আপাদমস্তক এক রঙিন মানুষের কথা বলব আজ। তিনি হলেন বহুমুখী প্রতিভাধর শিল্পী 'অবন ঠাকুর'। যাঁর পোশাকী নাম অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর। এবছর তাঁর জন্মের দেড়শো বছর পূর্ণ হল।
১৮৭১ খ্রিস্টাব্দের ৭ই অগাস্ট জোড়াসাঁকোর বিখ্যাত ঠাকুর পরিবারে জন্ম হয়েছিল অবনীন্দ্রনাথের। তিনি ছিলেন মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাইপো গুণেন্দ্রনাথের ছোট ছেলে। তাঁর মা হলেন সৌদামিনী দেবী। দাদা গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুরও ছিলেন অসাধারণ চিত্রশিল্পী। আর তাঁর কাকা হলেন গিয়ে আমাদের বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ।
প্রথম পরিচ্ছেদ
চিত্রশিল্পী অবনীন্দ্রনাথ ছোট থেকেই চারপাশে ছড়িয়ে থাকা প্রকৃতির রূপ রং কে নিংড়ে নিয়ে সাজিয়ে দিতেন নিজের ক্যানভাসে। অনেক বড় বড় আঁকিয়েই তো জন্মেছেন আমাদের দেশে, কিন্তু অবনীন্দ্রনাথের কী বিশেষত্ব ছিল জানো? তিনি ছবি আঁকার এমন সব ধারা বা স্টাইল তৈরি করেছিলেন যা আগে কেউ করেননি। বারবার আঁকার ধারাও বদলিয়ে বদলিয়ে গেছেন। নিজের কাজ নিয়ে পরীক্ষানিরীক্ষা করে গেছেন আজীবন। প্রথমদিকে তাঁর ছবির বিষয় সাধারণত ভারতীয় পুরাণ হলেও, সে সব ছবি তখনকার দিনের প্রথা অনুযায়ী ইউরোপিয়ান রীতিতেই আঁকতে শিখেছিলেন অবনীন্দ্রনাথ। কিন্তু পরে তাঁর মন বড় খুঁতখুঁত করেছিল। শ্রীরাধা কে নিয়ে পাশ্চাত্য রীতিতে নিজের আঁকা ছবি 'শুক্লাভিসার' দেখে অবনীন্দ্রনাথের মনে হয়েছিল এ যেন কোনো ভারতীয় নারীই নয়, কোনো মেমসাহেবের গায়ে শাড়ি জড়ানো হয়েছে। এই রাধার ভাব ভঙ্গি সবই যেন বিদেশি। তখনই ঠিক করলেন- এভাবে নয়; এমন ভাবে ছবি আঁকতে হবে যা হয়ে উঠবে খাঁটি ভারতীয় জিনিস। নিজেকে ছাপিয়ে যেতে চেয়ে তিনি আঁকার ক্ষেত্রে 'ভারতীয় রীতিনীতি' -কে আবার করে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করলেন। এই রীতিতে প্রথম দিকের আঁকা তাঁর ছবিগুলো ছিল 'কৃষ্ণলীলা' নিয়ে। তাঁর বিখ্যাত 'ভারতমাতা' ছবিটি দেখে ভগিনী নিবেদিতাও স্বীকার করেছিলেন যে এটির 'আকার -প্রকার-আদর্শ' সবই একেবারে খাঁটি ভারতীয়। কিন্তু সেখানেই থেমে থাকেননি শিল্পী। জাপানি রীতিতেও আঁকা শুরু করলেন। যার সবচেয়ে বড় উদাহরণ তাঁর অঙ্কিত 'ওমর খৈয়াম'। মুঘল যুগের ইতিহাস নিয়ে তাঁর এক একটি অনবদ্য সৃষ্টি রয়েছে। মিনিয়েচার ধারায় আঁকা 'শাহজাহানের মৃত্যু' ছবিটি অন্যান্যদের সঙ্গে সঙ্গে তাঁর নিজেরও খুব পছন্দের ছিল।
অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আঁকা ছবিঃ বাঁ দিক থেকেঃ শাহজাহানের মৃত্যু, ভারত মাতা, ওমর খৈয়াম
দেশ-বিদেশের মানুষকে দেখাবার জন্য কেবল নানা রীতিতে ছবি আঁকাই নয় আমাদের বাংলায় যে নানা রকমের পুজো-আর্চা বা ব্রত পালন হয়, সেই সব উদযাপনে মেয়েরা যে আলপনা দিয়ে থাকে তা নিয়েও ভেবেছেন অবনীন্দ্রনাথ। আলাদা আলাদা ব্রত পালনের জন্য যে নির্দিষ্ট আলপনা থাকে, সেই আলপনার পেছনে যে মানুষের কত কামনা বাসনা স্বপ্ন জড়িত থাকে তা আমরা আগে এত বিশদে জানতাম না। এইসব আলপনায় আঁকা পদ্ম লতাপাতা পশুপাখি গাছগাছালি নদীরও যে আবার কত রকমের ভাগ হয় তা নিয়েও কাজ করেছেন উনি। মেয়েলি ব্রতের অঙ্গ বলে উঁচুদরের শিল্পের মর্যাদা না পাওয়া এইসব অপরূপ আলপনাকে অবনীন্দ্রনাথ অচ্ছুৎ করে রাখেননি। এই সব নিয়ে রীতিমত গবেষণা করে দুনিয়াকে এর ঐতিহ্য বা গুরুত্ব জানিয়েছেন বলেই আজ আমাদের সমাজে 'আলপনা' আলাদা মর্যাদা পেয়েছে। ওঁর লেখা 'বাংলার ব্রত' বইটি পড়লে আমরা এই বিষয়ে ভাল করে জানতে পারি।
ছবি আঁকার স্টাইলের ক্ষেত্রে এক এক সময়ে যেমন এক এক পথে হেঁটেছেন তিনি, তেমনি মিডিয়াম হিসেবেও এক এক বার এক এক রকম জিনিসকে বেছে নিয়েছেন। কাগজ, কাপড়, কাঠ, পাথর, তালের আঁটি, বাতিল হয়ে যাওয়া নানা রকম জিনিস- এ সবকিছুই তিনি ব্যবহার করেছেন নিজের শিল্পীসত্তাকে ফুটিয়ে তুলতে। এই ভাবেই তিনি সৃষ্টি করলেন 'কুটুম কাটাম'। সে ভারি মজার জিনিস। কাঠ পাথর যাই হোক না কেন তার বাড়তি অংশ কেটে দিয়ে কোনো একটা মূর্তির রূপ দেওয়া হত। কোনো গাছের গুঁড়ি বা ডাল অথবা বাঁশের গাঁট দেখলে যদি অবনীন্দ্রনাথের মনে হত এটা কোনো জন্তুর বা পাখির মুখ অথবা মানুষের অবয়ব, তাহলে তিনি সেগুলোর অতিরিক্ত ডালপালা ছেঁটে অন্য কোনো কিছুর ওপর বসিয়ে সাজিয়ে দিতেন। এই 'কুটুম কাটাম' -এ কিন্তু খোদাই করা চলত না। শোনা যায় একবার তাঁর স্ত্রীর হাত থেকে পড়ে গিয়ে একটা শ্বেতপাথরের রেকাব ভেঙে গেলে অবনীন্দ্রনাথ সেই ভাঙা টুকরোগুলো থেকেই ছেনি-র সাহায্যে এক অপরূপ নারী মূর্তি বার করে এনেছিলেন। এ থেকেই নিশ্চই বুঝতে পারছ কী অসম্ভব ধারালো শিল্পীমন ছিল তাঁর? যে কোনো জিনিস থেকে অন্য আরেকটি জিনিসের রূপ ফুটিয়ে তোলা তো আর চারটি খানি কথা নয়!
