মূল অসমিয়া ৷৷ হরেন্দ্রনাথ বরঠাকুর
বাংলা অনুবাদ ৷৷ সুশান্ত কর
৷৷ চরিত্রগুলো ৷৷
রানি ৷৷ প্ল্যাটফর্মবাসী গৃহহীন দলটির নেত্রী।
মুনিয়া ৷৷ এক অন্ধ মেয়ে।
বুলু ৷৷ সিনেমার পোস্টার লাগানোর কাজ করা ছেলে।
মকবুল ৷৷ চা দোকানির থেকে চা কিনে এনে বিক্রি করে যে ছেলে।
হিরা ৷৷ পান সিগারেট বিক্রেতা ছেলে।
বিরু ৷৷ জুতো পালিশ করিয়ে ছেলে।
আলিবাবা ৷৷ ফেলে দেওয়া জিনিস কুড়িয়ে বিক্রি করে যে ছেলে।
মুন্নি ৷৷ রেলস্টেশনে গাইয়ে মেয়ে।
মুন্না ৷৷ রেলস্টেশনে গাইয়ে ছেলে।
কুরবান ৷৷ খবরের কাগজ বিক্রেতা ছেলে।
যতীন ৷৷ শিল্পী সাংবাদিক
মতিউর রহমান ৷৷ কনস্টেবল
ইসমাইল ৷৷ জুতো পালিশ করিয়ে ছেলে।,
১ম প্রহরী,২য় প্রহরী,RPF ( রেলওয়ে পুলিশ), কনস্টেবল , পুলিশ অফিসার,স্টেশন মাস্টার,মোটে ,মোটে ,কিছু যাত্রী।
[অনুবাদ সম্পর্কেঃহরেন্দ্রনাথ বরঠাকুরের জন্ম ১৯৪১-এ। আশি উত্তীর্ণ এই নাট্যকার ২০১৭তে অসমীয়া শিশু সাহিত্যে, তথা নাটকে জীবনজোড়া অবদানের জন্যে সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কারে সম্মানিত হয়েছেন। শিশুনাটকগুলো জড়ো করে এর আগে ‘শিশুনাট সমগ্র’ প্রকাশিত হয়েছিল ২০১৪তে। বইটিতে মাত্র ১০টি নাটক সংকলিত হলেও অপ্রকাশিত নাটকের সংখ্যা আরও অনেক, যেগুলো নানা মঞ্চে অভিনীত হয়েছে। একাধিক শিশু উপন্যাসও তিনি লিখেছেন। ‘খরিয়ে মেলিলে পাট’ ও ‘কণ পরুআর বিলৈ’ এর মধ্যে অন্যতম। আকাশবাণীর স্বকৃত গীতিকবি তিনি। ‘মই কিয় নাস্তিক হলো’ নামে ভগৎ সিঙের বইয়ের অসমিয়া অনুবাদও করেছিলেন। সারা অসম জনসাংস্কৃতিক পরিষদের দীর্ঘদিন সভাপতি ছিলেন। আকাদেমি পুরস্কার ছাড়াও ‘মাধবীলতা সাহিত্য বঁটা ২০০৯’ ‘ধর্মেশ্বর কটকী শিশু সাহিত্য বঁটা ২০১১’ -র মতো বেশ কিছু পুরস্কারেও তিনি সম্মানিত হয়েছেন।
মূলকে অক্ষত রেখে করা কোনও অনুবাদই ভালো অনুবাদ নয়। তবু বড়দের জন্যে লেখা গল্প, উপন্যাস,প্রবন্ধ অব্দি মূলের অনেকটা ধারে কাছে রেখে দেওয়া যায়।প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে কবিতা, নাটক ইত্যাদি।বিশেষ করে যদি সেই সব ছোটোদের জন্যে হয়। তাঁর অধিকাংশ নাটকই রূপক নাটক। এই নাটকের মতো দুই একটি জীবনবাস্তবতা নির্ভর। কিন্তু এর গান-কবিতাগুলোকে অবশ্যই আক্ষরিক অনুবাদ করা সমস্যা ছিল। আমরা ভাবানুবাদই করেছি। একেবারে শেষের গানটি বাদ দিয়ে। আমাদের মনে হয়েছে সলিল চৌধুরীর গানটিই সেখানে যথোপযুক্ত হবে। শিশুদের জন্যেও দুরূহ নয়। ]
৷৷ প্রথম দৃশ্য ৷৷
দৃশ্য সজ্জা ৷৷ দর্শকের বাঁদিকে ওভার ব্রিজ দিয়ে ওঠানামা করবার সিঁড়ি। ডানদিকে প্ল্যাটফর্মের ছাদ ও খোঁটার বিশেষ আকারের আভাস। খোঁটা এবং সিঁড়ির মাঝে আরামে বসবার বেঞ্চ। নাটকের মূল চরিত্র---বুলু, মুনিয়া, মুন্নি, রানি, আলিবাবা, বিরু, হিরা, মকবুল, কুরবান মঞ্চের নানান কোণায় দাঁড়িয়ে থাকবে। পর্দা ওঠার আগেই নচিকেতার ‘অন্তবিহীন পথ চলাই জীবন’ গানটি পুরো বা প্রথম স্তবক গাওয়া যেতে পারে বা শুধুই সুর বাজতে পারে। পর্দা উঠলে ছেলে-মেয়েরা সমবেত কণ্ঠে সুর করে বলে উঠবে...গানের সুর পরিচালক ভেবে নিতে পারেন।
৷৷ গান ৷৷
এই যে পান্থশালা
আমাদের প্ল্যাটফর্ম
দাঁড়াও ফুফু খালা,
দাঁড়াও ড্যাড মম।
দিদিমা দাঁড়িয়ে যাও,
দাদুও দাঁড়িয়ে যাও।
দাঁড়াও দাদা দিদি,
ঠাকুরদা ঠানদিদি
দাঁড়াও না নানা-নানি
আমাদের কী কাহিনি
বলছি, বলছি শোনো
ঝিঁ-ই-ই কুক কুক
এই যে বোনটি শোনো,
আঙ্কল আন্টি শোনো,
আমাদের ছাই চাপা দুঃখ ও শোক।
আসে যায় কত গাড়ি
কত শত যাত্রী
পড়ে থাকে রেল লাইন
স্থির দিন রাত্রি।
মকবুল ৷৷ ‘চায়ে গরম!’ খেয়ে যাও এক কাপ ‘চায়ে গরম!’
কুরবান ৷৷ খবর! পড়বে যদি-- খবর! জীবনে বহু পথ এখনও দুর্গম ।
মকবুল ৷৷ ‘চায়ে গরম!’ খেয়ে যাও এক কাপ ‘চায়ে গরম!’
মুনিয়া ৷৷ আমি অন্ধ –আমার জীবনে আঁধার চরম।
মকবুল ৷৷ ‘চায়ে গরম!’ খেয়ে যাও এক কাপ ‘চায়ে গরম!’
মুন্নি ৷৷ আমার গাইতে করে না লজ্জা শরম।
মকবুল ৷৷ ‘চায়ে গরম!’ খেয়ে যাও এক কাপ ‘চায়ে গরম!’
মুন্না ৷৷ আমাদের নেই বাড়ি, বাড়ি মানে পেলেটফরম!
মকবুল ৷৷ ‘চায়ে গরম!’ খেয়ে যাও এক কাপ ‘চায়ে গরম!’
৷৷ দ্বিতীয় দৃশ্য ৷৷
(প্ল্যাটফর্মের সদাব্যস্ত পরিবেশ। মকবুলের গেঞ্জি-শার্টখানা পরছিল। হিরা ওর ছোট্ট দোকানে পান সুপারি সাজাচ্ছিল। বিরু বুট পালিশের বাক্সটি একটি কাপড়ে পরিষ্কার করছিল। আলিবাবা এক কোণে জমা করে রাখা ভাঙা টুকরো জিনিসগুলো বস্তাতে ভরছিল। কুরবান কিছু দৈনিক ও সাময়িক পত্রিকা ঠিকঠাক করে ব্যাগে ভরছিল। মোদ্দা কথা, সবাই দিনের কাজে বেরিয়ে যাবার প্রস্তুতি চালাচ্ছে। রানি মুন্নির চুল আঁচড়ে দেয়, নিজেও চুল আঁচড়ায়। প্ল্যাটফর্মে যাত্রীর আসা যাওয়া চলছে। মোটেরা যাত্রীদের সামনে পেছনে মাথাতে মোট নিয়ে যাতায়াত করছে। দুই একজন টিটিই, গার্ড, পুলিশ কনস্টবলও পেরিয়ে যায়। এক মোটে মাথাতে বোজা নিয়ে যেতে যেতে হিরাকে বলে যায়...)
মোটে ৷৷ আরে, হিরা ভায়া! ইতনা লেট কিঁউ? ট্রেইন আনে কো টাইম হো গয়া।
হিরা ৷৷ যা রহা হু চাচা।
রানি ৷৷ জলদি কর, জলদি কর! ঐ আলি, যা, মুনিয়াকে রেখে আয়। লেট করিস না।
(আলি ‘চল মুনিয়া, চল!’ বলে ওকে হাতে ধরে ওভার ব্রিজের দিকে নিয়ে যায়।)
রানি ৷৷ চল, চল! সবাই বেরো।
(সবাই নিজের নিজের কাজে প্ল্যাটফর্মের ভেতরে যায়। প্ল্যাটফর্ম অধিক ব্যস্ত হয়ে পড়ে। যাত্রীদের সমাগম এবং নানা কোলাহলপূর্ণ শব্দে পরিবেশটা চঞ্চল করে তোলে।
হঠাৎ প্ল্যাটফর্মের মাইকে ঘোষিত হয় “মনোযোগ দিয়ে শুনবেন, মনোযোগ দিয়ে শুনবেন! একটি বিশেষ জরুরি ঘোষণা। আজ সকাল ৭টায় এসে পৌঁছুবার ঊর্ধ্বমুখী কাঞ্চন জঙ্ঘা এক্সপ্রেস এবং ব্রহ্মপুত্র মেইল গাড়ি দুটি বঙাইগাওঁর কাছে রেলসেতুতে বোমা বিস্ফোরণের জন্যে সময়ে এসে পৌঁছুতে পারছে না। এই পথে গাড়ি চলাচলে বিঘ্ন ঘটেছে। তাই আবার ঘোষণা না করা পর্যন্ত সমস্ত ঊর্ধ্বমুখী ও নিম্নমুখী ট্রেন চলাচল অনির্দিষ্ট কালের জন্যে বাতিল বলে ঘোষণা করা হয়েছে। সবিশেষ জানবার জন্যে যাত্রীদের ৬ নম্বর কাউন্টারে যোগাযোগ করবারা আবেদন জানানো হচ্ছে।” গোটা প্ল্যাটফর্মের গতি স্তব্ধ হয়ে যাবে। যাত্রী আর অন্যান্য চরিত্রগুলো স্থির [ফ্রিজ] হয়ে যাবে। আলো ধীরে ধীরে ফেড আউট হবে এবং এক নির্জন সাংগীতিক পরিবেশে প্ল্যাটফর্ম ডুবে যাবে।)
৷৷ তৃতীয় দৃশ্য ৷৷
(প্ল্যাটফর্মে তখন সন্ধ্যা। এক হাতে পোস্টারের বাণ্ডিল। অন্য হাতে রশিতে বেঁধে ঝোলানো একটি ‘ডালডা’র ডিবা। তাতে ময়দার আঠা। সে আঠার ডিবা বেঞ্চের নিচে ঠেলে দিয়ে পোস্টারের বাণ্ডিলকে বালিশ করে সটান লম্বা হয়ে বেঞ্চে শুয়ে পড়ে। খানিক পরে অন্ধ মেয়ে মুনিয়াকে ধীরে ধীরে পা ফেলে সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসতে দেখা যাবে। ওর হাতে একটি এলুমিনিয়ামের বাটি। হঠাৎ ওর হাত থেকে বাটিটা খসে পরে সিঁড়ির তলাতে এসে পৌঁছুবে। এর শব্দে বুলু উঠে বসবে। সিঁড়ির দিকে তাকিয়ে মুনিয়াকে দেখে উঠে গিয়ে ওকে হাত ধরে নামিয়ে আনে।)
মুনিয়া ৷৷ কে?
বুলু ৷৷ আমি।
মুনিয়া ৷৷ বুলু? আর কেউ নেই? (বুলুর হাতে ধরে সে নেমে আসবে। বুলু বাটিটা তুলে ওর হাতে দেবে, আর বেঞ্চে নিয়ে বসিয়ে দেবে
গিয়ে)
বুলু ৷৷ না, আমি একাই আছি।
মুনিয়া ৷৷ এতো চুপচাপ আছিস যে? ওরা এখনও আসে নি? রানি গেল কই?
বুলু ৷৷ আছে কোথাও। আজ আর যাবে কই? ট্রেন তো আসবে না। পুরো প্ল্যাটফর্ম খালি।
মুনিয়া ৷৷ পুরো দিন এমনিই বসে রইলাম। প্যাসেঞ্জার তো নেইই, অন্য মানুষজনও নেই।
বুলু ৷৷ কত পেলি?
মুনিয়া ৷৷ এক টাকা।
বুলু ৷৷ এক টাকা!!
