সবুজ মনের রসদ
Ichchhamoti Logo

ভূত যে আছে এ ব্যাপারে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই। বিশ্বাস না হলে মেজোদিদাকে জিজ্ঞেস কর। মেজোদিদা পরিষ্কার বলে দেবেন – কত রকমের ভূত আছে, তাদের স্বভাব-চরিত্র কী রকম, কোন্ ভূত কী খেতে ভালবাসে, কখন তারা পাড়ায় টহল দিতে বের হয়, কোন্ তিথিতে তাদের মেজাজ-মর্জি কেমন থাকে। এখন প্রশ্ন হল মেজোদিদা এতসব জানলেন কীভাবে? তার উত্তর হচ্ছে মেজোদিদা এদের সকলকেই স্বচক্ষে দেখেছেন এবং এখনও প্রায়ই দেখে থাকেন।

মেজোদিদা কক্ষনও বানিয়ে বানিয়ে ভূতের গল্প বলেন না। মানে বলতে পারেন না – এমনটাই জানিয়েছেন মেজোদিদা স্বয়ং। যেমন – যদি মেজোদিদাকে জিজ্ঞেস করো, স্কন্ধকাটা ভূত কেমন হয়? তার উত্তরে মেজোদিদা সবিনয়ে বলবেন, 'আমার জানা নেই ভাই, আমি কখনো দেখি নি'। কিন্তু পেত্নী, ব্রহ্মদত্যি, একানড়ে, গো-ভূত, ছাগ-ভূত, মেছোভূত, ভেতোভূত, বেতোভূত, গেঁতোভূত, দেঁতোভূত এইসব ব্যাপারে মেজোদিদার বিস্তর অভিজ্ঞতা আছে। চাইলেই যে কোন সময়, মেজোদিদা ওইরকম দু' চারটে ঘটনার কথা শুনিয়ে দিতে পারেন।   
বাঁটুল সাঁটুলকে বলল, 'আমি শুনেছি, স্কন্ধকাটাদের মুন্ডু থাকে না। মানে গলা থেকে উপরের অংশটা নেই একেবারে'।
সাঁটুলের গলায় অবিশ্বাসের সুর, 'তা কী করে হবে? এরকম ভূত থাকলে, ঠাকুমা এতদিনে নিশ্চয়ই দেখে ফেলত। তাছাড়া ভেবে দেখ্, কোন লোক কী মাথা ছাড়া ঘুরে বেড়াতে পারে। দেখবে কী করে? খাবে কী করে? শুনতেও তো পাবে না। এমন কি মাথা না থাকলে চুল আঁচড়ানোরও ভারী অসুবিধে'।
বাঁটুল ভূত-বিশেষজ্ঞের মত উত্তর দিল, 'ভূতেরা সব পারে। দিদা বলেছিল ভূতেদের অশরীরী বলে, কারণ তাদের শরীর থাকে না। তাহলে শরীর ছাড়াই যদি তারা সব কাজ করতে পারে তাহলে মাথা না থাকলে কী এমন অসুবিধে?'
সাঁটুল বলল, 'ঠিক আছে, চুল আঁচড়ানোর কথাটা ছেড়ে দিলাম। কিন্তু না খেলে বাঁচবে কেমন করে?'
