ক'দিন ধরেই ভাবছে বাইরে বেরোবে কিন্তু বেরোনো আর হয়ে উঠছে না। সকালে উঠেই ঠিক করলো আজ বেরোতে হবেই।আসলে বের না হলে আর চলবে না কারণ ঘরে যা ছিল তাতে গতকাল পর্যন্ত চলেছে । যা ছিল বলতে চাল,ডাল থেকে মুড়ি চিঁড়ে। চাল ডাল আগেই শেষ হয়েছে, তারপর গত দুদিন তো চিঁড়ে মুড়ি খেয়েই কাটিয়েছে। কী করবে রোজগার যে বন্ধ। লকডাউনে ট্রেন, বাস বন্ধ ।ট্রেন, বাস না চললে তার কাজ হবে কী করে? নিবারণ ভাবছে কী করা যায়? কী করলে পেট চলবে ? লকডাউনে না খেতে পেয়ে তো তার শাটডাউন হবার উপক্রম। অবশ্য এ অবস্থাটা তার একার নয়, প্রায় সকলেরই। তার চিন্তা অবশ্য নিজেকে নিয়েই কারণ সংসারে সে ছাড়া আর কেউ নেই। বাপকে দেখেই নি। তার দুবছর বয়সে তিনদিনের জ্বরে তাদের ছেড়ে চলে গেছে। মা তখন পাঁচ বাড়ি কাজ করে কোন রকমে তাকে বড়ো করেছে। বড়ো বলতে যখন পনেরো বছর বয়স তখন মা ও হঠাৎ করে অজানা জ্বরে ভুগে তাকে ছেড়ে চলে গেল। সেই থেকেই সে একা। লেখা পড়া তার বেশি দূর হয় নি, মা চেষ্টা করেছিল কিন্তু তারই ভালো লাগতো না । তার চেয়ে বরং আমবাগান জামবাগান ঘোরা আর নদীর ঘাটে গিয়ে নৌকা চড়াতেই তার ঢের বেশি মজা,আনন্দ। ক্লাস সিক্সে দুবার ফেল করার পর আর সে স্কুলের দিকে যায় নি। মা যতদিন ছিল কোন চিন্তা ছিল না। আমবাগানে ঘোরাঘুরি , নদীর ঘাটে গিয়ে নৌকা চরা ,মাঠে ফুটবল খেলা সবই চলছিল বেশ কিন্তু মা চলে যেতেই সবকিছু কেমন যেন থমকে গেল, সে একেবারে একা হয়ে গেল। এবার সে কী করবে? কিন্তু থেমে তো কিছু থাকে না। তার ও থাকলো না ।থাকলো না বিলের জন্য। বিলেই তাকে নিয়ে গেল গুরুর কাছে। গুরুই তাকে শেখালো কীভাবে কী করতে হবে। সেই শিক্ষা পেয়ে আর নিয়মিত অভ্যাসের জন্য সে পাকা কারিগর হয়ে উঠলো। তাদের এ লাইনে যে যত ভালো কাজ জানবে আর খাটতে পারবে বুদ্ধি করে তাদের রোজগার তত বেশী। কিছু দিন আগে পর্যন্ত তার রোজগার বেশ ভালোই হচ্ছিল। শুধু তার নয় তাদের প্রায় সকলেরই কিন্তু ইদানিং এই লকডাউনের কিছু দিন আগে থেকেই দেখছে লোকজন রাস্তাঘাটে টাকা পয়সা কম নিয়ে বেরোচ্ছে। এখন মোবাইল আর কার্ডে জিনিস কেনা কাটা,ইলেকট্রিক বিল,ফোনের বিল দেয়া সবকিছুই হচ্ছে।
আগে মাসের প্রথম দিকে রোজগার বেশ ভালোই হতো। কারণ বাবুরা মাইনে পেয়ে কেনাকাটা করে বাড়ি ফিরতো।এখন তো মাইনের টাকা সরাসরিই ব্যাংকে চলে যাচ্ছে এমনই শোনা যাচ্ছে। ব্যাংকের থেকে ইচ্ছে মতো টাকা তুলে বাজার করো। অফিস, বাজার, সব জায়গাতে নগদ টাকার বাবহারটাই কমে যাচ্ছে, ওষুধের দোকান থেকে জামা কাপড় সব জায়গাতেই কার্ড ব্যবহার হচ্ছে। এইসব নিয়েই কিছু দিন আগে কথা হচ্ছিল বিলের সঙ্গে, নিত্য-ও ছিল পাশে। এখন বাড়িতে বসে ফোনে অর্ডার দিচ্ছে অনেকেই আর জিনিস ও ঠিক সময়ে বাড়িতে পৌছে যাচ্ছে। কে আর বাজার থেকে জিনিস বইছে। যখন বাড়িতে বসে সব পাওয়া যাচ্ছে তখন ভাবনা কী?
