সবুজ মনের রসদ
Ichchhamoti Logo
খোকার সাধ

স্কুলে তোমার নিশ্চয় কোনো না কোনো প্রিয় বিষয় আছে??

নিশ্চয় তোমার মনে হয় সেই বিশেষ বিষয়টা নিয়েই তো আমি ভবিষ্যতে পড়াশোনা করব, তাহলে আর আমি কষ্ট করে অন্যান্য বিষয় গুলো কেন পড়ব? কেন জানব? এত সব জেনে এত পড়ে আমার কী লাভ হবে?
কী লাভ হবে জানো?

বড় হয়ে সফল মানুষ হওয়া ছাড়াও তুমি যত বেশী পড়বে, যত বেশী জানবে, তত বেশী নিজের বুদ্ধি দিয়ে ঠিক-ভুল, ভাল-মন্দ বিচার করতে শিখবে। তোমার আশেপাশে ঘটে চলা অন্যায় অত্যাচার কে প্রশ্ন করতে, অমান্য করতে শিখবে। কারা করে এমন অন্যায়? --- তারা হতে পারে দেশের শাসকেরা, হতে পারে তোমার আশেপাশের খুব ক্ষমতাশালী অন্যান্য মানুষেরা যারা অন্যদের জীবন নিয়ন্ত্রন করতে চায়। তারা অবশ্য চাইবে তুমি যাতে পড়াশোনা না কর। কারণ পড়াশোনা করলে যে তাদের খুব মুশকিল। তাদের মিথ্যে কথাগুলো যে তুমি ধরে ফেলবে, তখন তাদের সিংহাসন টলমল করে উঠবে। তাই তারা নানাভাবে চেষ্টা চালিয়ে যাবে তোমার শিক্ষার পথ বন্ধ করার। শিক্ষা নামের বিরাট অস্ত্রটার কারণে তারা ছাত্র ছাত্রীদের খুব ভয় পায়। এইসব খারাপ লোকেদের, দুষ্টু লোকেদের বিরুদ্ধে লড়বার জন্যেও কিন্তু তোমাকে অনেক পড়তে হবে, অনেক জানতে হবে।

একটা সুন্দর গল্পের ছলে এই শিক্ষাই আমাদের দিয়ে গেছেন মহান চলচ্চিত্র পরিচালক সত্যজিৎ রায় তাঁর 'হীরক রাজার দেশে' ছবিটিতে। তুমি তো নিশ্চই জানো সত্যজিৎ রায় হলেন বাংলা তথা বিশ্ব চলচ্চিত্র জগতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ চিত্রপরিচালক। তিনি কিন্তু শুধু পরিচালক নন, তিনি শিল্পনির্দেশক, সুরকার, গীতিকার, চিত্রনাট্যকার, চিত্রশিল্পী এবং অবশ্যই একজন সুলেখক। চলচ্চিত্র জগতের সর্বোচ্চ সম্মান অস্কারে সম্মানিত হয়েছেন তিনি। ১৯২১ সালের ২রা মে তাঁর জন্ম হয়। তার মানে এই বছর এই বিখ্যাত মানুষটির জন্মের একশো বছর হল। এই উপলক্ষে তাঁকে শ্রদ্ধা জানিয়ে এবারে আমরা আলোচনা করব ১৯৮০ সালে মুক্তি পাওয়া 'হীরক রাজার দেশে' ছবিটি নিয়ে। ছবিটি আজ থেকে একচল্লিশ বছর আগে তৈরী হলেও এর বক্তব্য কিন্তু আজও প্রাসঙ্গিক।

