নিজের ছেলেবেলা সম্পর্কে লেখা কারো পক্ষেই সহজ ব্যাপার নয়, আমারও নয় । ইংরাজ কবি ওয়ার্ডসোয়ার্থ নাকি তাঁর একটা কবিতায় লিখেছিলেন শিশুদের বাস স্বর্গেতে । তো প্রতিদিন নরকের বাসিন্দা হয়ে আশি পেরনো আমার পক্ষে সেই কবেকার শৈশবের স্বর্গে বা ছেলেবালায় পৌছে স্মৃতি খুঁজে ফেরা বা খুঁড়ে বের করা সহজ কাজ নয় ।
জন্মেছিলাম সেই কবে ১৯৪২এ, মানে স্বাধীনতারও পাঁচবছর আগে । পঁচাত্তর-আশি বছর আগের সেই নিতান্ত ছোটবেলার স্মৃতি কারই বা মনে থাকে! তবে নানান ব্যাপারে সেই ছোট বেলা থেকেই ঘা খেয়েছি বা খেয়ে আসছি বলেই হয়তো সত্তর-পঁচাত্তর বছর মানে আমার ছোটবেলার অনেক কথা মনে আছে আজও । আমার জন্মের বছরেই ভয়ঙ্কর দুর্ভিক্ষ হয়েছিল শুনেছি, যার নাম তেতাল্লিশের মন্বন্তর। সেই মন্বন্তরের প্রভাব আমার শৈশবে পুরোপুরিই পড়েছিল। চাল, ডাল আটার মত খাদ্যবস্তুর অভাব, হাহাকার আমার নিজের অভিজ্ঞতাতেই ধরা আছে, আর তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধেরও শেষ পর্যায় ।
“মন্বন্তরে মরিনি আমরা মারি নিয়ে ঘর করি” এই আপ্তবাক্য সঙ্গে নিয়ে স্কুলে ভর্তি হয়েছিলাম ।কে কবে আমাকে স্কুলে ভর্তি করে দিয়েছিল আমার মনে নেই । এখন যেমন কিন্ডারগার্টেন, কেজি ওয়ান, কেজি টু ইত্যাদি পার করে ক্লাস ওয়ানে পঠন শুরু করতে হয়, তখন এরকম ছিল না ।ক্লাস ওয়ানের আগে একটাই শ্রেণী ছিল, বলা হত ইনফ্যান্ট ।তা ইনফ্যান্টেই ভর্তি হয়েছিলাম । আর কি আশ্চর্য সেই ইনফ্যান্টে পড়ার সময়কার স্কুলের প্রাইমারি সেকশনের প্রধান শিক্ষক মশাইয়ের নাম, চেহারা, এমনকি তাঁর কন্ঠস্বরটাও বেশ মনে আছে এই পচাত্তর বছর পরেও , হয়তো খুব ভয় পেতাম সেইজন্যই মনে আছে । মনে আছে দুএকজন সহপাঠীর কথা, এমনকি শ্রেণীকক্ষের দেওয়ালে টাঙানো ছবিগুলোর কথাও মন থেকে একেবারে মুছে যায়নি । শ্রেণীকক্ষের দেওয়ালে কাঁচের ফ্রেমে অনেক মহাপুরুষের বাণী টাঙানো, একটায় লেখা থাকতো ‘আবার তোরা মানুষ হ', কে বলেছিলেন জানি না, মনেও নেই । কয়েকমাস আগে আয়োজিত একটা সেমিনারে আমন্ত্রিত হয়ে গিয়েছিলাম সেই শৈশবের আমার স্কুলের সেই ফেলে আসা শ্রেণীকক্ষে, সেটা তখন সভাকক্ষ । খুঁজেছিলাম দেওয়ালে সেই লেখাটা এখনো আছে কি না। ছিল না, হয়তো ইতিমধ্যে সবাই মানুষ হয়ে গেছে তাই ।
