সবুজ মনের রসদ
Ichchhamoti Logo
কাছের মানুষ নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী

“তোমরা আমার মাথায় ছিলে, তোমরা আমার বুকে
তোমরা আমার দুঃখে এবং সুখে
এই কথাটি বলব বলেই এতটা পথ এসেছিলাম
অষ্টপ্রহর ঝগড়া করে দারুণ ভালো বেসেছিলাম” ।

কবির বলা এই ‘তোমরা’ কারা ? কবি সে কথা বলেননি, কিন্তু এই ‘তোমরা’ হল শিশুরা, ছোটরা । আমি কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীর কথা বলছি ।ছোটদের এবং আমাদের সকলের কাছের মানুষ । শিশুরা তাঁর কবিতায় এসেছে নানাভাবে । তাঁর চোখে শিশুরা সত্যবাদী, সত্যকথা বলার মত সাহসী । নীরেন্দ্রনাথের এই সাহসী শিশুই উলঙ্গ রাজার সামনে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞাসা করতে পারে ‘রাজা তোর কাপড় কোথায়’ । বড় হলে তুমি নীরেন্দ্রনাথের এইসব কবিতা পড়বে । এখন তোমাদের জন্য লেখা তাঁর অজস্র ছড়া, গল্প ও গদ্য লেখার সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সময়। সেইসব লেখার মধ্যে দিয়েই তিনি ছোটদের কাছের মানুষ হয়ে উঠেছেন ।

নীরেন্দ্রনাথের জন্ম এখনকার বাংলাদেশের ফরিদপুরের চান্দা গ্রামে । ঠাকুরদা লোকনাথ চক্রবর্তীর কর্মস্থল ছিল কলকাতা । কর্মজীবন থেকে অবসর নিয়ে চলে যান ফরিদপুরের চান্দা গ্রামে। সেখানেই নীরেন্দ্রনাথে জন্ম ১৯২৪ সালের ১৯শে অক্টোবর । পিতা জীতেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী ছিলেন কলকাতার একটি কলেজের ভাইস প্রিন্সিপাল । নীরেন্দ্রনাথের পিতা ও মাতা থাকতেন কলকাতায় আর নীরেন্দ্রনাথ থাকতেন ফরিদপুরের গ্রামে ঠাকুরদা-ঠাকুমার কাছে । সেখানে পাঠশালায় প্রাথমিক শিক্ষার পর কলকাতায় মা বাবার কাছে চলে আসেন ১৯৩০এ ঠাকুরদার মৃত্যুর পর । কলকাতার মিত্র ইনস্টিটিউশন থেকে প্রবেশিকা (এখনকার দশ ক্লাস) পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন । তাঁর শৈশব-কৈশোরের অধিকাংশ সময়ই কেটেছিল পূর্ববঙ্গের শ্যামল পল্লীর জল-হাওয়াতেই। সেখানেই তৈরি হয় তাঁর কবিমন । শৈশবে অনেক ছড়া, কবিতা লিখেছেন, কিন্তু ছাপার অক্ষরে প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয় ১৬ বছর বয়সে,‘শ্রীহর্ষ’ নামের একটি পত্রিকায়। নীরেন্দ্রনাথ একবার বলেছিলেন "ছোটদের জন্য না লিখলে কলম শুদ্ধ হয় না" । বড় হয়ে নিজের ছেলেবেলা দেখেন এইভাবে-

“এইতো আমার অঞ্জলিতেই মস্ত পুকুর,
কেউ আচমকা ছুঁড়লে ঢেলা
দেখতে থাকি কেমন করে প্রকাশ্য হয়
খুব নগন্য ছেলেবেলা” (অঞ্জলিতে ছেলেবেলা)।

নিজের কবিতা নিয়ে নীরেন্দ্রনাথ নিজেই জানিয়েছেন 'কবিতা লেখায় আমার কল্পনার হাত নেই তেমন। চারপাশে যা দেখি, শুনি, যা অভিজ্ঞতা হয় ঘুরতে ঘুরতে, তাই নিয়েই আমার কবিতা।' এক উলঙ্গ ভিখারি শিশুর ব্যস্ত কলকাতার রাস্তা পার হওয়া দৃশ্য কবিতার ভাষা পায় নীরেন্দ্রনাথের কলমে । শিশুটি হয়ে যায় তাঁর কবিতার নায়ক, রচিত হয় তাঁর বিখ্যাত কবিতা ‘কলকাতার যিশু’ । কিভাবে একটা সামান্য ঘটনা কবিতার রূপ পেল তা বলেছেন নীরেন্দ্রনাথ “একবার আনন্দবাজার অফিস থেকে বিকেল বেলায় দোতলা বাসে উঠে বাড়ি ফিরছি। হঠাৎ বাসটা প্রচণ্ড ব্রেক কষে থেমে গেল। তাকিয়ে দেখি, একটা বছর চার-পাঁচের সম্পূর্ণ উলঙ্গ শিশু চিত্তরঞ্জন এভিনিউয়ে রাস্তার উল্টো দিকের ফুটপাথে ছুটে চলে যাচ্ছে। কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই তার। বাস, ট্যাক্সির মধ্য দিয়েই সে দুরন্ত দৌড়ে রাস্তাটা পার হচ্ছে। সেই রাতেই লিখি কলকাতার যিশু”। লিখলেন –