যদিও লোকজন বাইরে বেরোচ্ছে শপিং মলে যাচ্ছে,সিনেমা হলে যাচ্ছে, হোটেলে রেস্টুরেন্টে খেতে যাচ্ছে, কিন্তু টাকা কম কার্ডই বেশি নিয়ে যাচ্ছে। বাস! হয়ে গেল তাদের আমদানির দফারফা। তাইতো তাদের বড় চিন্তা। উপায় না দেখে তাদের মধ্যে অনেকেই মোবাইলের দিকে নজর দিয়েছে। দিনে একটা দুটো সরাতে পারলেই --- হবে যদি তা দামি হয় ।নিবারণ অবশ্য এখনও ঐ কাজে হাত দেয় নি। কিন্তু কতদিন এইভাবে চলবে? ভাবতে গেলেই মাথাটা কেমন যেন ঘুরে যায়। তবে মাথা ঘুরলে তো হবে না মাথা ঠান্ডা রাখলে তবেই পেট ভরার ব্যবস্থা হবে। মাথা ঠান্ডা করে সে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে চারপাশে দেখে নিলো।এগুলো তাদের লাইনে সবাইকেই করতে হয় সেটাই নিয়ম । চোখ কান সর্বদা খোলা রাখাটাই সবচেয়ে আগে দরকার। আর এই দেখতে দেখতে তার চোখ আটকে গেল এক জায়গায় একটা ভিড়ের কাছে ।খুব বেশি ভিড় না, আবার একেবারে ছোট ও নয়, একটা পাঞ্জাবি পরা লোক বাঁ হাতে বাজারের ব্যাগ তাতে ভর্তি সবজি যেগুলো ব্যাগের ভিতর থেকে উঁকি মারছে, একটু ভালো করে লক্ষ্য করলেই দেখা যাবে মানিব্যাগটাও উঁকি মারছে পাঞ্জাবির বাঁদিকের পকেটে। মানিব্যাগ এবং তার মালিকের চেহারা দেখে মনে হচ্ছে দুটোর অবস্থাই বেশ ভালো। সুতরাং এটাকেই পাখির চোখ করতে হবে, তবে খুব সাবধানে মাথা ঠান্ডা করে কারণ বাজারে বেশ ভালোই ভিড় ।লকডাউনের পর যেদিনই বাজার খুলছে মানুষ চেষ্টা করছে সামর্থ্য অনুযায়ী জিনিস কিনে নিতে যাতে লকডাউনের সময় অসুবিধা না হয়। সবজি থেকে মুদিখানা সর্বত্র শুধু ভিড়। আর এই ভিড়ই তার দরকার কারণ কাজ তো ভিড়েই হয়, ফাঁকা জায়গায় হওয়া বেশি মুশকিল। ফাঁকা জায়গায় ঝুঁকিটা অনেক বেশি। তাদের কাজটাই সবসময় ঝুঁকির। নিবারণ জানে এই ঝুঁকির মধ্যেও আনন্দ আছে সেটা কাজ ভালো ভাবে হওয়ার পর মানে নিরাপদে সবকিছু মিটে গেলে বোঝা যায়। আশপাশে চোখ বুলিয়ে নিবারণ আগে একবার দেখে নেয় সেই লোকটাকে খুব ব্যস্ত হয়ে যে মুদিখানার দোকানে জিনিস কিনছে।