‘রূপুলি বেতের ঝাঁপি’তে জড়ো করে রাখা আছে একগুচ্ছ গল্প। মানুষের মুখে মুখে বহুকাল ধরে প্রচলিত নানান গল্প। তাদের মূল কাঠামোকে অপরিবর্তিত রেখে সংযোজিত হয়েছে কেবল যুগের সঙ্গে প্রাসঙ্গিক কিছু বদল। আবার কোনও কোনও গল্প প্রায় অপরিবর্তিতই রয়ে গেছে। বইয়ের মুখবন্ধ থেকে লেখিকাকে উদ্ধৃত করেই বলা যায়, সেসব গল্পের “উপরিতলের কথাবস্তুর নীচে আছে সাধারণ মানুষের দীর্ঘ অভিজ্ঞতা, পর্যবেক্ষণ ও ভাবনার কাঠামো।……… এসব ভাবনার মধ্যে যা আমার কাছে সবচেয়ে প্রধান হয়ে ধরা দিয়েছে তা হল ছড়ানো এক জীবন আর সেই জীবনের সঙ্গে সুষমভাবে নিজেকে মিলিয়ে মানুষের বাঁচা।“
যারা উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর লেখা ‘টুনটুনির বই’ পড়েছ, তাদের কাছে কিছু গল্পের কাহিনী চেনা ঠেকবে। ‘রূপুলি বেতের ঝাঁপি’ উপুড় করে সব গল্পগুলো পড়া হয়ে গেলে যদি হাতের কাছে ‘টুনটুনির বই’ পাও, তবে সেটাও আরেকবার পড়ে ফেলতে পারো। রূপুলি বেতের ঝাঁপি’তে গল্পদের নিয়ে লেখিকা ঠিক কী করতে চেয়েছেন, সেটা দিব্যি বুঝতে পারবে। যেসব গল্পকে আমরা অনেক ছোটবেলায় নিছক গল্প ভেবেই শুনেছি, যাদের গ্রন্থিত করেছিলেন বাংলা শিশুসাহিত্যজগতের অন্যতম পথিকৃৎ উপেন্দ্রকিশোর, সেসব গল্পের পরতে পরতে মিশে আছে সমাজের যে অর্থনৈতিক সামাজিক রাজনৈতিক চিত্রাবলী, মিশে আছে মানুষের চরিত্রের অগণিত মৌলিক প্রবৃত্তি, ভালয়-মন্দয় মিলিয়ে যারা রূঢ় সত্য, তাদেরই আরেকটু বিশদে ব্যাখ্যা আমাদের কাছে তুলে ধরেছেন লেখিকা তাঁর এই গ্রন্থে। গল্প তো প্রায় সবই চেনা। কিন্তু তাদের যেভাবে তিনি বুনেছেন, গল্পের খাঁজে খাঁজে রেখে দেওয়া এক-একটি আপাতসাধারণ অথচ শক্তিশালী বাক্যাংশ, তাতেই যেন বিভিন্ন ছবি স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
যেমন ধরো ‘শেয়ালে-কুমিরে’ গল্পটা। চেনা গল্প। বোকা কুমির বারবার ধূর্ত শেয়ালের কাছে পর্যুদস্ত হয়। তাও সে টক্কর দিতে চায় শেয়ালের সঙ্গে, আবার নাকাল হয়, আবার শেয়ালের চাতুরির ফাঁদে পা দেয়। কেন করে সে এরকম? কারণ, “চালাক চতুর হবার তার খুব শখ”। লেখাপড়া জানে না বলে তার একটা সুপ্ত দুঃখ আছে বোঝা যায়। লেখাপড়া সে শেখেনি কেন? “যতবার শিখতে চেষ্টা করে, তার পড়াশুনায় খালি নদীর জল মিশে যায়। জল মেশানো পড়াশুনা তো আর বেশিদিন টেঁকে না।