বাঁটুল বলল, 'সেটাই তো বলছি - ভূতেরা সব পারে। হাত দিয়ে খাবার চটকে সরাসরি গলার নলিতে ঢুকিয়ে দেবে। ব্যস, কাজ শেষ'।
এবার একটু বাঁটুল সাঁটুলের পরিচয় দেওয়া যাক। বাঁটুলের মেজোদিদা হল সাঁটুলের ঠাকুমা। মানে বাঁটুলের মায়ের মা, মানে বাঁটুলের দিদার মেজো জা হল সাঁটুলের ঠাকুমা। মানে বাঁটুলের মায়ের মা মানে দিদার মেজো জা হল সাঁটুলের বাবার মা। মানে সহজ কথায় বাঁটুল, সাঁটুল হল পিসতুতো-মামাতো ভাই। বাঁটুলের মামাতো ভাই হল সাঁটুল আর সাঁটুলের পিসতুতো ভাই হল বাঁটুল।
বাঁটুল, সাঁটুল দুজনেই গ্রামের একমাত্র প্রাইমারী স্কুলটিতে ক্লাস থ্রি তে পড়ে। সারা বিকেল অবিশ্রান্ত ছোটাছুটির পর সন্ধ্যের সময় যখন তারা পড়তে বসে ঘুমে তাদের চোখ জড়িয়ে আসে। কোনরকমে দু-চারপাতা ইস্কুলের পড়া শেষ করেই তারা পড়ার জায়গাতেই শুয়ে পড়তে চায়। রাতের খাবার খাওয়ার জন্য তাদের কোন উৎসাহ থাকে না। এদিকে রান্না শেষ হতে তখনও বেশ কিছুটা দেরি। এই সময়টাই গল্প বলে তাদের জাগিয়ে রাখতে হয়। আর গল্পের মধ্যে ভূতের গল্প হল ঘুম তাড়ানোর সব চেয়ে ভাল ওষুধ।  
আজ শুরু হল গো-ভূতের গল্প। বাঁটুল, সাঁটুল জানত মানুষ মরে গেলে ভূত হয়। কিন্তু গো-ভূতের কথা কিছু তাদের জানা ছিল না। মেজোদিদা বললেন, 'গো মানে গরু। গরু মরে গেলে যে ভূত হয় তাকে বলে গো-ভূত'।
'গরুরও ভূত হয়?' বাঁটুল সাঁটুলের চোখ প্রায় কপালে, ঘুম-টুম সব হাওয়া
মেজোদিদা কেমন যেন উদাস গলায় বলেন, 'হয়, হয়। সব কিছুরই ভূত হয়। মানুষ, জীবজন্তু, গাছপালা, পুকুর, নদী, মাঠ, কাশফুল সবকিছুর। যারা থাকে না তারা সব ভূত হয়ে থাকে'।
সাঁটুল বলল, 'ও ঠাকুমা, তুমি কীসব বলছ, কিছু বুঝতে পারছিনা। তোমাকে কি ভূতে ধরল নাকি?'
বাঁটুল সঙ্গত করে, 'হ্যাঁ মেজোদিদা, আমিও কিছু বুঝতে পারছি না। তুমি গো-ভূতের গল্পটা বল না'।
মেজোদিদা বলেন, 'আচ্ছা শোন্ তবে। তোদের মনে আছে, সেই যে সাদা গাইটা তিনদিনের পেটখারাপে মারা গেল, ছোট বাছুরটাকে রেখে – সেই তো এখন গো-ভূত। সে এখনও আসে'।
বাঁটুল, সাঁটুলের পরিষ্কার মনে আছে সে দিনের ঘটনা। অত বড় গাইটা কেমন রোগে কাহিল হয়ে পড়েছিল। গরুর কবরেজ এসে কত কী বেটে খাওয়াল, কিছুতেই আর গাইটা সুস্থ হল না। ওরা দুজনে খড়ের আঁটি, বাঁশপাতা এগিয়ে দিয়েছিল। কিছুই খেল না গাইটা। শুধু ক্লান্ত মাথাটা দু'দিকে নাড়িয়েছিল। তারপর তো মারাই গেল। অনেকে মিলে তাকে নিয়ে গিয়ে ভাগাড়ে ফেলে এসেছিল। ওদের খুব মন খারাপ হয়ে গিয়েছিল সেইদিন। বাছুরটাও – যার নাম কালু, কালো রঙের জন্য, চুপ করে বসেছিল সেইদিন। কালু এমনিতে খুব ডাকাবুকো। ওর সঙ্গে দৌড়ে কখনো পেরে ওঠে না বাঁটুল, সাঁটুল। তাও শুধু দৌড়লে একটা কথা ছিল। ছুটতে ছূটতে কালু কখন কোন্ দিকে বাঁক নেবে, কখন হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে মিহি হাম্বারব ছাড়বে, কখন ঘাড় উঁচু করে সামনের দুই-পা তুলে আবার নীচের দিকে নামিয়ে অদৃশ্য প্রতিপক্ষের সঙ্গে লড়াই করবে, কিছুই বলা যায় না। তিনদিন বয়সী কালুর কাছে দৌড়ে হেরে বাঁটুল, সাঁটুল হাঁফাতে হাঁফাতে এসে বটগাছের তলায় বসে ভাবছিল – এমন অবিশ্বাস্য ঘটনা কী করে ঘটল! শেষে বাঁটুল বলল, 'ছেড়ে দে, ওর চারটে পা!'