মুনিয়া ৷৷ আর কী! এই দ্যাখ। (মুনিয়া জামার পকেট থেকে একটাকা বের করে দেখায়।)
বুলু ৷৷ দিনে তবে খেলি কী?
মুনিয়া ৷৷ কই আর কী খেলাম? ঠাণ্ডা পানি। (বুলু ওর মুখের দিকে তাকাল খানিক।)
বুলু ৷৷ দাঁড়া , কিছু একটা আনি।
মুনিয়া ৷৷ তুই কি কিছু খেয়েছিস? (সে ডান দিকে মঞ্চের বাইরের দিকে তাকিয়ে মকবুলকে চেঁচিয়ে ডাক দিল।) এ্যাই, মকবুল! দুই
কাপ চা আর দুটো বন নিয়ে আয় তো।
মুনিয়া ৷৷ তোর কি কোনও রোজগার হল আজ?
বুলু ৷৷ আজ তো শুক্রবার। সিনেমা পাল্টেছে। পুরো দিন শহরে ঘুরে পোস্টার সেঁটেছি।
মুনিয়া ৷৷ দিনে কী খেলি?
বুলু ৷৷ দিনে কী আর খাবার সময় পেলাম? হাতে পয়সাই নেই। এখন আসবার সময় ম্যানেজার ২০টাকা দিল। ১০ টাকার ধোসা
খেলাম। ১০ টাকা আছে। (তিন কাপ চা আর তিনটা বন নিয়ে এল মকবুল।)
মকবুল ৷৷ তিনটা এনেছি কিন্তু।
বুলু ৷৷ তুইও খাসনি? দিনে কিছু খেয়েছিস কি না?
মকবুল ৷৷ কোত্থেকে খাবি? চা দেখ দেখি, রোজ ওরই চা কামরায় কামরায় নিয়ে বিক্রি করি। বললাম, রুটি দুটি খেতে দে, পরে পয়সা
দেব। দেয়ই না। পরে একটা মাত্র পপ দিল। ঐ টুকুনই। (মকবুল খেতে শুরু করে। বুলু মুনিয়ার হাতে এক কাপ চা আর বন
তুলে দেয়। ) পয়সা তো পাবিই রে বাবা। আজ নয় তো কাল। আমি পালিয়ে তো আর যাচ্ছি না।
(রানি আর আলিবাবা এসে প্রবেশ করে আলিবাবার হাতে একটি ছেঁড়া ব্যাগ। ব্যাগে ভাঙা চুরা প্লাস্টিকের কৌটো, কণ্ডেনসড মিল্কের খালি ডিবা, মিনারেল ওয়াটারের খালি বোতল ইত্যাদি। ব্যাগটি এক কোণে ছুঁড়ে ফেলবার শব্দে মকবুল, বুলু, মুনিয়া---তিনজনেই ওদের দুজনের দিকে ঘুরে তাকায়। বুলুও বন খেতে শুরু করে।)
রানি ৷৷ কী খাচ্ছিস তোরা?
বুলু ৷৷ বন।
রানি ৷৷ পেলি কই? আজ তোদের কামাই হল? মুনিয়া!
মুনিয়া ৷৷ এক টাকা।
বুলু ৷৷ বিশ টাকা।
মকবুল ৷৷ এক পয়সাও না।
রানি ৷৷ (বুলুকে) দে, ২০টাকা জমা দে। আমরা পুরো দিন শুধু ঠাণ্ডা জলখেয়ে আছি।
বুলু ৷৷ পুরো দিন রোদে রোদে ঘুরে পোস্টার মেরেছি। ২০টাকা দিয়েছে। খিদেতে পেট জ্বলছিল। ১০ টাকার একটা ধোসা খেয়ে
নিয়েছি। মুনিয়া আর মকবুল কিছু খায় নি। পকেটে ১০ টাকা ছিল। তাতেই এখন তিন কাপ চা আর বন তিনটা এনে খাচ্ছি। হ্যাঁ,
তোরা দুজনেও খা। (সে বনটা দুই ভাগ করে রানি আর আলিবাবাকে দিল।) মকবুল, নে চায়ের পয়সা দিয়ে আয়। (বুলুর হাত
থেকে ১০ টাকা নিয়ে মকবুল চলে যায়।) রানি খা। আমি তো ধোসা একটা খেয়েছি। খালি পেটে থাকার চেয়ে যা পাচ্ছিস তাই
খেয়ে ফেল। গাড়ি কখন চলবে তার ঠিক নেই।
মুনিয়া ৷৷ জলদি যে গাড়ি চলবে –তার আশা নেই। লোকে বলাবলি করছিল, শুনলাম--- বোমা মেরে পুল উড়িয়ে দিয়েছে। ঠিক
করতে কম করে হলেও এক সপ্তাহ।
রানি ৷৷ এক সপ্তাহ! এক সপ্তাহ খেতে না পেলে বেঁচে থাকবি?
বুলু ৷৷ বেঁচে তো থাকতেই হবে। প্ল্যাটফর্মে টহল দিতে থাকলে চলবে না। আমাদের সবাইকে বাইরে যেতে হবে।
রানি ৷৷ তোদের জমা করা একটা পয়সাও আমার হাতে নেই। রোজগার করবি, পয়সা জমা করবি। তবেই না তোদের জন্যে কিছু
করতে পারি। এত দিন ধরে ডাইনিং কার থেকে দুই বেলা এনে যা করেই হোক চালাচ্ছিলাম। বাইরে বাইরে রোজগার করে
যদি ধোসা খেয়ে ফেলিস, আমি তবে কী করে ঘর চালাই?
বুলু ৷৷ কসম খেয়ে বলছি, আমার খুব খিদে পেয়েছিল রে। এই দেখ, আজ থেকে খিদেতে মরে গেলেও খাব না।
(বুলু দুই কান ধরে।)
রানি ৷৷ থাকলে সবাই ভাগ করে খাব, না থাকলে খাব না। আমাকে তোরা রানি করেছিস। আমাকে তো তোদের সবার কথা ভাবতে
হবে। টাকা পয়সা পাস, জিনিস পাস –সব এনে আমার হাতে জমা দিবি। তখনই আমি চালাতে পারব। তুই একাই যদি দশ টাকা
হজম করে ফেলিস তবে কী করে চলবে?
বুলু ৷৷ কসম বলছি, আজ থেকে মরে গেলেও খাব না।
(মকবুল আসে। এক হাতে এক বোতল ঠাণ্ডা পানি, আর হাতে বাকি টাকা।)
মকবুল ৷৷ নে, রানি দি। চার টাকা। মুনিয়া পানি খাবি?
মুনিয়া ৷৷ দে।
(মুনিয়া এলুমিনিয়ামের বাটিটা তুলে নেয়। মকবুল জলদেয়, সে খায়। ঠিক সেই মুহূর্তেই ওভার ব্রিজের সিঁড়ির উপরে বিরু আর হিরাকে দেখা যায়।বিরুর হাতে জুতো পালিশ করবার সরঞ্জামের বাক্স। আর হিরার গলাতে পান বিড়ি সিগারেটের ডালা। হিরা বিরুকে ধরে ধরে নিয়ে আসছে। সিঁড়ির উপর থেকেই হিরা ডাক দেয়...)
হিরা ৷৷ রানি দিদি!
রানি ৷৷ আরে! কী হল? বিরুর কী হল?
(সবাই সন্ত্রস্ত হয়ে সিঁড়ির কাছে যায়। বিরুকে এনে বেঞ্চে বসায়।)
বুলু ৷৷ কী হল?
হিরা ৷৷ মেরেছে।
রানি ৷৷ মেরেছে? কে মেরেছে? কেন মারল?
হিরা ৷৷ স্টেশনের বাইরে জুতো পালিশ করতে গেছিল বলে। স্টেশনের বাইরেটা বুঝি ওদের। প্ল্যাটফর্মের ভেতরটাই আমাদের। বিরু
একটি লোকের জুতো পালিশ করছিল। তখন ওরা এসে সব কেড়ে নিয়ে যাচ্ছিল। ওর ব্রাশ, রং বাক্স সব ছুঁড়ে ফেলে দিল।
রানি ৷৷ তুই বাইরে গেছিলিই কেন?
বিরু ৷৷ পুরো দিন এখানে ছিলাম। একটাও প্যাসেঞ্জার নেই। এক পয়সারও কামাই হচ্ছিল না। সে জন্যেই গিয়েছিলাম।
মকবুল ৷৷ চোট পেয়েছিস? (বিরু মাথা নেড়ে সম্মতি জানায়।)
রানি ৷৷ কই চোট পেলি? ঘুসি মেরেছে?
হিরা ৷৷ একদম ধস্তাধস্তি। পাঁচটাতে ধরে মেরেছে। রিকশাওয়ালা ক’জনে ধরে ছাড়িয়ে দিল বলেই বেঁচেছে।
বুলু ৷৷ কে রে ওগুলো?! চল তো যাই, দেখি গে।
রানি ৷৷ দাঁড়া! কেউ বাইরে যাবি না। দাদাগিরি দেখাতে হবে না। সবাই এখানে থাক। জলখাবি? (মকবুল জলের বোতল এগিয়ে
দেয়।) টেপে যা। হাত মুখ ধুয়ে আয়। ভালো লাগবে। ঐ আলিবাবা! যা তো ওকে হাত মুখ ধুয়ে নিয়ে আয়।
(আলিবাবা বিরুর হাত ধরে মঞ্চের ডান দিকে প্রস্থান করে।)
রানি ৷৷ দিনে মনে ও খায়ও নি কিচ্ছু। মকবুল, যা তো বন দুটো নিয়ে আয়।
(বুলুর দেওয়া চার টাকার থেকে দু-টাকা বের করে রানি মকবুলকে দেয়। মকবুল চলে যায়।)
মুনিয়া ৷৷ রানিদি, মুন্না আর কুরবান কি এখনও আসে নি ?
রানি ৷৷ না আসে নি।
মুনিয়া ৷৷ ওরা দু-জনেও মনে হয় আজ কিছু খেতে পায় নি।
বুলু ৷৷ কুরবান যে করেই হোক দুই চারটা কাগজ বিক্রি করতে পারবে। কিন্তু এই মুন্না মুন্নি কী করবে? গাই গাইবে কই? দু-জনে
যদি এক সঙ্গে আছে তবে দু-জনেই বাসস্ট্যান্ডে কাগজ-পত্র বিক্রি করতে পারবে।
হিরা ৷৷ না, মুন্নি আজ পুরো দিনই আমার সঙ্গে ছিল। কুরবান তো সেই সকালেই বেরিয়ে গেছে।
রানি ৷৷ ওরা মার খেয়ে না এলেই রক্ষা।
(মকবুল আর বিরু আসে। বিরুকে বেঞ্চে বসিয়ে খেতে দেয়। সেই সময়ে সিঁড়ি দিয়ে দু-জন টিটিই কথা বলতে বলতে আসে। ডানদিকের প্রবেশ পথ দিয়ে বেরিয়ে যাবার মুহূর্তে হঠাতই একজন আর জনকে বলে ‘দাঁড়ান তো!’ থেমে হিরাকে আঙুলের ইশারাতে ডাকেন।)
প্রথম টিটিই ৷৷ এ্যাই, এদিকে আয় তো। (হিরা উঠে যেতে উদ্যত হয়) তোর পানের ডালাটা নিয়ে আয়। (হিরা ডালা গলাতে ঝুলিয়ে
এগিয়ে যায়।) দে, দুটি পান দে।
হিরা ৷৷ (পান সাজিয়ে দিল) ট্রেন কখন চলবে বাবু? আজ একেবারেই রোজগার নেই।
দ্বিতীয় টিটিই ৷৷ আজ রাতের মধ্যে যদি সেতু মেরামত হয়ে যায়, তবে কালকে দুই একটা চলবে। (পান মুখে পুরে নেন)। সিগারেট
আছে? চারমিনার?
হিরা ৷৷ আছে। (দু-জনেই পান মুখে পুরে সিগারেট নিয়ে যেতে উদ্যত হন।) টাকা, বাবু।
১ম টিটিই ৷৷ পরে নিবি, যা।
হিরা ৷৷ বললাম না, এক পয়সাও রোজগার নেই। আজ পুরো দিনে কিছু খাইনি বাবু।
২য় টিটিই ৷৷ ট্রেন না চললে, আমাদেরও রোজগার নেই। তোদের তো যা করেই হোক চলে যায়। আমাদেরই চলা কঠিন। ট্রেন চললে কাল পাবি, যা। তোর সঙ্গেও ঐ ছেলেটা দেখছি আয়েশ করে বন চিবুচ্ছে। (দু-জনেই চলে যায়।)
হিরা ৷৷ হুঁহ! কাল দেবে! ট্রেন চললে তবেই দেবে।
রানি ৷৷ ভালোই হয়েছে। ডালাটা দেখিয়ে মেলে রাখলে কী হবে? ( ওভার ব্রিজের সিঁড়িতে কুরবান। হাতে একটি ‘সান্ধ্য খবর’)
কুরবান ৷৷ খবর, খবর, খবর। সান্ধ্য খবর। রেল লাইনে বোমা। কাল থেকে আবার রেল চলাচল শুরু...।
বুলু ৷৷ অই! তুই চেঁচাবার আর জায়গা পেলি না? পেট ফুল করে এসেছিস মনে হচ্ছে।
রানি ৷৷ মুন্নি, মুন্নি কই?
