আর কেউ তাঁর চরিত্রের নাম দেবেন না হাঁদা-ভোঁদা, বাঁটুল, মুটকি-শুঁটকি, হাতিরাম পাতি, কেউ আর সুপারিনটেনডেন্ট স্যারের মতো রেগে গিয়ে বলবে না 'মর্কট, বেল্লিক, ছুঁচো' । আজকের পরিমার্জিত ভাষায় এসব শব্দ এখন শিশুসাহিত্যে হয়তো ব্রাত্য। আর সেজন্যই নারায়ণ দেবনাথকে নিয়ে লেখা খুব সোজা, আবার খুব কঠিনও। সোজা, কারণ একটু হাত বাড়ালেই তাঁর সম্পর্কে জানতে পারবে। তাঁকে নিয়ে লেখার উপকরণ সীমিত, বেশি ঘাঁটতে হয় না। মিতভাষী, অনাড়ম্বর, আটপৌরে, অত্যন্ত ডিসিপ্লিনড মানুষটি নিজের সম্পর্কে খুবই কম কথা বলতেন। তাঁর জীবন আমাদের অনেক কিছু শিক্ষা দেয়। যা রেখে গেছেন, তা লালমাটি প্রকাশন খুব যত্নে তিন খন্ডে 'নারায়ণ দেবনাথ সমগ্র' নাম দিয়ে প্রকাশ করে ফেলেছেন। নারায়ণ দেবনাথের বড় ভক্ত শান্তনু ঘোষ প্রচুর কষ্ট করে সংগ্রহ করেছেন নারায়নবাবুর দুর্লভ কাজগুলো। বইগুলো পড়লেই সেসব হাতের কাছে পাওয়া যায়। কিন্তু তাঁকে নিয়ে বলতে গেলে শুধু তাতেই তো হয় না! আর সেজন্যই নারায়ণবাবুকে নিয়ে লেখা এত কঠিন। কেন? কারণ চরিত্রগুলো সবার পরিচিত। এমন একটা মানুষ, যাঁকে নিয়ে সবারই কিছু বলার আছে। শেষ আধা-শতাব্দীর বেশি সময় ধরে বাঙালির শৈশবের খাসমহলে বাস করত হাঁদা-ভোঁদা, বাঁটুল দি গ্রেট আর নন্টে ফন্টেরা। ফলে তোমাদের কাছে তাঁর কথা বলতে গেলে আবেগ সরিয়ে নিরপেক্ষভাবে কথা বলাটাই দস্তুর। আবার তেমনি, আমাদের ছেলেবেলার কথা না বললেও তাঁকে আট থেকে আশি সবার ভালোবাসার কারণ বোঝানো যাবে না। মজার ব্যাপার, এখানে শুধু আমাদের ছেলেবেলা নয়, অনেক ছেলেবেলার কথা বলতে হয়। আমাদের ছেলেবেলার চেয়ে আবার আমাদের বাবা মায়েদের বা দাদু দিদাদের ছেলেবেলা ছিল অনেক আলাদা। যাঁরা নারায়ণবাবুর একদম প্রথমদিকের পাঠক তাঁরা তোমাদের দিদা-দাদুর বয়সী হবেন এখন। আর তোমরা হয়তো, পত্রিকাতেও তাঁর লেখা পড়ার সুযোগ পাওনি, অ্যানিমেশনে দেখেছ কমিকসগুলোকে। তাই চলো, গোড়া থেকেই শুরু করা যাক।
নারায়ণবাবুকে বুঝতে হলে আমাদের ফিরে যেতে হবে ওঁর শৈশবে। ১৯২৫ এ জন্মানো নারায়ণবাবু নিজের চোখে দেখেছেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কার কলকাতাকে। জাপানী বোমা পড়ার ভয়ে তখন তটস্থ থাকত কলকাতা। খুব ভালো সাঁতার কাটতে পারতেন ছোটবেলায়। বাবার সোনার দোকানে নক্সা আঁকা দিয়ে হাতে খড়ি। পরে আর্ট কলেজে যখন পড়ছেন, তখন বাবা মারা যাওয়ায় পাঁচ বছরের শিক্ষা চার বছরেই মুলতুবি দিয়ে কাজ খুঁজতে হয় তাঁকে। বিভিন্ন পত্রপত্রিকার প্রচ্ছদ, ভেতরের অলংকরণ, ধারাপাতের অক্ষর, হাতের লেখার বইয়ের অক্ষর এসব এঁকেছেন শুরুর দিকে। যেদিন বিয়ে হয় তাঁর, সেদিন খবর আসে ওইদিনই গান্ধীজিকে কেউ হত্যা করেছে। কলকাতা শহরে সেদিন আলো জ্বলেনি, যানবাহন চলেনি রাস্তায়। বিয়ের অতিথিদের পায়ে হেঁটে ফিরতে হয়েছিল।