খোকার সাধ

তুমি যদি 'গুপী গাইন বাঘা বাইন' ছবিটা দেখে থাকো তাহলে তো গুপী-বাঘার সঙ্গে পরিচয় তোমার আগেই হয়ে গেছে। সেখানে তো তুমি দেখেছ কীভাবে গুপী-বাঘা ভূতের রাজার দেওয়া বরের সাহায্যে হাল্লা আর শুণ্ডির যুদ্ধ থামাতে সফল হয়েছিল। সেই গুপী আর বাঘার পরবর্তী অভিযান হল 'হীরক রাজার দেশে'। হীরক রাজা ভারি স্বার্থপর নিষ্ঠুর অত্যাচারী এক রাজা। সে নিজেকে আর তাকে যারা তোষামোদ করে তাদের ছাড়া আর কাউকে ভালবাসে না। নিজের রাজ্যে হীরের খনি থাকা সত্ত্বেও সমস্ত প্রজাদের দারিদ্রের মধ্যে রাখে। চাষীদের দিন কাটে অনাহারে। চাবুক মেরে শ্রমিকদের বেগার খাটায়। প্রজারা খাজনা (Tax) দিতে না পারলে তাদের ওপর নানা ভাবে অত্যাচার করে। এই রাজার অত্যাচারের অস্ত্রটা আবার একটু আলাদা। তুমি 'ব্রেন ওয়াশ' কথাটা তো জানো? হীরক রাজা সবার 'ব্রেন ওয়াশ' বা মগজ ধোলাই করে ছাড়ে। তার জন্য সাহায্য নেয় নিজের পোষা বিজ্ঞানীর তৈরী 'যন্তর-মন্তর' ঘরের। প্রতিবাদী প্রজাদের এই ঘরে পুরে রাজার গুণগান গাওয়া কোনো মন্ত্র দিয়ে তাদের মগজ ধোলাই করে ছেড়ে দেওয়া হয়। যাতে সারা জীবন তারা রাজার সব অত্যাচার অনাচার ভুলে গিয়ে কেবল তার গুণগান করে বেড়ায়।

এই যন্তর মন্তর ঘরের বিষয়টা চেনা লাগছে কি? অনেকটা ঠিক এখনকার মিডিয়ার মত না? এই যে খবরের কাগজ, টিভির বিভিন্ন সংবাদের চ্যানেল, সোশ্যাল মিডিয়াগুলো সব সময় রাজনৈতিক দলের নেতা-নেত্রীদের হয়ে প্রচার করে করে আমাদের মগজ ধোলাই করে দেয়, আসল সত্যি চেপে গিয়ে নিজেদের বলা কথাগুলোকেই খাঁটি সত্য বলে ভাবতে বাধ্য করে- এটাও তো এক ধরনের মগজ ধোলাই-ই, তাই না। যেমন‌ ধর আমরা রোজ টিভিতে, হোয়াটসঅ্যাপ বা সোশ্যাল মিডিয়ায় কত রকমের তথ্য পাই, সেগুলো পেয়েই আমরা সেটার সত্যতা যাচাই না করেই সেগুলো অন্ধ ভাবে মানতে শুরু করে দিই আবার সবাইকে ফরোয়ার্ডও করে দিই। তার ফলে কত ভুল খবর চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে কত ক্ষতি হয় বল তো? এই কিছুদিন আগেই একজন বেশ প্রভাবশালী মানুষ বলেছিলেন গোমূত্র খেলে করোনা সেরে যায়, আর কিছু করার দরকার নেই। সেটা শুনে অনেকেই বিনা বিচারে মাস্ক খুলে দূরত্ব বজায় না রেখে গোমূত্র খেয়ে ভাবল তারা করোনাকে আটকাতে পারবে। তার ফলে কী হল? খুব স্বাভাবিক ভাবেই করোনা তো কমলই না বরং গোমূত্র খেয়ে লোকে অসুস্থ হয়ে পড়ল। যতই নেতা-নেত্রীরা বলুক না কেন, এই যদি মানুষ নিজের বিচার বুদ্ধি প্রয়োগ করত তাহলে এই পরিস্থিতি তৈরী হত না। হীরক রাজাও ঠিক এই কাজটিই করত। সত্যবাদী স্পষ্টবক্তা মানুষদের মগজ ধোলাই করে, তার বিচার বিবেচনা করার ক্ষমতা নষ্ট করে, শুধু ভুল তথ্য দিয়ে নিজের গুণগান গাইবার জন্য তাদের বাঁচিয়ে রাখত।