স্টেটবাসের জানালায় মুখ রেখে
একবার আকাশ দেখি, একবার তোমাকে।
ভিখারি-মায়ের শিশু,
কলকাতার যিশু,
সমস্ত ট্রাফিক তুমি মন্ত্রবলে থামিয়ে দিয়েছ।

নীরেন্দ্রনাথের আমাদের কাছের মানুষ হয়ে ওঠার রহস্যটা কি ? সেই রহস্য হল তাঁর সরল অনাড়ম্বর ভাষা । তাঁর লেখা পড়লে মনে হয় যেন সামনে বসে কথা বলছেন । ছোটরা বড় হয়ে আধুনিক কবিতা পড়বে, হয়তো কবিতার সঙ্গে তাদের দূরত্বও তৈরি হতে পারে ভাষার জটিলতার কারণে । কিন্তু নীরেন্দ্রনাথের ক্ষেত্রে তেমন কথা বলা যাবে না । আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের, যাপনের অনাড়ম্বর সহজ ভাষায় ধরা রয়েছে তাঁর লেখা । আটপৌরে জীবনের নিত্যদিনের যাপনের পরতে পরতে রয়েছে ছন্দ । সামনে বসে কথা বলার মতই নীরেন্দ্রনাথের কবিতার ভাষা আর ছন্দ বিন্যাস । নীরেন্দ্রনাথ বিশ্বাস করতেন ভাষা ও প্রকাশের সরলতা পাঠককে কবিতার কাছে টেনে আনে । বলেছেনও “মানুষ মুখের ভাষায় যেভাবে কথা বলে,এর চেয়ে ভালো কবিতার উপাদান আর হয় না”। তাঁর এই ভাবনার ছায়া আমরা দেখি ছোটদের জন্য লেখা কবিতাগুলিতে, যেমন এই কবিতাটি,

দুটি ভাই

আষাঢ়ে আকাশ কালো বিকেলবেলায়
দুটি ভাই জলে ভেজে রথের মেলায়
কিনেছে লোহার খাঁচা, পাখি কেনা হলে
গুটি গুটি দুটি ভাই ঘরে যেত চলে।
ঝেঁপে আসে ঝড়জল, বলে ছোটভাই
“চলো দাদা বেলাবেলি ফিরে চলে যাই।”
বাড়ি ফিরে খাবে তারা নাড়ু আর মুড়ি,
রাতে মা দেবেন রেঁধে ইলিশ-খিচুড়ি।

তাই নবীনদের জন্য বিলিয়েছেন অগাধ পরামর্শ তার লেখায়- গদ্য, প্রবন্ধে এবং কবিতাতেও । নবীনদের কবিতা লেখা বা কবিতার কাছে আসার প্রস্তুতি কেমন করে নিতে হবে তা নিয়ে লিখেছেন ‘কবিতার ক্লাস’,‘কবিতা কী এবং কেন’ ও ‘বাংলা কী লিখবেন, কেন লিখবেন’।

