...'যেমন রবির শেষে ঠাকুর। ...তুমি সত্যিই বোকা, না বোকা সেজে রয়েছ, সেটা আমাকে জানতে হবে।'
কিছু কাহিনী হয়, কিছু গল্প হয় যাদের কোনও ধাঁচে ফেলা যায় না, আবার চেষ্টা করলে হয়তো সব ধাঁচের সঙ্গেই সাদৃশ্য দেখা যায়। ফটিকচাঁদ আমার কাছে এইরকম একটি আবিষ্কার। এই উপন্যাসিকার শুরু থেকে হয়তো একটু রহস্যময় মনে হলেও কিছু পরেই হয়ে ওঠে সামাজিক কাহিনী, তারপর কিছু পৃষ্ঠা উল্টেই তা হয়ে যায় একরকম রোমাঞ্চকর অভিযান, আর পরতে পরতে মিশে থাকে মনকেমন করা অনুভূতি। রেনেসাঁর সময় থেকেই এইরকম কাহিনীর দেখা মিলেছে বিশ্বের সাহিত্যে যা সামাজিক নানা ঘটনা নিয়ে তৈরি হলেও তাতে রহস্য, অভিযানের কমতি থাকে না।
একটি দুর্ঘটনা দিয়ে এই উপন্যাসিকার শুরু, আর এই দুর্ঘটনার মাধ্যমেই হঠাৎ জন্ম হয় ফটিকচন্দ্র পালের। জন্মের পর যেমন ধীরে ধীরে শিশু বড় হয়ে উঠতে থাকে আর প্রতিদিন আবিষ্কার করতে থাকে তার আশপাশের জগৎ, ফটিকও তেমনিই সব ভুলে গিয়ে রোজ আবিষ্কার করতে থাকে পৃথিবীকে। কিছু কিছু জিনিস তার চেতনায় ধরা দেয় সহসা আর কিছু থাকে অধরা। অধরা জিনিসগুলোকে ধরিয়ে দিতেই চলন্ত ট্রেনে ওঠার চেষ্টা করতে থাকা অবসন্ন ফটিকের হাত ধরে টেনে তুলে আনে হারুন, যার পুরো নাম 'হারুন অল রসিদ; বোগদাদের খলিফা, জগলারের বাদশা।' ট্রেনের মধ্যে কিছুক্ষণের আলাপে সদ্য চেনা হারুনকে যেমন ভরসা করতে ফটিকের দ্বিধা হয় না, তেমনই হারুনও যেন অমোঘ কিছু খুঁজে পায় ফটিকের মধ্যে। হারুন ফটিকের জীবনকে একটা পথ দেখায়, যে পথে ফটিক স্বাবলম্বী হয়, নিজের মতো স্বপ্ন দেখতে পারে। ফটিক অবাক হয়ে যায় তার হারুনদাকে দেখে, হারুনদাকে ম্যাজিশিয়ান বললেও হয়তো কম বলা হয়। মানুষটা কী ভীষণ আশ্চর্য এবং কঠিন খেলা সাবলীলভাবে দেখিয়ে যেতে পারে, মানুষকে স্তম্ভিত করে দিতে পারে। ফটিক বেশ ভালো থাকে, ফটিক হারুনদাকে দেখে শেখার চেষ্টা করতে জাগলিং। ধীরে ধীরে ভালোবাসতে শুরু করে নিজের এই জীবনকে।
কলকাতায় বসে নিজের ছেলের জন্য চিন্তায় শহরের আইনকানুনের সমস্ত ভিত নাড়িয়ে দেন দুঁদে ব্যারিস্টার শরদিন্দু সান্যাল। তাঁর ছোট ছেলে নিখিলকে কারা যেন কিডন্যাপ করেছে। পুলিশ বিস্তর খোঁজ করে জানতে পেরেছে কিডন্যাপারদের মধ্যে দুজন দুর্ঘটনায় মারা গেছে আর দুজন বেপাত্তা। তবে আশার আলো এই যে, নিখিল সম্ভবত বেঁচে রয়েছে। সবার সঙ্গে পরামর্শ করে শরদিন্দুবাবু ঠিক করেন, তাঁর ছেলেকে খুঁজে দিলে সেই ব্যক্তিকে তিনি মোটা টাকা পুরস্কার দেবেন এবং প্রতিটি নিউজপেপারে সেই কথা এবং নিখিলের ছবিসহ বড় করে বিজ্ঞাপন দেওয়ার নির্দেশ দেন।
বরাতজোরে বেঁচে যাওয়া দুই মারাত্মক অপরাধী কলকাতায় ফিরে এসে নিজেদের ভোল পাল্টে ফেলে, পাছে পুলিশ চিনতে পারে তাদের। যে অপরাধ তারা ঘটাতে পারেনি, কার্যসিদ্ধি করতে পারেনি তার জন্য তাদের আফসোসের শেষ থাকে না। কিন্তু হঠাৎই চায়ের দোকানে তারা একটি ছেলেকে দেখতে পায়। তারা চমকে ওঠে, যে ছেলেকে তারা মৃত ভেবেছিল সে কি তাহলে বেঁচে আছে?