কুরবান ৷৷ কই গেছে কী করে জানব ? (মুন্নির প্রবেশ)
বুলু ৷৷ ঐ আসছে। এ্যাই, মুন্না কই?
রানি ৷৷ কই গিয়েছিলি তুই একা একা?
মুন্নি ৷৷ একা নয়। মুন্নার সঙ্গে গিয়েছিলাম।
রানি ৷৷ কই গিয়েছিলি?
মুন্নি ৷৷ বাইরের বাজারে গান গাইছিলাম। মাত্র দুই টাকা কামাই হল। মুন্না বাস স্ট্যান্ডে চলে গেল। আমাকে সঙ্গে নিল না। সে বুঝি
একা একা গান গাইবে। (কুরবান আর মুন্নি বেরিয়ে যায়)
হিরা ৷৷ গান গাইতে গেছে। ট্রেন নেই তো... একেবারে রেডিও, দূরদর্শন... ।
রানি ৷৷ এ্যাই, ফাজলামি করবি না। ছেলেটা এখন অব্দি আসে নি। তোর স্ফূর্তি লাগছে, তাই না? দিনে কিছু খেয়েছে কি খায় নি
তার ঠিকানা নেই। কোথাও মার খেয়ে পড়ে আছে কি না কে জানে?
হিরা ৷৷ কিছু না খেলেও মার তো খেয়েইছে।
রানি ৷৷ চুপ। ছেলেটা আসছে না। কই ওর খোঁজে বেরোবে, তা না। ফাজলামি করতে আসছে। এ্যাই, সবাই শুতে যা। বিরুকে বেঞ্চে
দে। যা, যা, নিজের নিজের জায়গাতে শুয়ে পড়।
(বেঞ্চের তলাতে, এখানে ওখানে ওদের সবার ছেঁড়া কাপড় কাঁথা তল্পি বেঁধে গোটানো ছিল। সেগুলো বের করে সবাই শোবার বন্দোবস্ত করল। রানি আর মুনিয়া এক সঙ্গে শোয়। মঞ্চের আলো ধীরে ধীরে নিষ্প্রভ হয়ে আসে। ক্ষীণ স্বরে নেপথ্য থেকে ট্রেন চলবার শব্দ শোনা যায়, সেই শব্দ আবার মিলিয়েও যায়। চারদিক নীরব, নির্জন। ওভার ব্রিজের সিঁড়িতে বিষণ্ণ মুন্নাকে দেখা যায়। ধীরে ধীরে নেমে এসে নিচের সিঁড়ির ধাপে বসে পড়ে। রানি কাত ফেরে। মুন্না ধীরে ধীরে রানির কাছে এসে আলতো ঠেলা দিয়ে আস্তে করে ডাকে---)
মুন্না ৷৷ রানিদি!
রানি ৷৷ (এক ঝাঁপে উঠে বসে) মুন্না!
মুন্না ৷৷ কিছু খাবার আছে কি রানিদি?
রানি ৷৷ না, কিচ্ছু নেই। এত রাত অব্দি কই গেছিলি?
মুন্না ৷৷ কিছু একটা খেতে দে না। আমার খুব খিদে পেয়েছে ।
(রানি মুন্নার হাতে ধরে ‘এই দিকে আয়’ বলে মঞ্চের সামনের একটা কোণে নিয়ে যায়। আলো ওদের দু-জনের উপরে এসে
স্থির হবে।)
রানি ৷৷ বল, সত্য বলবি, কই গেছিলি? (মুন্না মৌন থাকবে) কই গেছিলি, বল!
মুন্না ৷৷ বলব। আমাকে কিছু খেতে দে । খুব খিদে পেয়েছে রে।
রানি ৷৷ খেতে দেবার কিচ্ছু নেই। কই গিয়েছিলি, বল।
মুন্না ৷৷ বাস স্ট্যান্ডে ।
রানি ৷৷ কেন?
মুন্না ৷৷ গান গাইতে। ট্রেন নেই। প্যাসেঞ্জার নেই। এখানে বসে থাকলে চলবে? সেজন্যেই চলে গেলাম।
রানি ৷৷ গান গেয়ে কত টাকা পেলি? (মুন্না নীরব) কত পেলি, বলছিস না কেন?
মুন্না ৷৷ অনেক। পঞ্চাশ টাকা।
রানি ৷৷ কী! পঞ্চাশ টাকা! কী করলি? দে, জমা দে।
(মুন্না এবারেও নীরব)
রানি ৷৷ চুপ কেন? দে। (মুন্না নীরব) কী করলি? হারালি?
মুন্না ৷৷ ডবল গুটি লটারি খেলে ফেললাম।
রানি ৷৷ কী-ই-ই! তারপর?
মুন্না ৷৷ হেরে গেলাম।
রানি ৷৷ সব!
মুন্না ৷৷ হুঁ!
(দুজনে দুজনার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। রানির মুখে বিস্ময়, মুন্নার মুখে বকা খাবার ভয়।)
মুন্না ৷৷ আমার খুব খিদে পেয়েছে। (সাট করে সে উঠে বেঞ্চের তলাতে খোঁচাখুঁচি করে খোঁজতে থাকে। আঠার ডিবাটা বের করে
আনে) এই সব কী? (টিনের ডিবার ভেতরে হাত চালায়)
রানি ৷৷ ময়দার আঠা। রেখে দে।
মুন্না ৷৷ আমি খাব।
রানি ৷৷ এ্যাই! পাগল হয়েছিস বুঝি? রেখে দে বলছি।
মুন্না ৷৷ কিছু হবে না, খাব। ( সে এক মুঠো আঠা তুলে নেয় হাতে। রানি খপ করে ওর হাতে ধরে ডিবাটা নিজের হাতে নিয়ে নেয়।)
রানি ৷৷ পাগল কোথাকার! অসুখ বাঁধিয়ে মরতে চাইছিস? বমি করতে করতে মরে যাবি, জানিস না। (বেঞ্চের তলা থেকে সে জলের
বোতল বের করে আনে।) দাঁড়া। হুঁ। জল খা।
(বোতলটা সে ওর মুখের উপরে মেলে ধরে। মুন্না মুখ মেলে। আলো মুন্নার মুখে আর জলের বোতলে স্থির হয়ে ক্রমে মিলিয়ে যায়। তীব্র গতিতে ট্রেন চলে আসবার শব্দ হয়।)
৷৷ চতুর্থ দৃশ্য ৷৷
(ট্রেন এসে পৌঁছুবার এক কোলাহলপূর্ণ পরিবেশ। ডানদিক থেকে তল্পি-তল্পা সহ একাধিক যাত্রী, তরুণ-তরুণী, পুরুষ-মহিলা, টিটিই, মোটে এবং অন্যান্য লোকেরা সিঁড়ি দিয়ে উঠে চলে যাবে। আড়াল থেকে ভেণ্ডার-হকারদের চেঁচামেচি শোনা যাবে। হঠাৎ আড়াল তথা নেপথ্যের থেকেই এক পুরুষ কণ্ঠে শোনা যাবে ‘ওই যায়! ওই যায়! ধর! ধর!’ বলে চিৎকার শোনা যাবে। খাবার ভরা একটি পলিথিনের ক্যারি ব্যাগ একটা নিয়ে হুড়মুড় করে এসে দৌড়ে ঢুকবে আলিবাবা। সে বেঞ্চের নিচে থলেটা রাখবে। পেছন পেছন ‘আলি! আলি!’ বলে চেঁচিয়ে ডাকতে ডাকতে আসবে রানি। ওর হাতেও পলিথিনের ব্যাগে খাবার। ওদের আসবার শব্দে -- বেঞ্চে আগে থেকেই শুয়েছিল বুলু—সে আঁতকে উঠে বসবে। সঙ্গে সঙ্গে আর পি এফ-এর কনস্টবল একজন দৌড়ে এসে আলিবাবার গলাতে পেছন থেকে খামচে ধরবে।)
কনস্টবল ৷৷ পকেট মেরে পালিয়েছিস? তোকে আমি রোজ দেখি প্ল্যাটফর্মে ঘোরাফেরা করিস। বের কর, দেখি কত মারলি?
বুলু ৷৷ ও পকেটমার নয়। ওকে ওভাবে কেন ধরেছেন?
কনস্টবল ৷৷ তুই কী করে জানলি যে সে পকেটমার নয়? অহ! তোদের তবে একই গ্যাং, তাই না? চালাকি করবি না। বের কর! পয়সা
বের কর, বলছি না?
আলি ৷৷ আমি পকেট মারি নি।
রানি ৷৷ আপনি কি দেখেছিলেন ও পকেট মেরেছে বলে?
কনস্টবল ৷৷ ওহ! তুইও তবে একই গ্যাঙের? দাঁড়া, তোদের সবার আজ মজা বের করছি। এসব কী? ব্যাগে এই সব কী?
রানি ৷৷ ভাত।
কনস্টবল ৷৷ ভাত? ভাত কই পেলি?
রানি ৷৷ ডাইনিং কার থেকে এনেছি।
কনস্টবল ৷৷ চুরি করেছিস? ডাইনিং কার থেকে চুরি করেছিস?
রানি ৷৷ আমরা চোর নই। ডাইনিং কার থেকে দিয়েছে, এনেছি। রোজ আনি।
কনস্টবল ৷৷ দেখি, তোর পকেট দেখি। (আলিবাবার পকেট পরীক্ষা করে।) কী করলি পয়সা? এ্যাই মেয়ে, তুই এর পেছনে পেছনে দৌড়ে
এসেছিলি না—চট করে তোর পকেটেই টাকাগুলো ঢুকিয়ে দিয়েছে হয়তো। দেখি, বের কর।
(জামার পকেট থেকে দুই টাকা বের করে রানি।)
রানি ৷৷ এই দেখুন, আমার কাছে মাত্র দুই টাকা আছে।
(ছোঁ মেরে সেই দুই টাকা নিয়ে নেয় কনস্টবলটি।)
কনস্টবল ৷৷ কত আছে দরকার নেই। দু-টাকাই হোক আর দুই হাজার---পকেট মেরেছিস। চল, থানাতে চল! (বুলুকে) অই, তুইও চল।
দেখি, তোর পকেট দেখি। (বুলুর দুই পকেট দেখে কিছুই পায় না।) চল, তিনটাই থানাতে চল।
(তিনটাকেই ঠেলে ঠেলে নিয়ে যায়। মঞ্চের আলো নিষ্প্রভ হয়। ওরা বেরিয়ে যায়।আলো আবার স্পষ্ট হয়। ব্যগ্র ভাবে এসে ঢোকে। বেঞ্চে পাশে দাঁড়ায়। ট্রেনের দীর্ঘ বাঁশি এবং ট্রেন ছাড়ার শব্দ। জুতো পালিশ করবার সরঞ্জামের বাক্স বেঞ্চের তলাতে রাখে সে। রানি ভাতের থলে বেঞ্চের উপরেই রেখে গিয়েছিল। সেটি মেলে দেখে বেঞ্চের তলাতে সরিয়ে রাখে। এগিয়ে উদ্বেগ উৎকণ্ঠাতে প্ল্যাটফর্মের এদিকে ওদিকে তাকায়। সিঁড়ি দিয়ে দ্রুত চড়তে গিয়ে মুনিয়াকে দেখে আবার নেমে আসে। ঠিক সেই সময় হিরা, মুন্নি, মকবুল এবং কুরবান আসে। )
বিরু ৷৷ অই! রানিদিদের পুলিশে নিয়ে গেছে।
হিরা ৷৷ জানি।
বিরু ৷৷ এখন কী করবি?
মুন্না ৷৷ কিচ্ছু করতে হবে না। যে লোকটার পকেট মারা পড়েছিল, সে নিজেই সাক্ষী দিয়েছে।
বিরু ৷৷ কী সাক্ষী দিয়েছে?
মকবুল ৷৷ কী দেবে আর? লোকটা নিজেই পকেটমারটিকে তাড়া করে গিয়েছিল। সে দুই নম্বর প্ল্যাটফর্মের গাড়িটার দুই কামরার ফাঁক
গলিয়ে পালিয়ে গেল।
কুরবান ৷৷ বেচারা আলি এমনি এমনি মার খেল।
(যতীন, আলিবাবা, বুলু আর রানি এসে ঢুকল। যতীন আলিবাবাকে হাতে ধরে বেঞ্চে বসায়। পাশে নিজেও বসে।)
যতীন ৷৷ তোমাকে কি খুব মেরেছে পুলিশটা?
আলি ৷৷ সেরকম মারে নি। ঘাড়ে ধরে ঠেলছিল। রানিদির টাকা দুইটা নিয়ে নিল।
রানি ৷৷ নিতে দে। দুই টাকার জন্যে না খেয়ে মরব না।
যতীন ৷৷ তোমাদের আমার জন্যেই শুধু শুধু বড় হেনস্তার মুখে পড়তে হল। আমার বড় বাজে লাগছে।
বুলু ৷৷ বাদ দিন সেই সব কথা। আপনি না থাকলে অবশ্য আমাদের ভরিয়ে রেখে দিত ভেতরে। এই প্ল্যাটফর্মে আমরা নজন আজ
পাঁচ বছর ধরে আছি। কখনও কারও সঙ্গে বেইমানি করিনি।
যতীন ৷৷ (সবার দিকে তাকিয়ে) তোমরা সবাই এখানে থাকো?