সেই কালুর মা এখন গো-ভূত হয়ে গেছে? কী করে সে এখন? কাকে ভয় দেখাতে আসে?
মেজোদিদা মিষ্টি হেসে বলেন, 'না না ভয় দেখাতে আসবে কেন? সে তো কালুর সঙ্গে দেখা করতে আসে। সে দিন মাঝ রাত্তিরে গোয়ালে গিয়ে দেখলাম, কালু মায়ের কোল ঘেঁষে বসে আছে। আর তার মা জিভ দিয়ে কালুর কপাল চেটে দিচ্ছে। মাঝে মাঝে লেজের ঝটকা দিয়ে কালুর গা থেকে মশা, মাছি তাড়াচ্ছে'।          
বাঁটুলের মনে ইদানীং একটু সংশয় দেখা দিচ্ছে – ভূত কি আছে? ইস্কুলের বিজ্ঞানের মাস্টারমশায় যে বললেন ভূত বলে কিছু হয় না, সবই মানুষের মনগড়া ব্যাপার। তারাও তো কোনদিন ভূত দেখেনি। তাহলে মেজদিদা এত ভূত দেখেন কী করে? এসব নিয়েই সাঁটুলের সঙ্গে আলোচনা হচ্ছিল। তবে সাঁটুলের আজ মেজাজটা খারাপ। পড়া না পারার জন্য ইস্কুলে আজ বাঁটুলের হাতে কানমলা খেতে হয়েছে। তাই সব কথার হ্যাঁ, হুঁ করে উত্তর দিচ্ছিল।      
ঘটনাটা হল - ইস্কুলে আজ ইংরেজির মাস্টারমশায় এইট বানান জিজ্ঞেস করেছিলেন। এক এক করে উঠে দাঁড়িয়ে সবাই বলতে লাগল ই আই টি – এইট। তারপর সবার জন্য মাস্টারমশায়ের একই উত্তর, দাঁড়িয়ে থাক্। সাঁটুলের পালা এলে সে উঠে দাঁড়িয়ে গম্ভীরভাবে বলল, 'না মাস্টারমশায় ই আই টি নয়, এইট বানান হচ্ছে এ আই টি'।
-    ওঃ একেবারে বিদ্যের জাহাজ এসেছেন। দাঁড়িয়ে থাক্। বাঁটুল তুই বল্, এইট বানান কী?
-    ই আই জি এইচ টি – এইট।
-    আমি জানতাম তুই পারবি। এবার যারা পারে নি তাদের সবার কান মুলে দে।
মাস্টারমশায়ের নির্দেশ পালিত হয়। ক্লাসের প্রায় অর্ধেক ছাত্রের কান মুলে দেয় বাঁটুল। এখন বাঁটুলের মনে হল, ওইজন্যই আজ সাঁটুলের মেজাজটা খারাপ। ঠিক করে কথা বলছে না বাঁটুলের সঙ্গে।
বাঁটুল বলল, 'দেখ্, আমি কিন্তু আস্তে করে কান মুলেছি তোর। এমনকি সেটাকে কানমলা না বললেও হয়। শুধু কানে হাত বুলিয়ে দিয়েছি একটু......ঠিক আছে, তুই কি এখন একবার আমার কান মুলে দিবি? শোধবোধ হয়ে যাবে'।
সাঁটুল চুপ করে কী যেন ভাবে। তার চোখদুটোও একটু ছলছল করে। বাঁটুলের সঙ্গে তার মারপিট প্রায় দৈনন্দিন ঘটনা। কিন্তু এখন বিনা প্ররোচনায় বাঁটুলের কান মুলে দেওয়াটা, বিশেষত যখন বাঁটুল নিজেই কানমলা খেতে চাইছে - ঠিক সমীচীন হবে না বলে তার মনে হয়। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সাঁটুল বলে, 'সে আর তুই কী করবি বল্? তোকে তো মাস্টারমশায় বলেছে। তবে তোকে আমি বলে রাখছি এই এইট বানানটা খুব গোলমেলে'।
অচিরেই সিদ্ধান্ত হয়ে যায় ইংরেজরা অতি বদ। তাদের বানানের কোন নিয়মকানুন নেই। এইট বানানে জি এবং এইচ অক্ষর দুটির উপস্থিতি একেবারেই অপ্রয়োজনীয়। সেটা শুধু তাদের মত সুকুমারমতি বালকদের বিভ্রান্ত করার জন্যই। ইংরেজদের বদমায়েশির আরও প্রমাণ পাওয়া গেছে, কিছুদিন আগে তাদের পাড়ায় অভিনীত 'রক্তে বোনা ধান' নাটকে। গরিব চাষিগুলোকে নীলকর সাহেবরা চাবুক দিয়ে কী মারটাই না মেরেছিল। জয় হিন্দ্! বন্দেমাতরম!
