সবুজ মনের রসদ
Ichchhamoti Logo
হাত বাড়ালেই বন্ধুঃ তৃতীয় পর্ব

শ্রেয়ান, সাক্ষী, বিয়াস, সায়ন্তন এরা সবাই আজ খুব উত্তেজিত। অনেকদিন পর একটা বার্থডে পার্টিতে সবার একসঙ্গে নেমন্তন্ন। বিয়াসের মা আর বাকিদের বাবারা একই অফিসে কাজ করে। ওঁদের এক কলিগের মেয়ের আজ জন্মদিন, সবাইকে ‘সপরিবারে’ নেমন্তন্ন করেছেন। ‘সপরিবারে’ কথাটার মানে সায়ন্তন আজকেই জানল, এই নেমন্তন্নর প্রসঙ্গে। একসঙ্গেই যাওয়া হবে, বিকেল থেকেই চারজনে সেজেগুজে ঘর বার করছে, শেষ পর্যন্ত বাবা মায়েদের সময় হল বেরোনোর!

শিবানী আণ্টির মেয়ে বৈশালীর আজ জন্মদিন। সে তো একেবারে কুইন এলসার মতো সেজে ঘুরে বেড়াচ্ছে। পার্টির থিম ডিজনির মুভি ফ্রোজেন। সায়ন্তনের অতটা ফেভারিট না হলেও শ্রেয়ান আর বিয়াসের খুব প্রিয় সিনেমা ফ্রোজেন। সায়ন্তনেরও অবশ্য ভালোই লাগছিল, হলটা সেই রাজপ্রাসাদের মতো সাজানো হয়েছে, ঝলমলে আলো, ফ্রোজেন থিমের মিউজিক চলছে ব্যাকগ্রাউণ্ডে, একজন কেউ স্নোম্যান ওলাফও সেজেছে, বাচ্চাদের সঙ্গে হ্যাণ্ডশেক করছে হেসে হেসে। সায়ন্তনদের সঙ্গেও হাত মিলিয়ে গেল ওলাফ, সঙ্গে একজন এসে ফ্রুটজ্যুস দিয়ে গেল। গ্লাসে চুমুক দিতে গিয়ে সায়ন্তন খেয়াল করল ছেলেটাকে। কোণার দিকের একটা চেয়ারে ছেলেটা বসে আছে, হাতে জ্যুসের গ্লাস, কানে বড় একটা হেডফোন, গান শুনছে বোধহয়, তালে তালে পা নাড়ছে।
“ছেলেটাকে দেখছিস? এখানেই তো গান বাজছে মিউজিক সিস্টেমে, তারপরেও ও আলাদা করে কেন হেডফোন কানে নিয়ে বসে আছে রে? মায়েরা আমাদের টিকটিক করে সারাক্ষণ ফোন ঘাঁটি বলে, বাড়িতে কারও সঙ্গে কথা বলি না বলে, এই ছেলেটা তো পার্টিতে এসেও কারও সঙ্গে কথা বলছে না, একলা বসে গান শুনছে!”
“কথা বলবি গিয়ে?”
“যদি ডাঁট দেখায়?”
“দেখালে দেখাবে! চল তো!”

চারজনের দলটা এগিয়ে গেল ছেলেটার দিকে।

“হাই! আমি শ্রেয়ান। কী গান শুনছ?”
ছেলেটা ওদের দিকে তাকালো না, যেমন গান শুনছিল শুনতে লাগল।
“তুমি কি বৈশালীর স্কুলফ্রেণ্ড?” এবার বিয়াসের জিজ্ঞাসা। তাও সাড়া দিচ্ছে না দেখে কাঁধ ঝাঁকিয়ে সায়ন্তন ছেলেটার হাতে আলতো করে হাত রাখল। তাতেই ছেলেটা এমন চমকে হাত সরিয়ে নিলো, হাতে জ্যুসের গ্লাসটা থেকে জ্যুস ছলকে পড়ে ওর জুতো ভিজিয়ে দিলো। ছেলেটা তাড়াতাড়ি করে জ্যুসটা খেয়ে নিয়ে বলল,
“অনীশ উইশ করবে।“

