সবুজ মনের রসদ
Ichchhamoti Logo
স্পেশাল অলিম্পিক্‌স উইণ্টার গেমস ২০১৭

এই ২০১৭ এর মার্চ মাসের চোদ্দ থেকে পঁচিশ তারিখে অস্ট্রিয়াতে অনুষ্ঠিত হল শীতকালীন স্পেশাল অলিম্পিক্‌স। ১০৫ টি দেশের প্রায় ২৭০০ প্রতিযোগী এই প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেছিলেন। ভারত ছিল অন্যতম প্রতিযোগী দেশ। ভারতীয় দলের সদস্যরা, স্পেশ্যাল অলিম্পিক্স ভারত (Special Olympics Bharat), এই অলিম্পিক থেকে সব মিলিয়ে ৭৩টি পদক জয় করেছেন, যার মধ্যে ৩৭টি সোনা, ১০টি রূপো এবং ২৬টি ব্রোঞ্জ। কী? খবরটা চমকে দেওয়ার মতো নয়? চলো, একটু জেনে নিই কী এই স্পেশাল অলিম্পিক্‌স? আর ৭৩টি পদকজয়ী এই ভারতীয় ক্রীড়াবিদরা কারা?

খেলাধুলোর দুনিয়ায় সবসুদ্ধু তিন ধরনের অলিম্পিক গেমসের আসর বসে। একটার কথা তো সব্বাই জানি,দ্য গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ (The Greatest Show On Earth), ১৮৯৬ সালে গ্রীসে যার শুরু, আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটি (IOC)-র উদ্যোগে চার বছর অন্তর আয়োজিত যে গেমসে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ ক্রীড়াবিদরা নিত্যনতুন রেকর্ড ভাঙ্গা-গড়ার ইতিহাস তৈরি করেন। এটি হল শারীরিক ও মানসিক ভাবে সম্পূর্ণ সবল ক্রীড়াবিদদের প্রতিযোগিতা।

দ্বিতীয়টি হল প্যারালিম্পিক গেমস। শারীরিক প্রতিবন্ধকতা আছে, এমন ক্রীড়াবিদদের প্রতিযোগিতা এটি। ১৯৬০ সালে রোমে প্রথমবার অনুষ্ঠিত হয়েছিল। আন্তর্জাতিক প্যারালিম্পিক কমিটি (IPC)-র উদ্যোগে এই প্রতিযোগিতাও চার বছর অন্তর অনুষ্ঠিত হয়। IOC এবং IPC-র চুক্তি অনুযায়ী ১৯৮৮ সাল থেকে অলিম্পিক্‌স এবং প্যারালিম্পিক-এর আসর একই শহরে বসছে। জানো নিশ্চয়ই, ২০১৬-র রিও প্যারালিম্পিক্‌সে ভারত দুটি সোনা, একটি রূপো ও একটি ব্রোঞ্জ জয় করেছিল। দীপা মালিক, দেবেন্দ্র ঝাঝারিয়া প্রমুখ ছিলেন পদকজয়ীদের তালিকায়।

এবার আসি তিন নম্বর অলিম্পিক্‌সের কথায়। এটি হল স্পেশাল অলিম্পিক্‌স।

স্পেশাল অলিম্পিক্‌স উইণ্টার গেমস ২০১৭
ইউনিস কেনেডি শ্রিভার

বুদ্ধির বিকাশে কিছু ঘাটতি রয়ে গেছে- জন্মজনিত অসুস্থতা, ছোটবেলার কোনো অসুখ কিংবা অজানা কোনো কারণে- এমন মানুষদের ভালো থাকা, এবং শরীর ও মনের উন্নতিতে খেলাধুলো খুব ভাল কাজ করে, এটা লক্ষ্য করেছিলেন ইউনিস কেনেডি শ্রিভার নামে এক মহিলা, ঘটনাচক্রে যিনি ছিলেন মার্কিন প্রেসিডেণ্ট জন এফ. কেনেডির বোন, এবং তাঁদের আরেক বোনের বৌদ্ধিক বিকাশের সমস্যা ছিল। এই ইউনিস কেনেডি শ্রিভার-এর বহু বছরের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলস্বরূপ জোসেফ পি. কেনেডি ফাউণ্ডেশনের উদ্যোগে ১৯৬৮ সালের ২০শে জুলাই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরে বসেছিল প্রথম আন্তর্জাতিক স্পেশাল অলিম্পিক্‌সের আসর। এরপর থেকে প্রতি দু’বছর অন্তর, একবার গ্রীষ্মকালীন এবং একবার শীতকালীন স্পেশাল অলিম্পিক্‌স অনুষ্ঠিত হয়ে চলেছে।

