বড়রাস্তা দিয়ে বড় বড় হলদে বাস, মোটরগাড়ি, ঘোড়ায় টানা টাঙ্গা, মোটরবাইক, গরুর গাড়ি চলতেই থাকে। ট্রাঙ্ক রোডের এই অবিরাম গাড়ির স্রোত মনে হয় যেন এপাশের ব্যস্ত নগর আর ওপাশের ঘুমিয়ে থাকা গ্রামগুলোর মাঝে একটা আড়াল গড়ে দেয়! ব্যস্ত রাস্তাটা যেন ভারতবর্ষকেই দু'ভাগে ভাগ করে ফেলে, যার একটা ভাগকে কমলা খুব অল্প চেনে, আরেকটা ভাগকে কখনও দেখেইনি।
কমলার দিদা জয়পুর শহরের একটু বাইরের দিকে থাকেন, তাঁর বাড়ির সামনের রাস্তাটা পেরোলেই মাইলের পর মাইল জুড়ে ছড়িয়ে আছে মাঠ আর গ্রাম। কিন্তু কমলা কখনও ওই রাস্তাটা পেরোয়নি। রাস্তাটা ব্যস্ত শহরকে ওই দিগন্তবিস্তৃত সবুজের কাছ থেকে আলাদা করে রেখেছে।
কমলা শহুরে জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত। ইংল্যান্ডে লণ্ডন আর ম্যাঞ্চেস্টার, আর এদেশে দিল্লি আর জয়পুর। বৃষ্টিভেজা ম্যাঞ্চেস্টার অবশ্য রৌদ্রস্নাত জয়পুরের চেয়ে অনেকদিক দিয়েই আলাদা, আর তাছাড়া ভারতীয় শহরগুলোর নিজস্ব যে বর্ণ গন্ধ, সবই বিলিতি শহরদের চেয়ে অনেক বেশি তীব্র। তবুও, দেশি হোক, বা বিদেশি, প্রতিটি শহরেরই অনেককিছু একইরকমঃ ব্যস্ত মানুষের তাড়াহুড়ো, টাকাপয়সার দেওয়া-নেওয়া, বাস ধরার তাড়া, স্কুলে যাওয়ার তাড়া, জমায়েতে হাজির হওয়ার তাগিদ, টিভি দেখার অভ্যেস, সবই একরকম। ইংল্যাণ্ডের গ্রাম্য এলাকা কমলা খুব কম দেখেছে, ভারতের গ্রামাঞ্চল দেখেছে আরওই কম।
ওর বাবা ম্যাঞ্চেস্টারে একটি বড় হাসপাতালের ডাক্তার। ও ইংল্যান্ডের স্কুলেই পড়ে, কিন্তু এবছর গরমের ছুটিতে দিদার সঙ্গে থাকবে বলে দেশে এসেছে। জয়পুরের শহরতলিতে একটা ছোট বাড়িতে দিদা একাই থাকেন, সঙ্গে থাকেন একজন কাজের মহিলা আর একজন বয়স্ক দারোয়ান। শীতকালে জয়পুরের আবহাওয়া বেশ ঠাণ্ডা আর আরামদায়ক, কিন্তু গ্রীষ্মে সূর্যের প্রখর তেজে চারিদিক ঝলসে যায়।
শহরের অন্য কোনও বাচ্চাই বড়রাস্তা পেরিয়ে গম, তুলো, বাজরার ক্ষেতে অভিযানে যাওয়ার চেষ্টা করে না, কিন্তু কমলা এবার ঠিক করে রেখেছে ইংল্যাণ্ডে ফেরার আগে সে একবার ঐ মাঠ-ক্ষেতের দিক থেকে ঘুরে আসবেই। বাড়ির ছাদ থেকে ও দেখতে পায় মাইলের পর মাইল ছড়িয়ে আছে গম-বাজরার ক্ষেত, পাকা গমের দল গনগনে হাওয়ায় মৃদু মাথা দোলাচ্ছে। শেষ পর্যন্ত, ফেরার যখন আর মাত্র দু’দিন বাকি,তারপরেই লণ্ডনের ফ্লাইট ধরার জন্য কমলাকে দিল্লি রওনা হতে হবে, এমন এক দিনে মনকে তৈরি করে সে বড়রাস্তাটা পার করেই ফেলল।
কাণ্ডটা কমলা ঘটাল ঠিক দুপুরবেলায়, যখন দিদা ঘুমোচ্ছেন, আর কাজের লোকেরা গেছে বাজারে। খিড়কির দরজা দিয়ে চুপিচুপি বেরিয়ে এসেই গলিপথে ধুলো উড়িয়ে সে দৌড়ে চলল বড়রাস্তার দিকে।
একখানা বাস গজরাতে গজরাতে চলে গেল, তার ফেলে যাওয়া ধুলোর ঘুর্ণি কমলাকে পাক খেয়ে নিলো। কমলা ধুলোর মধ্যেই দৌড়ল,রাস্তার ধারের জ্যাকারাণ্ডা গাছগুলোকে পেরিয়ে।
হঠাৎই পৃথিবীটা যেন বিরাট বড় আর রহস্যময় হয়ে উঠল, সেইসঙ্গে, অল্প একটু ভয়ও করতে লাগল যেন!