“কে অনীশ?”
নিজের বুকে হাত রেখে ছেলেটা আবার বলল,
“অনীশ উইশ করবে।“
“তোমার নাম অনীশ? হাই! আমি সাক্ষী। কী গান শুনছ?”
“ওলাফ সং। “হোয়েন আই অ্যাম ওল্ডার’।“
ওলাফের গানই শুনছে! তাহলে হেডফোন কেন? এখানেও তো একই থিমের মিউজিক বাজছে! জিজ্ঞেস করবে ভাবতে ভাবতে সায়ন্তনরা দেখল অনীশ সামনের চেয়ারগুলোর নিচে কী যেন খুঁজছে।
“কী খুঁজছ?”
“গারবেজ।“
বলেই অনীশ নিচু হয়ে অন্যান্য চেয়ারের নিচ থেকে খালি জ্যুসের গ্লাস কুড়োতে লাগল। কয়েকটা গ্লাস কুড়িয়ে সোজা এগিয়ে গিয়ে ডাস্টবিনে ফেলে এল। সায়ন্তনরা অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিল, জন্মদিনের পার্টিতে নিমন্ত্রিত হয়ে এসে অন্যের এঁটো গ্লাস কুড়িয়ে ডাস্টবিনে ফেলছে, এমন কাজ খুব একটা কেউ করে না তো!
“অবাক হচ্ছ?”
একজন আন্টি, একদম অনীশের মতো দেখতে, ওদের পাশে এসে বসেছেন।
“তুমি কি অনীশের মা? একরকম দেখতে তোমাদের!” সাক্ষীটা বেশি কথা বলে, চটপট জিজ্ঞেস করল।
“হ্যাঁ, আমি অনীশের মা।“
“ও নোংরা গ্লাসগুলো কেন তুলে ফেলে এল?”
“ধরে নাও ও চারপাশের পরিবেশকে পরিষ্কার রাখতে খুব ভালবাসে!”
“ও আমাদের সঙ্গে কথা বলল না কেন?”
“ওর আসলে অচেনা কারও সঙ্গে মিশতে একটু অসুবিধা হয়। ওর একটা ইয়ে, মানে, একটা ব্যাপার আছে। অনীশের অটিজম স্পেকট্রাম ডিজঅর্ডার আছে।“
“আই নো অটিজম। স্কুলে আমার এক বন্ধুর অটিজম আছে!” সায়ন্তন পড়া বলার মতো করে হাত তুলে বলে উঠল।
“ও, ইউ নো অটিজম? গ্রেট!”
অনীশ গ্লাসগুলো ফেলে এসে মায়ের কাছে হ্যাণ্ড স্যানিটাইজার চাইল।
“গুড! ইট’স আ গুড হ্যাবিট। গারবেজ তুলে ডাস্টবিনে ফেলে আসার পর অলওয়েজ হ্যাণ্ড ওয়াশ বা স্যানিটাইজ করতে হয়।“
অনীশও বুড়ো আঙুল তুলে গুড সাইন দেখায়।
“অনীশ, এরা তোমার নতুন বন্ধু। তুমি যে গারবেজ তুলে ডাস্টবিনে ফেলে এসেছ, সেটা দেখে ওরা খুব খুশি হয়েছে।“
“সত্যি, আমরা অবাক হয়ে গেছি। তুমি কেন করো এটা? তোমার ঘেন্না করে না?”
“পৃথিবীকে সুস্থ রাখতে হবে। দূষণ, প্লাস্টিক, ঢেকে গেছে চারপাশ। ইট’স ডেঞ্জারাস। পরিবেশকে রক্ষা করতে হবে।“