“ তবে কুমির যে খুব হেলাফেলা করার মতো জীব তা যে নয়, তাও লেখিকা অনায়াসেই বুঝিয়ে দেন একটিমাত্র বাক্যের মোচড়ে, “কিন্তু কুমিরের গায়ে খুব জোর, সে জন্য তাকে সবাই ভয় পায়”। এই ভয়কে সম্বল করেই কুমির আরেকটু এগোতে চায়, অনেকদিন ভিজে ডাঙায় রইল সে, এবার শুকনো ডাঙায় উঠে বুদ্ধি শিখে সে আরেকটু সম্ভ্রম আদায় করবে, এই তার মনোবাসনা। না, লেখিকা তার মনোবাসনার কথা স্পষ্টভাবে লেখেননি, তবে তাঁর গল্প বোনার জাদুতে অনায়াসেই না বলা কথাও মূর্ত হয়ে ওঠে। কুমিরের কথা পড়তে গিয়ে আমাদেরই আশেপাশে থাকা ভয় দেখিয়ে সম্ভ্রম আদায় করতে চাওয়া এমন অনেক মানুষের কথা মনে পড়ে যায় না? ভেবে দেখো একটু, চিনতে পারবে তেমন চেহারাগুলোকে।
আরেকটা গল্প, ‘বড়োরা আর ছোটোরা’। এ-ও চেনা গল্প। ছোট্ট পাখি টুনটুনির পায়ে বেগুনগাছের কাঁটা ফুটল, সে গেল নাপিতের কাছে, কাঁটা বের করে দেওয়ার কথা বলতে। নাপিত হল গিয়ে রাজনাপিত, রাজার দাড়ি কামায়। টুনটুনির মতো এলেবেলে পুঁচকে একটা পাখির কষ্ট বুঝতে তার বয়ে গেছে। সে পত্রপাঠ হাঁকিয়ে দিল টুনটুনিকে। এরপর টুনটুনি ঘুরে ঘুরে লাঠি আগুন জল হাতি সবার দ্বারস্থ হল নাপিতের অন্যায়ের বিহিতের জন্য, টুনটুনির অভিযোগে যারা আমল দিচ্ছে না, তাদের একটু করে শাস্তি হোক, এই তার পণ। কিন্তু তার মতো অকিঞ্চিৎকর এক প্রাণীর কথা মেনে কাজ করতে সবারই আঁতে লাগল, কেউই তার কথা মানল না। এ অবস্থায় টুনটুনির পাশে দাঁড়াল একদল কাঠপিঁপড়ে। সব শুনে তারা বেজায় রেগে গেল। দুর্বলের ওপর সবলের অত্যাচার তারা সইবে কেন? তারা দিল হাতিকে বেশ করে কামড়ে। হাতি তো বিষের জ্বালায় ‘বাবা রে মা রে’ করে টুনটুনির কথা মেনে চলল জলকে শুষে নিতে। শুষতে আর হল না, সেই ভয়েই জল চলল আগুন নেভাতে, আগুন জলের ভয়ে চলল লাঠিকে পোড়াতে, লাঠি চলল পুড়ে ছাই হবার ভয়ে নাপিতকে পেটাতে। এসব হুমকিটুমকি পেয়ে নাপিত বসল টুনটুনির ফোড়া কাটতে। ন্যায়ের জয় হয়েছে, নিশ্চিন্ত হয়ে পিঁপড়েরা ফিরে গেছে নিজেদের কাজে। পরিস্থিতির রাশ এখন নাপিতের হাতে, এবং ছোট্ট টুনটুনির কাছে নাকাল হবার অপমান তার বুকে বেজায় বেজেছে। এখানেই, শেষ অনুচ্ছেদে এসে গল্পে আসে এক অমোঘ মোচড়। পাঠকরা, এবং