বুলু ৷৷ হ্যাঁ, আমরা এখানেই থাকি। এই প্ল্যাটফর্মেই আমাদের সবার ঘর।
হিরা ৷৷ পাঁচবছর আগে আমরা যেখানে সেখানে থাকতাম। কীভাবে যে সবাই এসে এখানে জড়ো হলাম। এখন সেই সব কথা মনে
করতে আর ভালো লাগে না।
যতীন ৷৷ তোমার নাম কী যেন বলেছিলে?
আলি ৷৷ আলিবাবা। এরা আমাকে আলি বলে ডাকে।
হিরা ৷৷ আমার নাম হিরা। পান-বিড়ি বিক্রি করি। রানিদি আমাদের ‘রানি’। আলিবাবা রানিদির বডিগার্ড। প্ল্যাটফর্মে যে সব ভাঙা ছেঁড়া
টিন পাওয়া যায়, পলিথিনের থলে, বোতল—সেই সব বেচেই সে দুই পয়সা পায়।
বুলু ৷৷ আমরা সবাই কাজ করেই খাই। পুরোদিন কাজ করে এসে যা কিছু পাই রানিদির কাছে জমা করি। রানিদি ডাইনিং কার
থেকে ভাত আনে। সবাই ভাগ করে খাই। আমি সিনেমার পোস্টার মারি। আমাকে ছাড়া এদের সবার কাজ এই প্ল্যাটফর্মেই।
যতীন ৷৷ (বিরুকে ) তুমি?
বিরু ৷৷ আমি বুট পালিশ করি। এই মুন্নি গান করে। মকবুল চা বিক্রি করে। আর কুরবান খবরের কাগজ বিক্রি করে।
রানি ৷৷ আর আছে মুনিয়া। সে অন্ধ। ব্রিজের কাছে বসে থাকে।
যতীন ৷৷ আর আমি কী করি জানিস? গান লিখি, গাই, শেখাই। মাঝে মধ্যে ছবি আঁকি। খবরের কাগজে খবর লিখি। আজ থেকে
আমিও তোদের একজন হয়ে গেলাম। খারাপ পাবে কি?
রানি ৷৷ আপনি আমাদের সঙ্গে থাকবেন?
বিরু ৷৷ আপনার বাড়ি নেই?
যতীন ৷৷ আছে। আমার বাড়ি আছে। কিন্তু আমি এখানে রোজই আসব। রানিদির হাতে বিকেলে বিকেলে আমার উপার্জনেরও এক
ভাগ দেব। আমি দশ নম্বর মেম্বার হলাম।
হিরা ৷৷ আমাদের মতো আপনারও বুঝি মা বাবা, ভাই—বোন কেউ নেই?
যতীন ৷৷ নেই। আমারও কেউ নেই। মুন্নি, মুন্না---তোমরা কী গান কর?
মুন্নি ৷৷ হিন্দি সিনেমার গান।
যতীন ৷৷ এখন থেকে হিন্দি সিনেমার গান গাইলেই হবে না। আমি তোমাদের জন্যে গান লিখব। আমরা সবাই গাইব। আর তোমার
নামটা যেন কী ছিল?
কুরবান ৷৷ কুরবান।
যতীন ৷৷ অহ! তুমি খবরের কাগজ নিজে পড় কি পড় না?
কুরবান ৷৷ আমি পড়তে জানি না। আমরা কেউ জানি না।
যতীন ৷৷ আমি তোমাদের সবাইকে পড়তে শেখাব। মন্দ হবে কি?
বুলু ৷৷ মন্দ কেন হবে? ভালোই হবে।
যতীন ৷৷ এখন তবে আমি যাই। আমাকে তবে তোমরা কী বলে ডাকবে?
বুলু ৷৷ মামা। (সবাই সমর্থন জানায়।)
যতীন ৷৷ বেশ! মামা বলেই ডাকবে। রানি—এই আমি আজ বিশ টাকা জমা দিলাম।
রানি ৷৷ ইশ! লাগবে না। আপনি পরে দেবেন।
বুলু ৷৷ মামা, আপনি আজ জমা দিতে হবে না। আমরা খারাপ পাব।
যতীন ৷৷ তবে কি আমি তোমাদের কেউ হলাম না?
হিরা ৷৷ কেন হবেন না? কিন্তু আজ না। আমাদের যখন দরকার হবে আপনার থেকে চেয়ে নেব। গত দুইদিন ট্রেন বন্ধই ছিল। আমরা
উপোসে কাটিয়েছি।
যতীন ৷৷ বেশ , তাই হবে। আমি তবে এখন যাই।
হিরা ৷৷ মামা, একটা পান খেয়ে যান। (হিরা পান দিতে যতীন চলে যান।)
বুলু ৷৷ কী হতে যাচ্ছিল, আর কী হয়ে গেল।
হিরা ৷৷ মানুষটিকে আমি রোজই এই প্ল্যাটফর্মে দেখি। কখনও আমার থেকে পান কিনে খান।
কুরবান ৷৷ খবরের সন্ধানে আসেন মনে হয়।
রানি ৷৷ এই বাবুদের মধ্যেও ভালো লোক নেই নয়।
হিরা ৷৷ মুন্নির কপাল ফুলেছে কিন্তু। এইবার হে রেডিও, দূরদর্শন। কে বা জানে—একেবারেই লতা মুঙ্গেশকর, আশা ভোঁসলে,
কৃষ্ণমূর্তি হয়ে যেতে পারে।
মুন্নি ৷৷ ইশ!
মকবুল ৷৷ ভালোই তো। আমরা তখন মুম্বাইর প্ল্যাটফর্মে থাকব। (সিঁড়ির উপর দিয়ে ধীর পায়ে মুনিয়াকে আসতে দেখা যায়।)
মুনিয়া ৷৷ (আনন্দে চেঁচিয়ে) রানি দি!
রানি ৷৷ (এগিয়ে যেতে যেতে) আরে মুনিয়া! কী হল? দাঁড়া! পড়বি দেখবি। (রানি মুনিয়াকে নিয়ে আসে। মুনিয়ার মুখে অনাবিল
হাসি।)
মুনিয়া ৷৷ রানিদি দেখ। এটা দেখ। বিশ টাকা না? একজন লোক একেবারে আমার হাতে দিয়ে গেছে।
(সবাই মুনিয়ার কাছে চেপে যায়। রানি টাকা মেলে ধরে। টাকার উপরে আলো স্থির হয়।)
রানি ৷৷ মামা!
সবাই ৷৷ হ্যাঁ। মামা! (সবাই টাকার দিকে চেয়ে থাকতেই আলো ওখানেই স্থির।)
৷৷ পঞ্চম দৃশ্য ৷৷
(রানি বেঞ্চে বসে স্লেট একটাতে লিখছিল ক, খ, গ, ঘ... । পাশে বসে মুনিয়া খোসা ছাড়িয়ে বাদাম খায়। মাঝে মধ্যে রানিকেও দেয় দুই একটা। খোসাগুলো সে তার বাটিতে রাখে।)
রানি ৷৷ মামার জোরে আজ পেট ভরে বাদাম খেয়ে নে।
মুনিয়া ৷৷ থাম তো। মামাটা সত্যিই ভালো, তাই না রানিদি?
রানি ৷৷ হ্যাঁ। খুব ভালো। ভালো ভালো লোক থেকেও বেশি ভালো।
মুনিয়া ৷৷ আমার বুঝি কেউ নেই। একা একা থাকে।
রানি ৷৷ হ্যাঁ। মুন্নিকে বাড়িতে নিয়ে গিয়েছিল তো। ছোট্ট ঘর একটা, তাও ভাড়া।
মুনিয়া ৷৷ আসলে আমাদের মতোও। বাড়ি-ঘর নেই। গৃহহীন।
রানি ৷৷ মুন্না বলেছে, ঘরটায় বুঝি বইই বই। গোটা কয় বাজনাও আছে। আর কী—জানিস?
মুনিয়া ৷৷ কী?
রানি ৷৷ মামা বুঝি ভালো ভালো ছবিও আঁকেন। পান-সুপারির ডালা গলাতে হিরা, জুতো পালিশ করতে ব্যস্ত বিরু আর সংবাদ পত্র বিক্রি করছে কুরবান৷৷ সেরকম ছবিও এঁকেছেন।
মুনিয়া ৷৷ ইশ! সত্যি!?
রানি ৷৷ সত্যি। বড় বড় ছবি। এত বড় ছবি আনা মুস্কিল তো। সে জন্যে আমরা সবাই একদিন দেখতে যাব।
মুনিয়া ৷৷ আমি তো দেখতে পাই না। তোরাই দেখিস।
রানি ৷৷ ছবি বাদ দে, তুই তো আমাদেরই দেখিস নি।
মুনিয়া ৷৷ না দেখলে কী হবে? তোদের গলা, পায়ের শব্দ আমি চিনতে পারি। কিন্তু ছবির তো গলা নেই।
(রানি ওর মাথাতে হাত বুলোয়।) এই খোসাগুলো ফেলে অল্প খাবার জল এনে দে না। (রানি বাটিটা নিয়ে খোসাগুলো ফেলে বোতল থেকে বাটিতে জল দেয় মুনিয়াকে। মুনিয়া জল খায়।)
রানি ৷৷ মামা তোর কথা কী বলেছে জানিস?
মুনিয়া ৷৷ কী বলেছেন?
রানি ৷৷ তুইও বুঝি লেখাপড়া শিখতে পারবি।
মুনিয়া ৷৷ ধ্যৎ। মিথ্যে কথা।
রানি ৷৷ মামা বুঝি মিছে কথা বলবেন? যারা চোখে দেখে না তাদেরও বুঝি লেখা পড়া শেখার স্কুল আছে। মামা বুঝি তোকেও অ-
আ-ক-খ লেখা শেখাবেন।
মুনিয়া ৷৷ সত্যি বলছিস? না আমার ভালো লাগবে বলে বলছিস?
রানি ৷৷ বেশ। মামা এলে জিজ্ঞেস করিস। (রানি আবার স্লেটের লেখাতে মনোনিবেশ করে।)
মুনিয়া ৷৷ রানিদি!
রানি ৷৷ দাঁড়া তো দেখি। আমাকে ক,খ –গুলো লিখতে দে। মামা এসে যদি দেখেন লিখিনি, তবে রাগ করবেন।
মুনিয়া ৷৷ ওটার নাম কী বলেছিলি?
রানি ৷৷ কোনটা?
মুনিয়া ৷৷ এই যে তুই লিখছিস?
রানি ৷৷ স্লেট।
মুনিয়া ৷৷ আমাকে ওটা ছুঁয়ে দেখতে দিবি? (রানি স্তব্ধ হয়ে ওর মুখের দিকে তাকায় খানিকক্ষণ। এর পরে স্লেট ওর হাতে তুলে দেয়।)
রানি ৷৷ হ্যাঁ। আর এটা হচ্ছে পেন্সিল। (মুনিয়া ছুঁয়ে ছুঁয়ে স্লেটের আকার অনুমান করবার চেষ্টা করল।) দাঁড়া দাঁড়া! মুছে ফেলবি না।
মুনিয়া ৷৷ কী মুছে ফেলব?
রানি ৷৷ আমি হরফ লিখে রেখেছি তো। হাত দিলে মুছে যাবে যে।
মুনিয়া ৷৷ তাই বুঝি? হরফ মুছে যায়?
রানি ৷৷ হ্যাঁ তো। তোকে মামা বুঝিয়ে দেবেন।
(রানি আবার স্লেট হাতে নিয়ে লেখাতে মন দেয়। মুন্নি, আলি, বিরু , হিরা এবং মকবুল সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসতে থাকে। চুপচাপ এসে রানি আর মুনিয়া বসে থাকা বেঞ্চের পেছনে সার বেঁধে দাঁড়ায়। হিরা পেছন থেকে রানির দুই চোখ চেপে ধরে।)
রানি ৷৷ কে? মামা বুঝি? অহ! না। হ্যাঁ, হ্যাঁ ! মামাই হবেন। (হিরা হাত সরিয়ে দেয়। সঙ্গে সঙ্গে সবাই হাত তালি দেয় আর হাসে।)
বাহ! আজ সবাই এক সঙ্গে যে?
মকবুল ৷৷ রানিদি, আজ আমি তোকে আমাদের রোজগারের পুরোটা দেব না।
রানি ৷৷ কেন দিবি না? পাঁচজনে মিলে কিছু একটা চালাকি করছিস তাই না? বের কর, টাকা বের কর।
হিরা ৷৷ আহ! দাঁড়া না। আমাদের কথা শুনে নে।
রানি ৷৷ শুনব না আমি। এই দেখ ,মুনিয়ার ফ্রকটার দিকে তাকা। এই ছেঁড়া জামাটাই ও দিনে রাতে পরে থাকে। সুই সুতো থাকলে
আমি নিজেই সেলাই করে দিতে পারি। ঠাণ্ডা পড়লে গায়ে দেবার বস্তা একটাও নেই। শীতের দিন এলে তোদের সবার যদি
অসুখ না বাঁধে তবে বলবি।
বিরু ৷৷ তুই শুধুই গালি দিস। আজ আমরা দু-টাকা মাত্র জমা দেব।
রানি ৷৷ বাহ! দু-টাকা,দু-টাকা কম জমা দেব। যেভাবে বলছিস, যেন শ শ টাকা কামাই করেছিস। আসলে তোদের আজ সিনেমা
দেখার তাল, তাই না?
