দেখতে দেখতে সারা নারায়ণপুরে শৈলেশ্বরানন্দ বাবাজীর অদ্ভুত ক্ষমতার কথা ছড়িয়ে পড়ল। নারায়ণপুর এমনিতেই ছোটো জায়গা, আধা শহর, আধা গ্রাম বললেও ভুল হয় না, সেখানে চাঞ্চল্যকর কিছু ঘটলে লোকের জানতে নিশেষ দেরি হয় না। তার মধ্যে এ তো অনেক বড়ো ব্যাপার। সত্যিকারের এরকম একজন সাধকের দর্শন যে বড়ো একটা পাওয়া যায় না সে কথা এক বাক্যে সকলেই স্বীকার করল। শৈলেশ্বরানন্দর কথা বলার ক্ষমতাটাই অদ্ভুত, কথাতেই মানুষকে মোহিত করে ফেলছেন, কথাতেই মানুষের বেশিরভাগ সমস্যার সমাধান। তার পরেও না হলে তখন তো তাবিজ, মাদুলি ইত্যাদি আছেই। শৈলেশ্বরানন্দ সেসব নিজে হাতে দেন। তবে টাকা পয়সা তেমন কিছুই নেন না, মানুষটা নাকি অত্যন্ত নির্লোভ।
সমুর জেঠুর অসুখও তো এই মাদুলিতেই ভালো হল। যখন তখন ঘুমিয়ে পড়ার রোগ ছিল সমুর জেঠুর। এই জন্যে অল্প বয়সে দুবার চাকরি হাতছাড়া হয়েছে। একবার তো মিটিং চলাকালীন ঘুমিয়ে পড়েছিলেন, নাক ডাকার বিকট আওয়াজে নাকি সহকর্মীদের খেয়াল হয়েছিল যে উনি ঘুমোচ্ছেন, সে দিনই সে চাকরির ইতি হয়েছিল, আরেকবার দরকারি কী সব কাগজপত্র দেখতে দেখতে টেবিলেই ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। এরপর আর চাকরিবাকরির চেষ্টাই করেননি উনি, ঘুমিয়ে ঘুমিয়েই দিন কাটাচ্ছিলেন, শেষমেশ সমুর ঠাকুরদা একটা স্টেশনারি দোকান করে দিলেন। তখন নারায়ণপুরে এখনকার মতো এত দোকানবাজার ছিল না, তার ওপর সমুর ঠাকুরদা ছিলেন এখানকার একজন নামী মানুষ, তাঁর ছেলের দোকান, তাই সে দোকান দিব্যি চলতে লাগল। খদ্দের সামলে আর সমুর জেঠু তেমন ঘুমোবার সুযোগ পেতেন না। তবে এখন দোকান আরও বড়ো হয়েছে, কর্মচারী আছে দুজন, সমুর জেঠু টাকা পয়সা সামলান বসে বসে আর সেই সঙ্গে রোগটাও আরও বাড়ছিল। নেহাত কর্মচারী দুজন খুব বিশ্বস্ত, তাই রক্ষে।
সমুর জেঠু গিয়ে শৈলেশ্বরানন্দর কাছে ধর্ণা দিলেন, "যা বলবেন তাই করব বাবা, কিন্তু আমার এ অসুখ সারিয়ে দিন। এ বুড়ো বয়সে লোকের হাসি তামাশা আর সহ্য হচ্ছে না। আর বেশি দিন এরকম চললে আমি বিবাগী হয়ে চলে যাব। এমন কী আমার ভাইপো, সবে দশ বছর যার বয়েস, সেও আজকাল কথায় কথায় বলে, 'তুমি আবার ঘুমিয়ে পোড়ো না যেন জেঠু।' নিজের ভাই ভাবে এ আমার ইচ্ছে করে করা, চেষ্টা করলেই