এই রাজারও শিক্ষা কে বড় ভয়। রাজা মনে করে মানুষ "যত বেশী পড়ে, তত বেশী জানে, তত কম মানে"। ঐ যে কথাগুলো দিয়ে এই লেখা শুরু করেছিলাম। বেশী জেনে গেলে অত্যাচারী রাজার মুখোশ যে খুলে ফেলা যায়। তাই হীরক রাজা ছাত্রদের শেখাতে চায়-

"জানার কোনো শেষ নাই
জানার চেষ্টা বৃথা তাই।"

অথবা

"বিদ্যা লাভে লোকসান
নাই অর্থ নাই মান।"

কিংবা
"লেখাপড়া করে যে
অনাহারে মরে সে।"

মাইনে করা কবিকে দিয়ে নিজের মনের মত এমন যত মগজ ধোলাই করার ছড়া শিখিয়ে আজীবনের জন্য পাঠশালা বন্ধ করে দেয় সে। সব বইপত্র পুঁথি যা যা থেকে মানুষ জ্ঞান অর্জন করতে পারে সব পুড়িয়ে দেয় হীরক রাজার সৈন্যরা। শিক্ষক উদয়ন পণ্ডিত কে পালিয়ে পালিয়ে বেড়াতে হয় রাজার পেয়াদাদের হাত থেকে বাঁচবার জন্য। ওদিকে রাজা কিন্তু প্রজাদের আধপেটা খাইয়ে নানা অনাচার করেও বাইরের রাজাদের হীরক রাজত্বের বর্ষপূর্তি উৎসবে নিমন্ত্রণ করে আনে নিজের বৈভব দেখাতে। পাছে বাইরের লোকের চোখে প্রজাদের দুঃখ দারিদ্র চোখে পড়ে যায় তাই একটা তাঁবুতে জোর করে সব গরীব দুঃখী মানুষদের জন্তু জানোয়ারের মত পুরে রেখে দেয়। তাদের সামান্য সম্বল সব ভেঙেচুরে পুড়িয়ে দেয়। কোথাও যাতে বাইরের লোক দারিদ্র্যের চিহ্নটুকুও দেখতে না পায় তাই এই ব্যবস্থা। বোকা রাজার দম্ভ এতটাই যে নিজেরই একটা বিশাল মূর্তি গড়ে সব নিমন্ত্রিতদের কাছে নিজের অহমিকা প্রচার করতে চায়। এই হীরক রাজ্যেই রাজার নিমন্ত্রণে গুপী-বাঘা আসে। আর ঘটনাচক্রে তাদের দেখা হয়ে যায় পালিয়ে বেড়ানো উদয়ন পণ্ডিতের সঙ্গে।

খোকার সাধ

'হীরক রাজার দেশে' আসলে রূপকথার আদলে একটা প্রতিবাদের, একনায়কতন্ত্রের (Dictatorship) বিরূদ্ধে বলা রাজনৈতিক ব্যঙ্গাত্মক ছবি বা যাকে বলে Political satire.

