বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা, আমাদের গ্রামে এর থেকে বড় উৎসব আর নেই। প্রতিটা গ্রামের কিছু না কিছু নিজস্ব বৈশিষ্ট্য থাকে। যেমন জশনান-এর কালীপুজো, বেরমাথাইয়ের বাইচ প্রতিযোগিতা, কুশিপুরের যাত্রাপালা, তেমনই আমাদের গ্রামের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা। দলগত খেলাগুলো যেমন ফুটবল, দড়ি টানাটানি, কাবাডি, ভলিবল, রিলে রেস, এগুলো হয় আবার একক প্রতিযোগিতাগুলো যেমন ১০০ মিটার, ২০০ মিটার, ৪০০ মিটার রেস, সাঁতার, স্মৃতি দৌড়, দাবা, বস্তা দৌড়, শট পাট প্রভৃতিও হয়। নিয়ম একটাই প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করা যাবে গ্রাম অনুসারে। মানে প্রতিটি গ্রাম থেকে একটি দল এসে এই প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করতে পারবে, সেই দলের প্রতিযোগীরা এক বা একাধিক খেলায় ভাগ নিতে পারে এবং সব শেষে যে গ্রাম সব থেকে বেশি পদক পাবে, সেই গ্রাম বিজয়ী হবে —ঠিকই ধরেছ, অলিম্পিকের মতোই আয়োজন, মিনি অলিম্পিক তো বটেই।
যেহেতু আমাদের গ্রামে খেলা হয়, তাই আমরাই আয়োজক। আমাদের গ্রামের মানুষরাই সবটা দেখাশোনা করে। আয়োজক দল হিসেবে আমরা মাঠেও নামি প্রায় প্রতিটি খেলায়। সিংহভাগ খরচ আমরা করলেও বছরের একটি নির্দিষ্ট সময় প্রায় সব গ্রাম থেকেই স্বেচ্ছায় কিছু না কিছু অনুদান আসে—প্রায় কুড়িটি মতো গ্রামের কাছে এ এক মহান উৎসব, তাই অভিযোগ, অনুযোগের ব্যাপার নেই। কিন্তু এবারই ব্যতিক্রম ঘটলো।
অন্যবারের মতো এবারও একমাস আগে থেকে আমরা সব খেলার জন্য নাম গ্রহণ শুরু করেছিলাম। এসময় প্রায় প্রতিদিনই এক একটি গ্রাম থেকে এক একটি দল এসে তাদের যাবতীয় প্রতিযোগীর নাম লিখিয়ে দিয়ে যায়, সেরকমই একটি দলকে দেখলাম ক্লাবের দিকে এগিয়ে আসছে।
পিন্টু নমস্কার জানিয়ে জিজ্ঞেস করলো, "বলুন কোন কোন খেলায় নাম দেবেন।"
ওদের মধ্যে একজন একটু সংকুচিত হয়ে বললো, "অনুমতি থাকলে সব খেলাতেই অংশ নেব। "
রবিদা হেসে বললো, "অনুমতির আবার কী আছে! বলুন, বলুন, নাম বলুন আর গ্রামের নাম বলুন, ব্যাস হয়ে যাবে।"
"আমরা কোনও গ্রামের তরফ থেকে আসিনি, বিভিন্ন এলাকার মানুষ, রিলিফের দৌলতে পাওয়া অস্থায়ী ক্যাম্পে বাস করি।"