গমের ক্ষেত ছড়িয়ে রয়েছে আদিগন্ত, দূরে বহুদূরে গিয়ে চোখধাঁধানো নীল আকাশের সঙ্গে মিশেছে। কমলার বাঁদিকে দাঁড়িয়ে আছে কয়েকটা গাছ আর সাদা কুঁড়েঘর। ডানদিকে লাল ধুলো ঘেরা ইঁটভাটা আর তার কালো চিমনি। সামনে একটু দূরে একটা উট একটা কুয়োর চারপাশে ঘুরছে আর মাঠে দেওয়ার জন্য জল তুলছে। কমলা উটটার দিকে এগোলো।
দিদা ওকে শহরের রাস্তায় একা একা ঘুরে বেড়াতে বারণ করে। কিন্তু এটা তো শহর নয়, আর ও যদ্দূর জানে উট মানুষ দেখলে তেড়ে আসে না।
উটের কাছে পৌঁছোতে বেশ অনেকটা সময় লাগল। প্রায় আধমাইল দূর, যদিও মনে হচ্ছিল অনেকটাই কাছে। কমলা ওখানে পৌঁছে আশ্চর্য হয়ে দেখল আশেপাশে আর কেউ নেই। উটটা নিজেই চাকা ঘোরাচ্ছে, কুয়োর চারপাশে ঘুরে চলেছে, ছোট ছোট ট্রে-তে জল উঠছে, সেই জল ছোট ছোট নালা বেয়ে ক্ষেতে গিয়ে পড়ছে। উটটা কমলার দিকে একবার ফিরেও তাকাল না, নিজের কাজ করে যেতে লাগল।
কয়েক গজ দূরে একটা আমগাছের দিকে হেঁটে যেতে যেতে কমলা ভাবল, এখানে কেউ তো থাকবে নিশ্চয়ই! আমগাছের ডালে পাকা সোনার দানার মতো পাকা আমগুলো ঝুলে আছে। একটা ছেলে গাছের নিচে শুয়ে ঘুমোচ্ছে।
ছেলেটার পরনে কেবল একটা নোংরা সাদা প্যাণ্ট। রোদে পোড়া গা, উস্কোখুস্কো চুল, ধুলোয় সাদা হয়ে যাওয়া পা। ছড়িয়ে রাখা এক হাতে বাঁশি। ছেলেটা রোগা, হাড়জিরজিরে পা, কিন্তু শক্তপোক্ত শরীর, কমলার মনে হল ছেলেটার গায়ে জোর আছে যথেষ্ট।
ও কখনও কোনও গ্রামের ছেলেকে দেখেনি। ঘুমন্ত ছেলেটার কাছে আস্তে আস্তে এগিয়ে এসে কৌতুহলী চোখে ছেলেটাকে দেখতে লাগল। ছেলেটার মুখের ওপর কমলার ছায়া পড়ছিল, ছেলেটার ঘুম ভেঙে গেল। চোখ খুলে কমলার দিকে তাকালো। কমলা কিছুই বলছিল না, ছেলেটা উঠে বসল, মাথা একদিকে কাত করে হাঁটুতে হাত রেখে কমলার দিকে তাকিয়ে রইল।
“তুমি কে?” কিঞ্চিৎ রুক্ষভাবে জিজ্ঞেস করল সে। একটা মেয়ে মুখের দিকে তাকিয়ে রয়েছে, ঘুম থেকে উঠেই এই দৃশ্য দেখা অভ্যেস নেই তো!