মুন্না ৷৷ না না রানিদি। মা কালি কসম। সিনেমা দেখবার জন্যে নয়।
রানি ৷৷ তবে? দুই টাকা করে দশ টাকা কী করলি? আগে আমাকে জমা দেবার জন্যে যা রেখেছিস সেগুলো দে। (সবাই নিজের
নিজের ভাগের পয়সা রানিকে দিল।) এখন বল, বাকি টাকা কী করেছিস?
মকবুল ৷৷ আমরা একটা জিনিস কিনলাম।
রানি ৷৷ জিনিস কিনলি? কী জিনিস? (সবাই এর ওর মুখে দিকে তাকায়।) কী কিনলি, বল।
মকবুল ৷৷ তুই গোসা করবি না বল, আগে।
রানি ৷৷ হয়েছে , হয়েছে। বাচ্চা ছেলের মতো ন্যাকামো করতে হবে না। কী কিনেছিস, দেখা।
মকবুল ৷৷ এটা (ক-মানের বই একটি দেখায়।)
রানি ৷৷ কী, দেখি। (প্রায় ছোঁ মেরে নেবার মতো নিজের হাতে নিয়ে নেয়।)
মুন্নি ৷৷ অনেক ছবি আছে, জান রানিদি? বর্ণগুলোও বড় বড়। কী যে মজার মজার ছবি।
(রানি কিছুক্ষণ প্রচ্ছদ দেখে। তার পরে পৃষ্ঠা উলটে দেখে। সবাই তন্ময় হয়ে রানির পৃষ্ঠা ওলটানো দেখে। রানির মুখে ক্রমে হাসি দেখা দেয়। মুনিয়া রানির হাতে ধরে ঝাঁকার দেয়।)
মুনিয়া ৷৷ কী জিনিস , রানিদি? মজার মজার কীসের ছবি?
রানি ৷৷ দাঁড়া। আমাকে দেখে নিতে দে। পরে তোকে বুঝিয়ে বলছি। কোত্থেকে আনলি এই বই?
মকবুল ৷৷ কুরবান এনে দিল। অই খবরের কাগজের দোকান থেকে।
রানি ৷৷ মামা দেখলে খুব খুশি হবেন।
(হাতে আঠার টিন আর পোস্টার নিয়ে বুলু সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসে।)
বুলু ৷৷ কী হল? সবাই এক জায়গাতে জড়ো যে?
রানি ৷৷ এটি দেখ। (বইটি দেখায়)
বুলু ৷৷ কী?
রানি ৷৷ ক-খ-এর বই।
বুলু ৷৷ পেলি কই?
মকবুল ৷৷ কুরবান ওর মালিকের দোকান থেকে কিনে এনেছে।
বুলু ৷৷ এখন রেখে দে। আমার হাত নোংরা। কুরবান কই?
হিরা ৷৷ সে বিক্রির পয়সা জমা করতে দোকানে গেছে।
বুলু ৷৷ মানে বাজারে গেছে?
হিরা ৷৷ হ্যাঁ।
বুলু ৷৷ যাহ! সে এখনও আসে নি? কথাটি ঠিক হয় নি।
রানি ৷৷ কেন ? কী হল?
বুলু ৷৷ তোরা কিছু টের পাসনি? (সবাই )
বিরু ৷৷ হুঁ। আমিও ভালো করে জানি না। মামা এলে জানতে পারবি।
রানি ৷৷ (বুলুর গায়ে ধরে) এ্যাই, তুই কি উলটা পুলটা কথা বলছিস? কই কী হয়েছে বলছিস না কেন?
বুলু ৷৷ ভালো করে জানি না এখনও। মামা বলেছেন, এসব কথা যার তার আগে বলে বেড়াবি না। (প্রত্যেকে একে অন্যের মুখে
অবাক হয়ে তাকায়।) মামা আরও বলেছেন, প্ল্যাটফর্মের বাইরে কেউ যাবি না। সবাই এক জায়গাতে থাকবি। এদিকে কুরবান এখনও আসে নি। (মুনিয়া রানির হাত খামচে ধরে।)
মকবুল ৷৷ আমরা সবাই তবে কুরবানকে ডেকে আনি গিয়ে।
বুলু ৷৷ এ্যাই, খবরদার! প্ল্যাটফর্মের বাইরে কেউ বেরোবি না। এলে নিজেই আসবে। না এলে কই মরে মরুক গিয়ে।
রানি ৷৷ অই, তুই মরার কথা বলছিস কেন? তুই কোনও কথা লুকোচ্ছিস, তাই না?
বুলু ৷৷ আমি বলতে পারব না। মামা আসবে। মামাকে জিজ্ঞেস করবি। আমাকে কিছু জিজ্ঞেস করবি না। অই, হিরা-বিরু-মকবুল—
এদিকে আয়। এই সব পোস্টার মামা পাঠিয়ে দিয়েছেন। আঠা লাগিয়ে দে, আমি সেঁটে যাব।
হিরা ৷৷ পোস্টার? মামা দিয়ে পাঠিয়েছেন? কই লাগাবি?
বুলু ৷৷ এখানে---পুরো প্ল্যাটফর্মে। লাগা আঠা। আঠা লাগা। (হিরা, বিরু , মকবুল আঠা লাগিয়ে যায়। বুলু প্রথমে প্ল্যাটফর্মের
খুঁটাতে পোস্টার একটা লাগায়। ‘সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে এক হোন!’ তার পরে খুঁটার উপরে নিচে এখানে ওখানে পোস্টার
সাঁটতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। এর কোনওটাতে লেখা ‘সাম্প্রদায়িকতাকে প্রতিহত করুন!’ কোনওটিতে বা ‘ ধর্মের নামে রাজনীতি
বন্ধ করুন!’
রানি ৷৷ মামা লিখেছেন?
বুলু ৷৷ হ্যাঁ। মামা লিখেছেন।
রানি ৷৷ কী লিখেছেন?
বুলু ৷৷ জানি না। সিনেমার পোস্টার মেরে মেরে অল্প স্বল্প হিন্দি ধররে পারি—এই সব কিছু ধরতে পারি না।
মুনিয়া ৷৷ কী হয়েছে রানিদি?
রানি ৷৷ জানি না , মুনিয়া। কিছু একটা হয়েছে। বড়সড় কিছু। মামা এলেই বুঝতে পারব।
(হঠাৎ বাইরে সাইরেন বেজে উঠে। যেন ফায়ার ব্রিগেডের গাড়ি দ্রুত পার করে যাচ্ছে। মঞ্চে স্তব্ধতা নেমে আসে। সবাই
যেখানে আছে সেখানেই নীরবে স্থির হয়ে যায়। প্ল্যাটফর্মের মাইকে ঘোষণা শোনা যায় ‘ একটি জরুরি ঘোষণা! শহরে
বিক্ষিপ্তভাবে এখানে ওখানে দুই এই সাম্প্রদায়িক ঘটার পরিপ্রেক্ষিতে আজ সন্ধ্যা ৫টা থেকে কাল সকাল ৫টা অব্দি সান্ধ্য আইন
বলবত করা হয়েছে। এই সময়ে যাতায়াত, বাজার হাট, জনসমাগম বন্ধ থাকবে। কেউ পথে বেরুবেন না। যে কোনও
অপ্রীতিকর ঘটনা এবং সন্দেহযুক্ত ব্যক্তি নজরে এলে ২৩৩০৫০৯ এই নম্বরে ফোন করে তৎক্ষণাৎ জেলা প্রশাসনের নজরে
নিয়ে আসবার অনুরোধ রইল। গুজবে কান দেবেন না। না দেখা ঘটনা বিশ্বাস করবেন না।’ দু’বার এই কথা ঘোষণা করা হবে।
কয়েক মুহূর্ত মঞ্চে স্তব্ধতা বিরাজ করবে। সিঁড়ির উপরে কুরবানকে দেখা যায়। ওর হাতে ব্যান্ডেজ।)
বুলু ৷৷ (প্রায় চেঁচিয়ে ওর দিকে এগিয়ে যেতে যেতে) কুরবান!
কুরবান ৷৷ (ঠোঁটে আঙুল দিয়ে) চু-উ-প। নাম নিবি না।
রানি ৷৷ কুরবান, তোর হাতে কী হল?
কুরবান ৷৷ নাম নিবি না বলছি না। কেউ কারও নাম ধরে ডাকবি না।
হিরা ৷৷ আরে তোর এই সব কী হয়েছে? তোর হাতে কী হল?
কুরবান ৷৷ (বেঞ্চে বসে) আমি রাস্তা দিয়ে আসছিলাম। রাস্তার পাশের দু-তলা এক বিল্ডিং থেকে মামা ‘কুরবান! কুরবান!’ বলে চেঁচিয়ে
ডাক দিল। আমি দাঁড়িয়েছি কি, চার পাঁচটি লোক কোত্থেকে এসে আমাকে ঘিরে ফেলল। আর ঘুসি মারতে শুরু করল। আমি পড়ে
গেলাম। বেহুঁশ হয়ে গেলাম।
রানি ৷৷ তার পরে?
কুরবান ৷৷ তারপরে আর জানি না। হুঁশ ফিরলে দেখি পুলিশ, ডাক্তার, মামা আরও কেউ কেউ। হাতটা মনে হয় ভেঙেছে।
বুলু ৷৷ এখানে এলি কী করে?
কুরবান ৷৷ মামা রেখে গেছেন।
রানি ৷৷ মামা কই?
কুরবান ৷৷ পুলিশের সঙ্গে। আসবেন। দোকান বাজার সব বন্ধ। রাস্তায় রাস্তায় কেবলই পুলিশ ঘোরাফেরা করছে। যেখানে সেখানে মারপিট আর খুন খারাবি হচ্ছে। নাম জিজ্ঞেস করে আর ধরে মারে। মামা না থাকলে আজ আমাকে মেরেই ফেলত।
(আর পি এফ-এর এক কনস্টবল এসে ঢোকে। পোস্টারগুলো দেখে। কাগজে মোড়া একটা জর্দা-পান বের করে মুখে পুরে। বেঞ্চে বসে। কাগজে লেগে থাকা চুন বার জিহ্বে চাখে।)
কনস্টবল ৷৷ (কারও দিকে না তাকিয়ে ) হাতে ব্যান্ডেজ কেন? (উত্তর না পেয়ে কুরবানের দিকে তাকিয়ে) বলিস না কেন? ব্যান্ডেজ কেন?
কুরবান ৷৷ (ঢোক গিলে) পড়ে গিয়েছিলাম।
কনস্টবল ৷৷ কই? কী করে?
কুরবান ৷৷ পাকা রাস্তাতে পা পিছলে।
কনস্টবল ৷৷ মারপিট নয় তো? নাম কী? (কুরবান নীরব থাকে) বল! নাম কী?
(কুরবান এবারেও নীরব। একে সে সবাইকে একই প্রশ্ন করলে সবাই নীরব থাকে।)
কনস্টবল ৷৷ বুঝলাম। নাম বলা নিষেধ। উপাধি কী? ধর্ম? (সবাই চুপচাপ।) বলতে হয়। পুলিশে প্রশ্ন করলে নাম, উপাধি, ধর্ম সব বলতে
হয়। নিরাপত্তার কথা আছে। বল বল। একে একে সবাই নাম বলে যা। কার কী নাম বল।
বুলু ৷৷ আমরা বলতে পারব না।
কনস্টবল ৷৷ বলতে পারবি না? নিজের নাম, উপাধি, ধর্ম বলতে পারিস না? ঠিকই করেছিস। মুখে রা না করে ভালোই করেছিস। মুখে রা
না করলে সবাই মানুষ। রা করলেই অসমিয়া, বাঙালি, বিহারি, হিন্দু, মুসলমান, বাংলাদেশি। ভগবানের নাম নিবি না। পাপ
হবে। পাপেই মৃত্যু। ভগবানের নাম নিলেই ধরা পড়ে যাবি—হিন্দু না মুসলমান। (বসার থেকে উঠে পোস্টারগুলো পড়ে।)
এগুলো এখানে কে লাগিয়েছে?
বুলু ৷৷ আমরা।
কনস্টবল ৷৷ তোরাই লাগিয়েছিস? লিখেছিসও তোরা?
বুলু ৷৷ আমরা লিখি নি। লাগাতে বলেছেন, লাগিয়েছি।
কনস্টবল ৷৷ কে লাগাতে বলল?
বুলু ৷৷ মামা।
কনস্টবল ৷৷ মামা? এখানে তোর মামা কে?
রানি ৷৷ শুধু ওরই নয়। আমাদের সবার মামা।
কনস্টবল ৷৷ তোদের সবার মামা? কী নাম তার ? (সবাই নীরব।) এ্যাই, ব্যান্ডেজ! (কুরবানকে) কী নাম তোদের মামার? (সবাই যথাপূর্ব
চুপ) । অই! পুলিশকে নাম ঠিকানা সব বলতে হয়। নিরাপত্তার ব্যাপার আছে। কী নাম বল!