আমরা একটু অবাক হলাম। রবিদা জিজ্ঞেস করলো, "অস্থায়ী ক্যাম্প? আপনারা যে যে গ্রামের মানুষ ছিলেন বা যেই এলাকায় থাকেন সেই গ্রামের নাম বলুন আর সেই গ্রামের দলের সঙ্গে কথা বলে সেই দলের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যান। আসলে এটা তো ব্যক্তিভিত্তিক প্রতিযোগিতা নয়, গ্রামভিত্তিক। ব্যক্তিগতভাবে পুরস্কৃত করা হলেও সবশেষে একটি গ্রামকেই সেরার শিরোপা দেওয়া হয়। তাই আপনারা যেমনভাবে চাইছেন, তেমনভাবে তো... "
রবিদা কথা সম্পূর্ণ করে না। অপরদিকের মানুষটি বড় হতাশ হয়ে বলে ওঠে, "সম্ভব নয়, না? আসলে আমরা সবাই কেউ একটি গ্রামের মানুষ নই, সবাই বিভিন্ন গ্রামের মানুষ। আর এখন যেখানে থাকি সেখানে সবাই খেলা নিয়ে আগ্রহী নয়। ঐ বর্ডারের পাশে অস্থায়ী ক্যাম্পগুলোয় আমরা সবাই গত কয়েক বছর ধরে থাকি। বর্ষায় নদীর পাড়ের ভাঙনের ফলে আমাদের বাড়ি চলে গেছে নদীর বুকে, নদী গ্রাস করে নিয়েছে। যারা এই অস্থায়ী ক্যাম্পে বসবাস করেছে, সবাই আগে মোটামুটি বিভিন্ন গ্রামের হয়ে আপনাদের প্রতিযোগিতায় যোগ দিতাম। এই ক্যাম্পগুলোতেও এখন লোক কমে গেছে, অনেকেই চলে গেছেন অন্য জায়গায়। কিন্তু যারা রয়ে গেছি, তারা একজোট হয়ে আপনাদের খেলায় অংশগ্রহণ করতে চাই। হয়তো একসময় আবার আমরা ঘর খুঁজে পাবো, আমরাও কোনও গ্রামের অংশ হবো। কিন্তু যতদিন না পাই ততদিন এই খেলার মাঠেই নিজেদের ঘর খুঁজে নিতে চাই। জানেন, যখন খেলি, মাঠে দাঁড়াই, দীঘিতে নামি, তখন মনে হয় সব ঠিক আছে, কিছু হারাইনি, আমরা নিজেদের গ্রামেই আছি। এখানে আসা এই সব মানুষের একই রকম মনে হয়, তাই আপনাদের প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করতে এলাম।"
আমরা সবাই চুপ হয়ে গেলাম। বর্ডারের ধারে অস্থায়ী ক্যাম্প বানিয়ে কিছু মানুষকে থাকতে দেওয়া হয়েছে জানি, কিন্তু তারা এভাবে এখানে এসে… কী বলবো ভেবে পাচ্ছিলাম না। ধীরে ধীরে গুঞ্জন শুরু হলো। সাকিব, সৌম্য, দীপু, ঝন্টু সবাই যেন নেওয়ার বিরুদ্ধে। বলছে, এদের নিলে বাকি গ্রামগুলো ঝামেলা করতে পারে, আমাদের চিরাচরিত নিয়মের বিরুদ্ধে হবে। গুঞ্জন ক্রমে বাড়তে লাগলো।
শিরীষদা এইসময় উঠে দাঁড়িয়ে জোরে ধমক দিয়ে সবাইকে চুপ করতে বলে। তারপর আগত মানুষগুলোর দিকে তাকিয়ে বলে,
" কোন কোন স্পোর্টসে নাম লেখাবেন ঠিক করুন, তারপর আপনারা এক এক করে নাম লেখান, গ্রামের জায়গায় 'রিলিফ কমিটি' লেখা থাকবে, আপত্তি নেই তো?"