জানো, উনি বিশ্বাস করতেন শিশুদের মনের মধ্যে শিল্পের প্রতি ভালবাসা জাগাতে হয় নইলে কোনো শিল্পের সাধনা কিছুতেই সম্পূর্ণ হয় না। আর এই বিশ্বাস থেকেই এসব সহজ উপকরণ দিয়ে শিশুদের কল্পনাকে জাগিয়ে তোলার চেষ্টাই ছিল 'কুটুম কাটাম'।
তাঁকে আমরা চিরকাল মনে রাখব কেবল চিত্রশিল্পী হিসেবে নয় চিত্রকলার নতুন ধারা বা স্টাইলের প্রবর্তক ও একজন প্রকৃত শিল্পগুরু হিসেবেও। তাঁর হাতে গড়া ছাত্ররা অনেকেই জগদ্বিখ্যাত। এঁদের মধ্যে নন্দলাল বসুর নাম আমরা সবাই জানি।
১৮৯৬ সালে কলকাতা আর্ট স্কুলের সহকারী অধ্যক্ষ করা হয় অবনীন্দ্রনাথকে। তখন তো ব্রিটিশ আমল তাই সমস্ত বড় বড় পদে একমাত্র ব্রিটিশরাই বসতেন। কোনো ভারতীয় কে সেই মর্যাদা দেওয়া হত না। তিনিই প্রথম ভারতীয়দের মধ্যে এই সম্মান পেয়েছিলেন। ১৯১১ সালে রাজা পঞ্চম জর্জ ও রানি মেরি যখন ভারতে এলেন, তাঁদের আর্ট গ্যালারির 'ওরিয়েন্টাল আর্ট' সম্পর্কে বোঝাবার দায়িত্বও পান অবনীন্দ্রনাথ। ভাবো তো কী গর্বের কথা! কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ১৯২১ সালে তাঁকে ডি.লিট. দেন। ১৯৪১ থেকে ১৯৪৫ পর্যন্ত শান্তিনিকেতনে বিশ্বভারতী-র আচার্যের দায়িত্বও পালন করেন অবনীন্দ্রনাথ।
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
গল্প শুনতে আমরা কে না ভালবাসি বলো? কিন্তু খুব কম মানুষই আছেন যাঁদের গল্প বলা আমাদের মনে ধরে। চিত্রশিল্পী অবনীন্দ্রনাথ ছিলেন এমনই এক মুগ্ধ করা কথক ঠাকুরও। তাঁর গল্প বলা চলত যেমন ক্যানভাসে, তেমন ছবি আঁকা চলত শব্দের মধ্যে দিয়ে কাহিনির পথ ধরে। তাই তো বলা হয় 'ওবিন ঠাকুর- ছবি লেখে' । সেই ছবি রং তুলি দিয়ে হোক, হাতুড়ি ছেনি দিয়ে হোক, কি কালি-কলম-অক্ষর দিয়েই হোক। তাঁর লেখা কাহিনিগুলো পড়লে আমরা ছবির মতই দেখতে পাই। মহৎ সৃষ্টির আর মহান শিল্পীর তো কোনো সীমারেখা থাকে না, অবনীন্দ্রনাথের সৃষ্টিরও তেমন কোনো সীমাবদ্ধতা ছিল না। তাঁর কল্পনার উড়ান নিজের রং ছড়িয়ে ছবি এঁকে বেড়াত সর্বত্র। 'চেনাশোনার কোন বাইরে যেখানে পথ নাই নাই রে' ভেবে যখন সবাই থেমে যায়, ঠিক সেখান থেকেই তাঁর সৃষ্টিশীলতার শুরু হয়। তাঁর লেখা গল্পগুলোতেও তাই মিলেমিশে আছে এক ধরণের সারল্য আর বাক্স বাক্স কল্পনার রং। রং-তুলি-অক্ষর দিয়ে এক অপরূপ জগতের সঙ্গে আমাদের পরিচয় করিয়ে গেছেন তিনি। ওঁর লেখা ছোটদের বইগুলো যদি পড়ো তো দেখবে যেন জাদুর ভাণ্ডার!! ছোটদের জন্য লেখা কিন্তু অত সহজ নয়। তোমাদের মন জয় করা খুব শক্ত, তাই না? শক্তিশালী লেখক ছাড়া কেউ তা পারেন না। কিন্তু আমাদের অবনীন্দ্রনাথ পেরেছিলেন। শিশু-কিশোরদের জন্য লেখা তাঁর গল্পগুলো পড়লে শুধু ছোটদের নয় বড় হয়ে যাওয়া শরীরের আড়ালে থাকা কচি মনের মানুষগুলোর প্রাণও জুড়িয়ে যায়। ছোটদের জন্য তাঁর লেখা 'শকুন্তলা', 'ক্ষীরের পুতুল', 'রাজকাহিনী', 'ভূতপত্রীর দেশে', 'নালক', 'বুড়ো আংলা', 'আলোর ফুলকি' ইত্যাদি পড়ে মুগ্ধ হয় না এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া ভার।