তাঁর স্ত্রীর আত্মীয় হরিপদ চক্রবর্তী ছিলেন দেব সাহিত্য কুটিরের প্রুফরিডার। সেই সূত্রেই আলাপ হয় দেব সাহিত্য কুটিরের কর্ণধার সুবোধচন্দ্র মজুমদারের সাথে। এই আলাপ বদলে দেয় নারায়ণবাবুর জীবন। সুবোধবাবুর ভাই ক্ষীরোদচন্দ্র মজুমদার আর মধুসূদন মজুমদার তখন ছোটদের জন্য প্রকাশ করছেন 'শুকতারা' পত্রিকা। হঠাৎ বৈঠকি আড্ডায় একদিন ক্ষীরোদবাবু নারায়ণবাবুকে বলেন, ছোটদের জন্য তো বাংলায় কমিকস নেই, যদি নারায়ণবাবু ছোটদের জন্য কমিকস বানান।
ভাগ্যিস বলেছিলেন! ১৯৫১ সালে প্রথম বেরোয় 'ভোঁদার ভোজবাজি', পরের বছর এলো নতুন চরিত্র হাঁদা। গল্পের নাম 'হাঁদার এক্সপেরিমেন্ট'। ১৯৬২ তে 'শুকতারা'র পাতায় আলাদা আলাদা এই দুটি চরিত্র একসাথে মিলে জুটি তৈরি হল। হাঁদা ভোঁদাকে নিয়ে প্রথম গল্প কী ছিল, তা বলা কঠিন। দেব সাহিত্য কুটির থেকে প্রকাশিত 'হাঁদা ভোঁদা সমগ্র' জানাচ্ছে গল্পের নাম ছিল 'হাঁদা ভোঁদার ক্রিকেট ম্যাচ'। আবার, এবিপি আনন্দের প্রতিবেদন জানাচ্ছে, তার নাম ছিল 'হাঁদা ভোঁদার জয়', যার বিষয়বস্তু ছিল ইস্টবেঙ্গল মোহনবাগান ম্যাচ। অর্থাৎ প্রথম গল্পে যে খেলাকেন্দ্রিক কিছু ছিল, সেটা অনুমেয়। হাঁদার আসল নাম হাঁদারাম গড়গড়ি, ভোঁদার পুরো নাম ভোঁদারাম পাকড়াশি। পরে ধীরে ধীরে জানা গেল, তাদের আবার এক পিসেমশাইও আছে, তাঁর নাম বেচারাম বক্সী। প্রথম দিকে লিখতেন 'বোলতা' ছদ্মনামে, পরে কমিকস বিখ্যাত হলে ফিরে আসেন নিজের নামেই। অনেকের মতে, একজন ব্যক্তির বানানো বিশ্বের সবচেয়ে বেশিদিন ধরে চলা সক্রিয় কমিকস্ট্রিপ হল 'হাঁদাভোঁদার কান্ডকারখানা'ই।
১৯৬৫ তে আত্মপ্রকাশ করে 'বাঁটুল দি গ্রেট'। প্রথমদিকে সঙ্গে থাকত দুই ভাগ্নে ভজা আর গজা। পরে তারাই হয়ে যায়, দুই বিচ্ছু । কখনো তারাই গুন্ডা, যারা পথের কাঁটা 'বাঁটলো' কে সরানোর ষড়যন্ত্র করছে, কখনো তাদেরকেই বাঁচাতে উদ্যত বাঁটুল নিজে। কখনো কখনো দেখা যায় বাঁটুলের সহকারী লম্বকর্ণকে। তার প্রখর শ্রবণশক্তি। কিছু গল্পে আবার দেখা মেলে বাঁটুলের দুই পোষ্যর। পোষা কুকুর 'ভেদো' আর উটপাখি 'উটো'। জেনে খুশি হবে ষাটের দশকে ভারত পাকিস্তান যুদ্ধের সময় বাঁটুলও যুদ্ধে গিয়েছিল। একা হাতে শত্রুসেনার ট্যাঙ্ক-বিমানকে পরাভূত করেছিল সে। নারায়ণবাবুর নাকি ইচ্ছা ছিল বাঁটুলকে দিয়ে করোনাকেও হারাবেন। অবশ্য বাঁটুলের কাছে সেটাও মোটেই অসম্ভব ছিল না।