একবার দেখে নিয়েই আবার অন্য দিকে তাকায় নিবারণ কারণ একভাবে একই দিকে কোনো কিছু দেখলে লোকে সন্দেহ করবে। এ লাইনে কাজ করতে গেলে সবকিছুই খেয়াল রাখতে হয়। সামান্য ভুলই যে কোনো বিপদ ডেকে আনতে পারে। এরকম অবস্থায় একবার তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে বলাই ধরা পড়েছিল এই বাজারেই অনেকদিন আগের এক রবিবারে। নিবারণ একটু দূর থেকে দেখতে দেখতে এইসব ভাবতে ভাবতে এগিয়ে যায় মুদিখানা দোকানটার দিকে যেখানে সেই লোকটা জিনিস কিনছে। কাজটা কি এখনই করবে নাকি বাজার করে ফেরার পথে করবে? এমন সময় মুদিখানার দোকানীকে বললে, "রবি হিসেবটা করে রাখ আমি মাছটা নিয়ে রিক্সা ভেকে নিয়ে আসি।" তার মানে এখনও টাকা দেওয়া হয় নি।
লোকটা এইবার মাছের বাজারের দিকে এগিয়ে যায়। পাশেই মাছের বাজার। এগিয়ে চলে নিবারণও। তাকে মাছ বাজারেই কাজটা সারতে হবে এমনটাই ভাবে নিবারণ কারণ মুদিখানার টাকা দেওয়ার আগেই কাজটা সারলে আমদানিটা বেশ ভালোই হবে কারণ লোকটা যা বড় ফর্দ দিলো তাতে মনে হচ্ছে অনেক টাকার জিনিসই নেবে। লোকটা ইতিমধ্যে মুদিখানার দোকান থেকে মাছবাজারের দিকে এগিয়ে যায়। নিবারণও এগিয়ে চলে সেই দিকে। কাজটা ঠিকঠাক করতে পারলে কিছু দিনের জন্য নিশ্চিন্ত। তার পেটতো এই একটাই। এই একটা পেটের জন্য বেশি হাঁকপাঁক করা ঠিক নয়। সে এমন ভাবে চারপাশে দেখতে দেখতে এগিয়ে চলেছে যাতে কেউ কোনোরকম সন্দেহ না করতে পারে। অবশ্য তার দিকে লক্ষ্য করার মতো সময় নেই কারোর। সবাই ব্যস্ত বাজার করতে, একটু পরেই বাজার বন্ধ হয়ে যাবে। এগারোটা পযন্ত বাজার খোলা লকডাউনের জন্য। এগোতে এগোতে রাস্তার পাশে পুলিশের গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। বড়বাবু সঙ্গে তিন জন সবজি বাজারের কাছে দাঁড়িয়ে নিজেদের মধ্যে কথা বলছে। আর আধ ঘন্টা পর বাজার বন্ধ হবে। সবাই যাতে নির্দিষ্ট সময়ে দোকান বন্ধ করে সে জন্যই বড়বাবুদের উপস্থিতি এটা ভালোই বুঝতে পারে নিবারণ । তবু তাকে সতর্ক হয়ে চলাফেরা কাজকর্ম করতে হবে। নিবারণ এগিয়ে চলে। সবজি বাজারের পরেই মাছবাজার। সবজি বাজার পার হয়ে একটু এগোতেই দেখে ঐ ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে আছে একটা মাছের দোকানের সামনে। কথা বলছে, মনে হয় দরদাম করছে। এখানেই তাকে কাজটা সারতে হবে। সেজন্য আরও এগোয় যেখানে লোকটা দাঁড়িয়ে আছে সেই দিকে।
- দাদা রুই না কাতলা কী দেবো? ট্যাংরাও নিতে পারেন, এছাড়া ভালো চিংড়িও আছে...