আমি নাকি এ রোগ সারাতে পারতাম, বাবার মতো, ওর মতো ভালো চাকরি করতে পারতাম। এও বলে মা নাকি আমার চিন্তায় চিন্তায় অস্থির হয়েই চলে গেছেন। বলুন তো বাবা, সহ্য হয় এসব কথা? কী করে বোঝাই ওদের যে আমি চেষ্টা করি, খুব চেষ্টা করি, ভাবি কী করলে আমার এরকম যখন তখন ঘুম আসবে না, কিন্তু দুঃখের কথা আর কী বলব বাবা, ওই ভাবতে ভাবতেই আবার ঘুমিয়ে পড়ি! কম ডাক্তার, বদ্যি দেখাইনি, ঠাকুর দেবতার কাছে কম মানত করিনি, কিন্তু কিছুতেই কিছু হয় না। দু দিন একটু কমে তো তিন দিনের দিন আবার যে কে সেই! আপনিই ভরসা বাবা, কিছু করুন।"
"তোমার সমস্যা সাধারণ নয় তা সত্যি, তবে কী জানো বাবা, সমস্যা থাকলে সমাধানও হয়," সব শুনে গম্ভীর স্বরে শৈলেশ্বরানন্দ বললেন, "তুমি কাল, না কাল নয়, পরশু, পরশু দিন ভালো, তোমার পক্ষে ভালো, পরশু এসো, সূর্যোদয়ের ঠিক বত্রিশ মিনিট পূর্বে। সময়টা ঠিক মনে রেখো কিন্তু, সূর্যোদয়ের ঠিক বত্রিশ মিনিট পূর্বে, তুমি তার একটু আগেও আসতে পারো, তবে মাদুলি আমি তোমাকে কাঁটায় কাঁটায় সূর্যোদয়ের বত্রিশ মিনিট পূর্বেই দেব। ওটাই উপযুক্ত সময়। চিন্তা কোরো না, মাদুলি ধারণ করলেই ফল পাবে। তুমি এখন এসো বাবা, থাক থাক, হয়েছে হয়েছে, ঈশ্বর তোমার মঙ্গল করুন।"
সমুর জেঠু খুব খুশি হয়ে বাড়ি ফিরলেন। বাড়ি ফিরে সমুর ছোটো ঠাকুমাকে বললেন, "এবার আর তোমরা কিচ্ছু বলতে পারবে না কাকীমা, আজ আর কাল সবুর কোরো, পরশু থেকেই দেখতে পাবে।"
ছোটো ঠাকুমা খাতা দেখছিলেন, দেখতে দেখতেই বললেন, "হলেই ভালো। এঁর ওপর আমারও বিশ্বাস আছে। ভদ্রলোক মনে হয় একেবারে ভণ্ড নন।"
এই কথা শুনে বাড়ির সবার মনেই আশা জাগল, নাহলে সমুর জেঠুর এরকম কুম্ভকর্ণের মতো ঘুম যে কখনও কমতে পারে সে কথা কেউ ভাবতেই পারত না। সত্যি কথা হচ্ছে সমুর ছোটো ঠাকুমা, অত্যন্ত কড়া প্রকৃতির মানুষ। নারায়ণপুর থেকে ছ'কিলোমিটার দূরের একটা উচ্চ মাধ্যমিক স্কুলের অঙ্কের শিক্ষিকা ছিলেন। নারায়ণপুর আর আশেপাশের অঞ্চলে এমন ছেলেমেয়ে খুব কমই আছে যারা ওঁর কাছে অঙ্ক করতে আসেনি। স্কুল থেকে অবসর গ্রহণ করেছেন দু বছর হল, কিন্তু ছাত্র ছাত্রী আসার বিরাম নেই। ভক্তিভাবটাব ওঁর মনে তেমন নেই, সকালে স্নান সেরে একবার মিনিট দশেকের জন্যে পুজো করা ছাড়া তেমন