“আমি কমলা। আমি ইংল্যাণ্ড থেকে এসেছি, কিন্তু আসলে আমি ভারতের মানুষ। মানে, আমি এদেশে বাড়ি এসেছি, কিন্তু আসলে আমি ইংল্যাণ্ডের লোক।” ব্যাপারটা ক্রমশ গোলমেলে শোনাচ্ছিল, তাই কমলা উলটে প্রশ্ন করল, “তুমি কে?”
“আমি গ্রামের সবচেয়ে শক্তিশালী ছেলে,” গম্ভীর মুখে ছেলেটা বলল।
“আমার নাম রোমি। আমি কুস্তি করতে পারি, সাঁতার কাটতে পারি, যেকোনও গাছে চড়তে পারি।”
“আর তুমি খুব ঘুমোতেও পারো?” কমলা নিরীহ মুখে জিজ্ঞেস করল।
রোমি মাথা চুলকে মুচকি হাসল।
“উটের জন্য জেগে থাকার তো কোনও মানে হয় না! ক্লান্ত না হওয়া পর্যন্ত ও কুয়োর চারপাশে ঘুরবে, তারপর থামবে। জিরোনো হয়ে গেলে আবার ঘুরতে শুরু করবে। এইভাবে সারাদিন কাটিয়ে দিতে পারবে, তবে প্রচুর খাবার খায়।”
উটের খাবারের কথা বলতে গিয়ে রোমির মনে পড়ল তার নিজেরও ক্ষিদে পেয়েছে। ইদানিং সে খুব তাড়াতাড়ি বেড়ে উঠছে, প্রায় সারাক্ষণই ক্ষিদে পায়। তার পাশে কয়েকটা আম পড়ে ছিল, একটা সে কমলাকেও দিল। কিছুক্ষণ ওরা চুপ করে রইল। আম চোষা আর কথা বলা দুটো কাজ তো আর একসঙ্গে করা যায় না! আমটাম খেয়ে ঐ ট্রেগুলোর একটায় হাত ধুয়ে এল দুজনে।
“গাছটায় টিয়া আছে!” কমলা বলল, মগডালে কিচিরমিচির করা তিন চারটে টিয়ার দিকে ওর নজর গেছে। এদের দেখে পপ গানের দলের কথা মনে পড়ে যায়!
“ব্যাটারা প্রায় সব আম নষ্ট করে দেয়!” রোমি বলল।
একটা ঢিল ছুঁড়ল সে টিয়াগুলোর দিকে তাক করে, গায়ে লাগল না, তবে পাখিগুলো ক্যাচরম্যাচর করে প্রতিবাদ জানিয়ে উড়ে গেল, সবুজ আর সোনালি ঝলক দেখা গেল ক্ষণেকের জন্য।
“তুমি কোথায় সাঁতার কাটো?” জিজ্ঞেস করল কমলা,, “ কুয়োর ভেতরে?”
“মোটেই না। আমি ব্যাঙ নই। এখানে কাছেই একটা খাল আছে। চলো, তোমায় দেখাই।”
ওরা যখন মাঠ পেরোচ্ছিল, একজোড়া নীলকণ্ঠ পাখি ঝোপ থেকে বেরিয়ে এসে এঁকেবেঁকে উড়তে লাগল।
দিদার বলা একটা গল্প মনে পড়ে গেল কমলার।
“এদের গলাগুলো নীল, এরা খুব পবিত্র পাখি, তাই না?”