কাছের মানুষ নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী

ছোটদের জন্য নীরেন্দ্রনাথের সবচেয়ে বড় কাজ ‘আনন্দমেলা’ পত্রিকার সম্পাদনা । ছোটদের প্রিয় পত্রিকা আনন্দমেলা পত্রিকার কথা কে না জানে ! ১৯৭৫ থেকে দীর্ঘদিন তিনি আনন্দমেলার সম্পাদনা করেছেন; পত্রিকাটিকে ছোটদের মনের মত করে তুলেছিলেন । ছোটদের কেমন লেখা ভালো লাগে তা তিনি জানতেন । তাই আনন্দমেলা সেজে উঠত বাংলার সেরা লেখকদের গল্প, কবিতা, ছড়া, কমিকস ইত্যাদি নানা ধরণের লেখায় । এখনও আনন্দমেলা ছোটদের সেরা পত্রিকা আর এই সেরা হয়ে ওঠার নির্মাণ হয়েছিল নীরেন্দ্রনাথের হাতে । অনেক লেখক আনন্দমেলাতেই শিশুসাহিত্য লেখা শুরু করেছিলেন । আর আমরা পেয়েছি কাকাবাবু, পান্ডব গোয়েন্দা, প্রফেশর শঙ্কুর মত কত চরিত্র । আনন্দমেলায় নীরেন্দ্রনাথ প্রথম বাংলায় ‘টিনটিন’ অনুবাদ করেছিলেন ।শুধু অনুবাদই নয়, ‘স্নোয়ি’র বদলে উপযুক্ত বাংলা নাম ‘কুট্টুস’, থমসন আর থম্পসন-এর বদলে উচ্চারণে সহজ ও মজাদার জনসন আর রনসন- এই নামগুলিও তাঁরই দেওয়া। তাঁর সরস অনুবাদে এই কমিক্‌স্‌ রিসিজের প্রতিটা চরিত্র বাঙালি পাঠকের মনে স্থায়ী জায়গা করে নিয়েছে।

নবীনরা যারা লেখালেখির জগতে আসবে তারা নীরেন্দ্রনাথের কবিতা, গদ্য, প্রবন্ধ পাঠের মধ্য দিয়ে নিজেদের প্রস্তুত করতে পারবে, জানবে কোথায আছে লেখার উপাদান । সেইসব উপাদান ছড়িয়ে আছে আমাদের চারপাশে, আমাদের চারপাশের মানুষের জীবন ও যাপনের মধ্যে । নীরেন্দ্রনাথ যেমন বলেছেন – “...আমি চারপাশের মানুষ দেখি, তাদের জগৎ, সংসার ও জীবন দেখি । এভাবেই আমার কাব্যভাষা তৈরি হয়েছে । সত্য কথা হল, কবিতা লেখার জন্য আমার কিছু কল্পনা করতে হয় , যা দেখি তা থেকেই লিখতে পারি” ।

বড় আপনজন, কাছের মানুষ নীরেন্দ্রনাথ চলে গেছেন গত ২৫শে ডিসেম্বর ২০১৮তে । কবিতায় আমাদের বলে গেছেন –

"ভালো থেকো
যে আছো যেখানে দূরে কাছে,
ভালো থেকো ।
হাত রেখো
পরিচিত এবং অপরিচিত সব
হাতের উপরে ।
ভেবে দেখো,
যা আশা করোনি, তাও জমা হয়ে আছে
বাহিরে ও ঘরে ।
সহসা ফুরালে কলরব
তাকে ডেকো,
যাকে ডাকনামে ডাকা যায় ।
যা কিছু শেখার থাকে প্রণয়ে, বিচ্ছেদে, বেদনায়
তাই শেখো ।"


ছবিঃ পার্থ মুখার্জি

কৃতজ্ঞতাঃ সৃজনী ঘোষ

প্রবীণ লেখক, মূলত সাহিত্য ও সামাজিক বিষয়ে প্রবন্ধ লেখেন । গল্প ও নাটকও লিখেছেন বেশ কয়েকটা । বড়দের জন্যই লেখেন । পঁচাত্তর বছর বয়সেও প্রচুর লিখে চলেছেন । এবার কলম ধরলেন ছোটদের জন্যেও।

আমরা, ভারতের জনগণ, ভারতকে একটি সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, সাধারণতন্ত্র রূপে গড়ে তুলতে সত্যনিষ্ঠার সঙ্গে শপথগ্রহণ করছি এবং তার সকল নাগরিক যাতে : সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ন্যায়বিচার; চিন্তা,মতপ্রকাশ, বিশ্বাস, ধর্ম এবং উপাসনার স্বাধীনতা; সামাজিক প্রতিষ্ঠা অর্জন ও সুযোগের সমতা প্রতিষ্ঠা করতে পারে এবং তাদের সকলের মধ্যে ব্যক্তি-সম্ভ্রম ও জাতীয় ঐক্য এবং সংহতি সুনিশ্চিত করে সৌভ্রাতৃত্ব গড়ে তুলতে; আমাদের গণপরিষদে, আজ,১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর, এতদ্দ্বারা এই সংবিধান গ্রহণ করছি, বিধিবদ্ধ করছি এবং নিজেদের অর্পণ করছি।

ফেসবুকে ইচ্ছামতীর বন্ধুরা