কী ভাবছ, সবাই আসছে, নন্টে ফন্টে কই? নন্টে ফন্টে আসে আরো একটু পরে। ১৯৬৯ সালে। 'কিশোর ভারতী' পত্রিকার সম্পাদক দীনেশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের অনুরোধে নারায়ণবাবু না করতে পারেন না। ১৯৬৯ থেকে ১৯৭১ অবধি নন্টে ফন্টে ছিল অনেকটা হাঁদা ভোঁদার মতোই। ১৯৭২ সাল থেকে শুরু হয় নন্টে ফন্টের হস্টেল জীবন। জন্ম নেয় নন্টে-ফন্টে-কেল্টুদা-সুপারিনটেনডেন্ট স্যারকে নিয়ে আজকের পরিচিত গল্পগুলো।
এবার আসি এমন বিষয়ে, যেটা নিয়ে প্রায় কাউকেই কিছু লিখতে দেখিনি। আচ্ছা, তোমাদের কখনো মনে হয়নি, হাঁদার চুলের ছাঁট ওরকম কেন? বা বাঁটুল ওরকম একটা অদ্ভুত গোলাপী স্যান্ডো গেঞ্জি পরে থাকে কেন? আমার তো ছোটবেলায় এদের গল্প পড়তে পড়তে এসব হামেশাই মনে হত! তখন উত্তর পাইনি, কিন্তু একটু ভাবলে হয়তো এখন উত্তর পেতে পারি। কিন্তু সেজন্য আবার একটু ইতিহাস ঘাঁটতে হবে। প্রথমে আসা যাক, হাঁদার চুলের স্টাইলে। সামনে উল্টানো ওরকম চুলের স্টাইল খুব বিখ্যাত হয়েছিল গতশতাব্দীর পঞ্চাশ আর ষাটের দশকে গায়ক এলভিস প্রেসলির দৌলতে। এতটাই তাঁর নামের সাথে ওই স্টাইল জড়িয়ে যায়, যে ওই চুল কাটার ধরণকে অনেকে 'এলভিস প্রেসলি কাট' বলত। বর্তমানে একে 'পম্পাদুর' (pompadour) নামে ডাকা হয়। দূরদর্শনের অনুষ্ঠানে এক সঞ্চালক নারায়ণ বাবুকে একবার জিজ্ঞেস করেছিলেন, আপনি সবসময় হাঁদাকে হারিয়ে ভোঁদাকে জেতান কেন? নারায়ণ বাবু বলেছিলেন, অতি চালাকের গলায় দড়ি, এটা বোঝাতে। ভোঁদার সাদাসিধে চুলের ছাঁটের তুলনায় হাঁদার বাহারি চুলের কেতা দিয়ে নারায়ণ বাবু হয়তো সেটারই ইঙ্গিত দিতে চেয়েছিলেন।
এবার বাঁটুলের স্যান্ডো গেঞ্জির ইতিহাস। ইউজেন স্যান্ডো ছিলেন প্রুশিয়ার বিখ্যাত ব্যায়ামবীর। ১৯০৫ সালে তিনি কলকাতায় আসেন। তাঁকে ঘিরে তখন হইহই ব্যাপার। তিনি শহরে ঘুরে ঘুরে বক্তৃতা দিচ্ছেন, আর বাঙালি ছেলেদের ব্যায়াম করতে উৎসাহ দিচ্ছেন। বলেছিলেন, খাদ্যাভাসের জন্য বাঙালির চেহারার উন্নতি হচ্ছে না। বাঙালি কুস্তিবীর গোবর গুহ নাকি তাঁকে দেখে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। মনে করে দেখো সুকুমার রায়ের 'নারদ নারদ' কবিতার সেই লাইন- 'আই ডোন্ট কেয়ার কানাকড়ি- জানিস আমি স্যান্ডো করি ?' ইউজেন স্যান্ডোর নাম এতই বিখ্যাত, যে তাঁর নামেই ব্যায়াম আর কুস্তির প্যাঁচ জানত লোকে। আর আমরা এখন যে স্যান্ডো গেঞ্জি দেখি, এর নামও তাঁর নাম থেকেই। শরীরের পেশী প্রদর্শন করতে তাঁর স্টাইলের এই গেঞ্জি তখন কুস্তিবীর-ব্যায়ামবীরেরা পড়ত। বাঁটুলেরও বিশাল চেহারা, তাই নারায়ণবাবুও যে বাঁটুলকে স্যান্ডো পরিয়ে রাখবেন তাতে আর আশ্চর্য কী!