বুলু ৷৷ আমরা মামা বলেই ডাকি। ছবি আঁকেন, গান করেন, কাগজে খবর লেখেন।
কনস্টবল ৷৷ অহ! মানে শিল্পী, গায়ক, সাংবাদিক। ঠিক, এগুলোও তো এক একটা নাম। আমার নাম পুলিশ। তোর নাম ব্যান্ডেজ। কেউ
বা রিকশাওয়ালা, ঠেলাওয়ালা, পানওয়ালা। এভাবে কি আমরা ডাকি না—‘অই, রিক্সা ! রিক্সা !’ ঠিক, এগুলোও তো নামই।
ভাষা নেই, ধর্ম নেই, উপাধি নেই, জাত নেই—এগুলো একদম নিরাপদ নাম। ঠিক ঠিক । (খানিক বাক-স্তব্ধ হয়ে থাকে।) কিন্তু
সেও তো হতে পারে না। কখনই হতে পারে না। এ্যাই, বল তোদের কী নাম? (সবাই নীরব।) অই! শিল্পী মামার ভাগনা-
ভাগ্নিরা! জন্মেই কেউ শিল্পী, গায়ক,সাংবাদিক হয়ে জন্মায় না। জন্মেই কেউ রিকশাওয়ালা, ঠেলাওয়ালা হয়েও আসে না। আসল
নাম একটা সবার থাকবেই। তোদেরও আছে। বল , বল—নাম বল।
(সবাই নীরব। এ ওর মুখের দিকে তাকায়। সেই সময় ওভার ব্রিজ দিয়ে যতীন নেমে আসে ।)
যতীন ৷৷ কেন ওদের নাম?
রানি ৷৷ মামা!
কনস্টবল ৷৷ ইনিই কি তোদের মামা?
যতীন ৷৷ হ্যাঁ, আমিই এদের মামা। নাম কেন চাই?
কনস্টবল ৷৷ মানে, কে হিন্দু, কে মুসলমান—এটা জানা দরকার। পরিস্থিতি কী হয়েছে আপনি তো জানেনই।
যতীন ৷৷ জানি। বাইরের গণ্ডগোল যাতে প্ল্যাটফর্মে এসে প্রবেশ না করে বিষয়ে চোখ রাখতেই আপনাকে এখানে পাঠিয়েছে—তাই
না? অপরাধীর নামই তো পুলিশের দরকার।
কনস্টবল ৷৷ কিন্তু এরা এখানে কী মতলবে... !
যতীন ৷৷ এদের কোনও মতলব নেই। এদের কোনও জাত ধর্ম নেই।
কনস্টবল ৷৷ তাজ্জব ব্যাপার।
যতীন ৷৷ এ হচ্ছে কুরবান। এই প্ল্যাটফর্মে একে জন্ম দিয়ে মা মারা গেলেন। মোটে বসির ওকে নিয়ে গিয়ে ছবছর অব্দি লালন পালন
করে। টিবি হয়ে বেচারা বসিরও মারা গেল। মুসলমান ঘরে বড় হয়ে মুসলমান নাম পেল—কুরবান। ওর আসল মা-বাবার কী জাত, কী ধর্ম ছিল কে বা জানে? একে আবার ‘রানি’ করে নিল। হয়ে গেল রানি।
কনস্টবল ৷৷ বাহ !
যতীন ৷৷ এরা সবাই এরকমই। কার কী জাত,কী ধর্ম –কেউ জানে না। সেই নিয়ে কাজিয়া করবার মানে নেই। জাত-পাত, ধর্ম
সম্প্রদায় না হলেও যে শান্তিতে বেঁচে থাকতে পারি—আমরাই এর প্রমাণ। পরিচয় দেবার জন্যে নাম একটা দিতে হয় বলেই
আছে—আমাদের প্রত্যেকের একটি নাম আছে—ব্যস—এতটুকুই।
কনস্টবল ৷৷ বুঝেছি, বুঝেছি। একেবারেই পরিষ্কার করে বুঝেছি। (বাইরে চিৎকার চেঁচামেচি, মারপিট। পুলিশের সাইরেন।) এক মিনিট।
এই, এখনই আসছি। (ওভার ব্রিজ হয়ে বেরিয়ে যায়।)
হিরা ৷৷ বাইরে কী হচ্ছে মামা?
যতীন ৷৷ মারপিট, খুনখারাবি, বাড়ি ঘর জ্বালিয়ে দেওয়া—এই সব। কেউ কাউকে লুঠ করছে, কেউ বা কারও উপরে বদলা নিচ্ছে।
ধনি আর ধূর্ত মানুষেরা গরিব গুরোব মানুষগুলোর মধ্যে কাজিয়া লাগিয়ে দিয়ে ওদের লুঠ করবার পথ পরিষ্কার করে নিচ্ছে।
কুরবান ৷৷ এভাবেই কি সবসময় চলতে থাকবে?
যতীন ৷৷ এই সব ধান্ধাবাজি সবসময় চলে না। মাঝে মধ্যে চলে। মতলববাজদের যখন দরকার হয় তখন চলে।
(কনস্টবল আবার এল। সঙ্গে ৯-১০ বছরের একটি ছেলে। নাম ইসমাইল। ওর হাতে বুট পালিশের বাক্স একটা। দুজনে এসে প্ল্যাটফর্মে পা দেবার সঙ্গে সঙ্গে বিরু বসার থেকে ধা করে উঠে আর ইসমাইলের দিকে প্রায় দৌড়ে যেতে উদ্যত হয়।)
বিরু ৷৷ ও, ও আমাকে সেদিন মেরেছিল মামা। একে আজ আমি ছাড়ব না। আমরা যদি প্ল্যাটফর্ম থেকে বাইরে যেতে পারি না, তবে
সে কী করে এখানে ভেতরে আসবে?
(ইসমাইল ভয়ে কনস্টবলের আড়ালে লুকোবার চেষ্টা করে।)
যতীন ৷৷ বিরু! দাঁড়া তো।
কনস্টবল ৷৷ এখানে মারামারি চলবে না কিন্তু।
বিরু ৷৷ সে আমাকে মেরেছিল।
যতীন ৷৷ ঠিক আছে। আমরা বিচার করব তো। এতো গরম হচ্ছিস কেন? (কনস্টবলকে) আপনি একে পেলেন কই?
কনস্টবল ৷৷ এ অনাথ ছেলে। তার নাম বুঝি ইসমাইল। ফুটপাথে বুট পালিশ করে। অরিজিন্যালি কোথাকার আমি জানি না। দিনে
রোজগার করে যা পায়, তাতেই খাওয়া দাওয়া করে –আর যেখানে রাত সেখানেই কাত হয়। কখনও রিক্সাতে, কখনও ট্রাকের
নিচে, কখনও বা সিটিবাসের উপরে।
যতীন ৷৷ এখন এই রাতে একে আপনি কোত্থেকে নিয়ে এলেন?
কনস্টবল ৷৷ এর নামই এখন কাল হল। এর নাম যে ইসমাইল সবাই জানে। আমি ওকে বাইরের টিকিট কাউন্টারের ভেতরে বসিয়ে
এসেছিলাম।
যতীন ৷৷ ইসমাইল। তোমার আর বিরুর নাম দুটিই আলাদা। তোমার নাম বিরু আর বিরুর নাম ইসমাইল হলে আলাদা কীই বা হত?
বাকি কথা তো সবই একই।
কনস্টবল ৷৷ একই তো। দুটিতেই জুতো পালিশ করে। দুটিই অনাথ। দুজনেরই বাড়িঘর কিছু নেই। হিন্দু হলেও হিন্দু নয়, মুসলমান
হলেও মুসলমান নয়।
যতীন ৷৷ আলাদা কী জান? তুমি একা রোজগার কর, একা খাও। এরা সবাই রোজগার করে, ভাগ করে খায়। এরা মারপিট
ভালোবাসে না, কিন্তু মার খায় ।
ইসমাইল ৷৷ (ফুঁপিয়ে কাঁদা শুরু করে। বিরুর পাশে চাপে) আমাকে মাপ করে দে। আজ থেকে আমি তোদের সঙ্গে থাকব।
(বিরু জড়িয়ে ধরে। যতীন আর কনস্টবল একে অন্যের দিকে তাকায়।)
রানি ৷৷ আমাদের সঙ্গে থাকলে কিন্তু রোজ রোজগারের টাকা আমার হাতে দিতে হবে।
( ইসমাইল পকেটে হাত ভরিয়ে যা কিছু খুচরো পয়সা পায় রানির হাতে জমা দেয়। সবাই হাত তালি দেয়।)
হিরা ৷৷ আজ থেকে আমরা এগারোজন হলাম।
কনস্টবল ৷৷ বাহ! বাহ! একেবারে ক্রিকেট ফুটবল খেলতে পারা হয়ে গেলে। ( প্ল্যাটফর্মের খুঁটিতে হেলান দিয়ে ) বুঝলেন মামা, এই
জাত-পাত-ধর্ম-বিধর্ম নিয়ে যত সব দাঙ্গা হাঙ্গামা , মারপিট-খুন খারাপ, হানাহানি। আজ তিন রাত শোবার অবসর পাইনি। (দীর্ঘ
আড়মোড়া ভেঙে) ভগবান, আল্লাহ, গড সবাই ঐ আকাশে মস্তি করে শুয়ে আছেন। আমাদের নেই ঘুম। অবসর নেই। আল্লাহ বড় না ভগবান রাম বড়। সবাই বড়রে বাবা। কেউ ছোটো নয়। শুধু এক কনস্টবল খোদার বান্দা মতিউর রহমান ছোটো। (ক্ষণিক নীরব থাকে) । ওহ! আমার নাম মতিউর রহমান। আজ তিন রাত পরে শোবার জন্যে এই দুনিয়াতে তামাম আরামের একটা জায়গা পেলাম। যেখানে জাত নেই, পাত নেই, ধর্ম নেই, আল্লাহ –গড-ঈশ্বর –কেউ নেই। শুধু মানুষ আছে। মানুষ। সাচ্চা মানুষ। (আরামে সেখানেই শুয়ে পড়ে) গুড নাইট, মামা। আমি শুয়ে পড়ছি। সবাই শুয়ে পড়। আল্লাহ, ঈশ্বর, ধর্ম, জাত পাত সবাই শুয়ে পড়। আমি শুব। গুড নাইট! গুড নাইট... মামা!
(কিছু ক্ষণ সব নীরব। হঠাৎ প্ল্যাটফর্মের বাইরে সাইরেন বেজে উঠবে। কনস্টবলের বাইরে সবাই সচকিত হবে।)
বুলু ৷৷ দাদা! ও পুলিশ দাদা। পুলিশ দাদা!
যতীন ৷৷ জাগাবি না। শুতে দে। আজ তিন রাতের পরে নিশ্চিন্তে বেচারা ঘুমিয়েছে। ঘুমোক। (সাইরেনের শব্দ ক্রমে মিলিয়ে যায়)
তোরা জেগে থাক। আমি আছি।
৷৷ ষষ্ঠ দৃশ্য ৷৷
(রাত দুপুর। ট্রেন এসে পৌঁছুবার সময়। প্ল্যাটফর্মে রানিরা এখানে ওখানে মুখে উৎকণ্ঠার ছাপ নিয়ে বসে থাকে। ওভারব্রিজের উপর দিয়ে আর বিপরীত দিয়ে মাঝে মধ্যে পুলিশ, সি আর পি, টিটিই মঞ্চের ভেতরে বাইরে আসা যাওয়া করতে থাকে। দুই একটা পরিবার বাক্স-প্যাটরা নিয়ে ফাঁকা জায়গাতে এখানে ওখানে বসে আছে। দুই এক যাত্রী দাঁড়িয়ে এদিকে ওদিকে তাকায়। একজন দারোগা এসে যাত্রীদের বলে...)
দারোগা ৷৷ আপনারা কেউ বাইরে যাবেন না। রাতে পরিস্থিতি দেখে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আপনারা যাতে শহরের ভেতরে যেতে পারেন,
সকাল হলে তার জন্যে এসকর্ট দেওয়া হবে।
(দারোগা চলে যান। যাত্রীরা সাঁটা পোস্টারগুলো দেখে। দুই একজন কাছে গিয়ে পড়ে। একে অন্যের সঙ্গে ফিসফিসিয়ে কী সব বলে। নিজের নিজের লাগেজের উপরে কেউ কেউ বসেন। কেউ কেউ আড়মোড়া ভাঙেন। যতীন আসেন ।রানিদের সবার দিকে তাকান। যতীনকে দেখে সবাই সোজা হয়ে বসে।)
যতীন ৷৷ রাতে প্ল্যাটফর্মের সবাইকে এখানেই থাকতে হবে।
প্রথম যাত্রী ৷৷ সকালে নিরাপদে বেরোনো যাবে কি?