মানুষগুলোর মুখে চওড়া হাসি ফুটলো। যেন এত খুশির খবর দীর্ঘদিন শোনেননি তাঁরা। সবাই সম্মত হলেন। এরপর এক এক করে নাম লেখাতে শুরু করেন। নাম লেখানো হয়ে গেলে বারবার অনেক অনেক ধন্যবাদ জানিয়ে ফিরে যান তাঁরা।
দীপু প্রথম কথাটা পাড়লো। "এটা কি ঠিক হলো শিরীষদা? রবিদা, সোনাদা, আলমদা তোমরাও কিছু বললে না? এরপর জানাজানি হওয়ার পর বিভিন্ন গ্রামের লোকজন যদি এসে ঝামেলা করে? তারা যদি এসে বলে আমরাও বাইরের জায়গা থেকে কোনও ভালো খেলোয়াড় এনে মাঠে নামাবো, তাহলে? বেকার এতদিনের শান্তিপূর্ণ ব্যাপারটা পুরো নষ্ট হয়ে যাবে। এই গ্রামের গৌরবটাও আর থাকবে না।"
শিরীষদা একটা ফিকে হাসি হাসলো। " ঠিকই বলেছিস হয়তো দীপু, তবে বাকি গ্রামের মানুষদের বোঝালে হয়তো বুঝবে ওরা। এতটাও নিরাশায় থাকিস না। এখানে বাকিদের কথা জানি না, কিন্তু আমি জানিস লোভ সামলাতে পারলাম না, একটা ভালো কিছু করার। ওরাও যে মানুষ, শুধু কোনও অস্থায়ী ক্যাম্পের বাসিন্দা নয়, সেটা মনে করে আর কিছু মাথায় এলো না। আর তাছাড়া যেখানে অলিম্পিক কমিটি পথ দেখিয়েছে, সেখানে আমরা একটা ছোট্ট গ্রাম সেটাকে অনুসরণ করতে পারবো না?"
এবার আমরা অনেকেই অবাক হয়ে গেলাম। আমার মুখ থেকেই বেরিয়ে গেল। "অলিম্পিক কমিটি?"
রবিদা হেসে ফেললো। "ঠিক ধরেছিস শিরীষ, একদম ঠিক জায়গায়।" তারপর আমাদের বিস্মিত মুখগুলোর দিকে ঘুরে বললো, "এত দিনরাত মোবাইল ঘাঁটিস আর এটুকু জেনে উঠতে পারলি না দেখে খারাপই লাগছে। "
সাকিব একটু ব্যস্ত হয়ে পড়লো, " একটু খোলসা করে বলো না।"
ঝন্টু বললো, "রবিদা, ওরা না জানলেও আমি বুঝতে পারছি কী বলতে চাইছো তোমরা। ইন্টারন্যাশনাল অলিম্পিক কমিটি ২০১৬ এবং ২০২০ মানে ২০২১ এই দুই অলিম্পিকের জন্য দুবারই রিফিউজি অলিম্পিক টিম গড়ে যেসব অ্যাথলিটরা নানা কারণে দেশছাড়া তাদের অলিম্পিকে অংশগ্রহণ করার সুযোগ করে দিয়েছিল। এটাই তো?"
রবিদা বললো, "হ্যাঁ, ঠিক। তবে এর শুরুটা হয়েছিল ২০১৫ এর অক্টোবরে। ইউনাইটেড নেশন্স (United Nations) এর সাধারণ সম্মেলনে রিফিউজি বা শরণার্থী মানুষদের সমস্যা কতটা গুরুতর তা নিয়ে আলোচনা হয়। প্রায় ৮-১০ কোটি মানুষ তাঁদের দেশে চলা যুদ্ধ, লড়াই, অত্যাচার, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ আরো নানাবিধ কারণে ঘর এবং দেশছাড়া। তাই এত মানুষকে উৎসাহ দিতে, তাদের পাশে দাঁড়াতে, তাঁরাও যে আসলে আর বাকিদের মতো একই সেটা যাতে কেউ ভুলে না যায় তাই আইওসি (IOC) ঐ সম্মেলনে ঘোষণা করে যে তারা রিফিউজি অ্যাথলিটদের নিয়ে একটি টিম বানাবে যা প্রথমবার অলিম্পিকে অংশগ্রহণ করবে। পরে এই টিমের নাম হয় ফ্রেঞ্চ নামের অনুসারে 'একিপ অলিম্পিক দ্য রেফুজি' (Équipe Olympique des Réfugiés) বা EOR। প্রচলিত ভাবে একে রিফিউজি অলিম্পিক টিমও বলা হয়। এই পুরো ব্যাপারটাই অকল্পনীয় ছিল, পৃথিবীতে খেলার ইতিহাসে প্রথমবার এরকম যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। রিফিউজি সমস্যা পৃথিবীর অন্যতম বড় সমস্যা, কোনও রাষ্ট্র এই সমস্যাকে এড়িয়ে চলতে পারে না। ২০১৬-এর রিও অলিম্পিকে মোট ১০ জন রিফিউজি অ্যাথলিট অংশ নিয়েছিলেন। আর সেইসঙ্গে যেন পৃথিবীর সমস্ত রিফিউজিদের কাছে বার্তা গিয়েছিল যে তাঁরা সবাই আসলে পৃথিবীর বাকি মানুষদের সঙ্গেই জুড়ে আছে, তারা আলাদা নয়, পরিত্যক্ত নয়। এই দশজন অ্যাথলিট প্রধানত ইথিওপিয়া, দক্ষিণ সুদান, সিরিয়া এবং কঙ্গোর বাসিন্দা ছিলেন। আইওসি(IOC) শুধুমাত্র তাঁদের অলিম্পিকে পাঠানোর উদ্দেশ্যে টিম গড়েনি, রিফিউজি সাপোর্ট অ্যাথলিট প্রোগ্রাম (Refugee support athlete program) এর মাধ্যমে তাঁদের জীবিকা এবং ভবিষ্যতের দায়িত্বও নিয়েছে। "
রহিম জিজ্ঞেস করলো, " কী ভীষণ ভালো! ২০১৬ এর অলিম্পিকে এরা কোনও মেডেল পেয়েছিল?"