একদিকে যেমন ছোটদের কমিক্সস্ট্রিপ আঁকতেন, অন্যদিকে তেমনি খুবই ভালোবাসতেন পাল্প ফিকশন পড়তে। বাড়ির কাছে ছিল এক সিনেমা হল, সেখানে যেতেন হলিউডের ছবি দেখতে। তখনকার জনপ্রিয় থ্রিলার লেখক স্বপনকুমারের প্রায় প্রত্যেকটা বইয়ের প্রচ্ছদ এঁকেছিলেন নারায়ণবাবু। এ ছাড়াও ছিল শশধর দত্তের মোহন সিরিজ। এসব গল্পের প্লটে প্রচুর ফাঁক থাকত। লেখক গল্পের কঠিন পরিস্থিতি থেকে নায়ককে উদ্ধার করতে প্রায়ই গোঁজামিল দিতেন 'কখন কেমন করিয়া কী ঘটিল বোঝা গেল না, শৃঙ্খলবদ্ধ মোহন মাঝসমুদ্রে ভাসিয়া উঠিল।' তোমরা বুদ্ধিমান, গোয়েন্দা গল্প পড়তে গিয়ে সূত্র খোঁজো, যুক্তিতে বিশ্বাস করো, তাই এসব আজগুবি গল্প হয়তো হাস্যকর লাগবে। কিন্তু তখন সাধারণ পাঠক সেসব নিয়ে বিশেষ মাথাই ঘামাত না। তাই এসব বইয়ের কাটতি ছিল সবচেয়ে বেশি। মানুষ গোগ্রাসে পড়ত এসব। পরে যদি কোনোদিন নারায়ণবাবুর তৈরি অন্যান্য চরিত্র - ডিটেকটিভ কৌশিক রায় বা ব্ল্যাক ডায়মন্ড ইন্দ্রজিৎ রায়ের কমিকস পড়ো, সেখানে এইসব পাল্প ফিকশনের ছায়া দেখতে পাবে।
'শুকতারা' আর 'কিশোরভারতী' ছাড়াও 'আসর', 'টগবগ' প্রমুখ অধুনালুপ্ত ছোটদের পত্রিকায় তাঁর লেখা আরো অজস্র চরিত্রের মধ্যে পটলচাঁদ দি ম্যাজিশিয়ান, বাহাদুর বেড়াল, হাসির অ্যাটম বোম, পেটুক মাষ্টার বটুকলাল, ডানপিটে খাঁদু আর তার কেমিক্যাল দাদু ইত্যাদি প্রচুর চরিত্র ছড়িয়ে আছে। এখানে আলাদা করে যে জুটির কথা আমাদের মনে রাখতে হবে তা হল শুঁটকি-মুটকি। দুই ডানপিটে বোনের কান্ডকারখানা। বাংলায় জুরান নাথের 'বিচ্চুর জাদুশক্তি' ছাড়া কেন্দ্রীয় চরিত্রে মেয়েদের রেখে এরকম কমিকস্ট্রিপ খুব কমই নজরে পড়ে। দুই বোন সব কাজেই খুব উদ্যোগী, কিন্তু তাদের আপাতনিরীহ কাজগুলোই বাবাকে সব গল্পের শেষে ফ্যাসাদে ফেলে। একটা গল্পে আবার তাদের কুকুর বুড়োর সাথেও আমাদের আলাপ হয়। দুর্ভাগ্যের বিষয় শুঁটকি-মুটকির নামে পত্রিকার দপ্তরে অভিযোগ করেন মায়েরা। কী অভিযোগ তা জানা যায় না। আন্দাজ করা যাতে পারে যে, দুষ্টু মেয়েদের গল্প সেই সময়ের সমাজ মেনে নিতে পারেনি! কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য, যে সেই অভিযোগের পর এ কমিকস বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেন কর্তৃপক্ষ।