ও রোমিকে সেই গল্পটা বলল, সেই যে, সমুদ্রমন্থনে ওঠা বিষ শিবঠাকুর পান করে নিজের গলার কাছে আটকে রেখেছিলেন, পৃথিবীকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করেছিলেন, সেই গল্পটা।
“তাই তো শিবঠাকুরের গলার রঙ নীল, নীলকণ্ঠ পাখির মতো।”
গল্পটা রোমির ভাল লাগল। কমলার প্রতি শ্রদ্ধা তার বেড়ে গেল বেশ। কিন্তু তাই বলে সে নিজে পিছিয়ে থাকবে না নিশ্চয়ই! তাই যখন একটা কাঠবেড়ালির দেখা মিলল, তখন সেও কমলাকে জানাল, কাঠবেড়ালিও খুবই পবিত্র প্রাণী। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ, যিনিও নাকি রোমিরই মতো কোনও এক চাষিবাড়ির ছেলে ছিলেন, তিনি নাকি কাঠবেড়ালি খুবই পছন্দ করতেন, তাদের হাতে নিয়ে ঘুরতেন, তাদের গায়ে হাত বুলিয়ে দিতেন।
“তাই তো কাঠবেড়ালির পিঠে অমন চারখানা কালচে দাগ রয়েছে। কৃষ্ণের গায়ের রঙ তো কালো, এই আমারই মতো, ওই কালচে দাগগুলো ওঁরই আঙুলের দাগ।”
“তুমি কাঠবেড়ালি ধরতে পারো?” কমলার প্রশ্ন।
“নাহ্, ওরা বড্ড তাড়াতাড়ি পালায়। আমি একবার সাপ ধরেছিলাম। সাপের লেজ ধরে পুরনো কুয়োতে ফেলে দিয়েছিলাম। ওই কুয়োটা সাপে ভর্তি। যে যখনই সাপ ধরি, না মেরে কুয়োতে ফেলে দিই। ব্যস, ওরা আর বেরোতে পারে না।”
গভীর কুয়োটার তলায় সাপ কিলবিল করছে ভেবেই কমলা কেঁপে উঠল। রোমির সঙ্গে আবার ওই কুয়োটার কাছে যেতে চাইবে কিনা ও নিশ্চিত হতে পারছিল না, তবে খালের কাছে পৌঁছে ও সাপের কথা ভুলে গেল।
একটা ছোট্ট খাল, দশ মিটার মতো চওড়া, খালের মাঝখানে কোমরজল, তবে নিচে প্রচুর কাদা। এত কাদাভরা নদীনালা কমলা জীবনে কখনও দেখেনি।
“নামবে?” রোমি জিজ্ঞেস করল।
“না। তুমি নামো।”
রোমি তো জলে নানারকম কায়দা দেখানোর জন্য তৈরিই ছিল। ঘাসজমিতে পা রেখে, পায়ের পেশি টানটান করে ঝপাং করে জলে ঝাঁপিয়ে পড়ল সে, ঝাঁপটা যদিও ভাল হল না, একটু অদ্ভুতভাবেই জলে পড়ল, তবে কমলা এতেই অবাক হয়ে গেল।
রোমি সাঁতরে ওপারে গেল, আবার এপারে ফিরে এল। যখন জল থেকে উঠল, একেবারে কাদায় মাখামাখি হয়ে গেছে। সাংঘাতিক দেখতে লাগছে তাকে।
“চল নামবে। বেশি গভীর নয় তো!”
“নোংরা যে!” কমলা বলল বটে, তবে ইচ্ছে ছিল একইরকম।
“আরে কাদা তো শুধু! কাদায় খারাপ কিছু নেই। উট, মোষ সবাই কাদা ভালবাসে।”
“আমি উট নই, মোষও নই।”
“বেশ, জলে নামতে হবে না, জলের ধার ধরে হাঁটো।”
একটু দোনামোনা করে কমলা চটি খুলে সাবধানে ঢালু জমি দিয়ে নেমে জল ছুঁয়ে দাঁড়াল। আর দূরে না গেলেও একটু একটু কাদাজল এসে ওর পরিষ্কার সাদা স্কার্ট ভিজিয়ে দিল। দিদাকে কী বলবে এবার? নরম কাদায় ওর পা ডুবে যাচ্ছিল, জল এসে ওর হাঁটু ভিজিয়ে দিচ্ছিল, ও একটু চেঁচিয়ে উঠল। ওই আঠালো কাদা থেকে একটু কষ্ট করেই পা টেনে বার করতে হল।
ওরা দুজনে জলের ধার দিয়ে টলমল করে হেঁটে যাচ্ছিল, ছোট্ট ছোট্ট মাছেরা ওদের পায়ের ফাঁক দিয়ে সাঁতার কেটে বেড়াচ্ছিল। একটা বক, একপায়ে খাড়া হয়ে দাঁড়িয়েছিল। যেই ওরা পেরোলো, অমনি ছোঁ মেরে জল থেকে একটা মাছ তুলে নিল। বকের পেটের ভেতরে মিলিয়ে যাওয়ার আগের মুহূর্তে ছোট্ট মাছটা রোদ্দুরে ঝিকমিক করে উঠল।
রোমি হঠাৎ ভীষণ অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল।
“কী হয়েছে?” ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করল কমলা।
“কচ্ছপ! দেখতে পাচ্ছ?”