" না মেডেল পাননি শেষ অব্দি, তবে ঐ দশজনের পারফরম্যান্স লক্ষ লক্ষ মানুষকে উদ্বুদ্ধ করেছিল। ২০১৮ সালে পরবর্তী অলিম্পিকের জন্য টিম বাছা হয়। আর এবারে মোট ৫৬ জন অ্যাথলিট এই টিমে অন্তর্ভুক্ত হয়। ফাইনাল বাছাইয়ের জন্য প্রস্তুতিপর্ব চলে প্রায় তিন বছর এবং শেষে ৮ই জুন ২০২১ ঐ ৫৬ জনের মধ্যে থেকে ২৯ জন অ্যাথলিট অলিম্পিকের মূল পর্বে মোট ১২টি স্পোর্টসে অংশগ্রহণ করতে পারে। সবমিলিয়ে ১৩টি দেশের বাসিন্দা এই ২৯ জন। ভাবতে পারছিস? কীভাবে পুরো প্রোগ্রামটি পজিটিভলি মানুষদের উৎসাহ দিয়েছে! এই ২৯ জনের মধ্যে ৬জন আগের রিও অলিম্পিকেও ছিলেন। এঁরা হলেন, সাঁতারু ইয়ুসরা মর্দিনি (Yusra Mardini), রানার এঞ্জেলিনা নাদাই লোহালিথ(Anjelina Nadai Lohalith), জেমস ন্যাং চিয়েঙিক(James Nyang Chiengjiek), রোজ নাথিকে লিকোনিয়েন(Rose Nathike Likonyen), পাওলো এমতুন লোকোরো(Paulo Amotun Lokoro), জুডো প্লেয়ার পোপল মিসেঙ্গা(Popole Misenga)। আর এঁদের সবার এমন এক একটি অনবদ্য লড়াইয়ের কাহিনী আছে যা আমরা এখানে বসে ভাবতেও পারবো না। এঁরা কী মেডেল পেলো সেটার থেকেও অনেক স্পেশাল এঁদের জার্নিটুকু। যা জানলে প্রতি পদে রোমাঞ্চিত হই।"
সবাই এরকম কাহিনীগুলো শোনার জন্য উদগ্রীব হয়ে পড়লাম, অনুনয় করতে শুরু করলাম। শিরীষদা সবাইকে থামিয়ে বলতে শুরু করলো, "আচ্ছা, আচ্ছা শোন। তবে আমি যা বলবো তা হয়তো এঁদের জীবনকে যথার্থ সম্মান দেবে না, তোরা বাড়ি গিয়ে আজ নিশ্চিতভাবে এঁদের ব্যাপারে পড়িস, জানিস, তারপর আরও পাঁচজনকে বলিস, যাতে তারাও জানতে পারে। যেমন রবি বললো, ইয়ুসরা মর্দিনির নাম। তিনি আদতে সিরিয়ার বাসিন্দা ছিলেন। মাত্র ১৪ বছর বয়সে আন্তর্জাতিক সাঁতার প্রতিযোগিতায় তিনি সিরিয়ার হয়ে প্রতিনিধিত্বও করেছিলেন। কিন্তু ২০১৫ সালে তিনি এবং তাঁর বোন সারা মর্দিনি আরো অনেক রিফিউজিদের মতো যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়া ছেড়ে এসেছিলেন প্রাণের ভয়ে। তুরস্ক থেকে গ্রীসের লেসবস দ্বীপ, এই ১০ কিলোমিটার, পঁয়তাল্লিশ মিনিটের যাত্রার জন্য একটি ছোট ডিঙির মতো নৌকায় তাঁরা উঠেছিলেন। যে নৌকায় আসলে ৬-৭জন যাত্রী উঠতে পারে, ২০ জন যাত্রী একসঙ্গে উঠে বিপজ্জনক জলপথে পাড়ি দিয়েছিলেন। যখন এই