স্পেশাল অলিম্পিক্‌স উইণ্টার গেমস ২০১৭
বাংলাদেশের মেয়েদের ফ্লোর হকি দল

এবারের স্পেশাল অলিম্পিক্‌সে ভারতীয় দলের সাফল্য প্রায় ইতিহাস তৈরি করেছে। পুরুষদের ফ্লোর হকি, ইউনিফায়েড ফ্লোর বল এবং ট্র্যাডিশনাল ফ্লোর বল—এই তিনটি দলগত ইভেণ্ট থেকে একই দিনে স্বর্ণপদক এসেছে দেশে। মহিলাদের হকি টিম জিতেছে ব্রোঞ্জ পদক। সে টিমে আবার আমাদের বাংলার চারটি মেয়েও রয়েছেন। হিমাচল প্রদেশের সঞ্জয় কুমার স্নোবোর্ডিং-এ জিতেছেন দুটি সোনা।

পুরুষদের ফ্লোর হকির ফাইনালে তো রীতিমত রুদ্ধশ্বাস লড়াই হয়েছিল। গ্রুপ ম্যাচে যে সুইডেনের কাছে ভারত হেরে গিয়েছিল, ফাইনালে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত লড়ে তাদেরই ৩-২ গোলে হারিয়ে সেরার শিরোপা ছিনিয়ে নেয় ভারতীয় হকি টিম। অন্যদিকে, ট্র্যাডিশনাল ফ্লোর বল ইভেণ্টে আয়োজক দেশ অস্ট্রিয়ার টিমকে ৮-০ গোলে ধূলিসাৎ করে সোনা জেতে ভারত।

স্পেশাল অলিম্পিক্‌স উইণ্টার গেমস ২০১৭
(বাঁদিক থেকে) মেঘা, সামশের, শিবাঞ্জলি

ভারতের স্বর্ণপদকজয়ের দৌড় শুরু করেন হিমাচল প্রদেশের মেঘা, আল্পীয় স্কিইং-এর একটি ইভেণ্টে সোনা জিতে। গেমসের উদ্বোধনে মশাল হাতেও তিনিই ছিলেন এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলের প্রতিনিধি হিসাবে, নিউজিল্যাণ্ডের এলা শার্প্‌ল-এর সঙ্গে। জন্মের পর থেকেই মেঘার কানে শোনা, কথা বলা এবং আরো নানারকম সমস্যা একে একে সামনে এসেছিল। বৌদ্ধিক বিকাশের সমস্যা তো ছিলোই। ২০০৪ সালে প্রয়াস ফাউণ্ডেশন স্কুলে ভর্তি হওয়ার পর থেকে আস্তে আস্তে মেয়েটির জীবন পাল্টাতে থাকে। এখন তো হাজারো সমস্যা থাকা সত্ত্বেও মেঘা আল্পীয় স্কিইং-এর মতো একটি দুরূহ ইভেণ্টের সম্রাজ্ঞী, সোনার পাশাপাশি একটি রূপোও রয়েছে তাঁর সংগ্রহে।

আরেকজন হলেন পঞ্জাবের সামশের সিংহ। প্রতিযোগিতার প্রথম দিনেই দেশকে স্নো-শুয়িং-এ রূপো এনে দিয়েছেন তিনি, এই খেলাতেই আরেকটি ব্রোঞ্জ-ও জিতেছেন। জন্ম থেকে তিনি সেরিব্রাল পালসির শিকার। অন্যান্য সমস্যাও ছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও দেশের জন্য পদক আনার প্রতিজ্ঞা করে যে চেষ্টা তিনি করেছিলেন, তাতে তিনি একশোভাগ সফল। কোনো সমস্যা বা প্রতিবন্ধকতাই তাঁকে দমিয়ে রাখতে পারেনি।

বৌদ্ধিক বিকাশের ঘাটতি যেমন দমিয়ে রাখতে পারেনি পনেরো বছর বয়সী শিবাঞ্জলিকেও। হিমাচল প্রদেশের এই মেয়েটির কাছে তিন বছর আগে পর্যন্তও জীবনের আলাদা করে কোনো মানে ছিল না। ‘চেতনা’ নামে একটি স্কুলের সঙ্গে তাদের পরিবারের যোগাযোগ হওয়ার পরেই শিবাঞ্জলির জীবন পাল্টাতে থাকে। আল্পীয় স্কিইং-কে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর মাধ্যম হিসেবে বেছে যে সে খুব ভুল করেনি, তার প্রমাণ অলিম্পিকের স্বর্ণপদক।