রোমি আঙুল তুলে খালের পাড়ের দিকে দেখালো। একটা ছোট কচ্ছপ সেখানে স্থির হয়ে শুয়ে আছে। রোমি হাঁচোড়পাঁচোড় করে পাড়ে উঠে পড়ল এবং কমলা তাকে থামানোর আগেই সে কচ্ছপটাকে হাতে তুলে নিল। যেই না তুলে নেওয়া, অমনি কচ্ছপ তার মাথা আর পা খোলার মধ্যে ঢুকিয়ে ফেলল।
“দ্যাখো!” যেখানে কচ্ছপটা ছিল সেদিকে দেখিয়ে কমলা চেঁচিয়ে উঠল।
“গর্তটায় কী আছে?”
ওরা গর্তে উঁকি দিল। আধমিটার মতো গভীর গর্ত, তার মধ্যে মুরগির ডিমের চেয়ে একটু ছোট পাঁচ-ছ’টা সাদা ডিম।
“ওটাকে ওখানে রেখে দাও,” কমলা বল, “ও ডিমে তা দিচ্ছিল।”
রোমি কাঁধ ঝাঁকিয়ে কচ্ছপটাকে তার গর্তে রেখে দিল। সেটা খোলা থেকে একবার উঁকি মেরে দেখল ছেলেমেয়েদুটো এখনও হাজির রয়েছে, ফলে আবার তার খোলার মধ্যে ঢুকে পড়ল।
“আমায় এবার যেতে হবে,” কমলা বলল। “দেরি হয়ে যাচ্ছে। দিদা খুঁজবে।”
ওরা আমগাছের কাছে ফিরে এল, কুয়োর জলে হাত পা ধুয়ে নিল। যদিও ধোয়ার আগে রোমি কমলাকে বুঝিয়ে বলল যে এই কুয়োতে সাপ নেই, ও পুরনো কুয়োতে সাপ ফেলার গল্প বলেছিল, সেটা গ্রামের অন্য প্রান্তে। এটা শুনে কমলা নিশ্চিন্ত হল।
কমলা বলল রোমিকে একদিন ওদের বাড়িতে নিয়ে যাবে, যদিও সে হবে পরের বছর, বা তারও পরের বছর, যবে কমলা আবার এদেশে আসবে।
“তুমি কি অনেক দূরে যাচ্ছ?” রোমির প্রশ্ন।
“হ্যাঁ গো, সেই সমুদ্র পার হয়ে তবে ইংল্যাণ্ড। আমায় বাবামায়ের কাছে ফিরতে হবে, স্কুলে যেতে হবে। আমি দিল্লি গিয়ে প্লেনে উঠব। তুমি দিল্লি গেছ?”
“জয়পুরের বাইরে আর কোথাও যাইনি। ইংল্যাণ্ড কেমন জায়গা? খাল আছে ওখানে? সাঁতার কাটা যায়?”
“সমুদ্রে সাঁতার কাটতে পারবে। প্রচুর লোক সমুদ্রে যায়। তবে বেশিরভাগ সময়েই খুব ঠাণ্ডা। আমি যেখানে থাকি সেখানে অনেক দোকান আছে, সিনেমাহল আছে, আরও অনেক জায়গা আছে যেখানে তুমি যা ইচ্ছে তাই খেতে পারবে। সারা বিশ্বের লোকজন সেখানে থাকতে আসে। লাল, বাদামি, কালো, সাদা সবরকম রঙের মুখ তুমি সেখানে দেখতে পাবে।”
“ আমি লালমুখ একবার দেখেছি জানো!” রোমি বলে উঠল। “গ্রামে এসেছিল ছবি তুলতে। আমায় উটে বসিয়ে ছবি তুলেছিল। বলেছিল আমায় ছবিটা পাঠাবে, কিন্তু পাঠায়নি।”
ঘাসে পড়ে থাকা বাঁশিটা কমলার চোখে পড়ল।
“এটা তোমার বাঁশি?”
“হ্যাঁ। এটা পুরনো। কিন্তু পুরনোগুলোই সবচেয়ে ভাল হয়। এটা গতবছর মাঠে কুড়িয়ে পেয়েছিলাম। এটা বোধহয় শ্রীকৃষ্ণের বাঁশি! তিনি তো সবসময় বাঁশি বাজাতেন!”
“তোমায় বাঁশি বাজাতে শেখাল কে?”
“কেউ না। নিজে নিজেই শিখেছি। শুনবে?”
