'হিমালয়ের পায়ের কাছে' সেই যেখানে পাকদণ্ডী পথের পাশে বেড়ালের মতো কুণ্ডলী পাকিয়ে পড়ে থাকে ফার্ণের গুচ্ছ, সেইখানে আছে ছোট্ট এক গ্রাম, নাম তার লখনা। সেই গ্রামে থাকে নরবু, শামু, কাঞ্চী, বাহাদুর এরা সব ছেলেমেয়েদের দল, আর তাদের সঙ্গে থাকে একপেট করে ক্ষিদে, সে ক্ষিদে তাদের মেটে না। কী করে মিটবে? বৃষ্টি হয়নি যে! জল পায়নি বলে চাষবাস হতে পায়নি, চাষ না হলে মানুষে খাবে কী? তাই লখনা গাঁয়ের ছেলেবুড়ো এমনকি ভেড়াদেরও বড় কষ্ট।
সে কষ্ট সারানোর উপায় খুঁজতে ছেলেপুলের দল গেল বড় লামার বাড়ি। বড় লামা কে? সন্ন্যাসী না বিজ্ঞানী না জাদুকর? উঁহু, বলব না। গপ্পবলিয়েদের শিরোমণি সাহিত্যিক লীলা মজুমদারের লেখা 'বাতাস বাড়ি' বইটা জোগাড় করে পড়ে ফেলো দেখি, সব প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যাবে সেখানে।
বইয়ের পাতায় পাতায় মিশে রয়েছে ম্যাজিক! বড় লামা বাতাস-বাড়ি খুঁজতে যাবেন বলে তোড়জোড় করছেন, তাঁর সঙ্গে হাতে হাতে কাজ করে দিচ্ছে ধিঙ্গিপদ, সে আবার রোদ ছাড়া আর কিচ্ছুটি খায় না। ভাবছো ধিঙ্গিপদটা আবার কে? সে আছে একজন, মানুষ কি মানুষ নয় সেসব বলব না, নিজেই বুঝে নিয়ে আমায় বুঝিওখন। ধিঙ্গিপদর সঙ্গে আলাপ হতে না হতে দেখবে আরেকজন এসে হাজির - উনপঞ্চাশ। নামের বাহার দেখছ তো একেকজনের! কাজের বাহার যে কত হবে আন্দাজ করতে পারছ নিশ্চয়ই?
এই যে বইয়ের নাম 'বাতাস-বাড়ি', বড় লামা খুঁজতে চলেছেন বাতাস-বাড়ি, তাঁর সঙ্গে চলেছে লখনা গাঁয়ের ছেলেপুলের দল, তা এই বাতাস-বাড়ি জিনিসটা কী জানতে ইচ্ছে করছে কি? যে বাতাসবাড়ি হারিয়ে গেছে, সে নাকি এক আজব যন্ত্র! সেবাড়ি গড়ে তুলতে একচিলতে জমিও লাগে না, সেবাড়িতে আলো জ্বলে সূর্যের তেজে, মানে আমাদের সোলার এনার্জি দিয়ে আর কি! সেবাড়ির ভাঁড়ার ভরা থাকে পেট ভরে যাওয়া খাবার বড়িতে, জল তৈরি হয় যন্ত্র থেকে। সুতরাং, বাতাসবাড়ির খোঁজ যদি পাওয়া যায়, তবে ভাবতে পারছ কী কাণ্ডটা হবে! ক্ষিদে, তেষ্টা, আলো হাওয়ার সমস্যা, জমিজায়গার অভাব - সব সমস্যা মিটে যাবে এক নিমেষে। মানুষের আর কোনও দুঃখ-কষ্ট থাকবে না।
এমন একখানা কাজের জিনিস হারিয়ে গেছে, সেটা কি আর অমনি অমনি খুঁজে পাওয়া যায়? তাহলে আর গপ্পো কীসের? তাই গল্পের মোড় ঘুরে যায়, ঢুকে পড়ে রহস্য, আর কিছু রহস্যজনক চরিত্র। পাদ্রী, দুলে, নেপেন এদের সম্পর্কে জানা যায় আস্তে আস্তে। এরা কারা? থাক বাবা, রহস্যের কথা সব আগেভাগে বলে দিতে নেই। 'বাতাস-বাড়ি'র পাতা ওল্টাতে থাকো একটা একটা করে, সব রহস্যের সমাধান হবে। বাতাস-বাড়ি খুঁজে পাওয়া গেল কিনা তাও জানতে পারবে নিজে নিজেই।
এককথায় বলতে গেলে, কল্পবিজ্ঞান, রহস্য, রূপকথা, অ্যাডভেঞ্চার, হাসিকান্নায় মেশানো মন ছুঁয়ে যাওয়া অনুভূতির দল, কী নেই 'বাতাস-বাড়ি'তে! সেইসঙ্গে লেখিকার আপন করে নেওয়া গল্প বলার ধরন আর শব্দ দিয়ে কল্পনার জাল বোনার ম্যাজিক তো রয়েছেই। পড়তে পড়তে মনে হয় লখনা গাঁয়ের ছেলেপুলেদের সঙ্গে আমরাও বেরিয়ে পড়েছি বাতাসবাড়ির খোঁজে! আর সেইসঙ্গে এই দুহাজার আঠেরো সালে চারিদিকের হরেকরকম দূষণ আর প্রাকৃতিক ভারসাম্যহীনতার মাঝে বসে মনে হয়, ওরকম একটা বাতাসবাড়ির সত্যিই বুঝি খুব দরকার, নইলে সভ্যতার সঙ্কট এড়িয়ে সামনে এগোনো বড়ই মুশকিল।
কৃষ্ণেন্দু চাকীর অনবদ্য অলঙ্করণ গল্পের গতি আর সারল্যকে ফুটিয়ে তোলে নিপুণভাবে, বর্ণনারা জীবন্ত হয়ে ধরা দেয় আমাদের সামনে।
বইয়ের শেষ পাতায় রয়েছে এই কথাগুলো :
"পৃথিবীতে যখন মানুষ থাকবার জায়গা কুলোবে না, কয়লা ফুরুবে, তেল ফুরুবে, তখনো যেন কেউ ভয় না পায়। এই আমি রেখে গেলাম আরো ভালো বাতাস-বাড়ির নক্সা; এই রইলো সূর্য-কলের নিয়মকানুন; খিদের বড়ির রন্ধনপ্রণালী; যে কাপড় ছেঁড়ে না বা পোড়ে না, গায়ের সঙ্গে বাড়ে কমে, রোজ যার রঙ বদলায়, তার গোপন তথ্য। পৃথিবীর দুঃখ ঘুচে যাক, সবাই সুখী হোক। ইতি....."
পৃথিবীর যাবতীয় জ্বালানি ফুরিয়ে যাওয়ার সেই ভয়ঙ্কর দিনটা যত দেরিতে আসে, ততই মঙ্গল। তবে আসবেই, হয়তো। কী হবে সেদিন? বলবে ভবিষ্যৎ। ততদিন, চলো, বিকল্প জ্বালানি আর বিকল্প জীবনের সন্ধান দেওয়ার এই 'বাতাস-বাড়ি' খুঁজতে থাকি আমরাও, লখনা গাঁয়ের ছেলেমেয়েদের হাত ধরে।
বই : বাতাস বাড়ি
রচনা : লীলা মজুমদার
প্রচ্ছদ ও অলঙ্করণ : কৃষ্ণেন্দু চাকী
প্রকাশক : আনন্দ পাবলিশার্স
দাম : ১০০ টাকা