তোমার মনে হতেই পারে রাজনীতি, ব্যঙ্গ ট্যাঙ্গ এত সব বড় বড় কঠিন কথা আমরা ছাত্র ছাত্রীরা জানব কেন!! কিন্তু কী জান তো, তোমরা আমাদের বড়দের থেকে অনেক বেশী খোলা মনে, নতুন দৃষ্টিতে, যুক্তি বুদ্ধি দিয়ে সবকিছু কে দেখতে পাও, তাই এই ছবিটাও যদি তুমি দেখ তাহলে তোমার চিন্তা-ভাবনা করার মত অনেক মনের খোরাক পাবে। তখন আর এই কথাগুলো কঠিন মনে হবে না। এই ছবিতে কিন্তু ছাত্রদেরও খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। তাদের সাহায্যেই রাজাকে নাকানিচোবানি খাওয়ানো গেছিল। যে সময়কে এই ছবিতে দেখানো হয়েছে সেই সময় মেয়েদের স্কুলে যেতে দেওয়া হত না, তাই হয়ত এই ছবিতে তুমি ছাত্রদের মাঝখানে ছাত্রীদের দেখতে পাবে না। কিন্তু তার মানে এই নয় যে পরিচালক বিচার-বিবেচনা-প্রতিবাদ কেবল ছাত্রদেরই করতে বলেছেন ছাত্রীদের নয়। বরং এই ছবি দেখে ছাত্র-ছাত্রী সকলকে শিখতে হবে বিচার বুদ্ধি দিয়ে অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করা। সব ছাত্র-ছাত্রীদের এই ছবিটা দেখা উচিত। প্রত্যেকটা স্কুলে, কলেজে,প্রতিটা পাড়ার ক্লাবে এই ছবিটি বারে বারে শুধু ছোটদের নয়, বড়দের ও দেখানো দরকার বলে আমার মনে হয়।

এ কথা কিন্তু ভেব না যে এই ছবিটা খুব জ্ঞান দেওয়া, একঘেয়ে, ঘুমপাড়ানো একটা ছবি। বরং এই ছবি দেখতে যে তোমাদের বেশ মজাই লাগবে সেটা কথা দিতে পারি। সুন্দর সুন্দর গান, সুন্দর দৃশ্যাবলী, সুন্দর গল্পের সঙ্গে এ ছবিতে আছে একটা নতুন জিনিস- ছন্দ মিলিয়ে ছড়া কেটে সংলাপ বলা।

ছবির শেষে কী হয়? গুপী-বাঘা কি রাজার অতিথি হয়ে এসেছে বলে রাজার সম্মান রক্ষার্থে রাজার পক্ষ নেয় নাকি উদয়ন পণ্ডিত কে সাহায্য করে রাজার বিরুদ্ধে বিদ্রোহে? কীভাবে নিজেদের ভূমিকা পালন করে তারা? আর ছাত্ররাই বা কোন ভূমিকা নেয় এই গল্পে? সেটা জানতে হলে তো তোমাকে ' হীরক রাজার দেশে' ছবিটা আগাগোড়া মন দিয়ে দেখতে হবে। দেখলে তুমি বুঝতে পারবে, এই ছবির সবথেকে জনপ্রিয় মগজধোলাই মন্ত্র কেন বহু মানুষের প্রিয় মন্ত্রঃ

"দড়ি ধরে মারো টান
রাজা হবে খান খান"।

আমরা, ভারতের জনগণ, ভারতকে একটি সার্বভৌম, সমাজতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, সাধারণতন্ত্র রূপে গড়ে তুলতে সত্যনিষ্ঠার সঙ্গে শপথগ্রহণ করছি এবং তার সকল নাগরিক যাতে : সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ন্যায়বিচার; চিন্তা,মতপ্রকাশ, বিশ্বাস, ধর্ম এবং উপাসনার স্বাধীনতা; সামাজিক প্রতিষ্ঠা অর্জন ও সুযোগের সমতা প্রতিষ্ঠা করতে পারে এবং তাদের সকলের মধ্যে ব্যক্তি-সম্ভ্রম ও জাতীয় ঐক্য এবং সংহতি সুনিশ্চিত করে সৌভ্রাতৃত্ব গড়ে তুলতে; আমাদের গণপরিষদে, আজ,১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর, এতদ্দ্বারা এই সংবিধান গ্রহণ করছি, বিধিবদ্ধ করছি এবং নিজেদের অর্পণ করছি।

ফেসবুকে ইচ্ছামতীর বন্ধুরা