যাইহোক, এবার আমার ছোটবেলার কথা বলি। তখন সবচেয়ে রঙচঙে ম্যাগাজিন ছিল 'আনন্দমেলা' । আমি ছেলেবেলায় ভাবতাম, নারায়ণ দেবনাথ কেন শুধু 'শুকতারা' আর 'কিশোর ভারতী'- তেই লেখেন, কেন তিনি 'আনন্দমেলা'-য় কমিকস লেখেন না? পরে জেনেছি, সে কথা ঠিক নয়। নারায়ণবাবু 'আনন্দমেলা'-তেও কাজ করেছেন। তবে সেসব একদম শুরুর দিকে। 'আনন্দমেলা' তখন আজকের মতো আলাদা করে প্রকাশ পেত না। 'আনন্দবাজার পত্রিকা'-এর সাথেই সপ্তাহে একদিন ছোটদের জন্য একটা পাতা থাকত, যার নাম ছিল 'আনন্দমেলা'। তোমাদের আগেই 'বোলতা'র সাথে আলাপ হয়েছে, এবার পরিচয় হবে 'মৌমাছি'র সাথে। তাঁর আসল নাম বিমল ঘোষ, যাঁর হাত ধরে হয়েছিল 'আনন্দমেলা'-র যাত্রা শুরু। ১৯৬১ সালে তাঁর অনুরোধে নারায়ণবাবু 'আনন্দমেলা'-র জন্য রবীন্দ্রনাথের জীবনের ছবি এঁকেছিলেন ধারাবাহিকভাবে। সেটা ছিল কবিগুরুর জন্মের একশ বছর। তখন 'রবিছবি' নামে প্রতি সোমবার ছোটদের জন্য একটা ধারাবাহিক বেরোত। ভাবো একবার! কলমে 'মৌমাছি', ছবিতে 'বোলতা'! তারপর ওই পত্রিকাতেই 'রাজার রাজা' নাম দিয়ে বেরিয়েছিল স্বামী বিবেকানন্দের জীবনী, সেখানেও পুরো কমিকস এঁকেছিলেন নারায়ণবাবু।
নারায়ণবাবু ছোটগল্প লিখেছিলেন দুটো। তার মধ্যে 'প্রজাপতির মৃত্যু' নারায়ণবাবু যে ধাঁচের কাজ করেন, তার চেয়ে একদম আলাদা। মনখারাপ করা একদম অন্যরকমের একটা লেখা। দুঃখের বিষয়, এত বড় জীবনে তাঁর কাজের স্বীকৃতি পেয়েছেন একদম জীবনসায়াহ্নে এসে। ২০১৩ সালে পান সাহিত্য একাডেমি পুরস্কার। ওই বছরই পান বঙ্গবিভূষণ সম্মান আর বিদ্যাসাগর পুরস্কার। ২০১৫ সালে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ব বিদ্যালয় সাম্মানিক ডি লিট প্রদান করেন। ২০২১ সালে পান 'পদ্মশ্রী' উপাধি। কিন্তু এসব আনুষ্ঠানিক সম্মান কি আর তাঁর মূল্যায়ন করতে পারে? একটা আত্মজীবনীমূলক লেখায় লিখেছিলেন নিজের ছোটবেলার কথা, শিল্পী জীবনের প্রথম দিকের কথা। জাদুকর পিসি সরকার জুনিয়রকে চেনো নিশ্চয়ই? তাঁর বাবা পিসি সরকার সিনিয়রের সাথে নারায়ণ বাবুর পরিচয় হয়েছিল সেই শুকতারার দপ্তরেই। নারায়ণবাবু যখন তাঁদের বাড়ি গিয়েছিলেন, তখন পিসি সরকার জুনিয়র অনেক ছোট। শুকতারার দপ্তরেই পরিচয় হয়েছিল রবীন্দ্রসংগীতের বিখ্যাত গায়িকা সুচিত্রা মিত্রের বাবা সাহিত্যিক সৌরীন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায় এর সাথে। দপ্তরের মাধ্যমেই সান্নিধ্য পেয়েছিলেন তারাশঙ্কর, প্রবোধ সান্যাল, অচিন্ত্য সেনগুপ্তদের মতো সেকালের বিখ্যাত সাহিত্যিকদের।