হাওয়াভর্তি রাবারের ডিঙি চালাতে মোটর চালু করা হয়, তা ওভারলোড হওয়ার কারণে বিগড়ে যায়, ভেঙে যায়। এই ২০ জন যাত্রীর মধ্যে বেশিরভাগই সাঁতার কাটতে জানতেন না। কিন্তু ইয়ুসরা এবং সারা দুই বোন জানতেন, তাই তাঁরা অন্যদের বাঁচাতে নিজেরা বোট থেকে নেমে সমুদ্রের ঐ তীব্র ঠান্ডা এবং স্রোতের মধ্যে এতটা পথ মানে পুরো পথটাই সাঁতার কেটে ঐ বোট এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন, গ্রীসের লেসবস দ্বীপের তীর পর্যন্ত। দুই বোনকে আরো দুজন যাত্রী সাহায্য করেছিলেন। গ্রীসে পৌঁছেও ইয়ুসরা বেশিদিন থাকতে পারেননি নানা কারণে। এরপর তিনি পায়ে হেঁটে, বাসে করে জার্মানির বার্লিন পৌঁছন যেখানে তিনি বর্তমানে থাকেন।
ইউসরার কথায়,
সাঁতার কাটাই তাঁর জীবন...
সুইমিং পুলই তাঁর ঘর...
স্পোর্টসই তাঁর জীবন বাঁচিয়েছে।'
এই কাহিনী যদি মানুষকে উদ্বুদ্ধ না করে, তাহলে আর কোন কাহিনীটি করতে পারবে?
যেমন ২০১৬তে অলিম্পিকে নামা জুডো প্লেয়ার পোপল মিসেঙ্গা বা ইয়োলান্ডে মাবিকা, শৈশবে পরিবারের থেকে তাঁদের বিচ্ছেদ ঘটে কঙ্গোর গৃহযুদ্ধের ফলে। একা একা রিফিউজি ক্যাম্পে বড় হতে হতে তাঁরা জুডো খেলার মধ্যে নিজেদের আবিষ্কার করে। জুডো খেলাই তাঁদের জীবনকে নতুন অর্থ খুঁজে দিয়েছিল, মনের শান্তি ফিরিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু কঙ্গোয় অ্যাথলিটদের সঙ্গে খুব খারাপ ব্যবহার করা হয়, নিয়মের নামে রীতিমতো অত্যাচার করা হয়। যদি তাঁরা মেডেল জিততে না পারতেন, তাহলে তাঁদের একটা ছোট খুপরিতে বন্দী করে রেখে দেওয়া হতো, মিলতো আধপেটা খাবার বা অপর্যাপ্ত জল। ২০১৩ সালে জুডো বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ চলাকালীন কঙ্গো সরকারি কর্তৃপক্ষ মিসেঙ্গা এবং মাবিকার প্রতি চূড়ান্ত অমানবিক আচরণ করে। তিনদিন তাঁরা কোনওরকম খাবার, টাকা, পাসপোর্ট ছাড়া কাটান ব্রাজিলের রিওর একটি হোটেলে। ম্যাচে নামার আগে তাঁদের মনে হচ্ছিল, তাঁরা হয়তো বাচঁবেনই না। এরপর তাঁরা ব্রাজিল সরকারের কাছে আশ্রয়ের আবেদন করেন এবং ভাগ্যক্রমে তাঁরা আশ্রয় পেয়ে যান ব্রাজিলে। এক বিশ্বখ্যাত ব্রাজিলিয়ান কোচ তাঁদের প্রশিক্ষণের দায়িত্ব নেন। পরিশেষে তাঁরা হয়তো একটি জীবন পেয়েছেন যা তাঁদেরকে শুধুমাত্র খেলার উপর ফোকাস করতে সাহায্য করে।
