আয়োডিন সংগ্রহ করে । অথবা অন্য ভাবে বলতে গেলে কী হারে রক্তের প্লাজমা থেকে তার পরিমাণ কমতে থাকে। এই পদ্ধতি ব্যবহার করে মাত্র ৩৫ মিনিটের মধ্যেই থাইরয়েড গ্রন্থির কার্যকারিতা যাচাই করলেন. একই ভাবে থাইরয়েড গ্রন্থির রোগ নির্ণয়, আয়োডিন কী করে শরীরের মধ্যে ব্যবহৃত হয় সে সব জানা গেল। এর আগে বিজ্ঞানীরা থাইরয়েড গ্রন্থির কার্যকারিতা যাচাই করতে রেডিও- অ্যাক্টিভ আয়োডিন মুখের ভেতর দিয়ে শরীরে প্রবেশ করাতেন । কিন্তু এখানে সেটি করা হলনা, প্রায় ১১০ জন মানুষের ওপর এই পরীক্ষা তারা করেছিলেন।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাঁদের কাজ বাঁক বদল করল। রোসালিনরা ভাবলেন আয়োডিনের এই রেডিও আইসোটোপের ব্যবহার করে যেমন থাইরয়েড গ্রন্থির হরমোন নিয়ে কাজ হয়েছে, এবার এই একই সংবেদী পদ্ধতিতে অন্যান্য ছোটখাট পেপ্টাইড হরমোন এর স্বল্প পরিমাণ নিখুঁত ভাবে নিশ্চয় মাপা যাবে । পেপটাইড তৈরি হয় কয়েকটি অ্যামাইনো অ্যাসিড জুড়ে । তাঁরা তাই মনোযোগ দিলেন ছোট আকারের পেপ্টাইড ইনসুলিন অণুর দিকে। কিন্তু দুজনের কারুরই ইনসুলিন নিয়ে তেমন কোন ধারণা নেই। ডাক্তারি পড়ার সুবাদে বারসনের ছিল শুধু কাজ চালানোর জন্য জ্ঞান । আর রোসালিনের সম্বল একটি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা । তার স্বামী আরন বারো বছর বয়স থেকে টাইপ ওয়ান ডায়াবেটিসে আক্রান্ত, যে রোগে শরীরে প্যানক্রিয়াস থেকে ইনসুলিন হরমোনের ঠিক মত ক্ষরণ হয়না। প্রতিদিন তাঁকে ইনসুলিন নিতে হয়। তখনকার দিনের মানুষ দেখেছিল থাইরয়েডের সমস্যার পরেই ডায়াবেটিস একটা খুব সাধারণ হরমোনের গোলমাল সম্পর্কিত ব্যাধি। অনেক মানুষকে এটি আক্রমণ করে। তাই ইনসুলিনের প্রয়োজন ব্যাপক, এর অভাবে মানুষের মৃত্যু হতে পারে। ১৯৫০ সালে গোরুজাতীয় প্রাণির শরীর থেকে পাওয়া ইনসুলিন ( বোভাইন ইনসুলিন) ব্যবহার করে মানুষের ডায়াবেটিসের চিকিৎসা করা হোত। অথচ ইনসুলিন শরীরে কিভাবে কাজ করে কেউ তেমন জানেনা। কিন্তু অন্যদিকে এই খুব ছোট আকারের পেপ্টাইড জাতীয় হরমোনটি সহজেই বিশুদ্ধ অবস্থায় সংগ্রহ করা যায়। তারা ইনসুলিনের ওপর পরীক্ষা শুরু করা মনস্থ করলেন। তখন সমাজে এমন ও দেখা গিয়েছিল যে কিছু কিছু ডায়াবেটিক রোগী ইনসুলিন ইঞ্জেকশন নিতেন , অথচ তাতে তেমন কাজ হোতনা। বিজ্ঞানীরাও দেখেছিলেন কিছু সময় পরে এইসব রোগীরা ইনসুলিনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। এই ব্যাপারে সরব হয়েছিলেন ড আই আরথার মারস্কি। ১৯৫২ সালে তিনি প্রস্তাব করেছিলেন বয়স্ক লোকের ডায়াবেটিস হওয়ার কারণ ইনসুলিন ক্ষরণের অভাব নয়, বরং শরীরের ভেতরেই যকৃত থেকে নিঃসৃত উৎসেচকের সাহায্যে অস্বাভাবিক দ্রুততার সঙ্গে এটির ভেঙ্গে যাওয়া।