কিছু করেনও না। করবেনই না কী করে? খাতা দেখে আর রাজ্যের ছেলে মেয়েকে অঙ্ক করিয়ে সময় পেলে তো? সমু এঁকে বেশ ভয় করেই চলে। ইদানীং উনিও সমুর ওপর বেশ খাপ্পা হয়ে আছেন। হাফ ইয়ার্লি পরীক্ষায় সমু কয়েকটা অঙ্কয় একেবারে বাজে ভুল করেছে, ওই যাকে বলে কেয়ারলেস মিসটেক। সমুর স্কুলের অঙ্কের স্যার আবার ছোটো ঠাকুমার ছাত্র। পরীক্ষার পরপরই একদিন রাস্তায় ছোটো ঠাকুমার সঙ্গে স্যারের দেখা, সমুও সঙ্গে ছিল। স্যার তো ছোটো ঠাকুমাকে দেখে শশব্যস্তে রাস্তাতেই প্রণাম করে কুশল জিজ্ঞেস করলেন, তারপর সমুকে দেখিয়ে বললেন, "সৌম্যদীপ বড্ড ছটফটে, এবার বিচ্ছিরি ভুল করছে পরীক্ষায়।"
ছোটো ঠাকুমা তখন কিছু বলেননি বটে, কিন্তু বাড়িতে ফিরে এসেই সমুকে অঙ্ক করতে বসিয়েছেন আর গল্পের বইএর আলমারিটায় তালা দিয়ে দিয়েছেন। এ বাড়িতে ছোটো ঠাকুমার কথার ওপর কথা বলার কথা কেউ ভাবতেও পারে না, তাই সমুকে সব চুপচাপ মেনে নিতে হয়েছে। তবে এ ক্ষেত্রে কেউ কিছু বলতও না। ছোটো ঠাকুমা সমুকে তক্ষুণি অঙ্ক কষাতে না বসালে সমুর মা যা বকাবকি করতে শুরু করতেন সে আর বলার নয়, দু ঘা লাগিয়েও দিতেন হয়তো।
এ হেন ছোটো ঠাকুমাকে যখন কিছু দিন আগে শৈলেশ্বরানন্দর ওখানে দেখা গেল, তখন সবাই এক বাক্যে বলল, "নারায়ণপুরের মানুষের অশেষ সৌভাগ্য, সত্যিকারের একজন মহাপুরুষ এখানে পায়ের ধুলো দিয়েছেন।"
ক'দিন যেতে না যেতেই মাদুলির ক্ষমতা বোঝা গেল। সমুর জেঠুর ঘুম টুম একেবারে উধাও। এমন কী দুপুরে দোকান যখন বন্ধ থাকে তখনও একটু ঘুমোন না।
এ তো সমুর নিজের চোখে দেখা। আরও অনেক লোকের আরও অনেক উপকার হয়েছে, সে সব ও বিশদে বলতে পারবে না, তবে সবাই যে শৈলেশ্বরানন্দর জয় জয়কার করছে সে তো আর জানতে বাকি নেই।
তবে শৈলেশ্বরানন্দর এবারের কথায় গোটা নারায়ণপুরে একেবারে সোরগোল পড়ে গেল। নারায়ণপুরের উত্তর দিকের কোণে একটা পুকুর আছে। পুকুরটা যে আকারে খুব ছোটো তা একেবারেই নয় কিন্তু কচুরীপানায় ঢেকে গেছে, আবর্জনাও কম জড়ো হয়নি তাতে।