কমলা ঘাড় নাড়ল। ওরা গাছে হেলান দিয়ে বসল, রোমি বাঁশি বাজাতে শুরু করল।
ধীর মিষ্টি একটা সুর, একটু মনখারাপের, একটু আনন্দের! মৃদুমন্দ হাওয়া যেন বাঁশির সুরগুলোকে ভাসিয়ে নিয়ে মাঠ পেরিয়ে কোথায় চলে যাচ্ছিল। পাখিরা, ওই উটটা, আর কমলা ছাড়া সেই সুর শোনার মতো আর কেউ কোত্থাও নেই। উটটার ভাল লাগছিল কি না জানা নেই, সেটার যা কাজ তা-ই করে চলেছিল। পাখিদের ভাল লাগছিল কি না বোঝার উপায় নেই, যদিও বাঁশি শুরু হতেই পাখিদের কিচিরমিচির থেমে গিয়েছিল। কমলার ভাল লাগছিল। রোমি যতক্ষণ বাজাচ্ছিল, ওর চোখ হাসছিল, আর আঙুল খেলা করছিল বাঁশিতে। যখন সে বাজানো থামালো, চারিদিক নিশ্চুপ, চারিদিক নিস্তব্ধ। কেবল গমের ক্ষেত দিয়ে বয়ে যাওয়া হাওয়ার শ্বাস আর কুয়ো থেকে তোলা জলের কলকলটুকুই আছে।
কমলা চলে যাওয়ার জন্য উঠে দাঁড়াল।
“আবার কবে আসবে?” প্রশ্ন করল রোমি।
“চেষ্টা করব পরের বছর আসতে,” কমলা উত্তর দিল।
“সে অনেক দেরি। ততদিনে তুমি বড় হয়ে যাবে। হয়তো আসতে চাইবে না।”
“আমি আসব।”
“আসবে?”
“হ্যাঁ।”
রোমি বাঁশিটা কমলার হাতে দিয়ে বলল, “রেখে দাও। আমি আরেকটা পেয়ে যাব।”
“কিন্তু আমি তো বাঁশি বাজাতে জানি না!”
“এটা নিজে নিজেই বাজবে,” রোমি বলে উঠল।
কমলা বাঁশিটা ঠোঁটে ঠেকিয়ে ফুঁ দিল, একটা চড়া বেসুরো আওয়াজ বেরিয়ে আমগাছে থাকা একটা একলা টিয়াকে চমকে দিল। রোমি হাসতে লাগল, কমলা ঘুরে মেঠো পথ ধরে দৌড়োতে লাগল। একটু দূরে গিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়ে রোমির দিকে তাকিয়ে হাত নাড়ল। রোমি কুয়োর কাছে দাঁড়িয়ে হাত নাড়তে লাগল।
হাত মুখের কাছে এনে সে চিৎকার করে বলল,
“পরের বছর আসতে ভুলো না!”
কমলাও বলে উঠল, “ভুলব না।” কিন্তু তার গলার আওয়াজ ছিল খুব আস্তে, শব্দগুলো হাওয়ায় ভেসে দূরে চলে গেল। রোমি কিছুই শুনতে পেল না।
"আমার বাড়ি কোথায়? ইংল্যাণ্ডেই কি?" কমলা ভাবছিল। নাকি ভারতের এই শহরই বাড়ি? নাকি ওর আসল বাড়ি ওই অন্য ভারতবর্ষে, ওই ব্যস্ত রাস্তা পেরিয়ে? একদিন নিশ্চয়ই কমলা উত্তরটা খুঁজে পাবে।
দূরে যেতে যেতে কমলা যতক্ষণ না একটা বিন্দুর মতো ছোট হয়ে এল, রোমি দেখছিল। তারপর ঘুরে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে উটটাকে আরও তাড়াতাড়ি ঘুরতে বলল। উটের যদিও তাতে কিছু হেলদোল হল না, সে তাকালোও না, আগের মতোই কাজ করে চলল, যেমনভাবে ভারতবর্ষ বয়ে চলেছে হাজার বছর ধরে, তেমনভাবেই উটটাও ঘুরে চলল কুয়োর চারপাশে, জলের কলকল আর মসৃণ পাথরে আছড়ে পড়াও চলতে লাগল একইভাবে।
(রাস্কিন বণ্ডের লেখা 'The Flute Player' এর অনুবাদ)
ছবিঃ শিল্পী ঘোষ