ডঃ সলোমন বারসন
এই প্রস্তাবের পরীক্ষা করার জন্য রোসালিন ও বারসন ইনসুলিন অণুর সঙ্গে আয়োডিনের রেডিও-আইসোটোপ( Iodine-131 বা আয়োডিন -১৩১) সংযুক্ত করলেন । একে বলা হয় রেডিও - লেবেলিং । এই তেজস্ক্রিয় ইনসুলিন থেকে যে রশ্মি বেরোবে তার সাহায্যে ইনসুলিন অণুর গতিপথ সম্বন্ধে ধারণা করা যাবে। ধরা যাক যদি এই রশ্মিকে রোগীর মুত্র থেকে বেরোতে দেখা যায় , তার মানে দাঁড়াবে ইনসুলিন ভেঙ্গে গেছে আর পরমাণু Iodine-131 বেরিয়ে আসছে। ডায়াবেটিক ও নন–ডায়াবেটিক রোগীর রক্তে ইঞ্জেকশানের মাধ্যমে এই ইনসুলিন প্রবেশ করালেন। সবিস্ময়ে দেখলেন যে সমস্ত স্বাভাবিক মানুষ আগে কখনো ইনসুলিন গ্রহণ করেন নি , তাদের তুলনায়, যে সমস্ত রোগী ডায়াবেটিস হওয়ার কারণে বা অন্য কোনো কারণে - যেমন শক থেরাপি বা সিজোফ্রেনিয়ার চিকিৎসায়) ইনসুলিন আগে গ্রহণ করেছেন , তাদের রক্ত থেকে রেডিও লেবেল করা ইনসুলিন এর মাত্রা কমছেই না প্রায়। এর মানে মারস্কির মতবাদটি ভ্রান্ত। কিন্তু কী করে ঘটনাটি ঘটছে? দিনের পর দিন দুজনে ল্যাবরেটরিতে বসে আলোচনা করেন। বিভিন্ন পদ্ধতিতে রক্তের নমুনায় ইনসুলিনের পরিমাণ মাপেন, অবশেষে প্রমাণ মিলল।
.
রোসালিন ও বারসন অনুমান করেছিলেন ডায়াবেটিকদের শরীরের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা বা ইমিউ্ন –সিস্টেম নিশ্চয় অন্য প্রাণির দেহ জাত (মনুষ্যেতর ) ইনসুলিন গ্রহণ করার জন্য প্রতিরোধ ব্যবস্থা তথা অ্যান্টিবডি তৈরি করছে। ধীর গতিতে রক্ত থেকে রেডিও-লেবেল করা ইনসুলিনের মাত্রা কমে যাওয়ার কারণ, সম্ভবত শরীরে আগেই প্রবেশ করানো বহিরাগত ইনসুলিনের বিরুদ্ধে তৈরি হওয়া আন্টিবডির সঙ্গে রেডিও-লেবেল করা ইনসুলিনের জোট বেঁধে থাকা। এই বিক্রিয়ার ফলে শরীর ইনসুলিন নিয়ে দরকারি কাজ করতে পারছেনা।•এর থেকে দুই বিজ্ঞানী ধারণা করলেন বোভাইন ইনসুলিনের থেকে মানুষের ইনসুলিন এই রোগীদের জন্য কার্যকরী বেশি হবে, মানুষের শরীর থেকে সৃষ্ট ইনসুলিন ব্যবহার করা হলে এমনটা হোতো না। অনেক পরে ১৯৮৬ সালে মানবদেহের জন্য নির্দিষ্ট ইনসুলিন সংগ্রহ করা সহজ হয়েছে। এটি ছিল প্রথম সরাসরি পরীক্ষা যে ইনসুলিনের মত ছোট্ট প্রোটিন ( পেপ্টাইড) শরীরের ভেতরে ইমিউন -সিস্টেমকে উত্তেজিত করতে পারে। রোসালিন আর বারসনের আসল উদ্দেশ্য ছিল ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রোগীদের শরীর থেকে এই ইনসুলিনের অ্যান্টিবডি বা গামা