কলকাতার লাগোয়া শহরতলি আড়িয়াদহ গ্রামে আমার জন্ম । গ্রামের স্কুলেই পড়েছি, গ্রামেই বড় হয়েছি । আমাদের এলাকায় দুটো স্কুল —‘আড়িয়াদহ কালাচাঁদ স্কুল’ আর ‘দক্ষিণেশ্বর স্কুল’। দুটো স্কুল প্রায় একই সময়ে স্থাপিত হয়েছিল । আমাদের স্কুলটা কালাচাঁদ স্কুলের চেয়ে বয়সে নয় বছরের বড় । তবুও কেন জানি না, কালাচাঁদ স্কুলকে একটু বেশি সমীহ করত সবাই । কালাচাঁদ স্কুলকে সবাই বলত ইংরাজি স্কুল আর দক্ষিণেশ্বর স্কুলকে বলত বাংলা স্কুল ।আসলে গ্রামবাসীরা কালাচাঁদ স্কুলকে একটু বেশি সমীহ করতো । তা করুক, তাতে আমাদের কারো কিছু এসে যাওয়ার কথা নয় । আমরা তো তখন স্বর্গে বাস করি !যখনকার কথা বলছি তখন দেশ স্বাধীন হয়নি কিংবা সবে স্বাধীন হয়েছে ।তখন দশ ক্লাস বা ম্যাট্রিকুলেশন পাশ না করেও স্কুলের প্রাইমারি সেকশনে প্রধান শিক্ষক হওয়া যেত । আমাদের প্রাইমারি সেকশনে, ভয়ে তটস্থ হওয়া প্রধান শিক্ষক এমনই ছিলেন ।
ছাত্র হিসাবে আমি প্রাইমারি বিভাগে বা তারপরেও কোনদিনই ভালো মনোযোগী ছাত্র ছিলাম না ।তখন বুঝতাম না, এখন বলতে দ্বিধা নেই যে আসলে স্কুলে পড়ানোর মত আর্থিক সঙ্গতি আমার পরিবারের ছিল না ।তখন তো বিনা বেতনে স্কুলে পড়া যেতো না, প্রাইমারি সেকশনেও বেতন লাগত । তবু যথাসম্ভব মাথা উচু করেই স্কুলজীবন কাটিয়েছি ।
আমি কোনদিন ক্লাস ফোর’এ পড়িনি । এরকম হয় নাকি ? হ্যাঁ হয়েছিল আমার ক্ষেত্রে, সেটা বলি । ক্লাস থ্রী পর্যন্ত দক্ষিণেশ্বর স্কুলে পড়ার পর আমাকে ভর্তি করেছিল আড়িয়াদহ স্কুলে ।কিন্তু স্কুল আমাকে বার্ষিক পরীক্ষায় বসতে দেয়নি ।মনে আছে তিন-চার মাসের বেতন বাকি থাকার জন্য আমাকে পরীক্ষায় বসতে দেয়নি, পরীক্ষার হল থেকে বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছিল । তখন সবে দেশ স্বাধীন হয়েছে, এখন হয়তো এমন ঘটনা আভাবিত, তখন কিন্তু সদ্যস্বাধীন দেশে এমনই অমানবিক অভিজ্ঞতা আমার হয়েছিল । হয়তো এমন অভিজ্ঞতার জন্যই, সদ্যস্বাধীন দেশের রাজপথে মিছিলে যখন স্লোগান শুনতাম – একজন মুখে চোঙা লাগিয়ে বলছেন ‘ইয়ে আজাদি ঝুটা হ্যায়’ আর অন্য অনেকে গলার শির ফুলিয়ে বলছে ‘ভুলো মাৎ, ভুলো মাৎ’ তখন নিজের অজান্তে, মানে না বুঝেও গলা মেলাতে চাইতো সেই স্লোগানের সঙ্গে । ক্লাস ফোরে আর পড়া হল না । একটা বছর বখাটে ছেলের মত ঘুরে বেড়ালাম, শেষে দক্ষিণেশ্বর স্কুলে ক্লাস ফাইভে ভর্তি হয়ে গেলাম । ওখান থেকেই স্কুল ফাইনাল পরীক্ষায় পাশ করলাম, ১৯৬০ সালে।প্রবেশ করলাম কলেজজীবনে ।তখনও হায়ার সেকেন্ডারি চালু হয়নি ।
