খেলাঘরখেলাঘর

FacebookMySpaceTwitterDiggDeliciousStumbleuponGoogle BookmarksRedditNewsvineTechnoratiLinkedin

পুষুর দুঃস্বপ্ন

আলমারির তাকে থরে থরে সাজানো মধুভর্তি বয়ামগুলোর দিকে তাকিয়ে পুষুর দু চোখ চকচকিয়ে উঠলো। 'কি মজা, দশ-দশটা বয়ামভর্তি মধু' - নিজের অজান্তেই হাততালি দিয়ে উঠল পূষু।


বাঘা ছিল পাশেই। বললো-'হুম, খুব মজা। কিন্তু দেখিস, লালহাতিয়াটা এসে আবার রাত্তিরে সব সাবাড় না করে ফেলে।'


'সেই ভয়ংকর লালহাতিয়াটা?' - পুষু চোখ বড় বড় করে ফেললো।


'ব্যাটা এক নম্বরের লোভী' - বাঘা বললো। 'তুমি কি দেখেছো ওকে?' 'না',বাঘা বললো,'কিন্তু দেখিনি বলেই কি আর ভয়টা কমে যায় না কি? দেখতে পাচ্ছি না বলেই তো আরও সাবধান হতে হবে। ব্যাটা কোথায় গা ঢাকা দিয়ে আছে কে জানে?'


পুষু বললো,'আমি সাবধানেই থাকবো, তুমি চিন্তা কোরো না।'


'হুমমমমম', গরগর করলো বাঘা,' তাহলে এখন আমি চলি'।


পুষু দরজা বন্ধ করে খাটে এসে উঠলো। মস্ত বড় ফাঁকা বাড়িটায় একলা পুষু জেগে রইলো। নাক পর্যন্ত লেপ চাপা দিয়ে মিটিমিটি চেয়ে দেখতে লাগলো লালহাতিয়াটা ঢুকে পড়ে কিনা। চেয়ে থাকতে থাকতে, চেয়ে থাকতে থাকতে ঘুমে চোখ বুজে এলো পুষুর।


এমন সময়, হটাত, সারা বাড়িটা উঠলো কেঁপে, যেন ছাতের উপর বাজ পড়েছে। হুড়মুড় করে দরজা ভেঙ্গে একটা মস্ত লালহাতিয়া দুমদাম করে ঘরে ঢুকে পড়লো। থালা বাসন ঝনঝনিয়ে, পেয়ালা-পিরিচ ভেঙ্গে, বাতিদানটা উলটিয়ে ফেলে থপথপ করে সেটা এগিয়ে গেলো মধুভর্তি আলমারির দিকে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই গবগবিয়ে সাবড়ে দিলো তিনটে বয়ামভর্তি মধু।


পুষু ভ্যাঁক করে কেঁদে ফেললো।


কান্নার আওয়াজে লালহাতিয়াটা ঘুরে দাঁড়ালো পুষুর দিকে।ক্যাটকেটে সবুজ রঙের ঘোলা চোখ দিয়ে কটমট করে চাইলো। সুরুত করে নীল শুঁড় বার করে পুষুর সর্বাঙ্গ শুঁকলো। 'আহা, এবার তো তোকে খাবো'। বলেই একটা খালি বয়াম পুষুর মাথায় উলটে দিলো।


ভয়ের চোটে খাট থেকে লাফ মেরে নীচে নামলো পুষু। দুহাত দিয়ে ঠেলে খুলে ফেলতে চাইলো বয়ামটা - কিন্তু বয়ামটাতো আর নেই মাথায়?! আর লালহাতিয়াটা? সেটাই বা কোথায় গেলো?


'কোথায় লুকোলো ভয়ংকরটা?' পুষুর মনে একরাশ দুশ্চিন্তা। ভয়ে খুঁজতেও পারছে না সে কোনোখানে। ভয়টাকে কোনোরকমে চাপা দিয়ে উর্ধ্বশ্বাসে ছুটলো কচিকাঁচার বাড়ির দিকে।


'ভাইরে, বাঁচা আমাকে' হাঁপাতে হাঁপাতে বললো পুষু, কোনোরকমে। 'কি হয়েছে-এত রাতে?' ঘুমের ঘোরে দুচোখ রগড়াতে রগড়াতে শুধোলো কচিকাঁচা। 'একটা সা-সাং-ঘাতিক ল-লালহাতিয়া!' জিভ টিভ জড়িয়ে একশা পুষু তখন।


ঘুম ছুটে গেলো কচিকাঁচার। তার আর তখন ভাবার সময় কোথায়? একছুট্টে পুষুর হাত ধরে বেরিয়ে এলো সে ওই অত রাতে। ভালো করে ভেবে দেখার সময় পেলে কি আর সে একটা সাংঘাতিক লালহাতিয়ার খোঁজে এভাবে বেরিয়ে আসতো?