গ্লোবিউলিন গুলোকে ( এক বিশেষ ধরণের গ্লোবিউলিন) আলাদা করে চিহ্নিত করা, আর তাদের পরিমাণ মাপা। সেই সময়ে, প্রচলিত ইমিউনোলজিক প্রকৌশল বা পদ্ধতি অ্যান্টিজেন এর বিরুদ্ধে তৈরি হওয়া অ্যান্টিবডির উপস্থিতি সনাক্ত করার জন্য যথেষ্ট ছিলনা। যেমন ইলেক্ট্রোফোরেসিস, অথবা সেই ধরণের পদ্ধতিতে এদের উপস্থিতি প্রমাণ করা গেলেও জলে দ্রবনীয় অ্যান্টিজেন-অ্যান্টিবডি যৌগ এর সনাক্তকরণের জন্য আরো সংবেদী পদ্ধতি ব্যবহার করার তাগিদে তাঁরা ব্যবহার করেছিলেন রেডিও-আইসোটোপ নির্ভর এই পদ্ধতি। তার ফলে দেখা গেল বাইরে থেকে অন্য প্রাণীর দেহজাত ইনসুলিন গ্রহণ করা মানুষের শরীরের সর্বত্র, এর বিরুদ্ধে তৈরি হওয়া অ্যান্টিবডি উপস্থিত । প্রমাণ হিসেবে তাঁরা দেখালেন রেডিওঅ্যাকটিভ আয়োডিন যুক্ত ইনসুলিন রক্তের মধ্যে এক বিশেষ গ্লোবিউলিন জাতীয় প্রোটিনের (গামা গ্লোবিউলিন) সঙ্গে যুক্ত অবস্থায় উপস্থিত। এই ধারণা অবশ্য গত শতকের পঞ্চাশের দশকের মধ্য ভাগে ইমিউনোলজিস্টরা মানতে চাননি। এই পরীক্ষায় প্রমাণিত হল, বোভাইন ইনসুলিনের ব্যর্থ হওয়ার কারণ, এবং ইনসুলিনের মত ছোট পেপ্টাইড অণুর বিরুদ্ধেও শরীরের অ্যান্টিবডি তৈরি করার ক্ষমতা । আর তাঁদের এই পরীক্ষার মধ্য দিয়ে গড়ে উঠল জৈব বস্তুর ন্যূনতম পরিমাণ সনাক্তকরণের এক নতুন পদ্ধতি, যা প্রচলিত ইমিউনোলজিক পদ্ধতি করতে অপারগ ছিল এ পদ্ধতির নাম তাঁরা দিলেন রেডিও-ইমিউনো অ্যাসে। এর আগে কেউ রেডিও-আইসোটোপ ব্যবহার করে কোন দ্রবণে অ্যান্টিজেন –অ্যান্টিবডির প্রাথমিক বিক্রিয়া দেখাতে পারেনি। যা সচরাচর দেখা যেত , তা হলো অ্যান্টিজেন- অ্যান্টিবডির বিক্রিয়ার দরুন দ্রবণে অধঃক্ষেপ পড়া, বা দানাদার জমাটবদ্ধ বস্তু দেখতে পাওয়া। এমন পরীক্ষালব্ধ প্রমাণেও বৈজ্ঞানিক মহল সন্দিহান রইলেন। তারা ভাবলেন পুরোটাই গাঁজাখুরি, এসব কিচ্ছু ঘটেনি। ১৯৫৫ সালে তাঁদের মূল গবেষণা-পত্র প্রত্যাখ্যান করল জার্নাল অফ সায়েন্স এবং জার্নাল অফ ক্লিনিক্যাল মেডিসিন।
কয়েক মাস ধরে অনেক তর্ক, আপোসের পর, গবেষণা পত্রের শিরোনাম বদলে দেওয়ার পর, ১৯৫৬ সালে গবেষণাপত্র গৃহীত হল। এ ঘটনা রোসালিনের মনে ভীষণ তিক্ত স্মৃতি রেখে দিয়েছিল।
অন্যান্য বিজ্ঞানীরা হয়তো এই ইনসুলিন অ্যান্টিবডির কাজটি নিয়েই সারাজীবন কাটিয়ে দিতেন। কিন্তু তাঁরা রোগীর রক্ত থেকে অ্যান্টিবডির পরিমাণ মাপার পাশাপাশি দেখতে চাইলেন , ইনসুলিনকেও কী করে মাপা যায়। ১৯৫৬ সাল থেকে তিন বছর ধরে গবেষণা করার পর ১৯৫৯ সালে প্রথম মানুষের রক্ত থেকে নির্ভুল ভাবে ইনসুলিনের পরিমাণ নির্ণয় করতে পারলেন। এই প্রথম মানুষের শরীর থেকে সরাসরি নয়, টেস্ট টিউবে গৃহীত রক্তের নমুনা থেকে ইনসুলিনের পরিমান মাপা গেল, এবং তেজস্ক্রিয় বিকিরণের সম্মুখীন না করিয়েই।
