সবুজ মনের রসদ
Ichchhamoti Logo
খেঁদির কথা: সপ্তদ্বীপা অধিকারী

এইবছর বইমেলার লিট্‌ল্‌ ম্যাগাজিন প্যাভিলিয়নের অগুন্তি টেব্‌লের মাঝে এক টেব্‌ল্‌ থেকে নিয়ে এসেছিলাম পাতলা এক বই — 'খেঁদির কথা'। যিনি বিক্রি করলেন, তিনি বলেছিলেন, নিয়ে যান, পড়ে ভালো লাগবে। এমন অনেকের কথা শুনেই অনেক বই কিনি, তারপরে পড়ে আর ভালো লাগে না। তবুও, বইটির নাম আর সূচিপত্র দেখে তুলে নিলাম। সঙ্গে চোখ টেনেছিল বইয়ের মলাট। সাধারণভাবে ছোটদের জন্য লেখা বইয়ের মলাটে এমন ছবি অনেকদিন চোখে পড়েনি। কোনো কমিক্স বা কার্টুন চরিত্র, পরী-সুপারহিরো, ফুল-পাখি, হাসিখুশি ছেলেমেয়ে নয় — একটি রোগা, সাদামাটা চেহারার, ফ্রক পরা মেয়ে , খানিকটা বিষণ্ণ মুখে, নিরুপায়ভাবে দাঁড়িয়ে রয়েছে একটা দেওয়াল ঘেঁষে। এ-ই নিশ্চয় খেঁদি!

'খেঁদির কথা' শুরু করার আগে এই ছোট্ট বইটির লেখিকা সপ্তদ্বীপা অধিকারী নিজের কিছু কথা লিখেছেন। ' আমার বাড়ি উত্তর ২৪ পরগণার বনগা সেকশনের গুমা রেলস্টেশন থেকে দু-আড়াই মাইলে ভেতরে এক গন্ডগ্রামে। গ্রামের নাম মানিকতলা। ওই গ্রামের চতুর্দিকে কাওড়া, মুচি, মেথরদের বসবাস। আমি ওদের সাথে খেলে বড়ো হয়েছি। আমার বাবার কখনো কোনো বিধি-নিষেধ ছিল না এদের সঙ্গে মেলামেশায়। এরা কেউই পড়াশোনা করত না বা স্কুলে যেত না। ভীষণ গরীব, খিদের সঙ্গে লড়তেই এদের দিনরাত এক হয়ে যেত। এখনকার মত বিনাপয়সায় স্কুলে পড়া বা খেতে পাওয়ার কোনো সুযোগ তখন ছিল না। ... এই রকমই এক পরিবারের মেয়ে ছিল খেঁদি।'

এই প্রাককথনটি পড়ে যে বাস্তব সমাজচিত্রের কথা চোখের সামনে এলো, শহরে বড় হয়ে ওঠা বেশিরভাগ ছেলেমেয়েদেরই হয়ত তেমন সব অভিজ্ঞতা নেই। কিংবা হয়ত আছে, চুপিচুপি, আড়ালে আবডালে। জাতের বিভাজন ভারতবর্ষের এক প্রাচীন সামাজিক সমস্যা, যাকে আমরা যতই দূরে ঠেলে দিতে চাই না কেন, মুছে ফেলতে চাই না কেন...ফিরে ফিরে আসেই। পশ্চিমবঙ্গের বড় শহরগুলিতে কিংবা কলকাতায় হয়ত এই সমস্যা সহজে আমাদের চোখে পড়ে না, প্রতিদিন খবরের হেডলাইন হয় না। কিন্তু ভারতের অন্যান্য অনেক রাজ্যে এই সমস্যা খুবই প্রকট, প্রায়ই হয়ে ওঠে টেলেভিশনের প্রধান খবর।

অত্যন্ত দরিদ্র পরিবারের ছোট্ট মেয়ে খেঁদিকে দুটো টাকা রোজগারের আশায়, তার মা-বাবা কাজ করতে পাঠায় সমীর ভটচায নামের এক মিষ্টি বিক্রেতার দোকানে। সেখানে খেঁদি সারাদিন অমানুষিক পরিশ্রম করলেও খেতে পায় খুব কম। যা পায়, তা দিয়ে তার ছোট্ট পেট ভরে না। তবুও সে মুখ বুজে কাজ করে চলে, বাড়িতেও কোনো কথা জানায় না, কারণ সে মনে মনে ঠিক করেছে তার ছোট্ট ভাইদুটো বাবুদের বাড়ির ছেলেদের মত জামা-জুতো পরে ইশকুলে পড়তে যাবে। তাই তার রোজগার করে বাবা-মা'কে সাহায্য করা দরকার। কৃপণ সমীর ভটচাযের বাড়িতে আর দোকানে কাজ করে এবং নানা কারণে অন্যায় শাস্তি পেয়ে জেরবার খেঁদির জীবনে নতুন বন্ধু, বড় দাদা হয়ে আসে কলকাতা শহর থেকে আসা অনিকেত। অনিকেতের বাবা পেশায় চিকিৎসক, তিনি বিনামূল্যে গরীব মানুষদের চিকিৎসা করেন। অনিকেতের মা বুলি সমীর ভটচাযের বোন হলেও তাঁর স্বভাব তাঁর নিষ্ঠুর, কৃপণ দাদার মত নয়। অনিকেতের পুরো পরিবার খেঁদি আর তার পরিবারকে সাহায্য করতে চায়। তাদের এই সিদ্ধান্তে খেঁদির মালিক বিরক্ত। এরপরে, বেশ কিছু ঘটনার ঘনঘটার পরে অবশ্য এই কাহিনির শেষে হয় দুষ্টের দমন আর শিষ্টের পালন। ছোট্ট খেঁদি তার পরিবারের সঙ্গে সসম্মানে বাঁচার পথ খুঁজে পায়। সবার উৎসাহে এটাও ঠিক হয় যে তার ছোট দুই ভাইয়ের সঙ্গে সেও লেখাপড়া শিখবে।