"অনর্থ করছ তোমরা! ও পুকুর কি যে সে পুকুর, যে সে জলাশয়!" বললেন শৈলেশ্বরানন্দ, "ওখানে ভগবান বিষ্ণুর বাস ছিল। বহু প্রাচীন কালে মানে বহু, বহু বছর আগে এখানে মন্দির ছিল, এই জলাশয়ের মধ্যস্থলে একেবারে, অতি মনোরম মন্দির, প্রভুর দয়ায় কাল রাতে স্বপ্নে দেখেছি আমি, এখনও যেন চোখের সামনে ভাসছে, ভাবলেই শিহরণ হচ্ছে আমার। এত দিনে বুঝলাম এত জায়গা থাকতে কেন এই নারায়ণপুরে আসার আদেশ পেয়েছি আমি। সে মন্দির তো এখন আর নেই, ভগবানের মূর্তিও নেই, কিন্তু তাই বলে জলাশয়ের এই দুর্দশা করে রাখা কি ভালো? কক্ষনও নয়। কী অমঙ্গল যে হবে তোমাদের তা তোমরা এখনও বুঝতে পারছ না। অবিলম্বে এর সংস্কারের কাজ আরম্ভ করো।"
"কিন্তু আমরা কী করে সংস্কার করব? ও পুকুর তো হারাধন পালের। নারায়ণপুরের সবচেয়ে বড়ো সোনার দোকার মালিক হারাধন পালের," সমবেত ভক্তদের মধ্যে গুঞ্জন উঠল, "এত বড়োলোক কিন্তু হাড় কিপটে। অনেকবার ওকে বলা হয়েছে পুকুরটা পরিষ্কার করে রাখতে, কিন্তু বলতে গেলেই তেড়ে আসে, বলে 'আমার পুকুর আমি যেমন খুশি রাখব, তোমাদের কী?' এখন আপনিই বলুন বাবা কী করে পুকুরের সংস্কার করা সম্ভব?"
"হারাধন পালের স্ত্রী তো আপনার কাছে আসেন বাবা, হারাধন পালও একবার এসেছে, আপনিই কিছু করুন।"
"হারাধন পাল অতি ধুরন্ধর লোক, ওকে দিয়ে কিছু করানো খুব কঠিন।"
শৈলেশ্বরানন্দ সবাইকে থামালেন, "ওরকম দোষারোপ করে কিছু হবে না। কাজের কাজ করতে হবে। হারাধন পালকে আমার কাছে আসতে বলো, আমি বলব। তাছাড়া শুধু হারাধন পালকে দোষ দিয়ে লাভ নেই, এই তোমরা যারা এখানে আছ তাদের মধ্যেও কি কোনও অবিশ্বাসী নেই? আছে, অবশ্যই আছে, তারা কারা তাও আমি জানি। বেশ কাল সকাল অবধি অপেক্ষা করো, তার মধ্যেই তোমরা প্রমাণ পাবে আমি যা বলছি তা ঠিক কিনা, ও জলাশয়ে ভগবান বিষ্ণুর বাস ছিল কিনা।"
এ কথা শুনে ওই পানাপুকুরের সামনে তখন থেকেই ভিড় লেগে গেল। যেই পারছে একবার করে দেখে আসছে।
"কবে কোথায় কী ছিল তা কে বলতে পারে? তবে উনি যখন বলেছেন তখন নিশ্চয়ই কোনও প্রমাণ পাওয়া যাবে," ছোটো ঠাকুমারও খুব বিশ্বাস।
সমুদের বাড়িতে সকালবেলা খবরের কাগজ দিতে আসে প্রণব, সে বলল সারা রাতও নাকি লোক ওখানে গেছে এসেছে, তবে এখনও কোনও প্রমাণ পাওয়া যায়নি। সকাল সাড়ে সাতটা নাগাদ স্বয়ং শৈলেশ্বরানন্দ গেলেন পুকুরের কাছে। পুকুর পাড়ে একটা আসন পেতে ধ্যানস্থ হলেন। সেখানে তখন তিল ধারণের ঠাঁই নেই। সবাই প্রমাণের জন্যে হা পিত্যেশ করে বসে আছে। এমন সময় হঠাৎ একজন, "এটা এখানে কোথা থেকে