স্পেশাল অলিম্পিক্‌স উইণ্টার গেমস ২০১৭
স্পেশ্যাল অলিম্পিক্সে ভারতীয় দল

৭৩টি পদকজয়ের নেপথ্যে আছে এমনই অনেক কাহিনী, যেগুলো নাটকীয়তায় গল্পকে হার মানালেও আসলে সবক'টা ঘটনাই চরম সত্যি। আছেন আরো অনেকে, যারা একটুর জন্য ছুঁতে পারেননি পদকজয়ের আনন্দকে। তাঁদের জীবনকাহিনীও কিন্তু নেহাত সাদামাটা নয়। সেই ছোট্টবেলা থেকে এঁরা হয়ত শুনে এসেছেন, "ও আবার দৌড়বে কী, সোজা হয়ে হাঁটতেই পারে না ভাল ক'রে!", কিংবা "ভালো করে কথাই বলতে পারে না, একটা কথা দশবার বললে মাথায় ঢোকে, ও নাকি খেলতে যাবে!" কতখানি মনের জোর থাকলে এইসব ব্যঙ্গ-উপহাসকে উপেক্ষা করে ১০৫টি দেশের ২৭০০ জন প্রতিযোগীর সঙ্গে এক মঞ্চে দাঁড়িয়ে একটি আন্তর্জাতিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় সফল হওয়া যায়, এঁরা সব্বাই সেটা দেখিয়ে দিয়েছেন।

কোনো প্রতিযোগিতাতেই সবাই সমান সফল হয় না। কিন্তু "আমি জিতব। কিন্তু যদি জিততে না-ও পারি, সাহসী হয়ে চেষ্টাটুকু অন্তত করব", স্পেশাল অলিম্পিক্‌সের এই মূলমন্ত্রকেই নিজেদের জীবনের মূলমন্ত্র করে সমাজের কাছে বার্তা পৌঁছে দিচ্ছেন সঞ্জয় কুমার, শিখা রানি-রা। চেষ্টা করছেন তাঁরা নিজেরাই। বাকি সমাজের দায়িত্ব শুধু তাঁদের এই চেষ্টা করতে সাহসটুকু দেওয়ার। ইচ্ছামতী-র বন্ধু, মনে রেখ, তুমিও কিন্তু এই সমাজের একটা বড় অংশ। সাহস দেওয়াটা কিন্তু তোমারও কর্তব্য। পারবে তো সেই কর্তব্য পালন করতে? আশা রাখি, নিশ্চয়ই পারবে। শুভেচ্ছা রইল।


ছবিঃ
উইকিপিডিয়া
স্পেশ্যাল অলিম্পক্সের ওয়েবসাইট ও টুইটার পেজ

ভূতপূর্ব ইঞ্জিনিয়ার, বর্তমানে সাংসারিক কাজের মাঝে সু্যোগ পেলেই পড়া আর লেখার আনন্দে মাতার চেষ্টায় থাকেন। সেই গোত্রের মানুষ, যারা আর কিছু না পেলে ঠোঙ্গায় ছাপা খবরও মন দিয়ে পড়েন। সারাদিনের অনেকটা সময় কাটে মেয়ে কুটুনের সঙ্গে; তার কীর্তিকলাপ মাঝেমধ্যে লিখতে চেষ্টা করেন;বর্তমানে ধানবাদের বাসিন্দা।

আমরা, ভারতের জনগণ, ভারতকে একটি সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, সাধারণতন্ত্র রূপে গড়ে তুলতে সত্যনিষ্ঠার সঙ্গে শপথগ্রহণ করছি এবং তার সকল নাগরিক যাতে : সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ন্যায়বিচার; চিন্তা,মতপ্রকাশ, বিশ্বাস, ধর্ম এবং উপাসনার স্বাধীনতা; সামাজিক প্রতিষ্ঠা অর্জন ও সুযোগের সমতা প্রতিষ্ঠা করতে পারে এবং তাদের সকলের মধ্যে ব্যক্তি-সম্ভ্রম ও জাতীয় ঐক্য এবং সংহতি সুনিশ্চিত করে সৌভ্রাতৃত্ব গড়ে তুলতে; আমাদের গণপরিষদে, আজ,১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর, এতদ্দ্বারা এই সংবিধান গ্রহণ করছি, বিধিবদ্ধ করছি এবং নিজেদের অর্পণ করছি।

ফেসবুকে ইচ্ছামতীর বন্ধুরা