নিবারণ দেখে— বেশ বড় বড় গদলা চিংড়ি আছে—দেখে জিভে জল আসছে। তার পছন্দের মাছ সেই কবে খেয়েছে ছোটবেলায় মা থাকতে ।মা দারুণ রান্না করতো মালাইকারি।
- ট্যাংরা না তুমি বরং কাতলাই দাও ,আগের দিন তো রুই নিয়ে গেছি, তোমার থেকেই তো নিয়েছি গত সপ্তাহে...
- দাদা জেঠু কেমন আছেন?
- আগের থেকে ভালো তবে অপারেশনটা করতেই হবে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব... এদিকে আবার ছেলেটারও সময় হয়ে এলো ব্লাড দেওয়ার কী যে করবো ভেবেই পারছি না...
- থ্যালাসেমিয়া রোগীর তো রক্ত দিতেই হয় নিয়মিত, এখন তো আবার শুনছি রক্তের ক্রাইসিস, সত্যি আপনার খুবই সমস্যা... ।
নিবারণ চমকে ওঠে কথাগুলো শুনে- সত্যিই লোকটার বিশাল সমস্যা। এই সমস্যাটার কাছে তার একদিন না খেয়ে থাকার সমস্যা কিছুই নয়,অথচ সে নিজের সামান্য সমস্যা মেটাতে গিয়ে একজন হাসিখুশি মানুষের হাসিটাই মুছে দেবে? ছিঃ ছিঃ এ কী করতে যাচ্ছিল !এই লোকটার তো টাকার ভীষণ দরকার। এই অবস্থায় যদি ... না, সে আর ভাবতে পারে না... । এখানে দাঁড়িয়ে থাকা আর ঠিক হবে না। সে এগিয়ে যায় বাজার থেকে বেরিয়ে রাস্তার দিকে। নিজের ওপরে কেমন যেন ঘেন্না হয়। কী করবে সে? কী করে নিজের পেট চালাবে? হঠাৎ দেখে তারই বয়সী একটা লোক ভ্যান রিক্সা করে চাল নিয়ে যাচ্ছে। এই লোকটা নিশ্চয়ই ভ্যান রিক্সা চালিয়ে তার সংসার চালাচ্ছে, তাহলে সেই বা পারবে না কেন?এভাবেও তো ভালো ভাবে বেঁচে থাকা যায়...
'নিবারণ কোথায় চললি? স্টেশনের দিকে? কিন্তু ট্রেন তো বন্ধ কাজ কারবার হবে কী করে? ওহো,বুঝতে পেরেছি, যা যা ঐখানে তো দুপুরে খাওয়াচ্ছে ব্যবসাই সমিতির থেকে প্রতিদিন... '
বড়বাবুর কথায় হুঁশ ফেরে নিবারণের। কোন রকমে বলে- 'হ্যাঁ স্যার '
- ঠিক আছে যা যা আর শোন রেশনে তো চাল দিচ্ছে নিয়েছিস ?
- না স্যার নেবো।স্যার আমার একটা উপকার করবেন?
- বল্ কী করতে হবে?
- আমাকে একটা ভ্যান রিক্সার ব্যবস্থা করে দেবেন? আমি এসব ছেড়ে ভ্যান রিক্সা চালাবো...
বড়বাবু অবাক- সত্যি বলছিস ?
- হ্যাঁ স্যার,তিন সত্যি...
- ঠিক আছে লকডাউনের পর দেখা করিস থানায়... ।
ছবিঃ আবির