আমরা যারা নব্বই দশকের শেষের দিকের কচিকাঁচা, যাদের মিলেনিয়াল বলা হয়ে থাকে, তারা অনেকেই জন্মদিনে উপহার পেয়েছিলাম পিগি ব্যাংক। সেই ব্যাংক জমা থাকত আমাদের খুব প্রিয় পকেটমানি। আমাদের দিদু, দাদু, জেঠু বা অন্যান্য গুরুজনদের দেওয়া অর্থ সম্পদ সযত্নে তোলা থাকতো ওই ব্যাংকে। কিন্ত ওইটুকু আমাদের জানার সীমাবদ্ধতা কারণ তারপর আমাদের সম্পদের উপযোগিতা কীভাবে হত, সেটা আমাদের জানার খুব একটা সুযোগ থাকতো না। আমি নিজের ক্ষেত্রে যতদূর জেনেছিলাম, আমার উচ্চ মাধ্যমিকের পর একটি আসল ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলা হয়েছিল, এবং সেখানে জমা হয়েছিল আমার বহু বছরের ভালোবাসার সঞ্চয়।
তবে প্লাস্টিকের পিগি ব্যাংক আসার অনেক আগে থেকেই আমাদের আগের প্রজন্মের অনেকের কাছে থাকত মাটির 'লক্ষীর ভাঁড়' — মুখ বন্ধ মাটির হাঁড়ির গায়ে পয়সা জমানোর একটা ফাঁক থাকত। যারা সেটাও কিনতে পারত না, তারা টিনের কৌটোর কাগজে মুড়ে মুখের কাছে ফাঁক রাখত আর পয়সা জমাত। যখন খরচা করতে ইচ্ছে বা প্রয়োজন হত, তখন সেই ভাঁড় ভেঙে বা টিন খুলে জমানো খুচরো পয়সা বের করে আনা হত।
আমার সময়কালে প্রায় অনেক বন্ধুদের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলা হয়েছিল আমাদের আঠারো বছরের পরই। আবার বহুজনের ক্ষেত্রে — এখন অনেক ছোট আছে তাই কী হবে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলে — এই নীতিতে চলতে গিয়ে আরও দেরি হয়েছে।
আমাদের রাজ্যে নাবালকদের মধ্যে — বিশেষ করে ছাত্রীদের মধ্যে — ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলার হুড়োহুড়ি শুরু হয়েছিল ৮ই মার্চ, ২০১৩ থেকে। সরকার থেকে প্রতিটি সরকারী এবং সরকার অধিকৃত স্কুল ছাত্রীদের জন্য এই প্রকল্পটি বাধ্যতামূলক করা হয়েছে, এবং এই প্রকল্পের কারণে আজ পশ্চিমবঙ্গে গড়ে ১০ শতাংশ ছাত্রীদের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট যে হয়েছে তা নিশ্চিত হয়েছে।
কিন্তু এই পরিসংখ্যান সত্যি খুব একটা আশানুরূপ না। যদি কলকাতা বা পার্শ্ববর্তী শহরতলির এলাকায় সার্ভে করা যায়, তাহলে দেখা যাবে, এই ডিজিটালাইজশনের যুগে বহু কিশোর কিশোরীদের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট আছে এবং তারা মোবাইল ব্যাঙ্কিং-এ বেশ পারদর্শী। কিন্ত একটু মফস্বল এলাকায় এই চিত্রটি বেশ আলাদা। তবে প্রাপ্তবয়স্কদের ব্যাংকিং হ্যাবিটও সেই সব অঞ্চলে খুব একটা পরিবর্তিত হয়নি।
সরকারি নিয়ম মেনে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলা হলেও, বেশিরভাগ ছেলেমেয়ে — এমন কী অনেক প্রাপ্তবয়স্ক মানুষেরও ব্যাংক অ্যাকাউন্ট সম্পর্কে বা অ্যাকাউন্ট থাকার সুবিধা সম্পর্কে যথেষ্ট ধারণা নেই। স্ত্রী-পুরুষ বা নাবালক-সাবালক নির্বিশেষে সবার কেন ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট থাকা উচিত সেটা নিয়ে আলোচনা করার আগে চলো সংক্ষেপে ব্যাংকিং ব্যবস্থা নিয়ে একটু জেনে নিই।
