কিছুদিন আগেই গেল রথযাত্রা। রথের দিন তো আমরা সবাই রথ সাজাই, বিকেলবেলা ছোটরা সেই রথ টানতে বেরোয়, সকলকে দেব-দর্শন করিয়ে প্রসাদ দিয়ে কিছু প্রণামী পায়। এসবে নিশ্চই তোমার খুব আনন্দ হয়? আচ্ছা, এই রথের মতনই ঝুলনযাত্রাও কি পালন করো তুমি? ঝুলন সাজাও? আমাদের ছোটবেলায় কিন্তু ঝুলন সাজানোর খুব চল ছিল। এটা আবার চলত প্রায় চার পাঁচ দিন ধরে, একেবারে পূর্ণিমায় গিয়ে শেষ হত। ফলে আরও বেশী আনন্দ। এখন আর এই উৎসব অতটা পালিত হয় কি না জানিনা। এই দিনটা নিয়ে আমাদের উত্তেজনার শেষ থাকত না।
বারো মাসে তেরো পার্বণের আমাদের এই দেশে এই ঝুলনও একটা পার্বণ। বর্ষাকালে এই উৎসব হয়। রাধা ও তাঁর সখীদের নিয়ে শ্রীকৃষ্ণ এই শ্রাবণ মাসেই দোলনায় বা 'ঝুলনে' দুলেছিলেন। সেই লীলা ও পৌরাণিক কাহিনী মনে রেখেই ভক্তরা রাধাকৃষ্ণের মূর্তিকে দোলনায় বসিয়ে পুজো করেন এই ঝুলনে। শ্রাবণ মাসের অমাবস্যার পরের একাদশী থেকে আরম্ভ করে শ্রাবণী পূর্ণিমা পর্যন্ত প্রায় পাঁচ দিন এই উৎসব চলে। শ্রাবণী পূর্ণিমা বা ঝুলন পূর্ণিমার দিন আবার রাখী পূর্ণিমাও হয়। দোলনা সাজানো, সেই দোলনায় রাধাকৃষ্ণকে বসিয়ে পূর্ব থেকে পশ্চিম দিকে দোলানো- এটাই হল 'ঝুলন'। এই যে রাধাকৃষ্ণের দোলনাকে পূর্ব থেকে পশ্চিম দিকে দোলানো হচ্ছে- এর মধ্য দিয়ে না আসলে সূর্যের উদয়-অস্ত কে বোঝানো হয়। সূর্যই তো পৃথিবীর সব ধরনের শক্তির উৎস আর রাধাকৃষ্ণ হলেন গিয়ে ভক্ত আর ভগবানের প্রতিনিধি তাই রাধাকৃষ্ণের মূর্তিকে পূর্ব-পশ্চিমে দোলানোর মধ্যে দিয়ে আসলে আমরা প্রকৃতির লীলাকে তার শক্তিকে শ্রদ্ধা জানিয়ে থাকি।
কৃষ্ণ ভক্তরা এই সময় রাধা-কৃষ্ণকে দোলনায় দোলানো ছাড়াও নানা রকম ভক্তিগীতি গেয়ে বা ঠাকুরের সামনে নেচে রাধাকৃষ্ণের প্রতি নিজেদের শ্রদ্ধা জানিয়ে থাকেন। বিশেষ করে উত্তর ভারতের বৃন্দাবন মথুরায় এই উৎসব ধুম করে পালন করা হয়। আমাদের পশ্চিমবঙ্গেও নবদ্বীপে, মায়াপুরে, কলকাতার ইস্কন মন্দিরে এবং বিভিন্ন বনেদি বাড়িতেও ঘটা করে ঝুলন উৎসব হয়।
সে তো গেল বড় করে উৎসব পালনের কথা। এই ঝুলনের সব থেকে মজার দিক হল প্রত্যেক ঘরে ঘরে ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের ঝুলন সাজানো। সে যে কী আনন্দের কী বলব! প্রত্যেক বছর এই দিনটা পালন করবার জন্য সারা বছর ধরে আমাদের নানা রকম প্ল্যানিং চলত। আগেরবার যে ভাবে সাজিয়েছি পরেরবার তার থেকে আলাদা কিছু করতে হবে কিংবা এবারে আমাকে আমার বন্ধুর থেকেও বেশী ভালো করে ঝুলন সাজাতে হবে- এই ভাবনা নিয়েই আমাদের দিন কাটত।