এমনকি ইংরেজির মাস্টারমশায়কেও খুব একটা ভাল মানুষ বলা যায় না। বেছে বেছে এইট বানানটাই জিজ্ঞেস করতে হল। তাও ক্লাস থ্রি এর ছেলেমেয়েদের। তাদের এখনো ক্লাস এইট এ উঠতে ঢের দেরী!
ইংরেজদের মুণ্ডপাতের পর আবার ভূত প্রসঙ্গ শুরু হল। সাঁটুল বলল, 'দেখ্, ঠাকুমা যখন বলেছে, তখন নিশ্চয়ই ভূত আছে'।
বাঁটুল বলল, 'তাহলে আমরা দেখতে পাচ্ছি না কেন? যত ভূত শুধু মেজোদিদাকেই দেখা দেয়। সেবারে যে মাছ ধরার গল্পটা বলল......তোর বাবা মানে মামা সন্ধ্যেবেলায় সন্ন্যাসী-ডোবায় মাছ ধরতে গিয়েছিলো। পেছনে লন্ঠন হাতে মেজোদিদা। আচমকাই অর্জুন গাছের আড়াল থেকে কে যেন বেরিয়ে এসে বলল, 'ঠাঁকুরমশায়, দুঁটা মাঁছ দাঁও দিঁকিনি, হাঁতচাটুতে ভেঁজে তাঁপ্পর নুঁন-তেঁল-পেঁয়াজ দিঁয়ে এঁকটু চঁটকে খাঁব'। সেটা নাকি ছিল সদগোপদের কোন্ সধবা বৌ, অল্প বয়স, মাথায় ঘোমটা। অপঘাতে মরেছিল। তারপর মেজোদিদা চারটে চ্যাং মাছ ছুঁড়ে দিতে তাই নিয়ে সে হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। তাকে তো মামাও দেখতে পায় নি। মামা পরে জিজ্ঞেস করতে মেজোদিদা বলেছিল, ওই একটা পেত্নী এসেছিল, দুটো মাছ দিলাম'।
তারপর সাঁটুল গিয়ে তার ঠাকুমা কে বলল, 'ঠাকুমা, বাঁটুল বলছে, ওকে ভূত দেখাতে হবে, তুমি তো এত ভূত দেখতে পাও'।
বাঁটুল কিঞ্চিৎ সংযোজন করে, 'শুধু আমি নয় মেজোদিদা, সাঁটুলেরও ভূত দেখার খুব শখ। আমাদের দেখাও না একবার। দেখাও না, দেখাও না'।
মেজোদিদা আঁতকে উঠে বলেন, 'ভুলেও ওসব কথা মুখে এনো না দাদুভাইরা। এই কি তোমাদের ভূত দেখার বয়স? কত তাগড়াই জোয়ানকে ভুতের ভয়ে অজ্ঞান হয়ে পুকুরপাড়ে পড়ে থাকতে দেখেছি। খুব সাহস আর মনের জোর না থাকলে সেসব দৃশ্য সহ্য করা মুশকিল। তাছাড়া সব ভূত যে ভাল আর নিরীহ হবে এমন তো কোন কথা নেই। আমি তো তোমাদের শুধু ভাল ভূতেদের কথাই বলেছি। বদ ভূতেদের পাল্লায় পড়লে, তখন জীবন নিয়ে টানাটানি। তবে আমার কথা আলাদা। যে রকম আমার মনের জোর, তেমনই আমার ঠাকুর দেবতায় ভক্তি। একবার ইষ্টমন্ত্র জপ করলে ওরা পালাবার পথ পাবে না। তবে সে-সবের দরকার পড়ে না। আসলে আমি তো বিপদে-আপদে ওদের সাহায্য করি, কলাটা, মূলোটা দিই। তাই সবাই আমায় খুব মান্যি করে'।              