রবীন্দ্রনাথের অনুরোধেই অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুুর শিশুদের জন্য লেখালেখি শুরু করেন।
প্রথমে মহাকবি কালিদাসের বিখ্যাত নাটক ‘শকুন্তলা’র কাহিনিকে বেছে নিয়ে ছোটদের জন্য নতুন ভাবে লেখেন তিনি। এক চিরকালীন রূপকথা 'শকুন্তলা’ তাঁর কলমের জাদুতে, ভাষা আর বর্ণনার সহজ সরল রূপে, অপূর্ব সব ছবিতে সম্পূর্ণ নতুন হয়ে দেখা দেয়।
এক রাজার দুই রানি- দুয়োরানি আর সুয়োরানির চিরপরিচিত রূপকথার গল্প হল 'ক্ষীরের পুতুল'। প্রথমে দুয়োরানির দুঃখের জীবন ও সুয়োরানির সুখের, আর গল্পের শেষে গিয়ে বাঁদর ছানার বুদ্ধির জোরে দুয়োরানির সব কিছু ফিরে পাওয়া। কিন্তু এই চেনা গল্পকেই যে ভাষায় অবনীন্দ্রনাথ বর্ণনা করেছেন তা যেন আমাদের কানে নূপুরের মত বাজে। কল্পনার ডানায় ভর করে আমরাও খুব সহজেই সেই রূপকথার জগতে চলে যাই। রাজা-রানিদের সঙ্গেই থাকি, তাদের সঙ্গে ঘুরে বেড়াই, তাদের সাজে সাজি। এমন মুগ্ধতা তৈরি হয় যে সে জগৎ থেকে বের হতে ইচ্ছে করে না। বড় হয়ে গিয়েও এই গল্পের রেশ রয়ে যায়। রূপকথা আর ছড়ার মিশেলে নির্মিত এক অনবদ্য কাহিনি এই 'ক্ষীরের পুতুল'। এ গল্পে ছড়াগুলো আলাদা করে ছড়া হিসেবে নয় আছে গল্পেরই চরিত্র হয়ে। যেমন এক জায়গায় আছে ষষ্ঠী ঠাকরুন সারাদিন কিছু খেতে না পেয়ে অবশেষে ক্ষীরের পুতুল দেখে লোভ সামলাতে না পেরে চুরি করে তা খেতে যান। কিন্তু কেউ যদি তাঁকে চুরি করতে দেখে ফেলে তাহলে তো লজ্জার শেষ থাকবে না, তাই তিনি দিনের বেলাতেই সবাইকে ঘুম পাড়াতে চেয়ে ডেকে পাঠালেন 'ঘুমপাড়ানি মাসি পিসি' কে। সেই মাসি-পিসি তখন সবে রাজ্যের ছেলেমেয়েদের ঘুম পাড়িয়ে নিজেরাও একটু ঘুমোতে গেছেন কিন্তু সেই সময়ই ষষ্ঠী ঠাকরুন তাঁদের ডেকে পাঠালেন। এই জায়গাটা পড়তে গিয়ে আমাদের মনে পড়ে যায় সেই ছোটবেলায় মায়ের মুখে শোনা 'ঘুমপাড়ানি মাসি পিসি ঘুম দিয়ে যা' ছড়াটা, তাই না?
আবার বাঁদরছানা যখন দিব্য চক্ষুতে দুয়োরানি-র জন্য নানা দেশে ছেলে খুঁজে বেড়াচ্ছে, সেই সময়ে যখন অবনীন্দ্রনাথ লেখেন এক দেশে '...চিকচিকে জলের ধারে ঝুুরঝুরে বালির চরে শিব ঠাকুর এসে নৌকা বাঁধলেন, তার সঙ্গে তিন কন্যে। এক কন্যে রাঁধলেন বাড়লেন, এক কন্যে খেলেন আর এক কন্যে না খেয়ে বাপের বাড়ি গেলেন।...'- তখন
'বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর নদেয় এল বান
শিব ঠাকুরের বিয়ে হল তিন কন্যে দান' - ছড়াটাকে যেন চোখের সামনে দেখতে পাই। আমাদের অতি পরিচিত মা-ঠাকুমার মুখে শোনা ছড়ার ভাণ্ডার এখানে গল্পের চরিত্র হয়ে উঠেছে।
অবনীন্দ্রনাথের আর একটা গুরুত্বপূর্ণ রচনা হল ’রাজকাহিনী’। তোমরা অনেকেই হয়তো এর কিছু গল্প পড়েছ স্কুলের পাঠ্য বইতে।