আমার মায়ের কাছেও শুনেছি তাঁর ছোটবেলার ঝুলন সাজানো নিয়ে নানা গল্প। আমি কলকাতা শহরে মানুষ তাই আমার ছোটবেলায় কলকাতাতে এই ঝুলন নিয়ে খুব বেশী মাতামাতি দেখিনি কিন্তু আমার মামার বাড়ি হুগলিতে ঘরে ঘরে সবাই ঝুলন সাজাতো।
বন্ধুদের মধ্যে, ভাই-বোনেদের মধ্যে মনে মনে চাপা প্রতিযোগিতার ভেতর দিয়ে উঠে আসত ছোট ছোট ছেলে মেয়েদের কত সৃষ্টিশীলতা। হ্যাঁ, ঝুলন সাজানোর পেছনে বড়দের চিন্তাভাবনা থাকত ঠিকই কিন্তু তাঁদের তত্ত্বাবধানে ছোটরাই কিন্তু পুরো ব্যাপারটা সাজিয়ে তুলত। যাদের বাড়িতে যতটুকু জায়গা সেই জায়গাটুকুকেই প্রত্যেকে নিজের নিজের মত করে সাজাতো। পাহাড় নদী গ্রাম জঙ্গল পুকুর- যে যা পারত তাই বানাতো। কেউ কাপড়ে রং তুলি দিয়ে পাহাড় ঝরনা এঁকে সেটাকে টাঙিয়ে দিয়ে তার সামনে বালি বা সিমেন্ট দিয়ে দু-ধার উঁচু করে পাড়ের মত বানিয়ে মাঝখানে জল ঢেলে নদী তৈরী করত। কেউ ঘাস সমেত চাক চাক মাটি কেটে এনে সেগুলো বসিয়ে দিত যাতে দেখলে মনে হয় জঙ্গল। যে যত বড় ঘাস পাবে তার তত বেশী গর্ব। অনেকে আবার নিজের যা যা খেলনাপাতি আছে সেইগুলোকেই সুন্দর করে সাজিয়ে কোনো নতুন থিম তৈরী করে ফেলত। সেই থিমে কখনো শহরের রাস্তায় গাড়ি চলছে, কখনো গ্রামের পুকুরে হাঁস সাঁতার কাটছে, কখনো জঙ্গলে জন্তু-জানোয়ার ঘুরে বেড়াচ্ছে, কখনো নদীতে নৌকো বইছে। কেউ কেউ নিজেরাই মাটি দিয়ে মানুষ জন্তু-জানোয়ার গাছ ফুল প্রদীপ প্রভৃতি গড়ে সেগুলো বাড়ির উনুনে পুড়িয়ে টেরাকোটার পুতুল বানিয়ে তা দিয়েও সাজাতো। এরই মাঝখানে ছোট্ট একটা দোলনা করে তাতে রাধা ও কৃষ্ণের মূর্তি বসিয়ে দোলানো হত। কারুর কারুর কাছে হয়তো রাধার মূর্তি থাকত না, শুধু কৃষ্ণের মূর্তি বা গোপালের মূর্তি থাকত। এমনকি হয়ত রাধা বা কৃষ্ণ একজনেরও মূর্তি থাকত না। হাতে এঁকে সেই ছবিটাকেই দোলনায় দোলানো হত। সেই দোলনাটাকেও কত জনে কত ভাবে সাজাতো। কেউ ফুল দিয়ে কেউ জরির ফিতে দিয়ে, কিংবা রঙীন কাগজের শিকলি দিয়ে। পুরো দৃশ্যটাকে সুন্দর করে সাজানো, তার ভেতরে কে কতটা সৃষ্টিশীলতা দেখাতে পারে সেটাই ছিল আসল। চার-পাঁচ দিনের ঝুলন যাত্রায় এক এক দিন এক এক রকম সাজও সাজাতো অনেকে। বড়রা যাঁরা ঝুলন দেখতে বাড়িতে আসতেন তাঁরা প্রণামীও দিতেন কেউ কেউ। সেই টাকা জমিয়ে শীতকালে ফিস্ট করার আনন্দ কখনও ভুলব না। বিকেল বেলায় নিজেদের বাড়ির বাতাসার 'হরির লুঠ' সেরে আমরা যেতাম আশেপাশের আত্মীয় বা বন্ধুদের বাড়ি ঝুলন দেখতে। কে কী রকম সাজিয়েছে দেখতে হবে না? সেই সব দেখে দেখে মনে মনে শিখে নিতাম। বাড়িতে এসে মাসিকে বলতাম। কারণ আমার মাসিই ছিলেন এইসব সাজানো গোছানোর পেছনে প্রধান উদ্যোক্তা। বলতাম পরের বার যেন আমারটা এদের সবার থেকে আলাদা হয়। মনে আছে একবার মাসি আমার ঝুলনে কী সুন্দর ইগলু বানিয়ে দিয়েছিলেন, মাটির সরা পিচবোর্ড আর তুলো দিয়ে। সেবারে আমার ঝুলন দেখে সবাই খুব প্রশংসা করেছিল আর বন্ধুদের যে একটু একটু হিংসে হচ্ছিল সেটা তাদের চোখ মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছিল, কিন্তু তা দেখে আমার খুব আনন্দ হয়েছিল।