অতঃপর বাঁটুল এবং সাঁটুলের মধ্যে কীসব গোপন শলা-পরামর্শ হয়। কাঁচি দিয়ে সাদা কাগজ কাটতে দেখা যায় তাদের, যেন সরস্বতী পুজোর জন্য কাগজের শিকলি বানাচ্ছে। তবে সরস্বতী পুজোর এখনও অনেক দেরী। সবে তো বর্ষাকাল।      
সারাদিন অঝোর ধারায় বৃষ্টি হয়েছে আজ। এখন সন্ধ্যে আটটা বাজবে প্রায়। আকাশে ঘন কালো মেঘ। চাঁদ, তারা কারুর পাত্তা নেই। নিকষ কালো অন্ধকার। মাটির বাড়ির পেছনের দিকটায় একটা ছোট চালা। সেখানে শুকনো কাঠকুটো রাখা আছে কিছু। একটু দূরে কচু আর ওলগাছের ঘন ঝোপ। বর্ষার জল পেয়ে লকলকিয়ে বেড়ে উঠেছে। তার নিচে ধানের জমি। একপাশে পুকুর। ঝিঁঝিঁ আর ব্যাঙের অবিশ্রান্ত ডাকাডাকি। একঝাঁক জোনাকি বাঁশবনে টিমটিমে আলো ছড়াচ্ছে। বাঁটুল বলল, 'সাঁটুল, আমার ভয় করছে। চল ঘরে ফিরে যাই। এখানে মশা কামড়াচ্ছে খুব। তারপর এক্ষুনি আমাদের খেতে ডাকবে'।
সাঁটুল বলল, 'আর একটু দাঁড়াই। আমি দেখে এসেছি, উনুনে কাঠ শেষ হয়ে এসেছে। একটু পরেই ঠাকুমা কাঠ নিতে বেরোবে। তারপরই......'।


প্রাথমিক পরিকল্পনা যদিও বাঁটুলেরই ছিল, কিন্ত এখন সাঁটুলেরই উৎসাহটা বেশি। মাঝপথে কাজ ছেড়ে যেতে সে আগ্রহী নয়। বলল, 'নে, বাঁটুল মুখোশটা পরে নে'।
দুজনে কাগজের মুখোশ পরে প্রস্তুত হয়। সাদা কাগজে, গোল গোল করে কেটে কয়েকটা জায়গা বাদ দেওয়া হয়েছে। সেখান থেকে দুই চোখ, নাক আর মুখ বেরিয়ে আছে। দুই দিক দিয়ে সুতোর সাহায্যে হালকা ভাবে মাথার পেছনের দিকে বাঁধা। সাঁটুলের অনুমান অভ্রান্ত। একটু পরেই খিড়কির দরজা দিয়ে একটা লন্ঠন হাতে তার ঠাকুমা বেরিয়ে আসেন। কিন্তু ঠাকুমা তো এদিকে তাকাচ্ছেন না। খুব গভীর মনোযোগে কাঠের স্তূপ পর্যবেক্ষণ করছেন, কোন্ কাঠগুলো হালকা আর বেশি শুকনো দেখছেন। এদিকে সময় বয়ে যায়। সাঁটুল বলল, 'ওরে, ঠাকুমা তো এদিকে তাকাচ্ছে না, কী করে ভয় দেখাব?'
বাঁটুল ফিসফিস করে বলল, 'ডাক ছাড়। জোরে ডাক দে'।
সাঁটুলের মাথাটা এইসময়েও ঠিকঠাক কাজ করছে। বলল, 'আরে এখন যদি ঠাকুমা ঠাকুমা বলে ডাকি, তাহলে তো চিনতে পেরে যাবে। চিনে গেলে আর ভয় পাবে কেন?'
