বাঁদিকেঃ নির্মলচন্দ্র কুমার । ডানদিকেঃ তাঁর পড়ার ঘর
যারা ফেলুদাকে চেনো, ফেলুকাহিনির রোমাঞ্চের জাদুতে যারা মুগ্ধ, তারা অবশ্যই সিধুজ্যাঠাকে চিনবে! সর্দার শঙ্কর রোডের এই বাসিন্দা 'কিছুই ' না করে, কেবল মনের জানলাটাকে খুলে রেখে দিয়ে আমাদের মনে রয়ে গেছেন। নতুন রহস্যের শুরুতে অজানা তথ্যের প্রয়োজন? ফেলুদার গন্তব্য সিধুজ্যাঠা। পুরোনো কোনও খবরের সন্ধান? গন্তব্য সিধুজ্যাঠা। যাবতীয় পুরোনো খবর সন তারিখ মিলিয়ে সাজিয়ে রাখা থাকে তাঁর সংগ্রহে। তেমনই তুখোড় স্মৃতিশক্তি ভদ্রলোকের। তোপসে তাঁকে বলে ‘শ্রুতিধর’।
সত্যজিৎ রায় কি কাউকে দেখে পেয়েছিলেন সিধুজ্যাঠার চরিত্র সৃষ্টির অনুপ্রেরণা? হ্যাঁ, বাস্তবিকই কলকাতার বাসিন্দা ছিলেন এমন একজন মানুষ, যিনি কাজেকর্মে সত্যিই ছিলেন 'বাস্তবের সিদ্ধেশ্বর বোস'।
বলছি নির্মলচন্দ্র কুমারের কথা, যিনি ছিলেন কলকাতার প্রথম অ্যাণ্টিকুয়েরিয়ান, দুষ্প্রাপ্য বই ও নথিপত্রের সংগ্রাহক। ছোটবেলা থেকেই তিনি ছিলেন একনিষ্ঠ পাঠক। একসময় নিজেও লেখালেখি করতেন, তবে তাঁর নিজের ভাষাতেই তাতে তিনি 'সাংঘাতিক ব্যর্থ ' হন। এরপর, ১৯৪০ সাল নাগাদ শুরু হয় তাঁর দুষ্প্রাপ্য বই সংগ্রহের অভ্যেস।
শুরুটা হয়েছিল ইয়াকুব নামে এক বইবিক্রেতার হাত ধরে। ইয়াকুব নিজে ছিলেন অক্ষরজ্ঞানহীন, কিন্তু তিনিই প্রথম নির্মল কুমারকে বইয়ের ব্যবসা শুরু করতে উৎসাহ দেন। অনুপ্রাণিত হয়ে নির্মলচন্দ্র ১৯৪৫ সালে মধ্য কলকাতার তালতলায় নিজের বাড়িতেই শুরু করেন বইয়ের দোকান 'কুমার্স্'। দুষ্প্রাপ্য বই এবং নথিপত্র সংগ্রহের সেই শুরু। সেই সময়ে কলকাতা শহরে দুষ্প্রাপ্য বইয়ের দোকান খুব যে বেশি ছিল তা নয়। বিখ্যাত পুরনো বইয়ের দোকান ‘ক্যাম্ব্রে’ ধীরে ধীরে তার খ্যাতি হারাচ্ছে, ‘থ্যাকার অ্যাণ্ড স্পিঙ্ক’ নামে আরেকটি দোকান ছিল বটে, তবে সেখানে দুষ্প্রাপ্য বইয়ের সংগ্রহ বিশেষ ছিল না। নির্মলচন্দ্র কুমারের দুষ্প্রাপ্য বইয়ের সংগ্রহ ধীরে ধীরে শহরের পুস্তকপ্রেমীদের গন্তব্যস্থল হয়ে ওঠে।
যে বাড়িতে ছিল 'কুমার্স্' এর বইঘর
'কুমার্স্'- এ পুরনো বইয়ের সংগ্রহের টানে আসা ব্যক্তিত্বদের মধ্যে থাকতেন সত্যজিৎ রায়, রাধাপ্রসাদ গুপ্ত, সাহিত্যিক মুলকরাজ আনন্দ, লোকসঙ্গীতশিল্পী নির্মলেন্দু চৌধুরী, তথ্যচিত্র নির্মাতা শান্তি চৌধুরী, ভারতীয় জনগণনার জনক অশোক মিত্র প্রমুখ। বিশিষ্ট পর্যটক এবং গবেষক ইলা মাইলার্ট এই সংগ্রহ দেখে লিখেছিলেন, নির্মলচন্দ্রের বাড়ি যেন তীর্থক্ষেত্র। সারাদিন বইয়ের পাতা উলটে যাওয়া, নির্মলচন্দ্রের সঙ্গে নানা বিষয়ে আলোচনা, সেই সঙ্গে মনোমুগ্ধকর আতিথেয়তা।
