আমাদের দেশের প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য এবং উদ্ভিদ ও বন্যপ্রাণের বৈচিত্র্য সম্পর্কে স্কুলের বইয়ে নিশ্চয়ই পড়ছ? ভাষা ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্রের পাশাপাশি এই বিশাল জীববৈচিত্র্যও কিন্তু ভারতবর্ষের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সম্পদ। কোনও একটি অঞ্চলের প্রাকৃতিক অরণ্য সেই অঞ্চলকে কীভাবে রক্ষা করে, সবাই মোটামুটি জানি। গাছের শেকড় মাটিকে শক্ত করে ধরে রাখতে সাহায্য করে, ধ্বস আটকায়, বন্যা আটকায়, বৃষ্টির জল মাটির নিচে জমিয়ে রাখতে সাহায্য করে, মাটির উর্বরতা বাড়ায়। এছাড়া জ্বালানির কাঠ, শুকনো পাতা, বিভিন্ন ওষধি উপকরণ, ফুল ফল ইত্যাদি অরণ্যসম্পদের বিশাল সম্ভার তো মানুষের কাজে লাগেই, বহুযুগ ধরে। আফসোসের কথা হল, এই সবই আমরা বইয়ের পাতায় পড়লেও কার্যক্ষেত্রে অরণ্য সংরক্ষণ কতটা জরুরি তা অনেক দেশেরই শীর্ষকর্তারা খেয়াল রাখেন না। অরণ্যাঞ্চলের রাস্তাঘাট ইত্যাদির অপরিকল্পিত উন্নতি করতে গিয়ে, অথবা স্বার্থলোভী কিছু মানুষের ব্যবসায়িক সুবিধার্থে এমন কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়, যা আসলে অরণ্য এবং পরিবেশেরই ক্ষতি করে। আমাদের দেশও ব্যতিক্রম নয়।
হিমালয় পার্বত্য অঞ্চলের প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষার জন্য এই অঞ্চলের অরণ্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়ে এসেছে বরাবর। সেই প্রাকৃতিক অরণ্যকে যথেচ্ছভাবে ধ্বংস করে অপরিকল্পিত নগরায়নের মতো ভুল মানুষ বারবার করে, এবং ভুলের মাশুল গুনতে হয় বহু নিরীহ মানুষকে। আমরা জানি উত্তরাখণ্ডে ২০১৩ সালের ভয়াবহ বন্যার কথা। তারও অনেক আগে, ১৯৭০ সালে অলকানন্দা নদীর বন্যায় বদ্রীনাথের কাছ থেকে হরিদ্বার পর্যন্ত বিস্তীর্ণ অঞ্চলের বহু গ্রাম জনপদ নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল। কেবল তাই নয়, ওই অঞ্চলে মাঝেমাঝেই ভূমিধ্বসের মতো দুর্ঘটনা ঘটতে থাকে, যার প্রধান কারণ ছিল প্রাকৃতিক অরণ্য ধ্বংস করে যথেচ্ছভাবে শুরু করা নগরায়নের বিভিন্ন প্রকল্প, এবং স্থানীয় অরণ্য ছেদনের জন্য বহিরাগত ব্যবসায়ীদের অনুমতি দেওয়ার মতো কিছু সরকারি প্রথা।
এর প্রতিবাদে, এবং তৎকালীন সরকারি নিয়ম অনুযায়ী বহিরাগত ব্যবসায়ীদের জন্য জঙ্গল নিলামের প্রথার বিরুদ্ধে স্থানীয় মানুষ ধীরে ধীরে আন্দোলন শুরু করছিলেন। সেই আন্দোলনই বিশাল আকারে শুরু হয় ১৯৭৪ সাল থেকে। ১৯৭৪ সালের ২৫ মার্চ গাঢ়োয়াল হিমালয়ের অন্তর্গত উত্তরাখণ্ডের রেনি গ্রামে ঠিকাদারের লোকজন গাছ কাটতে এলে শ্রীমতী গৌরা দেবীর নেতৃত্বে গ্রামের মহিলারা গাছ কাটার কাজে প্রতিবাদ করে এগিয়ে আসেন। ঠিকাদারের লোকদের সঙ্গে আলোচনায় কোনও কাজ না হলে মহিলারা অরণ্য রক্ষার তাগিদে একেকটি গাছকে জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে থাকেন। শুরু হয় পরিবেশরক্ষার আন্দোলনের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়, চিপকো আন্দোলন। হিন্দি শব্দ 'চিপকো'র অর্থ হল hug বা জড়িয়ে ধরা। মূলত মহিলাদের হাত ধরে শুরু হওয়া এই আন্দোলনকে আরও বড় পরিসরে নিয়ে যাওয়ার জন্য, এবং দেশের মানুষকে অরণ্যরক্ষার জন্য দায়বদ্ধ করার জন্য যিনি আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলেন তিনি হলেন পরিবেশবিদ সুন্দরলাল বহুগুণা। কোভিড -১৯ অতিমারি সম্প্রতি এই প্রবীণ পরিবেশবিদকে কেড়ে নিয়েছে। ইচ্ছামতীর পাতায় আজ রইল তাঁর কর্মকাণ্ড নিয়ে কিছু কথা।