হাত বাড়ালেই বন্ধুঃ তৃতীয় পর্ব

অনীশের মা এবার সায়ন্তনকে বলেন,
“অটিজম নিয়ে কী জানো বলছিলে?”
“অটিজম একধরনের ডেভেলপমেণ্টাল ডিজঅর্ডার, যাতে অন্যের সঙ্গে কমিউনিকেট করতে সমস্যা হয়, নিজের অনুভূতি, নিজের চাহিদা এগুলো অন্যকে বোঝাতে, এবং অন্যের দৃষ্টিভঙ্গি বুঝতে সমস্যা হয়।“
“বাঃ, খুব গুছিয়ে বললে তো! থ্যাঙ্ক ইউ, কথাগুলো বোঝার জন্য। অটিজম আছে এমন মানুষজনের সঙ্গে মিশতে হলে অটিজমকে যদি একটু বুঝতে পারো তাহলে দু’পক্ষেই খুব ভাল হয়। অটিজমের সঙ্গে আরও কিছু জিনিস জড়িয়ে থাকে।“
“কী?”
জন্মদিনের পার্টিতে এসে একটা নতুন বিষয়ে জানার সুযোগ পেয়ে সবাই খুব আগ্রহী হয়ে শুনছে।অনীশ অবশ্য নিজের ব্যাপারে শোনার চেয়ে বেশি আগ্রহী গানে, সে আবার হেডফোন কানে লাগিয়ে বসে পড়েছে।
“কোনও কাজ বা জিনিসের প্রতি মাত্রাতিরিক্ত আকর্ষণ। যাকে বলা হয় অবসেশন। সবার থাকে না, কারও কারও থাকে। অনীশের এই যে জঞ্জাল দেখলেই তুলে ডাস্টবিনে ফেলে আসার স্বভাব, এটা কিন্তু একধরনের অবসেশন। কাজটা ওর এতটাই ভাল লাগে, যে, চাইলেও ও কাজটা না করে থাকতে পারে না।“
“ইউটিউব দেখার মতো? ওটাও তো চাইলেই ছেড়ে দিতে পারি না আমরা, নেশার মতো লাগে!”
“কিছুটা একইরকম, আবার আলাদাও বটে। ইউটিউব তুমি বাড়িতে কারও ফোনে দেখবে, বা ডেস্কটপ বা ল্যাপটপে দেখবে। অন্য কারও বাড়ি গিয়ে, বা রাস্তায় ট্রেনে বাসে অন্য কারও ফোন নিয়ে দেখতে শুরু করবে কি?”
“দেখতে ইচ্ছে করবে হয়তো, কিন্তু দেখব না। লোকে খারাপ বলবে।“
“ইয়েস। তোমার আশপাশের অচেনা লোক, অর্থাৎ সমাজ, তোমায় খারাপ বলবে, এমন কাজ তুমি ইচ্ছে থাকলেও করবে না, কারণ তুমি জানো কোন কাজটা সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্য, আর কোনটা নয়। অনীশ বা অনীশের মতো সমস্যা যাদের আছে তাদের কাছে এই সামাজিক গ্রহণযোগ্যতার ধারণাটা আপনা-আপনি স্পষ্টভাবে তৈরি হয় না। সেই কারণেই কোনও একটা কাজের প্রতি যদি মাত্রাতিরিক্ত আকর্ষণ জন্মায়, তবে স্থানকালের ভেদ ভুলে সেই কাজটা করে যেতে ইচ্ছে করে, নিজেকে আটকাতে পারে না।

হাত বাড়ালেই বন্ধুঃ তৃতীয় পর্ব

নানারকম ট্রেনিংয়ের মাধ্যমে সামাজিক গ্রহণযোগ্যতার ধারণাটা তৈরি করতে হয়। ধরো, তুমি কেক খেতে ভীষণ ভালবাসো। বৈশালীর জন্মদিনে যে কেকটা কাটা হবে, সেটা পুরোটা খেয়ে নিতে তোমার খুব ইচ্ছে করছে। কিন্তু তুমি জানো সবার জন্য আনা কেক তোমার একা খাওয়া উচিত নয়, সেটা সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্য (socially acceptable) আচরণ নয়। অটিজম স্পেকট্রামে থাকা কেউ কেউ এই বিভাজনটা করতে পারে না, তাদের এটা বিভিন্ন সোশ্যাল স্টোরির মাধ্যমে, ছবির মাধ্যমে, মডেলিংয়ের মাধ্যমে শেখাতে হয়।“