ব্যাংক অ্যাকাউন্ট সম্পর্ক একটা প্রাথমিক ধারণা রাখা প্রত্যেকের থাকা দরকার। ব্যাংক অ্যাকাউন্ট মূলত তিন ধরনের হয় — সেভিংস অ্যাকাউন্ট (সঞ্চয়ী আমানত), ফিক্সড ডিপোজিট অ্যাকাউন্ট (মেয়াদী আমানত) এবং কারেন্ট অ্যাকাউন্ট (চলতি আমানত)।
সেভিংস অ্যাকাউন্টে বছরে নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ ব্যাংকে জমা রাখা যায় এবং এই জমার নিরিখে, ব্যাংক গ্রাহকদের একটা অংশ সুদ হিসেবে দেয়। অন্য দিকে কারেন্ট অ্যাকাউন্ট এর ক্ষেত্রে ব্যাপারটা পুরোটা উল্টো। এই ক্ষেত্রে, বেশ ভারী অঙ্কের অর্থ জমা রাখা যায় এবং যখন যতটা প্রয়োজন টাকা তোলা যায়। কিন্ত এই ধরনের আমানতে সুদ পাওয়া যায়না। ফিক্সড ডিপোজিটের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা একটু আলাদা, এই ক্ষেত্রে গ্রাহক নির্দিষ্ট সময়সীমার জন্য নিজের অর্থ জমা রাখে এবং সেই নির্দিষ্ট সময় পরই গ্রাহক সুদসহ তার জমা করা অর্থ তার অ্যাকাউন্ট থেকে তুলতে পারে।
এখানে প্রশ্ন হল, আমাদের সঞ্চয় বিভিন্ন আমানতে রাখা থাকলে তাতে ব্যাংকের কী লাভ হয়? ব্যাংক আসলে তাদের গ্রাহকদের গচ্ছিত অর্থ মাধ্যমে, অন্যান্য গ্রাহকদের ঋণ বা লোন দিয়ে থাকে এবং এই ঋণের বিনিময়ে গ্রাহকদের থেকে সুদ গ্রহণ করে। এই প্রাপ্ত অর্থ হলো ব্যাংকের প্রফিট।
ভারতে সেপ্টেম্বর ২০২২ এর পরিসংখ্যান অনুযায়ী পাবলিক ও প্রাইভেট ব্যাংকের সংখ্যা ২৪ টি। প্রতিটি দেশের একটি করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থাকে, ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংক হল রিজার্ভ ব্যাংক অফ ইন্ডিয়া। পাবলিক ব্যাংকগুলি আসলে সরকারের মালিকাধীন ব্যাংক, যারা পুরোপুরি রিজার্ভ ব্যাংক অফ ইন্ডিয়ার নিয়ন্ত্রণে থাকে। অন্য দিকে প্রাইভেট ব্যাংকের ক্ষেত্রে মালিকানা বেসরকারি হলেও, তারাও রিজার্ভ ব্যাংক অফ ইন্ডিয়ার কাছে দায়বদ্ধ। আরো একটা কথা জানিয়ে রাখা ভালো রিজার্ভ ব্যাংক অফ ইন্ডিয়া বা ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংক হলো প্রতিটি ব্যাংকের বা বাণিজ্যিক ব্যাংকের ব্যাংকার এবং এই কেন্দ্রীয় ব্যাংকই একমাত্র সরকারের ব্যাংক হিসেবে কাজ করে।
ছাত্রছাত্রীদের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থাকাটা শুধু মাত্র টাকা জমানোর জন্য নয় আরো অনেক কিছুর জন্য প্রয়োজন।
প্রথমে মাথায় রাখতে হবে যে স্কলারশিপ বা বৃত্তি সবই আজকাল ব্যাংক অ্যাকাউন্ট-এ জমা পরে, অর্থাৎ স্কুল বা কলেজে স্কলারশিপ পাওয়ার ক্ষেত্রে যে যে অফিসিয়াল ফর্মালিটিসগুলো থাকে তার মধ্যে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থাকাটা একটি বাধ্যতামূলক প্রক্রিয়া। এর মানে খুবই সহজ — আমি একজন মেধাবী পড়ুয়া ; আমার রেজাল্ট খুবই ভালো কিন্ত আমার ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলা হয়নি, তাই আমি স্কলারশিপ নাও পেতে পারি, কারণ স্কলারশিপের জন্য একটা নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে আবেদন জানাতে হয়। এছাড়াও, উচ্চশিক্ষার জন্য লোন নিতে চাইলেও নিজের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থাকতেই হবে।