'মার্ভেল' বা 'ডিসি'র ছবি আঁকা, গল্প লেখা, প্লট তৈরি, চরিত্র চিত্রায়ন এসবের জন্য আলাদা আলাদা লেখক শিল্পীরা থাকেন। উল্টোদিকে আমাদের বাঙালির ছিলেন নারায়ণবাবু। একা হাতে বাঁটুলের মতো এসব কাজ তিনি একাই সামলেছেন। যখন প্রথম দূরদর্শন থেকে ঠিক হয় 'বাঁটুল দি গ্রেট' এর অ্যানিমেশন হবে, তখন তার ভার পড়েছিল গায়ক-কার্টুনিষ্ট উপল সেনগুপ্তর উপর। তিনি নারায়ণবাবুর কাছে জানতে গিয়েছিলেন বাঁটুলের গলার আওয়াজ কেমন হবে? কুস্তিবীর বলে কথা! ভারী গম্ভীর ব্যারিটোন গলার আওয়াজ? নাকি আর পাঁচজনের মতোই? নারায়ণবাবু দ্বিতীয়টাই বেছেছিলেন। সবাই এর কারণ দেখায়, বাঁটুলের মধ্যে ছেলেমানুষিও তো ছিল, তাই ওটাই জুতসই লেগেছিল ওনার। কিন্তু আমরা সবাই মনে মনে জানি- তিনি নিজেই আসল বাঁটুল দি গ্রেট। এত ভালোবাসার শক্তিতে বলীয়ান হয়েও যিনি নিজেকে কখনো কেউকেটা ভাবেননি। যে প্রকাশকের হাত ধরে তিনি কমিকসের যাত্রা শুরু করেছিলেন, শেষদিন অবধি তাঁর কমিকস সে পত্রিকাতেই প্রকাশ করে গেছেন। সবসময় তাঁর বাড়ির দরজা খোলা থাকত পাঠকদের জন্য। আমার বহু বন্ধু-পরিচিতরা গিয়ে দেখা করেছে তাঁর সঙ্গে। নিয়মিত তুলিকলম নিয়ে বসতেন কাজে, যতদিন তিনি পেরেছেন। স্মৃতিকথাতে তিনি লিখেছিলেন, 'আমার আগে শুকতারায় যেসব শিল্পীর কথা বলেছিলাম তাঁরা কেউ আর ইহজগতে নেই। তাঁদের অভাব আর পূরণ হবে না। আর আমার যে কয়জন বন্ধু ছিল তাদেরও বেশিরভাগই আর ইহজগতে নেই। আছে শুধু স্মৃতি আর স্মৃতি। আমিও এখন বয়স ভারাক্রান্ত, তবু ছোটদের ভালোবাসি বলে এখনও তাদের জন্য তুলিকলম ছাড়তে পারিনি।' গত ১৮ই জানুয়ারি তিনিও ইহজগত ছেড়ে পাড়ি দিলেন তাঁর 'দোস্ত' আর 'স্যাঙাৎ'দের সাথে দেখা করতে, রেখে গেলেন তাঁর অসংখ্য কমিকসস্ট্রিপ আর এইসব অনবদ্য চরিত্রদের। 'মার্ভেল' আর 'ডিসি'-এর পাশাপাশি একটু পরিচয় করতে পারো এইসব 'দিশি' চরিত্রগুলোর সাথে। এতগুলো বছর পেরিয়ে তারা আজও চিরনতুন হয়ে অপেক্ষা করছে তোমাদের সাথেই আলাপ করবে বলে।
প্রতিকৃতিঃ পার্থ মুখার্জি
আমাদের প্রিয় চরিত্রগুলির ছবি নেওয়া হয়েছে বিভিন্ন ওয়েবসাইট থেকে