১৯৫৯ সালে তাঁদের এই শ্রমসাধ্য গবেষণাটি প্রকাশিত হল বিখ্যাত নেচার পত্রিকায়। বিজ্ঞানের ইতিহাসে এই গবেষণা পত্রটির গুরুত্ব অপরিসীম । রোসালিন ও বারসন প্রথম জানালেন 'টাইপ টু ডায়াবেটিসে' আক্রান্ত রোগীর শরীরে ইনসুলিনের ক্ষরণ বেশি হয়, ডায়াবেটিক নয় এমন মানুষের থেকে তাদের রক্তেও ইনসুলিন এর মাত্রা বেশি থাকে, কিন্তু রোগীর শরীর এই ইনসুলিনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলে এটিকে ব্যবহার করতে পারেনা। টাইপ টু ডায়াবেটিসে ইনসুলিন এর সম্পর্কে এই সাড়া না দেওয়ার ব্যাপারটি কিন্তু এখন প্রতিষ্ঠিত সত্য। তাই এই ধরণের রোগীর চিকিৎসায় কৌশলী খাদ্য গ্রহণ , ব্যায়াম আর গ্লুকোজের প্রতি সুগ্রাহী বা সংবেদনশীল কিছু ওষুধের ব্যবহার করতে হয়। গত শতকের ষাটের দশকে রোসালিন এবং বারসন তাঁদের গবেষণাকে আরো সুক্ষ্মতর পর্যায়ে নিয়ে গেলেন। RIA টেকনিকের সাহায্যে রোসালিন বারসন ও তাদের সহযোগী গবেষকেরা আরো কিছু হরমোন মাপতে পারলেন। হরমোন ও ভাইরাস নিয়ে গবেষণায় এক নতুন পৃথিবী খুলে গেল। সদ্যোজাত শিশুর থাইরয়েড গ্রন্থির কাজে ঘাটতি অনুসন্ধান করা সম্ভব হল। এর ফলে যথাযথ চিকিৎসার মাধ্যমে তাদের মস্তিষ্কের স্বাভাবিক বৃদ্ধি এবং বিকাশের পথ খুঁজে দেওয়া গেল। অন্য গবেষকেরা এটি ব্যবহার করে বন্ধ্যাত্বর - এর কারণ অনুসন্ধান করে শরীরের মধ্যে বিশেষ স্টেরয়েড জাতীয় যে যে হরমোন তৈরি হচ্ছে সে সম্বন্ধে ধারণা করতে পারলেন। RIA টেকনিক যেমন একদিকে হরমোনের আধিক্য অথবা ঘাটতি জনিত অসুখগুলিকে চিহ্নিত করল , তেমনি দেহের ভেতরে পেপ্টিক আলসারের কিংবা হরমোন ক্ষরণকারী ক্যান্সারের অস্তিত্ব জানিয়ে দিল। সে সময়ে ব্লাড- ট্রান্সফিউসান বা রক্ত-সংবহনের একটা প্রধান সমস্যা ছিল হেপাটাইটিস ভাইরাসের সংক্রমণ। রক্তের মধ্যে হেপাটাইটিস ভাইরাস এর উপস্থিতি সহজে সনাক্ত করা গেল। গত শতকের সত্তরের দশকের শুরুতেই RIA পদ্ধতি অত্যন্ত বিশ্বাসযোগ্য বলে বৈজ্ঞানিক মহলে আন্তর্জাতিক স্তরে স্বীকৃত হল। বিভিন্ন জার্নাল এটির প্রয়োগকে কেন্দ্র করে অজস্র গবেষণা পত্র প্রকাশ করতে উৎসুক হয়ে উঠল। এর ফলে চিকিৎসা শাস্ত্রের গবেষনায় এন্ডোক্রিনোলজি বা হরমোন –বিদ্যা একটি স্বতন্ত্র শাখা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করল। আরো পরে জন্ম হল আরেক শাখা , যার নাম নিউরো –এন্ডোক্রিনোলজি, যার মাধ্যমে জানা গেল মস্তিষ্ক থেকে ক্ষরিত বিভিন্ন রাসায়নিক কিভাবে অন্যান্য হরমোনের কাজকে প্রভাবিত করে।