মাত্র ৭৮ পাতায় শেষ হয়ে যাওয়া এই কাহিনিকে হয়ত আরও একটু বড় করে, আরও একটু গুছিয়ে লেখার সুযোগ ছিল। কিছু কিছু জায়গাতে কল্পনার উড়ান আর কঠিন সমস্যার অতি সহজ সমাধান দেখতে পাওয়া যায়। চরিত্র নির্মাণের ক্ষেত্রেও, খারাপ আর ভালো মানুষের তফাৎ খুব প্রকট — যারা খারাপ, যেমন সমীর ভটচায, তার স্ত্রী এবং ছেলে আর তার প্রতিবেশী — তার সবাই খুব বেশি খারাপ; যারা ভালো, যেমন অনিকেত, তার মা-বাবা, খেঁদির প্রতিবেশী প্রতিমার মা — তারা সবাই খুব বেশি ভালো। এমন না হয়ে চরিত্রগুলি একটু সাদায়-কালোয় মেশানো হতে পারত। যেমন, কেন স্বচ্ছল পরিবারের দয়ালু মায়ের ছেলে এবং পরোপকারী বুলির দাদা সমীর এত কৃপণ এবং নিষ্ঠুর মিষ্টি বিক্রেতা হয়ে গেল, গল্পের মধ্যে তার কারণ বিস্তার হলে হয়ত কাহিনিটি অন্য মাত্রা পেত।

এসবের পরেও, এই বইটি নিয়ে আলোচনা করতে এই কারণেই ইচ্ছা করল যে, ইদানীংকালে বাংলায় লেখা ছোটদের বইতে এমন বিষয় খুব একটা দেখিনি, যেখানে মূল চরিত্র একটি গরীব, তথাকথিত 'নীচু জাতের' ছোট্ট মেয়ে; যে কাহিনিতে সরাসরি জাতের দোহাই দিয়ে দুর্বলের ওপর অন্যায় অত্যাচার বা মিথ্যে চুরির ঘটনা সাজিয়ে চোর অপবাদ দিয়ে সরকারী হোমে পাঠিয়ে দেওয়ার মত কঠিন বাস্তব সমস্যার কথা উঠে এসেছে। এটাও উল্লেখযোগ্য যে, লেখিকা নিজে প্রান্তিক মানুষজনের সঙ্গে ভালোভাবে পরিচিত বলে, তাদের জীবনযাত্রার বিশদ বর্ণনা, এবং আঞ্চলিক ভাষা খুব সফলভাবে ব্যবহার করেছেন। বিভিন্ন পরিচ্ছেদে কথক বা চরিত্রের দৃষ্টিকোণ অনুযায়ী ভাষা বদল করে লেখা হয়েছে।

সপ্তদ্বীপা অধিকারীর লেখা 'খেঁদির কথা' প্রকাশিত হয়েছে 'ইচ্ছে ফড়িং' প্রকাশনা থেকে। বইয়ের শেষে রয়েছে লেখিকার সংক্ষিপ্ত পরিচয়। তবে যে প্রচ্ছদ দেখে আমি বইটি তুলে নিয়েছিলাম, সেই ছবির শিল্পীর নাম কোথাও উল্লেখ নেই। থাকলে ভালো লাগত।

বইঃ খেঁদির কথা
রচনাঃ সপ্তদ্বীপা অধিকারী
প্রকাশকঃ ইচ্ছে ফড়িং
প্রকাশকালঃ ২০২১
মূল্যঃ  ১৫০/-

 

বইপোকা অবশ্যই নতুন নতুন বই পড়তে ভালবাসেন। আরো ভালবাসেন সেইসব বই এর খোঁজ সবাইকে দিতে। নতুন নতুন বইয়ের খোঁজ পেতে চোখ রাখ বইপোকার দপ্তরে। আর তোমার কাছে যদি কোন খুব ভাল বই থাকে, যেটার কথা তুমি বন্ধুদের এবং বইপোকাকে জানাতে চাও, তাহলে বইপোকাকে সেই বইয়ের খবর জানিয়ে চিঠি লেখ ইচ্ছামতীর মেইল ঠিকানায়।

আমরা, ভারতের জনগণ, ভারতকে একটি সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, সাধারণতন্ত্র রূপে গড়ে তুলতে সত্যনিষ্ঠার সঙ্গে শপথগ্রহণ করছি এবং তার সকল নাগরিক যাতে : সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ন্যায়বিচার; চিন্তা,মতপ্রকাশ, বিশ্বাস, ধর্ম এবং উপাসনার স্বাধীনতা; সামাজিক প্রতিষ্ঠা অর্জন ও সুযোগের সমতা প্রতিষ্ঠা করতে পারে এবং তাদের সকলের মধ্যে ব্যক্তি-সম্ভ্রম ও জাতীয় ঐক্য এবং সংহতি সুনিশ্চিত করে সৌভ্রাতৃত্ব গড়ে তুলতে; আমাদের গণপরিষদে, আজ,১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর, এতদ্দ্বারা এই সংবিধান গ্রহণ করছি, বিধিবদ্ধ করছি এবং নিজেদের অর্পণ করছি।

ফেসবুকে ইচ্ছামতীর বন্ধুরা