এল?" বলে চেঁচিয়ে উঠল। তার আঙুল নির্দেশ করছে পুকুরের পাড়ের একেবারে কাছাকাছি একটা জায়গায়। লোকে হুমড়ি খেয়ে পড়ল সেখানে। কচুরী পানার পাতার মধ্যে রয়েছে একটা ছোটো শাঁখ। সাদা ধবধবে শাঁখ। একজন অতি উৎসাহী সেটাকে তুলেও নিয়ে এল। শৈলেশ্বরানন্দ তখনও ধ্যানমগ্ন। কেউ বুঝতে পারছে না ওঁর ধ্যান ভঙ্গ করা উচিত হবে কিনা। হাজার হোক, সিদ্ধ পুরুষ, ধ্যান ভঙ্গ হলে রেগে গিয়ে যদি অভিশাপ টাপ দিয়ে বসেন! সকলে উদগ্রীব হয়ে অপেক্ষা করতে লাগল। শৈলেশ্বরানন্দর ধ্যান ভাঙল এক সময়ে। যে শাঁখটা তুলেছিল সেই সেটা ওঁর কাছে নিয়ে গেল, "এই দেখুন বাবা এটা ছিল এখানে।"
শৈলেশ্বরানন্দ শাঁখটাকে নিজের হাতে নিয়ে দু চোখ বন্ধ করে নিজের কপালে ছোঁয়ালেন, তারপর সমেবেত জনতার দিকে তাকিয়ে জলদ গম্ভীর স্বরে বললেন, "আর কী প্রমাণের দরকার তোমাদের?"
কেউ কিছুই বুঝল না, কিন্তু সে কথা নিজের মুখে প্রকাশ করতেও লজ্জা, তাই সকলেই চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল।
"মূর্খ!" শৈলেশ্বরানন্দর কন্ঠস্বর উঁচুতে উঠল, "ভগবান বিষ্ণুর চতুর্ভুজ রূপের হাতে কী কী থাকে? শঙ্খ, চক্র, গদা, পদ্ম। এ হল সেই শঙ্খ অর্থাৎ শাঁখ। এত বড়ো প্রমাণ পেয়েও তোমরা কিছুই বুঝছ না! ভগবান বিষ্ণু তোমাদের ক্ষমা করুন!"
প্রবল গুঞ্জন উঠল, "আমি তো আগেই বুঝেছিলাম,' "শাঁখটা দেখেই আমার গেয়ে কেমন যেন কাঁটা দিয়ে উঠল," "অন্যায় করছে হারাধন পাল আর তার ফল আমাদের সকলকে ভুগতে হবে!" এরকম নানান কথা নানান জনে বলতে লাগল।
হারাধন পাল আর তাঁর স্ত্রী উপস্থিত ছিলেন। হারাধনবাবুর স্ত্রী তো কেঁদে কেটে অস্থির। হাত জোড় করে বারবার বলতে লাগলেন, "আপনার আদেশ শিরোধার্য বাবা, আমি আজই লোক লাগাচ্ছি, এ পুকুর আমি সংস্কার করিয়েই ছাড়ব।"
শৈলেশ্বরানন্দ গম্ভীর স্বরে বললেন, "এত লোকের সামনে এই শঙ্খকে সাক্ষী করে এ কথা বললে। মনে রেখো, কথার খেলাপ হলে কিন্তু মহা বিপদ।"
"না না বাবা, ও কথা বলবেন না," হারাধনবাবুর স্ত্রী একেবারে আর্তনাদ করে উঠলেন, "কথার খেলাপ হবে না আমার।"
হারাধন পালকেও কথা দিতে হল যে যথা শীঘ্র সম্ভব পুকুর সংস্কারের কাজ শুরু করবেন। সত্যি কথা বলতে গেলে এসব দেখে তিনিও একটু ঘাবড়ে গেছিলেন বৈকি। হাজার হোক ঠাকুর দেবতার ব্যাপার!