বাড়ির সামনে এসে হাঁক পাড়লো পুষু-'কোথায় লুকিয়েছিস রে লালহাতিয়া? বেরিয়ে আয়।'


কচিকাঁচা পুষুর দরজার কোনা থেকে ঝাঁটাটা নিয়ে বনবন করে মাথার ওপর ঘোরাতে লাগলো।


'আচ্ছা পুষু', কচিকাঁচার যেন হঠাত ঘুম ভাঙ্গলো, 'যদি সত্যিই আমরা লালহাতিয়াটাকে দেখতে পাই, তাহলে কি করবো?'


তাইতো? তাইতো? তাইতো? ভেবে কুলকিনারা পেল না পুষু। 'তারচেয়ে চল, কেষ্টদাকে ডেকে আনি', কচিকাঁচা বললো।


'সেই ভালো'- হাঁপ ছাড়লো পুষু।


কেষ্টদা তখন নাক ডাকিয়ে ঘুমোচ্ছে। দুজনে মিলে ঠেলে তুললো অকে। 'পুষু', একটু যেন বিরক্ত গলায় বললো কেষ্টদা, 'তুই নিশ্চয়ই একটা যাচ্ছেতাই স্বপ্ন দেখেছিস। সত্যি সত্যি কোনো লালহাতিয়া নেই।' 'কি বলছো তুমি?' অভিমানী গলায় পুষু বললো,' ওই লালহাতিয়াটা আমার বিছানার পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলো। ওড় নীল শুঁড়টা দিয়ে আমাকে শুঁকছিলো। বললো আমাকে খেয়ে ফেলবে। আর তুমি বলছো সত্যি নয়?'


'ঠিক আছে', কেষ্টদা একটু নরম গলায় বললো,'তোর বাড়িতে যদি সত্যি সত্যি একটা লালহাতিয়া লুকিয়ে থাকে, তাহলে আমি আর কচিকাঁচা মিলে ওটাকে খুঁজে বার করবই।'


'আমরা? দুজনে মিলে?' ঢোঁক গিলে বললো কচিকাঁচা।


'হ্যাঁ রে ভীতুর ডিম', ধমকে বললো কেষ্টদা। 'বেশ, তাই হবে', কচিকাঁচা বললো।


সবাই মিলে লেফট-রাইট করতে করতে চললো পুষুর বাড়ির দিকে। তাড়াতেই হবে লালহাতিয়াটাকে।


বিছানার তলায় খুঁজলো। লালহাতিয়া নেই।
আয়নার পেছনে খুঁজলো। লালহাতিয়া নেই।
টেবিলক্লথ তুলে টেবিলের নীচে খুঁজলো। লালহাতিয়া নেই।
আলমারির দরজাটা খুললো। কী আশ্চর্য! দশটা বয়ামই তো থাকে থাকে সাজানো, ঠিক যেভাবে ঘুমোতে যাবার আগে সাজিয়ে রেখেছিলো পুষু।


কান চুলকোতে লাগলো পুষু। 'তাইতো, তবে ত স্বপ্নই দেখেছি। কিন্তু স্বপ্নটা বড্ড সত্যির মতো। কেন এরকম স্বপ্ন দেখলাম বলোতো ?'


'স্বপ্নগুলো মাঝে মাঝে সত্যি মনে হয়', বিজ্ঞের মত বললো কেষ্টদা। 'কিন্তু সেগুলো সব মনের মধ্যে দেখা দেয়, সত্যি সত্যি নয়।'


'কিন্তু', পুষু বললো,' আমি যদি ঘুমিয়েই ছিলাম, তাহলে মনের মধ্যে লালহাতিয়াটা ঢুকে পড়লো কি করে?'