জেমস ন্যাং চিয়েঙিক, অলিম্পিকের ৮০০ মিটার দৌড়ের প্রতিযোগী তাঁর কৈশোরেই তাঁর দেশ দক্ষিণ সুদান ছেড়ে পালিয়ে এসেছিলেন যাতে ঐ অল্প বয়সে তাঁর হাতে কেউ জোর করে অস্ত্র তুলে দিতে না পারে, যাতে তাঁকে ঐ বয়সে সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে না হয়, প্রাণে মারা পড়তে না হয়। বাবা-মাকে ছেড়ে তিনি কেনিয়াতে আশ্রয় নিয়েছিলেন, সেখানেই তাঁর দৌড়ানোর প্রতিভার সন্ধান মেলে।
ম্যারাথনার ট্যাকলোইনি গ্যাব্রিইয়েসস (Tachlowini Gabriyesos) যিনি ইয়ুসরা মর্দিনির সঙ্গে এবারের অলিম্পিকে রিফিউজি অলিম্পিক টিমের হয়ে পতাকা বয়েছিলেন, তিনি আসলে এরিট্রিয়া—পূর্ব আফ্রিকার একটি দেশের বাসিন্দা ছিলেন। মাত্র ১২ বছর বয়সে তিনি দেশ ছেড়ে অবিশ্বাস্য দৃঢ়তার সঙ্গে তাঁর যাত্রাপথে অসাধ্য সাধন করেছিলেন। পায়ে হেঁটে, দৌড়ে, ট্রেক করে উত্তরের দিকে সুদান এবং ইজিপ্ট দুটি দেশ পার করে পৌঁছে গিয়েছিলেন ইজরায়েলে। যাত্রাপথের একটি বড় অংশ মরুভূমি ছিল, যা তিনি পায়ে হেঁটে পার করেছিলেন। এখন তিনি তেল অভিভের একটি লোকাল ক্লাবে প্রশিক্ষণ নেন।
জানিনা, কোথায় শেষ করবো? এঁরা প্রত্যেকেই ভীষণ স্পেশাল। আসলে রিফিউজি অলিম্পিক টিমের প্রতিটি প্রতিযোগীরই এক অসামান্য লড়াইয়ের কাহিনী রয়েছে। "
শিরীষদা থামলো। সময়ও যেন থমকে গেল। কারোর মুখ থেকে কোনও কথা বেরোলো না। বেশ কিছুক্ষণ সবাই নিজের নিজের মনের ভেতরে যেন উঁকি দিলাম, খোঁজার চেষ্টা করলাম আমাদের ভেতরের লড়াকু সত্ত্বাটিকে।
রবিদা প্রথম কথা বললো, খানিকটা নিজের মনেই বলে উঠলো, "কিমিয়া আলিজাদে (Kimia Alizadeh) যদি আরেকটা ম্যাচ জিতে যেতেন, তাহলে ইতিহাস তৈরী হয়ে যেত।"
আমরা শোনার জন্য চুপ করে তাকিয়ে রইলাম। রবিদা বলে চললো, "কিমিয়া ২০১৬ সালে রিও অলিম্পিকে টাইকন্ডোতে ইরানের হয়ে লড়েছিলেন এবং ব্রোঞ্জ জিতেছিলেন। কিন্তু ইরানের সরকার অ্যাথলিটদের সঙ্গে অত্যন্ত কঠিন ব্যবহার করে, তাঁদের একপ্রকার পরাধীন করে রাখে। কলের পুতুলের মতো ইরান কর্তৃপক্ষের সব কথা শোনা চাই, নাহলে কঠোর শাস্তি। কিমিয়া এই আচরণ সহ্য করতে না পেরে ২০২০ সালের জানুয়ারি মাসে ইরান ত্যাগ করে তাঁর বরের সঙ্গে জার্মানিতে থাকা