১৯২৭ সালের ৯ জানুয়ারি উত্তরাখণ্ডের তেহরির কাছে মারোদা গ্রামে সুন্দরলাল বহুগুণার জন্ম। মহাত্মা গান্ধীর আদর্শ দ্বারা অনুপ্রাণিত ছিলেন তিনি, কৈশোর থেকেই বিভিন্ন সমাজসেবামূলক কাজে জড়িয়ে থাকতেন। অস্পৃশ্যতার বিরুদ্ধে লড়াই, পরবর্তীকালে মাদক-বিরোধী অভিযানে স্থানীয় মহিলাদের সামিল করা, এবং অবশ্যই অরণ্য ধ্বংসের প্রতিবাদে আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া, এসবে বহুগুণা আজীবন জড়িয়ে থেকেছেন। কল্যাণমূলক প্রতিটি কাজেই তিনি পাশে পেয়েছিলেন স্ত্রী শ্রীমতী বিমলা বহুগুণাকে। বিমলা নিজেও ছিলেন গান্ধীজীর আদর্শে অনুপ্রাণিত, এবং মানুষের কল্যাণের জন্য কাজ করা ছিল তাঁর মূল ব্রত। বিয়ের পর উত্তরাখণ্ডের সিলিয়ারা গ্রামে তাঁরা বসবাস শুরু করেন, এবং সেখানে গড়ে তোলেন নবজীবন মণ্ডল আশ্রম। আশ্রমের যাবতীয় দায়িত্ব সামলানো, স্থানীয় মহিলাদের অরণ্যরক্ষার কাজে সংগঠিত করা, তাঁদের নেতৃত্ব দেওয়ার মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজে বিমলা বহুগুণা নিজেকে নিয়োজিত করেছেন।
গান্ধীজীর আদর্শে দীক্ষিত সুন্দরলাল বহুগুণা ও তাঁর সঙ্গীরা মাঝেমাঝেই হিমালয় পার্বত্য অঞ্চলের গ্রামগুলিতে এবং অরণ্যাঞ্চলে পদযাত্রা করতেন। পায়ে হেঁটে ঘোরার সময় বিভিন্ন মানুষের সংস্পর্শে এসে, জঙ্গল ধ্বংসের ছবি চোখের সামনে দেখে তাঁর কাছে স্পষ্ট হয় মুষ্টিমেয় কিছু মানুষের লোভ এবং অপরিকল্পিত নগরায়নের ধাক্কায় হিমালয়ের অরণ্য কীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, ধীরে ধীরে ওই অঞ্চলের প্রকৃতি ও মানবজীবনের ওপর নেমে আসছে ধ্বংসের ছায়া। এরপর তিনি বিভিন্নভাবে স্থানীয় মানুষদের বোঝাতে থাকেন অরণ্যরক্ষার তাৎপর্য। পার্বত্য গ্রাম শহরগুলির অপরিকল্পিত তথাকথিত 'আধুনিকীকরণ', যত্রতত্র রাস্তা তৈরির জন্য জঙ্গল কেটে ফেলা, এসব যে আসলে প্রকৃতির ক্ষতি, মানুষের ক্ষতি ছাড়া আর কিছুই নয়, সেকথা মানুষকে বোঝানোর জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ নেন। বিভিন্ন সময়ের পদযাত্রাগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল ১৯৮১ থেকে ১৯৮৩ এই সময়ের মধ্যে কাশ্মীর থেকে কোহিমা পদযাত্রা।
১৯৭৪ সালের ২৫ মার্চ মহিলাদের নেতৃত্বে যে চিপকো আন্দোলনের সূচনা হয়, তাতে যোগ দিয়ে আন্দোলনকে অন্য এক মাত্রা দেন বহুগুণা। আন্দোলনের স্লোগান তৈরি করেন তিনি, "Ecology is permanent economy." ‘সুস্থ পরিবেশই একমাত্র স্থিতিশীল অর্থনীতি’। দীর্ঘ পাঁচবছর অরণ্যরক্ষার জন্য আন্দোলন চলার পর জয় আসে। তৎকালীন সরকার ওই অঞ্চলে প্রাকৃতিক অরণ্য ছেদনের ওপর পনেরো বছরের নিষেধাজ্ঞা জারি করে।
