সবুজ মনের রসদ
Ichchhamoti Logo
সেয়ানে-সেয়ানে

গল্পটা আমার বম্মার কাছে শোনা। বড়মা, বা বম্মা, মানে আমার মায়ের দিদা বিয়ের পর এগারো বছর বয়সে শ্বশুরবাড়ি গিয়েছিলেন। সেকালে এটাই ছিল রীতি। পুতুল খেলার বয়স না পেরোতেই মেয়েরা শ্বশুরবাড়ি চলে যেত। গিন্নি হতে যেটুকু বাকি থাকত, শাশুড়ি-দিদিশাশুড়িরা গড়েপিটে সেটুকু সেরে নিতেন।

বড়মার শ্বশুরবাড়ির দেশ ছিল এখনকার বাংলাদেশের রাজশাহী। তখন পূর্ববঙ্গ, অন্য দেশ তখনো হয়নি। তা, বম্মা তো নতুন বৌটি সেজে সেবাড়িতে ঢুকলেন। বিয়েবাড়ির ক'দিন সেখানে মেলা লোক, বাগানে উনুন খুঁড়ে গামছা-কাঁধে ঠাকুর সাঙ্গোপাঙ্গ নিয়ে রেঁধে চলেছে, পাত পেড়ে লোকজন কবজি ডুবিয়ে খাচ্ছে, নানা বয়সের মেয়ে-বউদের ভিড় নতুন বউকে সর্বক্ষণ ঘিরে রয়েছে, সব মিলিয়ে হৈ-হৈ কাণ্ড। এগারো বছরের খুকী কনে সবে ভাবতে শুরু করেছে, বাঃ! এদের বাড়িতে বচ্ছরভর এমন আমোদ-আহ্লাদ লেগেই থাকে বুঝি! ব্যস, বিয়েবাড়ি শেষ। বিয়ের দিনসাতেক পর থেকেই লোকজনের ভিড় কমতে শুরু করেছিল, দশদিনের মাথায় দেখা গেল বাড়িতে রয়েছেন শাশুড়ি-ঠাকরুণ, ভাসুর-ঠাকুর, কর্তা, দেওর, ছিদাম চাকর আর কুকুর টম। তা-ও পনেরোদিন পর কলেজ খুলতেই কর্তা আর দেওর কলকাতা রওনা হলেন। ভাসুর সারাদিন বাড়ির বাইরেই থাকেন নানা কাজে। দুপুরে একবার খেতে আসেন, ফেরেন অনেক রাত্রে।

বাড়িতে সারাদিন বড়মা আর তাঁর শাশুড়ি, ছিদাম চাকর তো নানান কাজে ব্যস্ত। আর আছে বাঘা কুকুর টম। তার চোখ এড়িয়ে বাড়িতে একটা চড়াইপাখিও ঢুকতে পারে না। গল্প না সত্যি জানি না, তবে শুনেছি সেবাড়ির কাঁঠাল গাছে পাকা কাঁঠালের লোভে মাঝরাত্রে শেয়াল আসত। টম দায়িত্ব নিয়ে কাঁঠালচোর শেয়ালের দলকে পাড়াছাড়া করত। এহেন টমকে প্রথম ক'দিন বড়মা এড়িয়ে চললেও পরের দিকে তাকে খেতে দেওয়া, বেচাল দেখলে কানমলা, চড়চাপড় দেওয়া সবই খোশমেজাজে করতেন। টমও দিব্যি কখনো ওনার উলের গোলা কুড়িয়ে এনে দিত, কখনো রান্নাঘরে মাছ পাহারা দিত।

বিয়ের বছরখানেক পর। সন্ধ্যেয় ঠাকুরঘরে শাঁখ বাজানো আর তুলসীতলায় প্রদীপ দেওয়ার কাজটা বড়মা-ই করতেন তখন। নতুন গরম পড়েছে। সন্ধ্যে হব-হব সময়ে গা ধুয়ে চুল বেঁধে বড়মা ঢুকেছেন ঠাকুরঘরে। প্রদীপ জ্বেলে শাঁখ বাজিয়ে প্রদীপটা নিয়ে ঠাকুরঘরের চৌকাঠ ডিঙোলেন। অন্যদিন টম চৌকাঠের কাছে থাবায় মুখ রেখে বসে থাকে। বড়মা প্রদীপ নিয়ে বেরোলে সে-ও তুলসীতলার দিকে হাঁটা লাগায়। আজ বিকেলে অনেকক্ষণ ছিদামের সঙ্গে ফুটবল খেলে এসে বাবু বোধহয় এখন জিরোচ্ছন।