শুরু করেন। ইরান তাঁর নাগরিকত্ব কেড়ে নেয়, তাঁকে ব্যান করে। কোনও দেশের নাগরিকত্ব না থাকায় কিমিয়া জার্মানিতে রিফিউজি স্ট্যাটাস পান এবং অলিম্পিকে রিফিউজি টিমের হয়ে অংশ নেওয়ার সুযোগ পান। ২০১৮-এর পর থেকে তাঁর জীবনে অনেক চোট আঘাত এসেছে। তাই যখন অলিম্পিকের ম্যাটে কিমিয়া নামেন, তখন তিনি নিজের বেস্ট ফর্মে নেই, তবু তিনি পরপর তিনটি ম্যাচ জেতেন। যার মধ্যে প্রথমটি ছিল তাঁরই প্রাক্তন সতীর্থ ইরানের নাহিদ কিয়ানি, যাঁকে কিমিয়া হারিয়ে দেন, এরপর কিমিয়া রিও অলিম্পিকের চ্যাম্পিয়ন ব্রিটিশ জেড জোন্সকেও হারান। শেষে সেমি ফাইনাল এবং ব্রোঞ্জ মেডেল ম্যাচ হেরে যান তিনি, তবে এত প্রতিকূলতার সঙ্গে লড়ে, পুরোপুরি ফিট না থেকেও তিনি যা করে দেখিয়েছেন তা হয়তো পৃথিবীর সবাইকে নিজের মনের কথা শোনার জন্য, মনের কথা শুনে এগোনোর জন্য সাহস দেবে।
২০১৬ সালে অলিম্পিক শুরু হওয়ার কিছু মাস আগে হাজার হাজার রিফিউজি বা শরণার্থী মানুষ মারা গিয়েছিলেন ভূমধ্যসাগর পার করতে গিয়ে, কারণ তাঁরা ভালো সাঁতার জানতেন না। তাই এই অ্যাথলিটরা অকল্পনীয় কষ্ট সহ্য করেও যখন "গ্রেটেস্ট শো অন দ্য আর্থ"-এ নামেন তখন বুঝিয়ে দেন যে কেউই সমাজে তাঁর অবদান রাখতে পারেন তাঁর প্রতিভা, দক্ষতা, আত্মবিশ্বাসের মাধ্যমে।"
রবিদা চুপ করে, আমরা সবাইও বুঝে যাই কতটা স্পেশাল হতে চলেছে আমাদের গ্রামের এবারের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা। হলফ করে বলা যায়, আগের প্রতিটি বছরকে ছাপিয়ে যাবে। মনের ভেতরে কীভাবে যেন অজান্তেই বল পাই।
অলিম্পিক রিফিউজি টিমের সবাই ঘরছাড়া, দেশ ছাড়া, তাঁদের কোনোও পতাকা নেই, জাতীয় সঙ্গীত নেই। তাই এঁরা যখন মাঠে নামেন, তা আসলে সারা পৃথিবীর কাছে আশার আলো হয়ে দাঁড়ায়। আর নিষ্ঠুর পৃথিবী বুঝতে পারে কী ভীষণ অন্যায় হয়ে চলেছে বছরের পর বছর এঁদের প্রতি। এত মানুষ, তাঁরা রিফিউজি হয়ে গেলেও তাঁদের স্বপ্ন আছে, তাঁরা তাঁদের স্বপ্নকে বাঁচিয়ে রাখে, আর ভাগ্যিস রাখে। এঁরা শুধু নিজেদের জন্য দৌড়ান না, সাঁতার কাটেন না, ক্যারাটে লড়েন না, আরো লক্ষ লক্ষ রিফিউজিদের জন্য করেন, যাতে তাঁরাও জীবনে লড়তে পারেন। বুঝিয়ে দেন আসলে আমরা সবাই এক, কোনও পার্থক্য নেই।
ছবিঃ অলিম্পক্স ডট কম