টুনটুনি নিজেও কিছু বুঝে ওঠার আগেই নাপিত তাকে মেরে ফেলে তার মৃতদেহটা ছুঁড়ে ফেলে দেয়। ছোটদের জন্য লেখা গল্পে রাগ দ্বেষ সচরাচর এড়িয়ে চললে ভাল, রূঢ়তাকে রূপকের মোড়কে ঢেকে পরিবেশন করলে ভাল, এমন ধারণাদের নস্যাৎ করে দিয়ে লেখিকা এখানে প্রতিটি পাঠককে টেনে এনে দাঁড় করান রূঢ় বাস্তবের সামনে। ‘দ্যাখ, এটাই সত্যি। চারপাশে তাকালে এটাই দেখবি।‘ পেলব শিশুমনে এভাবেই বাস্তবের বীজ বুনে দিতে চেষ্টা করেন লেখিকা।দুর্বলের কাছে সবলের হার অত সহজে মেনে নেওয়া যায় না। আঘাত আসেই। তাই কেবল শুভবোধের ওপর অন্ধ আস্থা রাখা ভাল নয়। ছোটোরা যদি জোট বাঁধে, সে জোট দাবির শেষটুকুও মেটা অবধি বেঁধে রাখতে হয়। কী সুন্দর করে এই শিক্ষা বুনে রেখে লেখিকা চলে যান পরের গল্পে, তারপরের গল্পে।
অচেনা গল্পগুলোর মধ্যে মন কেড়ে নেয় ‘মাকড়সা ঠাকুমার বোনা গল্প’। কী যে মিষ্টি গল্পখানা কী বলব! ছোট্ট ছেলে বিরসা বাড়িতে একলা বসে মন খারাপ করছিল। চড়ুই, শালিখ, কাক আর মাকড়সা ঠাকুমা কেমন করে তার মন খারাপ সরিয়ে তার মুখে হাসি ফোটাল, এ তারই গল্প। পুরোটা বলব না, নতুন গল্প তো, বলে দিলে মজা মাটি। তার চেয়ে নিজেই পড়ে নিও বইটা জোগাড় করে, দেখবে তোমার মুখেও আলতো হাসি ফুটে উঠছে। আর যদি বাড়িতে একলা থকো? তবে তো কথাই নেই, বইটাই হয়ে উঠবে তোমার মস্ত বড় বন্ধু।
বিশদে লিখলাম মোটে তিনটে গল্পের কথা। আসলে বইয়ের বারোটা গল্পের প্রত্যেকটাই খুব সুন্দর, পড়ে নতুন করে ভাবতে হয় গল্পগুলোর কথা। আর তেমনই সুন্দর প্রচ্ছদ আর অলঙ্করণ। প্রতিটি ছবি যেন কথা বলে ওঠে, দৃশ্যগুলোকে জীবন্ত করে তোলে। সাদাকালো প্রচ্ছদে ডালপালা মেলে থাকা গল্পের গাছ যেন আবহমান কাল ধরে চলে আসা গল্প বলার চল আর মানুষের মনে সেইসব গল্পের শিকড়ের চারিয়ে যাওয়াকেই প্রকাশ করে।
বইয়ের বাঁধাই ছোটদের ছোট্ট হাতের জন্য যথোপযুক্ত। হাল্কা, অথচ পলকা নয়। হাতে নিয়ে উল্টেপাল্টে নেড়েচেড়ে দেখো, পড়তে পড়তে ডুব দাও গল্পের ঝাঁপিতে, দিব্যি লাগবে।
পুজোর ছুটির উইশলিস্টে ‘রূপুলি বেতের ঝাঁপি’কে রাখতে পারো। ঠাকুর দেখার দেদার মজার ফাঁকে ফাঁকে অবসরটুকু বেজায় ভাল কাটবে, দেখো!
বইঃ রূপুলি বেতের ঝাঁপি
রচনাঃ জয়া মিত্র
প্রচ্ছদঃ শিবাজী বসু
প্রকাশকঃ থীমা
দামঃ ৯০ টাকা