১৯৭২ সালে বারসনের মৃত্যুর পর রোসালিন কাজের গতি আরো বাড়িয়ে দিলেন । আবিষ্কার করলেন আরো কিছু হরমোন যা একই সঙ্গে দেহের অন্ত্র এবং মস্তিষ্ক থেকে ক্ষরিত হতে পারে। ১৯৭৭ সালে পেলেন প্রার্থিত নোবেল প্রাইজ। আমেরিকার মহিলাদের মধ্যে ফিজিওলজি ও মেডিসিন বিভাগে নোবেল প্রাপক হিসেবে দ্বিতীয় নারী বিজ্ঞানী ছিলেন রোসালিন ইয়েলো।
সারা জীবন অজস্র পুরস্কারে সম্মানিত হয়েছেন— নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তিতে তাঁর কাজের গতি কমে গেলনা। ছাপ্পান্ন বছরের লড়াকু নারীটি ব্রংক্সের সাধারণ মানের ল্যাবরেটরিতেই গবেষণার কাজ অব্যাহত রাখলেন। সারা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে RIA –র ব্যবহার নিয়ে ট্রেনিং দিতে রোসালিন নিজে এগিয়ে এসেছেন । ১৯৭৭ সালে, নোবেল প্রাইজ পাওয়ার পর পরই ভারতে এসেছিলেন, ভাবা আটমিক রিসার্চ সেন্টারে। অডিটোরিয়ামে প্রায় এক হাজারের বেশি মুগ্ধ বিজ্ঞানী শ্রোতার সামনে এই পদ্ধতির ভবিষ্যত নিয়ে আলোচনা করলেন, কীভাবে সংক্রামক রোগ সনাক্ত করতে এটি ব্যবহার করা যাবে।
১৯৯১ সালে ৭০ বছর বয়সে রোজালিন ভি এ হাসপাতালে তাঁর প্রায় ৪৪ বছরের কর্মজীবন থেকে অবসর নিলেন। অবসৃত জীবনে তিনি নিজেকে ব্যস্ত রেখেছিলেন বিজ্ঞানের নীতি প্রণয়নে, পোস্ট ডক্টোরাল ফেলোদের, বিশেষত যারা তৃতীয় বিশ্বের দেশ থেকে এসেছে, তাদের কাজে সহায়তা করায়, এদের সবার কাছে তিনি ছিলেন যেন এক মা । স্কুলের মেয়েদের বিজ্ঞান পড়ার জন্য, বিজ্ঞানে কেরিয়র করার জন্য খুব উৎসাহ দিতেন। নিজের কাজের সফলতা নিয়ে তাঁর আত্মপ্রত্যয় থাকলেও RIA কে পেটেন্ট নেবার কথা ভাবেন নি কখনো। আর এ কাজ না করার জন্য তাঁর মনে কোন অনুশোচনা ছিলনা। ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত তিনি লিখেছেন পাঁচশোর বেশি গবেষণাপত্র। তারপর দীর্ঘ কাল অসুস্থ হয়েছিলেন।
২০১১ সালের ৩০শে মে নিউইয়র্কের ব্রঙ্কস অঞ্চলে এই বিজ্ঞানীর জীবনাবসান হয়। রোসালিনের জীবন সর্বার্থেই আর্থ –সামাজিক ভাবে এক পিছিয়ে পড়া শ্রেণির প্রতিনিধির বর্ণময় দিনলিপি। যে জীবন উপেক্ষা করেছে, সমাজের বেঁধে দেওয়া হিসেবে শ্রেণিগত অথবা লিংগগত কারণে সংস্কার, অথবা অসাম্য, যে জীবন পুরুষ কেন্দ্রিক পেশায় অজস্র প্রতিবন্ধকতাকে মাড়িয়ে নক্ষত্রের মত উদ্ভাসিত হয়েছিলেন, অজস্র পুরস্কার সম্মাননায় জীবদ্দশাতেই যিনি হয়ে উঠেছিলেন এক কিংবদন্তী নারী ।
ছবিঃ সায়েন্সহিস্ট্রি ডট অর্গ, নোবেলপ্রাইজ ডট অর্গ, উইকিপিডিয়া