বাঁটুল বলল, 'ঠিকই বলেছিস। তাহলে মানুষের ডাক নয়, ভূতের ডাক দে'।
সাঁটুল কাঁদো-কাঁদো হয়ে বলে, 'ভূতেরা কেমন করে ডাকে, আমি যে জানিনা...'।
বাঁটুল বলল, 'ওই তো চন্দ্রবিন্দু দিয়ে, মেঁজোদিঁদা, মেঁজোদিঁদা......'।
সাঁটুল হঠাৎ বাঁ হাতটা দিয়ে বাঁটুলের মুখ বন্ধ করে দেয়। তারপরে জোরে ডেকে ওঠে, 'ম্যাঁহ্যাঁহ্যাঁহ্যাঁহ্যাঁহ্যাঁ.........ম্যাঁহ্যাঁহ্যাঁহ্যাঁহ্যাঁহ্যাঁ.........ম্যাঁহ্যাঁহ্যাঁহ্যাঁহ্যাঁহ্যাঁ.........'
আওয়াজ শুনে মেজোদিদা লন্ঠনটা তুলে ওদের দিকে তাকান। সেই আলোতে সব কিছু ঠিকঠাক ঠাহর হয় না। আবছা আবছা দুটো সাদা মুখ যেন। আবার সেই ডাক। মেজোদিদা লন্ঠন ফেলে দিয়ে, ঊর্ধ্বশ্বাসে ভূত...ভূত করে দৌড়ে খিড়কির দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকে রান্নাঘরের সামনের মেঝেতে বসে হাঁফাতে থাকেন। মুখ দিয়ে কোন কথা বের হয় না কিছুক্ষণ। চোখ উলটে গেছে। সাঁটুলের বাবা, মা এসে চোখে মুখে জল দিয়ে, তালপাতার পাখা দিয়ে হাওয়া করতে থাকে। মিনিট দশেক পরে মেজোদিদা একটু ধাতস্থ হন। বাঁটুল, সাঁটুলও ভয় পেয়ে চূপ করে একপাশে বসে থাকে। মেজোদিদার চীৎকার শোনার পরেই তারা মুখোশ ছিঁড়ে ফেলে দিয়েছিল। তারপর চুপি চুপি সামনের দরজা দিয়ে ঘরে ঢুকে আসে। সবাই মেজোদিদাকে নিয়ে ব্যস্ত থাকার ফলে, কেউ তাদের খেয়াল করে না।
সাঁটুলের বাবা বলেন, 'মা তুমি এমন করো না। ভয় পাইয়ে দিয়েছিলে। এই সন্ধেবেলায় কোথ্থেকে ভূত আসবে? এই তো আমি দেখে এলাম, কোথাও কেউ নেই। সব ভূত খালি তোমাকেই দেখা দেয়। দেখো তো বাঁটুল সাঁটুলও কেমন ভয় পেয়ে গেছে'।
মেজোদিদা চুপ করে থাকেন। এখনও বুঝতে পারেন না, কোন্ ভূতের পাল্লায় আজ তিনি পড়েছিলেন। ম্যাঁহ্যাঁহ্যাঁহ্যাঁহ্যাঁহ্যাঁ করে একটা আওয়াজ শুনেছিলেন যেন। ছাগভূতই হবে হয়তো বা! 

ছবিঃ শিল্পী ঘোষ

জন্ম পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার ঝাঁকরা গ্রামে। লেখালেখির শুরু স্কুল জীবনে, মূলত মায়ের উৎসাহেই। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং এ স্নাতক। বর্তমানে চাকুরীসূত্রে হায়দ্রাবাদের বাসিন্দা।

আমরা, ভারতের জনগণ, ভারতকে একটি সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, সাধারণতন্ত্র রূপে গড়ে তুলতে সত্যনিষ্ঠার সঙ্গে শপথগ্রহণ করছি এবং তার সকল নাগরিক যাতে : সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ন্যায়বিচার; চিন্তা,মতপ্রকাশ, বিশ্বাস, ধর্ম এবং উপাসনার স্বাধীনতা; সামাজিক প্রতিষ্ঠা অর্জন ও সুযোগের সমতা প্রতিষ্ঠা করতে পারে এবং তাদের সকলের মধ্যে ব্যক্তি-সম্ভ্রম ও জাতীয় ঐক্য এবং সংহতি সুনিশ্চিত করে সৌভ্রাতৃত্ব গড়ে তুলতে; আমাদের গণপরিষদে, আজ,১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর, এতদ্দ্বারা এই সংবিধান গ্রহণ করছি, বিধিবদ্ধ করছি এবং নিজেদের অর্পণ করছি।

ফেসবুকে ইচ্ছামতীর বন্ধুরা