আরেকটা বিষয়েও আমার বন্ধুরা আমায় একটু হিংসে করত। আমি ছোটবেলায় যে কোয়ার্টারে থাকতাম সেখানে কোনো বাগান বা উঠোন ছিল না। ফলে বাড়ির মধ্যেই ঝুলন সাজাতে হত। তাই বৃষ্টির জল লেগে সে সাজ নষ্ট হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা ছিল না। কিন্তু আমার যে সব বন্ধুরা নিজেদের বাড়িতে থাকত তারা তাদের উঠোনে বা বাগানেই ঝুলন সাজাতো আর সেদিন যদি বৃষ্টি পড়ত তাহলে মাথার ওপরে কোনো শেড না থাকলে বেশীরভাগ সময়ই তাদের ঝুলন-সাজ নষ্ট হয়ে যেত। কেন জানি না এতে বন্ধুরা আমার ওপর একটু রেগে যেত। ওদের ঝুলন-সাজ নষ্ট হয়ে গেলে কিন্তু আমার খুব কষ্ট হত। আমার নিজের ঝুলন সাজানো নষ্ট না হলেও বন্ধুদের এতদিনের এত কষ্ট করে সরঞ্জাম যোগাড় করে সুন্দর করে সাজানো জিনিস বৃষ্টির জলে ধুয়ে গেলে মন খারাপ হওয়াই স্বাভাবিক, তাই না?
একবার এক বন্ধুর কাকা আমাদের ঝুলন সাজানোর একটা কম্পিটিশন করেছিলেন। বলেছিলেন যে তিনজনের সাজানো সবচেয়ে সুন্দর আর অভিনব হবে তারা গল্পের বই পুরস্কার পাবে। কী আনন্দ, টেনশন আর এক্সাইটমেন্ট যে ছিল সেবার, সে বলে বোঝানো যাবে না। সেই অসীম কাকু সন্ধ্যেয় সবার ঝুলন সাজানো দেখলেন। তাঁর গম্ভীর মুখ দেখে কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। বলছেনও না কাদের টা সবচেয়ে ভাল সাজানো হয়েছে। কিছুক্ষণ পরে তিনি নিজের কাঁধঝোলা টা থেকে ধীরে ধীরে একটামাত্র বই বার করলেন। সেটা দিলেন পাড়ার সবচেয়ে ছোট মেয়ে টুসকি কে। আমরা তো অবাক! ও তো ঠিক করে ঝুলনই সাজায়নি! ও কী করে প্রাইজ পাবে? ও তো কেবল নিজের কাঠের হাত-পা আঁকা বাবা-মা-ছেলে-মেয়ের যে পুতুলের সেট টা ছিল, সেটাই গামছা দিয়ে দোলনা বানিয়ে তার মধ্যে রেখে দুলিয়েছিল। আর একটা বাটিতে দুটো আলুর চপ রেখে দোলনাতেই দিয়ে দিয়েছিল। কাকু ওকে সাজানোর থিম জিজ্ঞেস করায় ও বলেছিল- ঝুলনের দিন বাড়ির সবাই একসঙ্গে তেলেভাজা খেতে খেতে দোলনায় দুলতে দুলতে বৃষ্টি দেখছে। ওর বাবার তেলেভাজার একটা ছোট্ট দোকান আছে, হয়ত সেই জন্যেই ওর মনে এই ভাবনা এসেছে। আমরা সবাই খুব হেসেছিলাম। আর সেই টুসকিই কি না প্রাইজ পেল! কাকু ওকে প্রাইজ টা দেবার সময় বললেন-" টুসকি এই পুরস্কারটা পাচ্ছে ওর যেটুকু জিনিস আছে তাই দিয়েই নিজের ভাবনাটাকে সুন্দর করে প্রকাশ করেছে বলে। সত্যিই তো উৎসব মানে সবাই মিলে আনন্দ করা। টুসকির