চৌকাঠ ডিঙিয়ে কিছুটা এসে বড়মার মনে হল চৌকাঠের সামনে জলের দাগ দেখলেন যেন! এখন আবার ওখানে জল কোত্থেকে এল? তবে কি ছিদাম রান্নাঘর ধুয়েছে একটু আগে? রান্নাঘর ধুলে জলের ধারা বেরিয়ে ঠাকুরঘরের সামনে দিয়ে গিয়ে দালানের নিচের নালীতে পড়ে। তাই-ই হবে।

তুলসীতলার প্রদীপটা জ্বেলে ঠাকুরঘরে ফেরার সময় চৌকাঠের দিকেআবার নজর গেল। হাতের প্রদীপটা এগিয়ে নিয়ে নিচে ঝুঁকে ভাল করে দেখতেই, ভয়ে হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে গেল বড়মার। জল নয়, ঠাকুরঘরের চৌকাঠের সামনে পড়ে রয়েছে একটা মোটা কালো সাপ। সেটার গায়ে প্রদীপের আলো পড়ে চকচক করছে। তাই প্রথমে জল বলে ভুল হয়েছিল। কি করতে হবে বোঝার আগেই গলা দিয়ে একটা 'মা গো!' বেরিয়ে এল। চিৎকার শুনে শাশুড়ি রান্নাঘর থেকে তড়িঘড়ি বেরোতেই বড়মা আঙুল দেখালেন সাপের দিকে। ভয়ে তখন আর গলা দিয়ে আওয়াজ বেরোচ্ছে না।

বড়মার চিৎকার শুনে কোথা থেকে টমও দৌড়ে এসেছে ইতিমধ্যে। এসে ব্যাপার দেখেই ঝাঁপিয়ে পড়ল সে। সাপ-ও কম তুখোড় নয়। বিপদ বুঝে ফোঁস করেছে। ফণা তোলা সাপের সে মূর্তি দেখে তো বড়মা ভয়ে চোখ বুজে ফেলেছেন। টমটার গায়ে যদি একটা ছোবল পড়ে! চোখ খুলে দেখেন লড়াই বেধেছে সেয়ানে সেয়ানে। সাপের ফণার নাগাল থেকে টম বিদ্যুৎগতিতে নিজেকে সরিয়ে নিচ্ছে। তেজী সাপ যতবার ছোবল মারতে এগোয়, টম অমনি সাঁই-ই করে অতবড় শরীরটা নিয়ে পাশ কাটিয়ে সরে যায়। সাপের হিস্‌হিস্‌ আর টমের গরগর আওয়াজে তখন মানুষগুলোর মুখে কথা সরছে না। কিছুক্ষণ এভাবে চলার পর সাপ একটু নিস্তেজ হয়েছিল মনে হয়, দু'একবার ছোবলটা ভুল জায়গাতেও পড়েছিল। ব্যস, এই সুযোগটাই নিল টম। চোখের পলকে দাঁত দিয়ে সাপটার মাথা কামড়ে ধরে ধড় থেকে আলাদা করে দিল। পুরো ঘটনাটা ঘটল বোধহয় কয়েকমিনিটের মধ্যে। সাপের দেহটা তখনো মাঝে মাঝে কেঁপে উঠছে, টম গরগর করতে করতে থাবা দিয়ে সেটাকে ছুঁড়ে উঠোনে ফেলে দিল, তারপর কিছু হয়নি গোছের মুখ করে বড়মার শাশুড়ির কাছে এসে পায়ে মুখ ঘষতে লাগল। টমের গজরানি শুনে ততক্ষণে ছিদাম দৌড়ে এসেছে। সাপ দেখে সে আঁতকে উঠল। এ নাকি সাক্ষাৎ কালকেউটে। একটা ছোবল একজন সমর্থ মানুষকে যমদুয়ারে পাঠাতে যথেষ্ট।