'শোন পুষু', কেষ্টদা মাস্টারমশাইয়ের মতো গলায় বললো,' রোজ রাতে তুই যখন ঘুমোতে যাস, তখন তোর শরীরটাই শুধু ঘুমোয়, মগজটার অনেকখানি জেগে থাকে।'


'আর সেই জেগে থাকা মগজটাই তখন স্বপ্ন দ্যাখে, বুঝলি?' ফুট কাটলো কচিকাঁচা।


'ঠিক তাই। এমনিতে স্বপ্নরা খুব সুন্দর হয়, আর না হলে বোকা বোকা। জেগে উঠে আর কিছু মনে থাকে না। কিন্তু তুই যদি খুব ক্লান্ত হয়ে বা চিন্তা করতে করতে ঘুমোতে যাস, তাহলে সেই বোকা বোকা স্বপ্নগুলোই বিদ্ঘুটে আর ভয়ংকর হয়ে যায়।' কেষ্টদা ভাষণ শেষ করলো।


'আসলে আমি একটু বেশিই চিন্তা করছিলাম শুতে যাওয়ার সময়ে। আর ঘুমটাও যা জোর পেয়েছে - কিন্তু-' পুষু ভাবতে ভাবতে বললো।


কচিকাঁচা জোর করে পুষুকে বিছানায় গুঁজে দিলো।


'আচ্ছা, আবার যদি আমার মগজ ঘুমের মধ্যে লালহাতিয়াটাকে ফিরিয়ে আনে?'পুষু জিজ্ঞেস করলো।


'দ্যাখ', কেষ্টদা বললো,' স্বপ্নটা তো তোর নিজের। তুই-ই ঠিক করবি তুই কি করতে চাস। যদি লালহাতিয়াটা ফিরে আসে, সোজা ওর চোখে চোখ রেখে বলবি -এইও-খবরদার - এক্ষুণি এখান থেকে চলে যা।'


'লালহাতিয়া-পালা-লালহাতিয়া-পালা-লাল-' বিড়বিড় করতে করতে পুষু আবার ঘুমিয়ে পড়লো।


কচিকাঁচাকে সঙ্গে নিয়ে কেষ্টদা নিজের বাড়ির দিকে রওনা হলো।


এমন সময়ে, হঠাত, আবার সারা বাড়িটা উঠলো কেঁপে, যেন ছাদের ওপর বাজ পড়েছে। একটা মস্ত লালহাতিয়া থপথপ করে করে এসে দাঁড়ালো পুষুর বিছানার পাশে। 'হো হো'। চেঁচিয়ে উঠলো লালহাতিয়াটা।


'লালহাতিয়া -পালা-লালহাতিয়া-পালা-লালহা-'কোনরকমে বলতে পারলো পুষু।


লালহাতিয়াটা একটু ঘাবড়ে গেলো।'মানে?' শুধোলো সে।


'এক্ষুণি এখান থেকে চলে যাও।' কড়া গলায় বললো পুষু।


লালহাতিয়াটা কেমন যেন হয়ে গেলো। ওর শুঁড়ের আগায় ঠোঁটদুটো তিরতির করে কাঁপতে লাগলো। ওর চোখদুটো ভরে এলো জলে।


'কি হলো?' পুষু জিজ্ঞেস করলো অবাক হয়ে।


'আমার খুব খিদে পেয়েছে, একটু জলখাবার খুঁজতে এসেছিলাম। আর তুমি আমাকে তাড়িয়ে দিচ্ছো?' ফ্যাঁচফ্যাঁচ করে কেঁদে ফেললো লালহাতিয়া।


পুষুর মনটা ভারী খারাপ হয়ে গেলো। ঈশ, বেচারার খিদে পেয়েছে, আর সে কি না এমন চটেমটে কথা বললো ওর সঙ্গে?


'আমারও না কেমন খিদে খিদে পাচ্ছে', পুষু বললো,' একটু মধু খাবে নাকি আমার সঙ্গে?'


পুষু ওর ছোট্ট চেয়ারে বসতে দিলো লালহাতিয়াকে। অতবড় লালহাতিয়াটাকে ওইটুকু চেয়ারে কি মজার দেখাচ্ছিলো।কিন্তু সে ব্যাটার অ্যায়সা খিদে পেয়েছিল যে ও এসব খেয়ালই করেনি।


মধুর বয়াম চেটেপুটে শেষ করতে করতে এবার পুষু আর লালহাতিয়া দুজনে মিলে একটা চমতকার সুন্দর স্বপ্ন দেখলো।

 

 

পার্থ দাশগুপ্ত
গড়িয়া, কলকাতা