সকলেই অথবা কেউকেউ নিজের নিভৃত সময়ে নিজের সঙ্গে কথা বলে, আমিও বলতে চেষ্টা করি । কিন্তু কোন উত্তর খুজে পাই না । স্কুল-কলেজের লেখাপড়ায় গড়পড়তা ছিলাম, ভালো ছিলাম না । তারজন্য কোন দুঃখ নেই ।সততা ও জীবনবোধের যে সঞ্চয়টুকু করেছিলাম তার দাম স্কুল-কলেজের পাঠ্যবই ভিত্তিক শিক্ষার দামের চেয়ে কিছু কম ছিল না, হয়তো বেশিই ।তবু ছোটবেলার স্কুলের কোন স্যারের কথা বিশেষ কিছু মনে না থাকলেও অবিনাশ স্যারের কথা কিছুতেই ভুলতে পারি না জীবনের শেষতম প্রান্তে পৌঁছেও। না, ভালো অঙ্ক শিখেছিলাম এমন নয়, সেই দিনগুলোতে চরম ফাঁকিবাজি করেছিলাম বলে । অবিনাশ স্যার ছিলেন আমাদের ক্লাস নাইন টেনের অঙ্কের স্যার । ক্লাস নাইন থেকে টেনে উঠতে অঙ্কে পেয়েছিলাম চৌদ্দ নম্বর । ভয় পেয়েছিলাম, অন্তত টেনেটুনে ত্রিশ নম্বর না পেলে তো স্কুলফাইনালটা পাশই করতে পারবো না । না, পাশটা করেছিলাম ভদ্রগোছের নম্বর পেয়েই, সে অন্য গল্প বলা যাবে কোন সময়ে । ব্যস সেই শেষ, তারপর অবিনাশ স্যারের ভয় মানে অঙ্কের ভয় সারা জীবন আমাকে তাড়া করেছে, এখনো করছে ।কলেজে পড়ার সময়, কে যে বুদ্ধি দিয়েছিল মনে নেই, কমার্স নিয়ে ভর্তি হয়েছিলাম । কমার্স মানে পদে পদে অঙ্কের ভয় ।বি কম পার্ট ওয়ানে অঙ্ক ছিল না, পাশ করে গেলাম, কিন্তু পরের বছর পার্ট টু পরীক্ষায় কাৎ হয়ে গেলাম, অঙ্ক রয়েছে যে ! প্রায় কিছু না লেখা খাতা একাউন্টেন্সির ব্যালান্সসিটের অঙ্ক না মেলাতে পারা সাদা খাতা জমা দিয়ে উৎপল দত্তর ‘ঘুম ভাঙ্গার গান’ নামে একটা সিনেমা দেখে বাড়ি ফিরে এসেছিলাম । স্নাতক হওয়া আর হল না। শুধু অবিনাশ স্যারের কথা মনে পড়েছিল । সে সব গল্প এখানে বলার কথা নয়, তখন তো স্বর্গবাস ছেড়ে নরকে ঢুকে পড়েছি ! পরিণত বয়সে মাঝে মাঝে ভেবেছি অবিনাশ স্যারের সামনে দুটো কান ধরে দাড়াই, বলি ‘স্যার শাস্তি দিন’, তাতে যদি তাঁর ক্লাসে গোলমাল করা ও ফাঁকি দেওয়ার পাপ একটু কমে ! সে সুযোগও পাইনি, আর জীবনের কোন অঙ্কই মেলাতে পারিনি ।
আমাদের গোলমাল থামাতে ক্লাসে ঢুকেই অবিনাশ স্যার বলতেন “আফ্রিকার জঙ্গলে একপ্রকার পক্ষী পাওয়া যায়, উহারা নিজেরা ডিম পাড়িতে পারে না, অপরকেও ডিম পাড়িতে দেয় না । দক্ষিণেশ্বর স্কুলের নবম শ্রেণীর ছাত্রগুলান সেইরূপ, ইহারা নিজেরাও পড়ে না, অপরকেও পড়িতে দেয় না”। স্কুলের যারা ভালো ছেলে অঙ্ক শিখে কত উন্নতি করলো আর আমি ক্লাসে ফাঁকি দিয়ে জীবনের কোন অঙ্কই মেলাতে পারলাম না । সত্যি বলছি, অবিনাশ স্যারের সামনে দুটো কান ধরে যদি একবার দাঁড়াতে পারতাম !
গ্রাফিকঃ মিতিল