মা যখন রান্না ঘরে রান্না নিয়ে ব্যস্ত থাকেন তখন সেখানে ঘুর ঘুর করতে ভালই লাগে। ঠিক কিনা বল?
এখন একবার রান্নাঘরে ঢুঁ মারলে কেমন হয়? দেখত মা কি করছেন? বোধ হয় কেটলি করে চায়ের জল চাপিয়েছেন গ্যাসের উপর। চল দেখি কেটলিটাকে নজর করি !
কিছু শুনতে পাচ্ছ? না, কিছুই শোনা যাচ্ছে না তো ! আরে ও কি? ছুই-ই-ই করে একটা শব্দ হল না? হ্যাঁ, ওই তো আর একটা হল। শব্দটা একটু পরেই মিলিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু খেয়াল করে দেখ, একটা মিলিয়ে যেতে না যেতেই আর একটা শুরু হচ্ছে। আর ক্রমশঃ শব্দের সংখ্যা বাড়তে থাকছে।
এরকম ভাবে অসংখ্য শব্দ একসাথে তৈরি হচ্ছে আর মিলিয়ে যাচ্ছে। এর ফলে একটা 'গুন গুন' আওয়াজ বের হচ্ছে কেটলি থেকে। এই আওয়াজটা ক্রমাগত বেড়ে বেশ জোরে শোঁ -শোঁ শব্দ তৈরি করল। কিন্তু আশ্চর্যের কথা হল এই শব্দটা বেশিক্ষন না থেকেই অন্য রকম একটা 'ফর-র-র, ফর-র-র' আওয়াজ শুরু হল। এর তীব্রতা আগের থেকে অনেক কম।
এই আওয়াজটা শুনে মা বলবেন " জলটা ফুটে গেছে, চা ভেজাতে হবে..." - কি মনে হচ্ছে? জল ফোটার সঙ্গে আওয়াজের একটা সম্পর্ক আছে? ঠিক তাই। আর একটা বিষয় লক্ষ্য করার আছে। কেটলির মুখটা দেখ একবার। কি রকম গোল গোল করে সাদা ধোঁয়া বেরচ্ছে। ধোঁয়া বললাম বটে আসলে কিন্ত ওটা মোটেই ধোঁয়া নয়। ওটা কি তাহলে?
ওটা হল বাষ্প বা জলীয় বাষ্প। ঠিকমত ভাল করে দেখত সবটাই সাদা বাষ্প কিনা! না, কেটলির ঠিক মুখটার কাছে কোন সাদা ত দেখা যাচ্ছেই না, এমনকি কোন কিছু আছে বলেই মনে হচ্ছে না।
এসবের কারন জানতে ইচ্ছে করছে? তাহলে জেনেই নি ব্যপারটা , চল।
গ্যাসের আঁচে যখন জল গরম হচ্ছে তখন প্রথমেই গরম হচ্ছে কেটলির একেবারে তলাকার স্তরের জল। ফলে কেটলির তলায় তৈরি হচ্ছে জলীয় বাষ্পের ছোট ছোট বুদবুদ। ওগুলো বাতাসের বুদবুদ নয় কিন্তু ! বুদবুদ গুলো তো জলের থেকে হাল্কা, তাই ওরা জল ঠেলে ওপরের দিকে উঠতে থাকে। এদিকে ওপরের জল তো বুদবুদ গুলোর তুলনায় ঠাণ্ডা । তাই তারা ঠাণ্ডা জলের মধ্যে এসে চুপসে ছোট হতে থাকে এবং শেষ পর্যন্ত চুপসে একদম মিলিয়েই যায়! এই সময়েই "ছুঁইইই" করে শব্দ হয়।
জল যত বেশি গরম হবে তত বেশি বুদবুদ তৈরি হবে। আর তত বেশি করে শব্দ বেড়ে যাবে। এক সাথে অনেকগুলি শব্দ মিলে 'শন শন' আওয়াজ ছাড়ে।
সবটা জল যখন গরম হয়ে যায় তখন ঠাণ্ডা জল থাকেনা। বুদবুদ গুলিরও চুপসে যাওয়ার কোন কারন থাকেনা। সেগুলি সোজা ওপরে উঠে বড় হতে থাকে এবং শেষ পর্যন্ত ফটাস করে ফেটে যায়। ফটাস বললাম বটে তবে তত জোরে শব্দ হয় না। "ফড়" করে শব্দ হয় মাত্র। অনেকগুলো বুদবুদ অনবরত ফাটতে থাকার ফলে "ফড়ফড়" শব্দ তৈরি হয়। ব্যপারটা বোঝা গেল?
"ফড়ফড়" তো বোঝা গেল, কিন্তু সাদা ধোঁয়ার কি হল?
তোমরা বিজ্ঞান বই তে পড়ে থাকবে যে বাতাসে জলীয় বাষ্প আছে। আমরা সেই বাষ্প কি দেখতে পাই? পাই না কারন বাষ্প দেখা যায় না। আমাদের কেটলিটাতে জল ফুটে বাষ্প তৈরি হয়ে নলের মুখ দিয়ে বাইরে আসছে। বাইরে এসেই ঠাণ্ডা বাতাসের ছোঁয়ায় জলকণায় পরিণত হচ্ছে। সেটাই সাদা ধোঁয়ার মত দেখাচ্ছে।
নলের বাইরে যে ছোট্ট জায়গায় সাদা ধোঁয়া দেখা যায় না সেই জায়গার বাষ্প কেটলির খুব কাছে থাকায় ঠাণ্ডা হতে পারে না, আর তাই আমরাও দেখতে পাই না।
কেটলির গান শুনতে শুনতে বাষ্পের কথাও জানা হল। তাহলে বাষ্পের কথা আর একটু শুনতে বিশেষ আপত্তি হবে না বোধ হয়। শীতের সকালে খুব শীত পড়লে কথা বলার সময় মুখ দিয়ে ভকভক করে সাদা ধোঁয়া বার হয় সেটা লক্ষ করেছ তো? সেটার কারণ ও কেটলির বাষ্পের মত।
আমাদের শরীর টা গরম এবং নিঃশ্বাস বায়ু নাক মুখ দিয়ে বেরোবার সময় প্রচুর গরম জলীয়বাষ্প বার হয়। সেটা বাইরে এসেই ঠাণ্ডায় জমে জলবিন্দুতে পালটে যায়। তাই সাদা দেখায়।
দেখ, গল্পে গল্পে কেমন কতগুলো বিজ্ঞানের কথা জেনে ফেললে!!
সন্তোষ কুমার রায়
রূপনারায়ণপুর, বর্ধমান