নির্মলচন্দ্র কুমারের সংগ্রহে থাকা উনিশ শতকের জিনিস - যেগুলি 'শতরঞ্জ কি খিলাড়ি' ছবিতে ব্যবহার হয়েছিল
সত্যজিৎ রায় যখন তাঁর ছবি ‘শতরঞ্জ কি খিলাড়ি’ নির্মাণ করছেন, তাঁর অন্যতম ভরসার জায়গা ছিল নির্মলচন্দ্রের গ্রন্থাগার। নির্মলচন্দ্র তাঁর সংগ্রহে থাকা সিপাহী বিদ্রোহ সংক্রান্ত যাবতীয় বই দিয়ে সাহায্য তো করেছিলেনই, উপরন্তু সিপাহী বিদ্রোহের উপর তৈরি একটি স্ক্র্যাপবুক লণ্ডন অকশন থেকে নিলামে নিয়ে আসেন। নিজের সংগ্রহ থেকে ছবিতে ব্যবহার করার জন্য দেন সেই আমলের নানা নিত্য ব্যবহার্য জিনিস – পানের বাক্স, পিকদানি ইত্যাদি। নির্মলচন্দ্রের এই অবদানের কথা সত্যজিৎ বারবার উল্লেখ করেছেন।
চিত্রশিল্পী উইলিয়াম হগার্থ, পর্যটক ডেভিড লিভিংস্টোন, লেখক কর্নেল স্লীম্যান, জর্জ হিগিন্স, জেমস হ্যামিলটন প্রমুখদের বহু বিরল বইয়ের সংগ্রহ ছিল নির্মলচন্দ্রের বাড়ির গ্রন্থাগার।
জুলজিক্যাল গার্ডেনে হিমালয়ের পাখিদের এবং বন্যপ্রাণী সংগ্রহের নেপথ্যেও নির্মলচন্দ্রের অবদান অনেকখানি।
তিনি তাঁর বইয়ের দোকানে একটি নতুন জিনিস শুরু করেছিলেন, দোকানে বসে বই পড়া। আজকাল কলকাতা শহরের অলিতে-গলিতে কত শৌখিন ক্যাফে হয়েছে, যেখানে বসে নিজের পছন্দমত বই পড়া যায়। কিন্তু সেই সময়ের কলকাতায় এই রীতির চল একেবারেই ছিল না।
১৯৭৫ এর শেষ দিক থেকে পুরনো বইয়ের ব্যবসার ধরনে বিরাট পরিবর্তন আসে। পুরোনো বইকে কেবলমাত্র পণ্য হিসেবেই দেখা শুরু হয়। বহু বইয়ের পাতা ছিঁড়ে আলাদাভাবে বিক্রি শুরু হয়। নির্মলচন্দ্র এই পণ্যের ব্যবসায় জড়িত হতে চাননি। তিনি ধীরে ধীরে নিজেকে সরিয়ে নেন।
১৯৭৬ সালে মাত্র ষাট বছর বয়সে নির্মলচন্দ্রের জীবনাবসান হয়।
প্রায় তিরিশ বছরের নিরলস প্রচেষ্টায় নির্মলচন্দ্র দুষ্প্রাপ্য বই এবং নথিপত্রের সংগ্রহটি তৈরি করেছিলেন। একটি প্রজন্মের সাহিত্যিক শিল্পী গবেষকদের কাজকে প্রভাবিত করেছিলেন তিনি, তাঁর সংগ্রহ এবং জ্ঞানের দ্বারা। ব্যবসায়িক মনোবৃত্তিকে সরিয়ে রেখে কেবলমাত্র জ্ঞান বিতরণের জন্য দুষ্প্রাপ্য বইয়ের ব্যবসা, পুরোনো বইয়ের সংরক্ষণ এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রের সঙ্গে জড়িত মানুষের সেই সংগ্রহালয়ে নিয়মিত উপস্থিতি, এমনটা সত্যিই বিরল। নির্মলচন্দ্রের মৃত্যুর পর কলকাতা শহরের সাংস্কৃতিক জগতে একটা অধ্যায় শেষ হয়ে গিয়েছিল বলা যায়।
নির্মলচন্দ্র কুমারের বিশাল বিচিত্র সংগ্রহ এখনও সযত্নে রক্ষিত রয়েছে তাঁর পুত্র অধ্যাপক অলোক কুমারের কাছে।
ছবি সৌজন্যঃ অলোক কুমার