কেবল চিপকো আন্দোলনই নয়, অরণ্য এবং প্রকৃতি রক্ষার জন্য সংগঠিত যেকোনও আন্দোলনেই যোগ দিয়েছেন সুন্দরলাল বহুগুণা। প্রবল শক্তিধর মুনাফালোভী সম্প্রদায়ের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে বারবার সত্যাগ্রহের পথে আন্দোলন করেছেন তিনি ও তাঁর সঙ্গীরা। অনশন সত্যাগ্রহ, গ্রেপ্তার, মুক্তি পেয়ে আবার একই পথে আন্দোলন, বহু বছর এই পথে চলেছে তাঁর প্রতিবাদ। তেহরি তে গঙ্গানদীর ওপর তেহরি ড্যাম প্রকল্পের বিরুদ্ধে বহুবছর ধরে সত্যাগ্রহ আন্দোলন করেছেন তিনি, দিনের পর দিন অনশন করেছেন, কারাবরণ করেছেন। শুনতে কী অদ্ভুত লাগে, না? প্রকৃতিকে রক্ষার কাজে আজীবন ব্রতী যে মানুষটিকে দেশের সরকারের পক্ষ থেকে পদ্মশ্রী ও পদ্মবিভূষণ পুরস্কারে ভূষিত করা হয়, পরিবেশ রক্ষার আন্দোলনে সামিল হওয়ার জন্য সেই মানুষটিকেই দেশের আইনব্যবস্থার নির্দেশে কারাবাসেও যেতে হয়! যদিও পদ্মশ্রী পুরস্কার তিনি প্রত্যাখ্যান করেছিলেন।
সুন্দরলাল বহুগুণার জীবন থেমে গেছে প্রকৃতির নিয়মেই। কিন্তু তাঁর প্রায় সত্তর বছরের কর্মকাণ্ড থেকে আমরা কিছু শিক্ষা নিয়েছি কি? হিমালয়ের প্রত্যন্ত গ্রামে বসে 'পাহাড়ের বিশুদ্ধ সৌন্দর্য' দেখার আশায় যেভাবে আমরা হন্যে হয়ে নতুন ট্রাভেল ডেস্টিনেশন খুঁজে চলি, এবং সেখানে পৌঁছেও যেভাবে নাগরিক আরামে থাকব বলে দাবি জানাতে থাকি, কিংবা সমুদ্রের উপকূলে একটার পর একটা প্রাকৃতিক অরণ্যের বাঁধকে ধ্বংস করে যেভাবে বিলাসবহুল রিসর্ট তৈরি করা হয়, নতুন নতুন পর্যটন কেন্দ্র তৈরি করা হয় প্রকৃতির বিরুদ্ধে গিয়ে, সেসব কান্ড দেখে তো মনে হয় না সুন্দরলাল বহুগুণার মতো নিবেদিতপ্রাণ পরিবেশবিদরা আমাদের কিছু শেখাতে পেরেছেন!
ইচ্ছামতীর বন্ধুরা এখন তো ছোট আছ, এখন তোমরা সবকিছু দেখছ, শুনছ, শিখছ। একটা ছোট্ট কথা যদি শিখে নিতে পারো, প্রকৃতি-মা আমাদের সৃষ্টি করেছেন, আমাদের যা কিছু শ্রী বৃদ্ধি, যা নিয়ে আমরা মানুষেরা শ্রেষ্ঠত্বের অহঙ্কার করি, তার সবটুকু কিন্তু প্রকৃতিরই দান। এই ছোট্ট কথাটা মনে রেখে যদি আমরা প্রকৃতি-মা কে সবাই একটু একটু করে যত্নে রাখি, তাহলেই দেখবে তিনি আমাদের দু'হাত দিয়ে আগলে রাখবেন। কিন্তু যদি আমরা প্রকৃতিকে ধ্বংস করতে মেতে উঠি, তাহলে প্রকৃতির রোষ আমাদেরই সবার আগে ধ্বংস করে ফেলবে। যেকোনও প্রাকৃতিক দুর্যোগের সামনে মানুষের চেয়ে অসহায় প্রাণী কিন্তু আর একটিও নেই, এটা আমাদের মনে রাখতে হবে।
খুব বড় কিছু যদি নাও পারি, আশেপাশের গাছপালা পশুপাখির যত্ন নেওয়া, নদী পুকুরের জলে যা খুশি তাই ফেলে দিয়ে না আসা, প্লাস্টিক জঞ্জাল এদিকে ওদিকে ছড়িয়ে না রাখা, যতটা পারা যায় ইকোফ্রেণ্ডলি অভ্যেস গড়ে তোলা, এই কাজগুলো তো আমরা নিজেরা করতেই পারি। ছোটরা যদি শুরু করি, ধীরে ধীরে বড়রাও দেখবে ঠিক সেসব অভ্যেস শুরু করেছেন। কী বলো তো, নিজেদের ভালোর জন্য যদি নাও পারি, যেসব মানুষ বছরের পর বছর নিজেদের সুখ স্বাচ্ছন্দ্য বিসর্জন দিয়ে পরিবেশ রক্ষার জন্য লড়াই করে চলেছেন, তাঁদের সম্মান জানানোর জন্য এটুকু করা আমাদের কর্তব্য। নইলে সেই মানুষগুলোর এতদিনের লড়াই যে মিথ্যে হয়ে যাবে, তা তো হতে দেওয়া যায় না, তাই না?
প্রতিকৃতিঃ পার্থ মুখার্জি
ছবিঃ উইকিপিডিয়া ও পিক্সাবে