বড়মা অন্ধকারকে এমনিতেই একটু ভয় পেতেন। একে অন্ধকার, দালানে মোটে একখানা প্রদীপের আলো চারপাশটাকে আরো কেমন ঘোরলাগা করে তুলেছে, তার ওপর আবার কালকেউটের ছোবল থেকে এক্ষুণি রেহাই পেয়েছেন, বড়মার হাত-পা তখনো নিজের বশে আসেনি। চৌকাঠের নিচে পড়ে থাকা জিনিসটাকে জল ভেবে যদি পা ঠেকাতেন তবে কি হতে পারত ভেবে কিছুক্ষণ অন্তর কেঁপে উঠছিলেন। শাশুড়ি ধরে ধরে ঘরে নিয়ে গিয়ে শুইয়ে দিলেন। বৌমানুষ, তাকে কি না শাশুড়ি ধরে ধরে শোওয়ার ঘরে নিয়ে যাচ্ছেন! বড়মা তো মরমে মরে যাচ্ছেন তখন! মিনিট পাঁচেক শোওয়ার পর হাতে ভর দিয়ে উঠে বসতে যাবেন, শাশুড়ির ধমক খেয়ে আবার শুয়ে পড়লেন। শাশুড়ি এবার উঠে রান্নাঘরে গেলেন বৌমার জন্য গরম দুধ আনতে, পাহারায় রেখে গেলেন টমকে। অন্য সময় হলে বাড়ির পোষা কুকুরের পাহারায় শুয়ে থাকার ব্যাপারটা বড়মার পক্ষে একটু অপমানজনক হতে পারত, কিন্তু এখন তো টম নেহাৎ সাদাসাপটা কুকুর নয়, বড়মার জীবনদাতাই বলা চলে তাকে! ওনার পায়ের কাছে মেঝেতে থাবায় মুখ রেখে ঠায় বসে রইল সে। একবার পরীক্ষা করে দেখবেন বলে উঠে বসেছিলেন, অমনি সে বাঘা কুকুর গুমগুমে গলার ধমকে বড়মাকে আবার শুইয়ে দিল।

সে রাত্রে ঘুমের মধ্যে বম্মা নাকি একটা স্বপ্ন দেখেছিলেন। টাটানগরে ওনার বাপের বাড়ির পাশের বড় মাঠটা জলে থৈ-থৈ করছে, সেখানে গাছকোমর দিয়ে শাড়ি পরে "ও কুমীর তোর জলকে নেমেছি" খেলছেন বম্মা, সেনকাকার মেয়ে রুণু, মা আর শাশুড়ি। কুমীর কে? না, সন্ধ্যেয় টমের আঁচড়-কামড়ে মরে যাওয়া সেই সাপটা। তার ধড়টা জমে থাকা জলে কিলবিলোচ্ছে, আর মুড়োটা এসে হিস্‌হিসিয়ে বড়মাকে বলছে "আয়, জলে নাম্‌ একবার, দ্যাখ কি অবস্থা করি তোর!"

আঁতকে উঠে ঘুম ভেঙ্গে বম্মা দেখেন ঘড়িতে বাজে রাত দুটো। খাটের নিচে টম থাবায় মুখ রেখে শুয়ে আছে। বড়মা উঠে বসতেই সে ভুক্‌ভুক্‌ করে দু'বার ডেকে খাড়া হয়ে উঠে বসল।

সেয়ানে-সেয়ানে

ছবিঃ পার্থ মুখার্জি

ভূতপূর্ব ইঞ্জিনিয়ার, বর্তমানে সাংসারিক কাজের মাঝে সু্যোগ পেলেই পড়া আর লেখার আনন্দে মাতার চেষ্টায় থাকেন। সেই গোত্রের মানুষ, যারা আর কিছু না পেলে ঠোঙ্গায় ছাপা খবরও মন দিয়ে পড়েন। সারাদিনের অনেকটা সময় কাটে মেয়ে কুটুনের সঙ্গে; তার কীর্তিকলাপ মাঝেমধ্যে লিখতে চেষ্টা করেন;বর্তমানে ধানবাদের বাসিন্দা।

আমরা, ভারতের জনগণ, ভারতকে একটি সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, সাধারণতন্ত্র রূপে গড়ে তুলতে সত্যনিষ্ঠার সঙ্গে শপথগ্রহণ করছি এবং তার সকল নাগরিক যাতে : সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ন্যায়বিচার; চিন্তা,মতপ্রকাশ, বিশ্বাস, ধর্ম এবং উপাসনার স্বাধীনতা; সামাজিক প্রতিষ্ঠা অর্জন ও সুযোগের সমতা প্রতিষ্ঠা করতে পারে এবং তাদের সকলের মধ্যে ব্যক্তি-সম্ভ্রম ও জাতীয় ঐক্য এবং সংহতি সুনিশ্চিত করে সৌভ্রাতৃত্ব গড়ে তুলতে; আমাদের গণপরিষদে, আজ,১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর, এতদ্দ্বারা এই সংবিধান গ্রহণ করছি, বিধিবদ্ধ করছি এবং নিজেদের অর্পণ করছি।

ফেসবুকে ইচ্ছামতীর বন্ধুরা