তাই হয়তো জানো এই রচনাটিতে মোট ন’টি গল্প আছে।
রাজস্থানের ইতিহাসের ওপর ভিত্তি করে লেখা হলেও এখানে এমন অনেক ঘটনা ও চরিত্র আছে যা লেখকের কল্পনা দিয়ে গড়া। এই রচনাটির ন'টি গল্প হল- 'শিলাদিত্য', 'গোহ', 'বাপ্পাদিত্য', 'পদ্মিনী', 'হাম্বির', 'হাম্বিরের রাজ্যলাভ', 'চণ্ড', 'রানা কুম্ভ' ও 'সংগ্রামসিংহ' । অবনীন্দ্রনাথের মোহময় বর্ণনায় এইসব ঐতিহাসিক রাজা রানি রাজপুত্রদের শৌর্য, আত্মবলিদান, আনন্দ, প্রেম, স্বপ্ন, দুঃখের কথা পড়তে গিয়ে রোমাঞ্চে যেমন গায়ে কাঁটা দেয় তেমনি কষ্টে আমাদের বুক ফেটে যায়।
'ভূতপত্রীর দেশে’ ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয়। এই রচনায় ছোটদের কাছে অবনীন্দ্রনাথ মেলে ধরলেন বাস্তব-অবাস্তব, ইতিহাস ও বর্তমানের এক অপরূপ আজগুবি জগৎ কে। অবনীন্দ্রনাথ তাঁর ফ্যান্টাসি রচনার আশ্চর্য প্রতিভা দেখিয়েছেন এখানে। ছোট ছেলে অবু পাল্কি চড়ে সহচর হারুন্দে আর কিচকিন্দে কে নিয়ে চলেছে। আর তারা গল্প শোনাচ্ছে তাকে। চিতাবাড়ি, ধাঁই কিড়ি, ঘোড়া-ভূতের সেই গল্পের জগতে কল্পনার রং ছড়ানো। স্থান-কাল-পাত্র উল্টেপাল্টে উদ্ভট সব ঘটনা ঘটে সেখানে। শেষে অবু এক লক্ষ্মীপেঁচাকে সঙ্গে নিয়ে মায়ের কাছে ফিরে আসে। এই কাহিনিতে আমরা এক অনন্য অবনীন্দ্রনাথকে পাই।
’নালক’ ১৯১৬ তে লিখেছিলেন। এটি গৌতম বুদ্ধের গল্প। কিন্তু এ কাহিনি কেবল বুদ্ধের জীবনী নয়। এতে আছে সুদূরের ডাক শুনতে পেয়ে শিশুর ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়ার তীব্র ইচ্ছের কথা। অজানাকে জানার প্রচণ্ড কৌতূহল নিয়ে নিজের মা-কে ছেড়ে বেরিয়ে পড়ে এক ছোট ছেলে নালক।
বাইরের জীবনে গিয়ে দেবল নামে এক ঋষির কাছে ছিল নালক। নালক ঋষির সেবা করত। একদিন রাতের অন্ধকারে সমস্ত আলো মিশিয়ে এক অপূর্ব অলৌকিক আলো ফুটলো। সেই আলো দেখে সন্ন্যাসী বুঝতে পারলেন কপিলাবস্তুতে গৌতম বুদ্ধের জন্ম হবে। নালককে তিনি বললেন তিনি সেখানে চলে যাচ্ছেন।
নালক একলা বসে রইল। ধ্যানে চোখ বন্ধ করে সে একের পর এক বুদ্ধের সারা জীবনের ছবি দেখতে পেল। গৌতম বুদ্ধকে স্বচক্ষে দেখার জন্য নালকের মনও আকুলি-বিকুলি করল। পুরো গল্পতে নালকের গৌতম বুদ্ধকে একটিবার দেখার ইচ্ছেই ছড়িয়ে রয়েছে।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত নালক বুদ্ধদেব নয় নিজের মা-কে দেখতে চেয়ে তাঁর কাছেই ফিরে যায়।
'বুড়ো আংলা' উপন্যাসে দেখি, খুব দুষ্টু এক ছেলের গল্প। তার নাম 'রিদয়', মানে হৃদয়। এদিকে সে কিন্তু ছিল একেবারে হৃদয়হীন। তার অত্যাচারে অতিষ্ঠ ছিল চারপাশের সব মানুষ আর প্রাণী। একদিন হল কী, গণেশ ঠাকুর তাঁর বাহন ইঁদুরকে বিরক্ত করার জন্য ভীষণ রেগে গিয়ে রিদয় কে অভিশাপ দিলেন যে সে বুড়ো আঙুলের মত ছোট্ট হয়ে যাবে। আর হলও তাই। হাঁস-সারসের মানুষ সহযাত্রী বুড়ো আঙলা 'রিদয়' ঘুরে বেড়াতে লাগল চারিদিকে। বাংলাদেশসহ ভারতের উত্তর-পূর্ব অঞ্চলের বিভিন্ন স্থানের বিবরণ আছে এই গল্প জুড়ে। তারপর কী হল? তার জন্য তো তোমায় পড়তে হবে মজাদার এই উপন্যাস 'বুড়ো আংলা'। কথাশিল্পী অবনীন্দ্রনাথের তুলি নিখুঁতভাবে তৈরি করেছে এই অসাধারণ কাহিনিটি।