এছাড়া অনেক ছেলেমেয়েই স্কুলের পড়ার পাশে পাশে অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের জন্য কিংবা হাতখরচ যোগাড় করতে ছোটখাটো কাজ করে। এমন ধরনের অনেক কাজ বাড়িতে বসে/ অনলাইনেই করা যায়। সেইসব কাজ করে পাওয়া টাকাও জমা হতে পারে এই অ্যাকাউন্টে। ব্যাংকের মাধ্যমে টাকা দেওয়া-নেওয়া হলে প্রতিটি লেনদেনের হিসেব ব্যাংকের অ্যাকাউন্টেই নথিভুক্ত থাকে, তাই পরবর্তীকালে কোনোরকমের ভুল বোঝাবুঝির সমস্যায় পড়তে হয় না। জমা টাকার ওপর ব্যাংকের দেওয়া সুদের হার যদিও খুব বেশি নয়, তবুও ছোট থেকে ব্যাঙ্কে জমা করার অভ্যাস থাকলে সঞ্চয় করার উপযোগিতা সম্পর্কে ধারণা বাড়ে।
ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট খোলা খুব একটা কঠিন কাজ নয়। প্রতিটি ব্যাংকের ক্ষেত্রে, ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলতে গেলে, বিশেষ করে সেভিংস অ্যাকাউন্ট এর ক্ষেত্রে কিছু নিয়ম আছে । ছাত্রছাত্রীদের জন্য, বা এখন এই সুবিধাটি প্রতিটি ছাত্র-ছাত্রী বা মাইনরিটি গ্রাহকদের ব্যাংক দিয়ে থাকে, সেটা হল জিরো ব্যালান্স অ্যাকাউন্ট। এই ধরনের অ্যাকাউন্টের ক্ষেত্রে, ছাত্র/ছাত্রীর নিজস্ব পরিচয়পত্র ( আধার কার্ড / স্কুলের পরিচয়পত্র) এবং তার অভিভাবকের পরিচয়পত্র ( ভোটারকার্ড/ প্যান কার্ড) ইত্যাদি জমা দিতে হয়।
মনে রাখতে হবে, ব্যাংক অ্যাকাউন্ট এক অর্থে একজন মানুষকে আলাদাভাবে পরিচিতি দেয়। ঠিক যেমনভাবে ভোটার বা আধার কার্ড পরিচয়পত্র, তেমনভাবেই ব্যাংকের অ্যাকাউন্টের পাসবই ও একজন মানুষের প্রাথমিক পরিচয়পত্রের কাজ করে। তাই ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করার পদ্ধতিগুলি সম্পর্কে সচেতন থাকতে হবে সবসময়। বিশেষ করে অনলাইন অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করার সময়ে — কখনোও কাউকে নিজের অ্যাকাউন্টের ইউজারনেম আর পাসওয়ার্ড দেওয়া যাবে না। নানারকমের প্রলোভন দেখিয়ে ফোন কল আসে, যেখানে বলা হয় অ্যাকাউন্ট নম্বর জানালে হটাৎ পাওয়া প্রাইজ কিংবা লটারিতে পাওয়া টাকা জমা হবে। এমন সব প্রলোভনে একেবারেই পা দেওয়া উচিত না। এই সমস্ত ব্যাপারে সতর্ক করতে ব্যাংকের তরফ থেকে নিয়মিত এস এম এস এ সতর্কবার্তা আসে। সেগুলি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল থাকা দরকার।
আজকের দিনে, ছাত্রজীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হলো, নিজেদের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলা এবং সেই অ্যাকাউন্টের উপযুক্ত ব্যাবহার করা। তুমি যদি বেড়ে ওঠার বয়স থেকে সঠিক ব্যাংকিং হ্যাবিট তৈরি করতে থাকো তাহলে সঠিক সময়ে নিজেদের প্রয়োজনে নিজেদের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে জমা রাখা সঞ্চয়ের সদ্ব্যবহার করতে পারবে।
ছবিঃ পিক্সাবে