যতীন ৷৷ পারা উচিত। আজ পুরো দিনে কোথাও কোনও অঘটন ঘটার সংবাদ মেলেনি। কাল দিনে পরীক্ষামূলক ভাবে সান্ধ্য আইন
তুলে দেবার কথা আছে।
দ্বিতীয় যাত্রী ৷৷ রক্ষা! তাহলেই হয়। (আড়মোড়া ভেঙে) বড় কষ্ট।
যতীন ৷৷ মুন্নি! (মুন্নি চমকে উঠে)
মুন্নি ৷৷ গান একটা গা। নতুন গানটা। সবার ভালো লাগবে। গা।
প্রথম যাত্রী ৷৷ মন্দ নয়। আমার হাতে একটা ট্রানজিস্টার আছে। কিন্তু এই রাত দুটোতে কই আর গান বাজবে?
রানি ৷৷ গেয়ে ফেল মুন্নি। পকেটে তোর বাজনাটা আছে না?
মুন্নি ৷৷ আছে। (পকেট থেকে দুটি চ্যাপটা পাথর বের করে। আঙুলের ফাঁকে নেয়।)
যতীন ৷৷ দাঁড়া। কোচের ভেতরে যেভাবে গান করিস, সেভাবে গা। আমরা সবাই যেন প্যাসেঞ্জার।
(মুন্নি পাথর দুটিতে তাল ধরে। সংগীত বেজে উঠে। যাত্রীদের সামনে হাত পেতে পেতে গান ধরে।)
গান
ঝিঁক ঝিঁক ঝিঁক ঝিঁক রেল চলে
কত ঘর নগর শহর পেছন ফেলে।
এক দুই তিন চার --এ চাপে ওর ধার
কামরায় কামরায় --- দীঘল দীঘল সার।
ঝিঁক ঝিঁক ঝিঁক ঝিঁক রেল চলে
কেউ কারও আগে নেই, কেউ নেই পাছে
সবারই চাকা বাঁধা --- এক ইঞ্জিনের কাছে।
এক চাপে খাড়া সবাই, এক চাপে চলে।
মানুষ মানুষে রেলে এমন করে মেলে।
ঝিঁক ঝিঁক ঝিঁক ঝিঁক রেল চলে---
পরকে টেনে পাশে আনি, দূরকে টানি কাছে
সুখ দুঃখের কত গল্প বুকে জমানো আছে।
আমার বাড়ি হয়তো শহরে, তোমার হয়তো গ্রামে ।
পাহাড় কিম্বা সমতলে হোক—কী আসে যায় নামে?
ঝিঁক ঝিঁক ঝিঁক ঝিঁক রেল চলে---
শিলচরে না শিবসাগরে কোথায় কেমন বাড়ি?
সবই এখানে এক করেছে ঝিঁ কু-উক, কু-উক গাড়ি।
আমরা সবাই যাত্রী একই —এক্সপ্রেস অথবা মেলে
বুকের ভেতর কাঁটা বেঁধে কেউ বা নেমে গেলে।
ঝিঁক ঝিঁক ঝিঁক ঝিঁক রেল চলে---
( গান চলতে থাকবে।সবাই তালি বাজায়। তালির শব্দ ক্রমে ক্ষীণ হয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে আলো নিষ্প্রভ হয়ে এসে মঞ্চ আধার করে ফেলবে। গান চলতে থাকবে।)
৷৷ সপ্তম দৃশ্য ৷৷
( গানের শেষ রেশ চলছিল। এরই মধ্যে গপ গপিয়ে স্টেশন মাস্টার, তাঁর দুজন সহকর্মী এবং পুলিশ চলে আসে। গান হঠাৎ বন্ধ হয়ে যাবে। সবাই নিজের নিজের জায়গাতে নিশ্চল হয়ে যাবে।)
স্টেশন মাস্টার ৷৷ (চারদিকে চোখ বুলিয়ে রানিদের উদ্দেশ্যে করে) এ্যাই, তোরা কজনে এখানে থাকিস?
রানি ৷৷ ১১ জন।
স্টেশন মাস্টার ৷৷ একেবারে একটা গ্যাং। শুন! আজ থেকে তোরা এখানে থাকতে পারবি না।
বুলু ৷৷ থাকতে পারব না? কেন?
পুলিশ ৷৷ কেন? এটা কি তোদের ঘর পেলি? এখানে ঘর বেঁধে থাকবার নিয়ম নেই।
কুরবান ৷৷ তবে আমি থাকব কোথায়?
স্টেশন মাস্টার ৷৷ কই থাকবি আমরা কী করে জানব? যেখানে খুশি মরগে। আজই প্ল্যাটফর্ম খালি করে দিবি। শুন! পরশু মিনিস্টার
আসবেন। রেলমন্ত্রী আসবেন। জি-এম আসবেন। সব সাফ করতে হবে।
বুলু ৷৷ সাফ করুন। আমরা তো রাতেই থাকি।
স্টেশন মাস্টার ৷৷ হবে না। প্ল্যাটফর্মে কেউ থাকতে পারবি না। নিরাপত্তার কথা আছে।
রানি ৷৷ পরশু থাকব না।
স্টেশন মাস্টার ৷৷ কোনওদিনই পারবি না। এখানে ঘর উঠবে। প্ল্যাটফর্ম ভেঙে দেওয়া হবে। রেললাইন অন্যদিকে বসবে। আজকের
ভেতরেই খালি করে দিবি।
(প্রস্থান। পুলিশটি থেকে যায়। মুন্না চট করে ওভার ব্রিজ দিয়ে বেরিয়ে যায়।)
পুলিশ ৷৷ ঐ, পানওয়ালা! গেলি কই (হিরাকে দেখে) তুই-ই তো? দেখি, একটা পান দে। (হিরা পান দেয়) ভালোয় ভালোয়
এখান থেকে চলে যা। তোদের বা কী? যেখানে রাত, সেখানে কাত। তোদের আবার থাকার জায়গা চাই বুঝি? (যেতে
উদ্যত হয়ে রয়ে যায়) না গেলে কিন্তু দিগদার আছে। মিনিস্টার আসবে। মরবি।
(প্রস্থান। সবাই রানিকে ঘিরে ধরে।)
মুনিয়া ৷৷ এখন কী হবে রানিদি?
রানি ৷৷ আহ! হবে কিছু একটা। চিন্তা করবি না তো। দুনিয়াতে এতো জায়গা, জায়গার অভাব হবে কেন? কিছু একটা করতে
হবে।
বুলু ৷৷ সবারই থাকার ঘর আছে। আমাদেরই নেই কেন?
রানি ৷৷ সবার থাকার ঘর নেই। কিছু লোকেরই আছে। কারও দালান আছে, কারও বা ঝুপড়ি। কারও গাছতলা, কারও কারও
প্ল্যাটফর্ম । বিচিত্র ঘর। ঘর না পেলে গাছতলাতে থাকব। আর কী?
মকবুল ৷৷ যার ঘরের কোনও দরকারই নেই তার আবার মার্বেল পাথরের ঘর। ‘হাওয়া’ [আদমের স্ত্রী হাওয়া] থাকে সেখানে।
মাটির মূর্তি, পাথরের মূর্তি—থাকবার জন্যে দালান ঘর।
কুরবান ৷৷ লাশ রাখবার জন্যেও ঘর আছে। গলা পচা লাশ।
হিরা ৷৷ আমাদের জন্যেও আছে। কেন—জেল, লক-আপ। (সিঁড়ির উপরে যতীন আর মুন্নি)
রানি ৷৷ মামা, আরে মুন্নি কখন গেলি? (যতীনকে চিন্তিত যেন দেখা যায়।)
যতীন ৷৷ ও-ই আমাকে খবর দিল গিয়ে। কী হল, সবাই একেবারে নিস্তেজ হয়ে আছিস যে? এত চিন্তা করবার কী আছে? ঠিক হয়ে
যাবে, সব ঠিক হয়ে যাবে।
আলি ৷৷ মামা, সবার বাড়িঘর আছে। আমাদের নেই কেন? দুনিয়াতে আমাদেরও কি থাকতে নেই? জন্তু-জানোয়ার সবাই থাকতে
পারে, আমরা মানুষ হয়েও থাকতে পারি না বুঝি?
যতীন ৷৷ আজ দেখছি আলিবাবার মুখে বোল ফুটেছে।
হিরা ৷৷ ঠিকই বলেছে সে। আমরা নিজেই রোজগার করছি, খাচ্ছি, বেঁচে আছি। কথায় কথায় আমরাই হুমকি ধমকি খেতে থাকি। সেই
টিকিট বাবু, গার্ড বাবু, পুলিশ সবাই আমাদের থেকে পান সিগারেট খায়। পয়সা দেয় না। আমরা তো ওদের থেকে এক
পয়সারও কিছু খাই না। ওদের ঘর আছে, বাড়ি আছে, সব আছে। আমাদের কিচ্ছু নেই।
কুরবান ৷৷ আরে ভগবান, আল্লাহ ঈশ্বর—কোনোদিন দেখিনি। আছে কি নেই তারও ঠিকানা নেই—তাদের জন্যেও ঘর আছে, দালান
ঘর। মন্দির মসজিদ গির্জা কত কী! আমাদের প্রাণ আছে, ঘর নেই। আমাদের কি বেঁচে থাকার ঘর নেই? অধিকার নেই?
যতীন ৷৷ আছে । আলবৎ আছে। পৃথিবীতে বেঁচে থাকার, কাজ করবার অধিকার, খেয়ে পরে বাস করবার অধিকার আছে। তোমাদেরও
আছে।
আলি ৷৷ তবে?
মকবুল ৷৷ এই প্ল্যাটফর্মে থাকার অধিকার তবে আমাদের নেই কেন?
যতীন ৷৷ অধিকার কেউ কাউকে যেচে দেয় না। অধিকার অর্জন করতে হয়। কেড়ে আনতে হয়। আমরা দুর্বল হয়ে আছি। অধিকার কেড়ে আনবার শক্তি আমাদের নেই। আমাদের শক্তি গোটাতে হবে।
রানি ৷৷ এই প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে আমরা তবে বেরিয়ে যেতেই হবে? এ তবে আর আমাদের প্ল্যাটফর্ম নয়?
যতীন ৷৷ এ এমনিতেও তোমাদের আসল প্ল্যাটফর্ম নয় , রানি।
রানি ৷৷ আসল প্ল্যাটফর্ম?
যতীন ৷৷ হ্যাঁ, আসল প্ল্যাটফর্ম। প্ল্যাটফর্ম মানে কী –জানিস? (ক্ষণিকের নীরবতা) প্ল্যাটফর্ম মানে মঞ্চ, ভিত, মাচান, সংগঠন, অনেক মানুষ এক সঙ্গে একই উদ্দেশ্য নিয়ে জড়ো হবার ঠাঁই।
বুলু ৷৷ আমরা দশজনে এত দিন এখানে জড়ো হয়ে আছি। এটা আমদের প্ল্যাটফর্ম নয়?
যতীন ৷৷ না। দেশে এমন রেল-প্ল্যাটফর্ম কটা আছে? প্রতিটি স্টেশনে প্ল্যাটফর্ম আছে। প্রতিটি প্ল্যাটফর্মে তোমাদের মতো গৃহহীন ছেলেমেয়ে আছে। তারাও তোমাদের মতোই হুমকি ধমকি খেয়েই টিকে আছে। তাড়া খাচ্ছে। থাকার জায়গা সন্ধান করে দিশেহারা হচ্ছে। ওদেরও বেঁচে থাকবার অধিকার আছে। (ক্ষণিকের নীরবতা। আলো যতীনের উপরে স্থির হবে) যা, ওদের খবর নে। তোদের বারোজন এই প্ল্যাটফর্মে গিয়ে একদিন এক শ বা এক হাজার হবি, হয়তো বা একদিন এক কোটি হবি। তোরা গড়ে তুলবি তোদের আসল প্ল্যাটফর্ম। অধিকার অর্জনের মঞ্চ। বেঁচে থাকবার ভিত। সেটিই হবে আসল প্ল্যাটফর্ম। সেই মঞ্চ খালি করে দিতে কেউ আমাদের হুকুম দিতে পারবে না।
(আলো ক্রমে নিষ্প্রভ হয়ে আসবে)
।। অষ্টম দৃশ্য ।।
(একই দৃশ্য সজ্জা। মঞ্চে শুধু মুনিয়ার মুখে আলো পড়বে। সে নিচের কবিতাটি আবৃত্তি করবে। আলো আবৃত্তির সঙ্গে ক্রমে স্পষ্ট হতে থাকবে। আবৃত্তি শেষে ফ্লাড হবে। মঞ্চের বাকি চরিত্রদের তখন দেখা যাবে। যতীনের হাতে একখানা পাণ্ডুলিপি।)
মুনিয়া ৷৷ ভাত এনেছি খোঁজে পেতে
তাতেই মেটাই খিদে
দিনটা গেছে লড়ে ঝড়ে
রাতটা কাটাই জিদে
কখনও ভিজি বৃষ্টি জলে
কখনও ভিজি শিশিরে
ফুটপাতেই জীবন যাপন
আমরা সবাই হাঘরে।
কুকুরেরও ঘর রয়েছে
বেড়াল গরু ছাগলের
আকাশ ফুঁড়ে অট্টালিকা
মুকুট যেন নগরের।
ধনির বাঁচা সহজ কত
আমাদেরই হাজার বালাই
ধনির জন্যেই দুনিয়া বুঝি
আমাদের কি কিছুই নাই?