'আলোর ফুলকি' লেখাটা যদিও পুরোপুরি ছোটদের জন্য নয় তবু সে লেখা ছোটরা পড়লে বেশ মজা পাবে। একটা মোরগকে কেন্দ্র করে বিচিত্র প্রকৃতিকে তুলে ধরেছেন তিনি। মোরগরা যে সুরে "কোঁকর কোঁ.." করে ডাকে, ঠিক সেই রকম করে "আলোর ফুল, আলোর ফুল, ফু-উ-উ-উল-কি-ই-ই...." বলে ডেকে রোজ আলোর জয়গান গেয়ে পাহাড়তলীর সব জায়গায় আলো ছড়িয়ে দেয় একটি মোরগ বা কুঁকড়ো। কুঁকড়োর সঙ্গে সঙ্গে আরো অনেক মুরগি, পায়রা, চড়াই, কুকুর, পেঁচা ও বনের অন্যান্য প্রাণীদের নিয়ে গল্প এই 'আলোর ফুলকি'। স্বার্থপরতা, হিংসে, বন্ধুত্ব, প্রেম সবকিছুকে এই গল্পে তিনি এমনভাবে দেখিয়েছেন যে পড়তে আমাদের সকলেরই আরাম লাগে। বিভিন্ন জাতের মুরগির চেহারা ও স্বভাব অনুযায়ী নাম, ষড়যন্ত্রকারী প্যাঁচাদের বর্ণনা, আদুরে সোনালিয়া মুরগির রূপের গুমোর, কুঁকড়োর প্রতি তার ভালোবাসা ও অধিকার-বোধ, পাহাড়ি কুত্তানি জিম্মার তেজ ও বিশ্বস্ততা, মিচকে চড়াই পাখির কথাবার্তা, চিনা মুরগি দিদির হাবভাব ও তার পার্টির নেশা , কিংবা বনে থাকাকালীন কুঁকড়োর নীল ধুতরো আর সাদা ধুতরো ফুল দিয়ে চড়াই পাখিকে 'ফোঁ' বা ফোন করার দৃশ্যে আমরা হেসে বাঁচিনা। আবার বিশ্বাসঘাতকতা আর হিংসের কারণে কুঁকড়োর শরীরে মনে যে আঘাত লাগে তা পড়ে ছোট বড় সবার মনই ভার হয়ে যায়। গল্প তো নয় যেন চোখের সামনে একটার পর একটা দৃশ্য ভেসে ওঠে।
শুধু ছোটদের জন্যই নয় বড়দের জন্যেও অনেক লেখাই লিখে গেছেন অবনীন্দ্রনাথ। তাঁর প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা প্রায় ছাব্বিশ। গল্প, কবিতা, চিঠিপত্র, শিল্প-আলোচনা, যাত্রাপালা, পুঁথি, স্মৃতিকথা সব মিলিয়ে প্রকাশিত রচনার সংখ্যাও প্রায় তিনশো সত্তরটি।
কিন্তু এ তো গেল কেবল কিছু তথ্য মাত্র। এই সব দিয়ে তো আর অবনীন্দ্রনাথের আসল সৃষ্টিকে চেনা যায় না। তাঁর দেড়শো বছরের জন্মদিন উপলক্ষ্যে তাঁকে সত্যিকারের শ্রদ্ধা জানানো হবে তখনই যখন তুমি, আমি, আমরা সবাই তাঁর রচনাগুলো পড়ব, তাঁর আঁকা ছবিগুলো দেখব। আর তখনই তো অনুভব করতে পারব যে কী অসাধারণ এক প্রতিভাকে আমরা পেয়েছিলাম আমাদের মধ্যে। যাঁর সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথও নিজে বলে গিয়েছিলেন-
“আমার জীবনের প্রান্তভাগে যখন মনে করি সমস্ত দেশের হয়ে কাকে বিশেষ সম্মান দেওয়া যেতে পারে তখন সর্বাগ্রে মনে পড়ে অবনীন্দ্রনাথের নাম।"
প্রতিকৃতিঃ পার্থ মুখার্জি
অন্যান্য ছবিঃ ইন্টারনেট
গ্রাফিকঃ মিতিল