“আণ্টি, শুধু সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা কেন? সব কাজ তো সব সময় নিজের জন্য সেফও হয় না? অনীশ জঞ্জাল সরাতে গেলে জার্মস থেকে ওর ইনফেক্টেড হওয়ার ভয় থাকবে তো?”
“একদম ঠিক বলেছ। ভয় তো থাকেই। কিন্তু ও যে কাজটা করছে সেটা তো একটা ভাল কাজ। অন্য অনেক লোক, যাদের কোনও ডিজঅর্ডার নেই, তারা পরিবেশ রক্ষার কথা একটুও না ভেবে চারপাশে জঞ্জাল ছড়িয়ে রাখছে, পরিবেশ দূষিত করছে। অনীশ পরিবেশ পরিচ্ছন্ন রাখার গুরুত্ব বুঝেছে, তাই ও যেখানে যা প্লাস্টিক দেখতে পায় কুড়িয়ে নিয়ে ডাস্টবিনে ফেলে আসে। ইনফেকশন থেকে ওকে রক্ষা করার জন্য আমাদের ওকে সচেতন করতে হবে। ভাল করে হাত ধুচ্ছে কি না খেয়াল রাখতে হবে।
“মুখে মাস্ক আর হাতে গ্লাভস পরতে বলবে ওকে।“
“হ্যাঁ, ঠিক বলেছ। গ্লাভসের সাজেশন অনীশের মামীও আমায় দিয়েছে। থ্যাঙ্ক ইউ।“
আরেকটা কথা আণ্টি। তোমাদের বাড়ি কি খুব দূরে?”
“না, কাছেই। কেন বলো তো?”
“আমরা কি মাঝেমাঝে ছুটির দিনে আশপাশের এলাকাগুলোয় জঞ্জাল সাফ করার কাজ করতে পারি? অনীশ থাকবে, আমরা থাকব, তোমরা বড়রাও থাকবে, পারি করতে?”
“গ্রেট আইডিয়া! তোমাদের বাবা মা-রা কোথায়? চলো আলাপ করি, এই নিয়ে কথাবার্তা বলি। প্ল্যান করাই যায়। অনীশ তো খুব খুশি হবে। অনীশ, আবার কোথায় যাচ্ছ?”
অনীশ আবার দেখেছে কারও এঁটো খালি জ্যুসের গ্লাস মেঝেতে গড়াগড়ি যাচ্ছে। ওর মাথার ভেতরে কীরকম একটা হয়, জঞ্জাল যেখানে সেখানে ছড়িয়ে থাকতে দেখলে। ডাস্টবিন কেন দিয়েছে? ডাস্টবিনগুলো কি শুধু অনীশ একাই দেখতে পায়, আর কেউ দেখতে পায় না? ম্যাজিক ডাস্টবিন নাকি?

না, অনীশ একা নয়। ওই তো সায়ন্তন, শ্রেয়ান, বিয়াস আর সাক্ষীও যাচ্ছে অনীশের সঙ্গে। যেখানে যত জ্যুসের গ্লাস, কাগজের ন্যাপকিন মেঝেতে এদিকে ওদিকে ছড়িয়ে রয়েছে, সব একজায়গায় জড়ো করে ডাস্টবিনে ফেলছে পাঁচজনে মিলে। ডাস্টবিনটা ম্যাজিক ডাস্টবিন নয়, অনীশের মনে বিশ্বাস আসে। কাজ সারা হয়ে গেলে বাকি চারজনের দিকে বুড়ো আঙুল তুলে বাহবা দেয় ও, মুহূর্তের মধ্যে প্রত্যুত্তর আসে ওদের কাছ থেকেও। কথা বলার প্রয়োজন পড়ে না তেমন, ভাষা আর ভাব বিনিময় ঠিকই হয়ে যায়, একটা ম্যাজিক বণ্ডও যেন তৈরি হতে থাকে কোথাও।

পূর্ববর্তী পর্বগুলিঃ
হাত বাড়ালেই বন্ধুঃ দ্বিতীয় পর্ব
হাত বাড়ালেই বন্ধু

পরবর্তী পর্বঃ
হাত বাড়ালেই বন্ধুঃ চতুর্থ পর্ব

ভূতপূর্ব ইঞ্জিনিয়ার, বর্তমানে সাংসারিক কাজের মাঝে সু্যোগ পেলেই পড়া আর লেখার আনন্দে মাতার চেষ্টায় থাকেন। সেই গোত্রের মানুষ, যারা আর কিছু না পেলে ঠোঙ্গায় ছাপা খবরও মন দিয়ে পড়েন। সারাদিনের অনেকটা সময় কাটে মেয়ে কুটুনের সঙ্গে; তার কীর্তিকলাপ মাঝেমধ্যে লিখতে চেষ্টা করেন;বর্তমানে ধানবাদের বাসিন্দা।

আমরা, ভারতের জনগণ, ভারতকে একটি সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, সাধারণতন্ত্র রূপে গড়ে তুলতে সত্যনিষ্ঠার সঙ্গে শপথগ্রহণ করছি এবং তার সকল নাগরিক যাতে : সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ন্যায়বিচার; চিন্তা,মতপ্রকাশ, বিশ্বাস, ধর্ম এবং উপাসনার স্বাধীনতা; সামাজিক প্রতিষ্ঠা অর্জন ও সুযোগের সমতা প্রতিষ্ঠা করতে পারে এবং তাদের সকলের মধ্যে ব্যক্তি-সম্ভ্রম ও জাতীয় ঐক্য এবং সংহতি সুনিশ্চিত করে সৌভ্রাতৃত্ব গড়ে তুলতে; আমাদের গণপরিষদে, আজ,১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর, এতদ্দ্বারা এই সংবিধান গ্রহণ করছি, বিধিবদ্ধ করছি এবং নিজেদের অর্পণ করছি।

ফেসবুকে ইচ্ছামতীর বন্ধুরা