(যতীন এবারে রানির দিকে হাতে নির্দেশ দেয়)
রানি ৷৷ নাই নাই নাই, আমাদের জন্যে এ জগতে নাই
এক ফালি ঠাঁই।
চারদিক ঘিরে আছে, প্রহরী দারোয়ানে
ভাই বন্ধু কেউ নাই।
এ দুনিয়াতে যদি ঠাঁই নেই আমাদের
ঠাঁই আছে তবে কই?
বেঁচে থাকবার সামান্য অধিকার
আছে কোন জগতে, কই?
(যতীন এবারে হিরাকে নির্দেশ দেবেন। তখনই মতিউর রহমান কনস্টবল এসে পাশে দাঁড়িয়ে এদিকে ওদিকে তাকাবে)
হিরা ৷৷ কে বানাল এই পৃথিবীর
সাত সাতটি বিস্ময়
কে বানাল মন্দির মসজিদ
দেউল দেবালয়?
কে বানাল আকাশ লঙ্ঘী
অট্টালিকাগুলো
প্রতিটিতে আছে কার কাহিনি
ঘাম আর পদধুলো
ইতিহাসে ঢেকে শ্রমের ব্যথা
লেখে তো কেবলই রাজার কথা
এই প্ল্যাটফর্ম যারা বানাল
তাদের ঠিকানা নাই।
শুধুই তাদের চলা আছে
নামার স্টেশন নাই।
আলিবাবা ৷৷ আমাদের মতো অসহায় অনাথ
বানিয়েছে যত দালান কোঠা
মাথা গুঁজবার ঠাই চাইতেই
পেয়েছে শুধুই লাথি ও ঝাঁটা।
যতীন ৷৷ (হাত তালি দিয়ে) দারুণ! সুন্দর! বাকিগুলো কি মুখস্থ হল? (সবাই সদর্থক মাথা নাড়ায়) আমরা প্ল্যাটফর্মে প্ল্যাটফর্মে এই
নাটক করব। স্টেশনের সামনে, যাত্রীদের মধ্যে –যেখানেই মানুষের সমাগম, তাতেই এই নাটক করব।
মতিউর ৷৷ কিন্তু মামা, দলে দলে পুলিশের লোক আসছেই স্টেশন মাস্টারের সঙ্গে। এখনই এদের মেরে ধরে এখান থেকে তাড়াবার
হুকুম হয়েছে। আপনারা এখান থেকে এখন চলে যাওয়াই ঠিক হবে মনে হয়।
যতীন ৷৷ এরা তো এখানে থাকছে না। এরা আজই রাতের নিম্নমুখী ট্রেনে এখান থেকে চলে যাবে। এরা আজ এই প্ল্যাটফর্মের বাসিন্দা
নয়। যাত্রী। তোমরা এখান থেকে যাবে না। আমি বাইরে গিয়ে তোমাদের জন্যে টিকিট নিয়ে আসছি গে।
(যতীন দৌড়ে ওভার ব্রিজ দিয়ে বেরিয়ে যায়। সঙ্গে সঙ্গে স্টেশন মাস্টার কিছু আর পি এফ-এর কনস্টবল সঙ্গে চলে আসেন।)
স্টেশন মাস্টার ৷৷ এইরে। এরা তো দেখছি, আজও এখান থেকে যায় নি। এ্যাই! তোরা এখান থেকে যাবি কি না? বেরো, এখনই বেরিয়ে যা বলছি।
(সঙ্গে সঙ্গে কনস্টবলেরা রানিদের উপরে প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়ে। ওদের তল্পি-তল্পা পায়ে লাথি দিয়ে, লাঠি দিয়ে ঠেকে ছড়িয়ে ফেলে। লাঠি দিয়ে ঠেলে ঠেলে প্ল্যাটফর্মের ভেতরের দিকে নিয়ে যেতে থাকে। মুনিয়া কী করবে দিশা না পেয়ে এদিক ওদিক ছুটো ছুটি করে। একটি কনস্টবল ‘ অই! কই যাচ্ছিস!’ বলে পথ আটকায়। মুনিয়াকে অন্ধ বলে ধরতে না পেরে ‘ কালা মনে হয়’ বলে ছেড়ে চলে যায়। মঞ্চে শুধুই মুনিয়া। সে ‘মামা! মামা! রানিদি!’ বলে ডাকতে ডাকতে বেঞ্চ পেয়ে তাতে বসে পড়ে। ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করে। খানিক করে ওভার ব্রিজ দিয়ে যতীন নেমে এসে দৃশ্য দেখে থমকে দাঁড়ায়। তার পরে দৌড়ে আসে মুনিয়ার কাছে।)
যতীন ৷৷ মুনিয়া, কী হল? (মুনিয়া যতীনকে জড়িয়ে ধরে)। রানিরা কই গেল?
মুনিয়া ৷৷ ওদের কেউ মেরে ধরে নিয়ে গেল।
যতীন ৷৷ মেরে ধরে নিয়ে গেছে? পুলিশ? (যতীন প্ল্যাটফর্মের ভেতর দিকের মঞ্চের কিনারে যায়। মুনিয়া আবার ‘মামা!’ বলে
ডাকলে আবার ফিরে আসে।) তুমি অল্প সময় এখানে বসে থাক।আমি ওদের খোঁজ করি গিয়ে।
মুনিয়া ৷৷ আমিও যাব। আমি এখানে একা থাকব না। আমাকেও নিয়ে চল।
যতীন ৷৷ ঠিক আছে। চল। (যতীন মুনিয়ার হাত ধরে এগোতেই উলটো দিক থেকে স্টেশন মাস্টার, জনা দুই কনস্টবল আর রানিরা
এসে ঢোকে আবার।)
যতীন ৷৷ রানি, মকবুল তোমরা গেছিলে কই?
রানি ৷৷ এঁরা ধরে নিয়ে গিয়েছিলেন।
যতীন ৷৷ ধরে নিয়েছিল? কেন?
রানি ৷৷ আমরা বুঝি প্ল্যাটফর্মে থাকতে পারব না। আপনার কথা বলতেই আপনার সঙ্গে দেখা করবেন বলে আবার নিয়ে এসেছেন।
স্টেশন মাস্টার ৷৷ এদের এখান থেকে চলে যেতে সেই কবেই অর্ডার দেওয়া হয়েছিল। এরা কেয়ারই করে নি। এটি প্ল্যাটফর্ম হয়। এদের
বাপের বাড়ি পেয়েছে বুঝি?
যতীন ৷৷ অনাথ আশ্রয়হীন এই ছেলেমেয়েদের প্ল্যাটফর্মে থাকার অধিকার নেই, সে না হয় বুঝলাম। কিন্তু আপনার স্টেশনের
প্যাসেঞ্জার হবার অধিকারও কি এদের নেই?
স্টেশন মাস্টার ৷৷ আপনি বলছেন কী—আমি বুঝি নি।
যতীন ৷৷ আমি সহজ প্রশ্ন করেছি মাস্টার বাবু। (রানিদকে উদ্দেশ্য করে) তোমরা আমার সঙ্গে এস। (যতীন রানিদের নিয়ে ওভারব্রিজের দিকে এগিয়ে যান। ওদের আগে আগে ব্রিজে উঠতে বলে নিজে সবার শেষে চড়তে গিয়ে হঠাৎ থেমে যান। ফিরে এসে স্টেশন মাস্টারকে বলেন...) শুনুন, মাস্টার বাবু! এই আশ্রয়হীন গৃহহীন ছেলেমেয়েদের কাছে প্ল্যাটফর্মখানা নিজেদের বাড়ির মতোই। (আলো যতীনের মুখে কেন্দ্রীভূত হয়) এই প্ল্যাটফর্ম ওদের নিজের বাড়ির মতোই আপন আর আদরের। আপনি কিন্তু এখানে একজন অস্থায়ী চাকরিজীবীই। চাকরিটা থাকা পর্যন্তই আপনার কর্তৃত্ব বা অধিকার থাকবে। এই প্ল্যাটফর্ম রানি—মুনিয়াদের বাড়িই নয়। এরা আজ আপনার যাত্রীও। (পকেট থেকে টিকিটগুলো বের করে দেখায়।) প্ল্যাটফর্মের প্রত্যেক যাত্রীকে সম্মান জানানো আপনার কর্তব্যের মধ্যে পড়ে। সেই সম্মান এদের প্রাপ্য। কোনও প্যাসেঞ্জারই আপনার গোলাম নয়। ( স্থির হয়ে যাবে। ক্রমে আলো মিলিয়ে যাবে।)
।। অন্তিম দৃশ্য।।
(প্ল্যাটফর্মে স্বাভাবিক ব্যস্ত পরিবেশ। রানিদের হাতে হাতে নিজের নিজের তল্পি তল্পা নিয়ে জড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ওদের মাঝখানে যতীন। যতীনের হাতে হ্যাণ্ডেল লাগানো টর্চ লাইট একটি। প্ল্যাটফর্মের মাইকে তখন ঘোষণা চলে “ মনোযোগ দিয়ে শুনবেন! নিম্নমুখী কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেস ট্রেনটি ২নং প্ল্যাটফর্মে ১নং লাইন থেকে যাবার জন্যে তৈরি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এই গাড়ি রাত ১২টা ৩০-এ ছাড়বে। ঊর্ধ্বমুখী মানস এক্সপ্রেস গাড়িটি ৩নং লাইনে অল্প পরেই এসে ঢুকবে।”)
রানি ৷৷ মামা, আপনাকে ছেড়ে যেতে আমাদের খুব কষ্ট হচ্ছে।
যতীন ৷৷ (যেন হঠাৎই তন্ময়তা ভাঙছেন) তোমরা কত বড় কাজে বেরিয়ে যাচ্ছ নিজেরাই হয়তো বুঝে উঠতে পারনি রানি।
রানি ৷৷ আমি বুঝে উঠতে পারছি মামা। সেজন্যেই বলছি, যদি আপনি আমাদের সঙ্গে থাকতেন।
যতীন ৷৷ আমি তোমাদের সঙ্গে সব সময় থাকব। তোমরা যেখানেই যাও, যেখানেই থাক আমি সঙ্গে সঙ্গে থাকব। তোমাদের প্রতিটি পা
ফেলবার শব্দ আমি এখান থেকে শুনতে পাব।
(মুন্না- মুন্নিরা নেমে আসে)
মুন্নি ৷৷ মামা!
বুলু ৷৷ মামা, আমরা যাচ্ছি। (যতীন সবাইকে জড়িয়ে ধরেন)
মুনিয়া ৷৷ এই প্ল্যাটফর্ম আমার কত চেনা। কই সিঁড়ি আছে, কই বেঞ্চ আছে, দেওয়াল আছে কই, আমি সব জানি। এখানে আমি
কোথাও ঠোকা খাই না। বাকি সব প্ল্যাটফর্মও কি এরকমই মামা?
যতীন ৷৷ সব প্ল্যাটফর্ম একই নয় মুনিয়া। তুমি হয়তো কোথাও কোথাও ঠোকা খাবে। কিন্তু ধীরে ধীরে সব ঠিক হয়ে যাবে। এই সব
আমাদের নিজেদের প্ল্যাটফর্ম নয় বলেই ঠোকা খেতেই থাকবে।
(দূরে ট্রেনের বাঁশি। ট্রেন ছাড়বার আলো আর শব্দ। প্ল্যাটফর্মে ব্যস্ততা। ইতিমধ্যে ট্রেন ছাড়বার ঘণ্টা পড়বে। ট্রেনের দীর্ঘ বাঁশি। রানিরা যতীনকে যাবার আগে বলতে থাকবে ‘মামা যাই! মামা যাই!’ যতীন সবাইকে জড়িয়ে বিদায় জানাবে। এরা এক এক করে ভেতরে চলে যাবে। প্ল্যাটফর্ম প্রায় জনশূন্য হয়ে যাবে। যতীন ওভারব্রিজের কয়েকটা সিঁড়ি চড়বেন। শেষ বাঁশি বাজিয়ে ট্রেন ছাড়বার শব্দ হবে। যতীনের হাতের টর্চ এমন ভাবে দুলতে থাকবে যেন গার্ড সবুজ সংকেত দিচ্ছে। এই সময়ে নেপথ্যে সলিল চৌধুরীর কথায় ও সুরে এই গানটি চলতে পারে...)
পথে এবার নামো সাথী পথেই হবে পথ চেনা
জনস্রোতে নানান মতে মনোরথের ঠিকানা,
হবে চেনা, হবে জানা।।
অনেক তো দিন গেল বৃথাই সংশয়ে,
এসো এবার দ্বিধার বাধা পার হয়ে
তোমার আমার সবার স্বপন
মিলাই প্রাণের মোহনায়
কিসের মানা।।
তখন এ গান তোলে তুফান
নবীন প্রানের প্লাব্ন আনে দিকে দিকে
কিসের বাধা, বিপদ বরণ মরণ হরণ,
চরন ফেলে সে যায় হেকে।
তখন তো আর শোষণ বাঁধনমানব না
সবার এ দেশ সবার ছাড়া তো জানব না
পরোয়া নেই আকাশ বাতাস
হবে আশার পরোয়ানা।।
ছবিঃ আবির