বাবা এই উৎসবের দিনগুলোতে আরও বেশী নিজের দোকান নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। পরিবারকে এই দিনগুলোতে সময় দেওয়া হয়ে ওঠেনা। তাই টুসকির হয়ত ইচ্ছে হয় যে এরকম একটা দিনে ওর বাবা দোকানের বদলে ওদের সঙ্গে সময় কাটান। বাবা মা ভাইয়ের সঙ্গে একসঙ্গে দোলনায় বসে তেলেভাজা খেতে খেতে আনন্দ করবে ও। এই ভাবনাটার জন্যই টুসকি আজ প্রাইজ পেল।"
আমরা অপেক্ষা করে আছি এরপর আর কারা পুরস্কার পায় সেটা দেখার জন্য। বুকের ভেতরটা দুরু দুরু করছে। আমার কি তাহলে বইটা পাওয়া হবে না? অসীম কাকু একটু বাদে আমাদের সবার দিকে তাকিয়ে হেসে বললেন- "আজকে তোরা সবাই প্রথম হয়েছিস। তোদের সবার ঝুলন সাজানো আমার খুব পছন্দ হয়েছে, তাই আজ তোদের সবাইকে আমি গল্পের বই পুরস্কার দেবো।" এই বলে তিনি সত্যি সত্যিই ব্যাগ থেকে এক বান্ডিল বই বার করলেন। সুকুমার রায়ের লেখা "হ-য-ব-র-ল"। তারপর সবাইকে ডেকে ডেকে হাতে সেই বই তুলে দিলেন। সেদিনের সেই আনন্দের সঙ্গে আর কোনো কিছুর তুলনা হয় না। এখন বুঝি অসীম কাকু আসলে কোনো কম্পিটিশন করতেই চাননি। চেয়েছিলেন কম্পিটিশনের অজুহাতে আমাদের মধ্যে যে ক্রিয়েটিভিটি আছে তার সবটুকু বার করে আনতে।
আজ আর অসীম কাকুদের মত মানুষও নেই আর আমাদের মত দিন-রাত জেগে ঝুলন সাজানো নিয়ে পাগলামো করার মত ছোটরাও নেই। এখনকার জীবন অনেক কঠিন। বাচ্চা বড় সবাই বড্ড ব্যস্ত। সবারই খুব চাপ। আর তাছাড়া এখন বিনোদনের কত রকমের উপকরণ- তাই এইসব ছোটখাটো আনন্দের মধ্যে দিয়ে আর কেউ সময় নষ্ট করে না। কিন্তু কেউ যদি এখনও এসব ছোট ছোট মজা খুশির মধ্যে দিয়ে যাও তাহলে নিশ্চয়ই জানো সেই আনন্দের সঙ্গে আর কোনো কিছুর তুলনা হয় না।
এখন তো আবার প্রায় দেড় বছর ধরে আমরা সবাই কোভিড মহামারীর কারণে বাড়িতেই বন্দী। স্কুল কলেজ অফিস সবই বাড়িতে থেকে করতে হচ্ছে, আর তার ফলে আসছে প্রচণ্ড একঘেয়েমি। এই সময় কিন্তু অনেকেই নানা সৃষ্টিশীল কাজ করে নিজেদের মন ভাল রাখছে। এস না এবার আমাদের সেই ছোটবেলার মত তুমিও একবার ঝুলন সাজিয়ে দেখ তো কেমন লাগে? আর এবার যদি নাও হয় পরের বছর একবার ট্রাই করে দেখতে পারো। তুমি তো আমাদের থেকে অনেক বেশি এক্সপার্ট, ছোটবেলা থেকেই স্কুলের প্রজেক্টের মাধ্যমে আর ইউ-টিউবের দৌলতে নানা রকম জিনিস বানাতে শিখে ফেলেছ। একবার বন্ধুদের মধ্যে নিজের নিজের ক্রিয়েটিভিটি দিয়ে ঝুলনযাত্রা পালন করে দেখই না কেমন লাগে? আমার বিশ্বাস তোমার ভাল লাগবেই। আর একবার যদি ভাল লেগে যায় প্রত্যেক বছরই পালন করো। দেখবে এত আনন্দ হয়ত কোনো ভিডিও গেম খেলেও তুমি পাওনি।
ছবিঃ ছোট্ট ঋদ্ধির সাজানো ঝুলন, সৌজন্যেঃ ধূপছায়া মজুমদার