এভাবেই গল্প প্রতি মুহূর্তে মোড় নিতে থাকে এবং তার সঙ্গে যেন ঝুলি থেকে বেরিয়ে আসে এক একটি সূত্র যা তাদের জীবনকে সমাধানের দিকে নিয়ে যায়।
'ফটিকচাঁদ' একটি কিশোরের সমস্ত কিছু হারিয়ে নিজেকে আবিষ্কার করার কাহিনী। যে সত্ত্বাকে হয়তো মাটির কাছে থেকে, মাটিতে পা রেখে, মাটির সঙ্গে মিশেই একমাত্র চেনা যায়। উঁচু বাড়িতে বসে সুখের নিস্তরঙ্গ জীবন কাটিয়ে হয়তো কখনোই বোঝা যায় না। এই গল্প একটি দুর্দান্ত অভিযানের কথা বললেও যেন জীবন এবং বাস্তবের সূক্ষ্ম অনুভূতির কথাও বলে। বলে একজন কৃতঘ্ন মানুষের কথা যিনি নিজের প্রয়োজন মিটে গেলে মানুষদের সহজেই ভুলে যেতে পারেন। বলে কিছু অপরাধীর কথা, যাদের কাছে মুনাফাটাই সব। বলে একজন কিশোরের কথা, যে নতুন জীবন পেয়ে সবটাকে সমান চোখে দেখতে পারে, বুঝতে পারে ভালোবাসার জন্য রক্তের সম্পর্কের দরকার হয় না। বলে একজন ম্যাজিশিয়ানের কথা, যে সংসার ছেড়ে এলেও সারা পৃথিবীকেই নিজের সংসার মনে করে, যে বিপদে মানুষকে সাহায্য করতে দুবার ভাবে না, যে মানুষকে খুশি করতে ভালোবাসে, যে অচেনা একজন কিশোরকে নিজের ভাই ভেবে নিতে পারে এবং সবাইকে বুঝিয়ে দেয়, যে সৎ এবং পরিশ্রমী সে সব লোভ এক লহমায় ত্যাগ করতে পারে।
এই উপন্যাসিকার সব চরিত্র নিজের জায়গায় এত যথার্থ যে এই গল্পে কোনোকিছুই কল্পকথা মনে হয় না।
সত্যজিৎ রায়ের লেখা অনেক গল্পের মতো এই উপন্যাসিকাতেও শেষ অব্দি উৎকণ্ঠা বজায় থাকে। লেখাটি পড়তে পড়তেই পাঠকরা ভেবে নিই, চেয়ে ফেলি কিছু। সেটা মেলে কিনা তার জন্য করতে হয় অপেক্ষা। প্রাঞ্জল ভাষা যেমন উপন্যাসিকাকে সঠিক গতি দিয়েছে, তেমনই বিভিন্ন সময়ে কথ্য ভাষার উপস্থিতি চরিত্রদের সঠিকভাবে উপস্থাপিত করেছে। দরকার মতো সাসপেন্স বজায় রাখার জন্য গল্পে বিভিন্ন চরিত্রের দিক থেকে গল্পকে যেভাবে একের পর এক দেখানো হয়েছে, যা অনেক সাধারণ ঘটনাগুলোকেই করে তুলেছে অসাধারণ।
'... কিন্তু ভাইকে বিক্রি করে কেউ টাকা নেয়?'
'ফটিকচাঁদ' বৈষম্য ভুলতে শেখায়, ভালোবাসতে শেখায়। এই গল্প বৃহত্তর সমাজ, সেই সমাজের অলিগলি, ঘুপচি কোণগুলোকে এবং সেইসঙ্গে জড়িয়ে থাকা জীবনগুলোকে চিনিয়ে দেয়। বুঝিয়ে দেয় নিরাপত্তা আসলে নিরাপদ নয়, বরং সমস্যার মুখোমুখি হয়ে বুদ্ধি করে সবদিক দেখে চললে বিপদকে চিরতরে দূর করা যায়। ফটিকচাঁদের মাধ্যমে জীবনের সরলতাকে, প্রাণের হাসিকে, কাজের গুরুত্বকে চিনিয়ে দেয় হারুন।
সত্যজিৎ রায়ের লেখা 'ফটিকচাঁদ' সারা বিশ্বে বহু ভাষায় অনূদিত এবং যাঁরাই এই কাহিনীর স্বাদ পরখ করেছেন, তাঁরাই উদ্বেলিত হয়েছেন লেখনীর ছোঁয়ায়। এমনকী সত্যজিৎ রায়ের জীবদ্দশায় তাঁর ছেলে সন্দীপ রায় এই গল্প নিয়ে বাংলা ভাষায় চলচ্চিত্র ছবিও তৈরি করেছিলেন ১৯৮৩ সালে। ছবিটি সমাদরও পেয়েছিল জনসাধারণে। তবে ছবির প্রয়োজনে গঠিত চিত্রনাট্য অনেকসময়ই মূল গল্পের থেকে কিছু আলাদা হয়ে থাকে। আর দুটি মাধ্যমেই তাই একই কাহিনী স্বকীয় হয়ে রয়ে যায়। তাই ছবিটি যাঁরা দেখেছেন, অথচ বইটি পড়েননি, তাঁদের কাছে বইটি কিন্তু অবশ্যপাঠ্য।
'ফটিকচাঁদ' পড়তে গিয়ে যে নিজেরও ঐরকম ফটিকের মতো বা হারুনের মতো হতে বারবার ইচ্ছে করবে তা হলফ করে বলতে পারি।
ফটিকচাঁদ
সত্যজিৎ রায়
আনন্দ পাবলিশার্স
পৃষ্ঠা সংখ্যা - ৭৮
মূল্য - ₹১৫০.০০ (অষ্টবিংশ মুদ্রণ ২০১৮)