"একবার সংস্কার করালেই চলবে না। সব সময় এ জলাশয় সুন্দর, পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। নাহলেই ভগবান রুষ্ট হবেন। এ শঙ্খ আমি নিয়ে যাচ্ছি, এ আমার কাছেই থাক," শাঁখ হাতে নিয়ে সে স্থান তখনকার মতো ত্যাগ করলেন শৈলেশ্বরানন্দ।
কাজ অবিলম্বে শুরু হল। শৈলেশ্বরানন্দ মাঝে মধ্যেই এসে দেখে যান। এ কাজের জন্যেই তাঁর নারায়ণপুরে আসা, এ কাজ সম্পূর্ণ হলেই তিনি নারায়ণপুর ত্যাগ করবেন – এ কথাও ইতিমধ্যে ঘোষণা করেছেন। এটা শুনে অবশ্য সবারই মন খারাপ, কিন্তু কী আর করা যাবে? উনি তো এক জায়গায় বেশি দিন কখনও থাকেন না।
যারা কাজ করছিল তাদের মধ্যে একজন বলল কাজ করতে করতে পায়ের তলায় শক্ত শক্ত মতো কী যেন ঠেকেছে, যেন পাথর।
শুনে সবাই একেবারে হাঁ হাঁ করে উঠল, "বুঝতে পারলি না? এ নিশ্চয়ই সেই প্রাচীন মন্দিরের পাথর। মন্দির ভেঙে গেছে, পাথর জলের নীচে পড়ে আছে। কিন্তু তোর কী হবে? তুই ও পাথরে পা দিয়েছিস যে!"
শুনে তো সে ভয় পেয়ে ছুটল শৈলেশ্বরানন্দর কাছে, তিনি শুনে বললেন, "তিনদিন একশ আট বার ভগবান বিষ্ণুর নাম জপ করো। কাজ করতে গিয়ে অসাবধানে হয়েছে এই যা রক্ষে, নাহলে..." তিনিও কীরকম যেন শিউরে উঠলেন।
পুকুর সংস্কার হল, পানা পুকুর পরিষ্কার করলে যে এরকম টলটলে পরিষ্কার জল দেখা যাবে তা কেউ আগে ভাবতেও পারেনি। এ যে দৈবী কৃপা সে ব্যাপারে কারুর আর কোনও সন্দেহই রইল না। দৈবী কৃপা না হলে হারাধন পালের মতো এরকম কৃপণ লোকও নিজের এক গাদা পরসা খরচ করে কখনও? আগে কেউ কিছু বলতে গেলেই তো কীরকম তেড়ে আসত! শৈলেশ্বরানন্দ চলে গেছেন নারায়ণপুর ছেড়ে, কিন্তু তাঁকে কেউ ভোলেনি, তাঁকেও লোকে ঠাকুর দেবতার মতোই ভক্তি করে, তাঁর কথা উঠলে বলে, "এ যুগেও যে এরকম সাধক আছেন তা এঁকে না দেখলে জানতাম না। কখনও নিজের জন্যে কোনও কিছু চাননি। মাদুলি দিলে নিতেন মাত্র পাঁচটি টাকা। সত্যিকারের মহাপুরুষ!"
এসব কথা শুনতে সমুর যা লাগে! সারা নারায়ণপুরে ওইই বোধহয় এক মাত্র যে শাঁখটা দেখেনি। ছোটো ঠাকুমা যেতে দিলে তো! অবশ্য ছোটো ঠাকুমাও নিজে যাননি দেখতে। শৈলেশ্বরানন্দর কাছে ও মাত্র একবারই গেছিল, মা নিয়ে গেছিলেন, সমুর ভবিষ্যৎ নিয়ে তিনি সব সময় খুব উদ্বিগ্ন থাকেন, হাফ ইয়ার্লি পরীক্ষায় অঙ্ক ভুল করায় সেটা আরও বেড়েছে, তাই নিয়ে গেছিলেন। গিয়ে যে সমুর খুব ভালো লেগেছিল তা মোটেই নয়, খালি তো এই করবে না আর ওই করবে না শোনা! কিন্তু শাঁখটা কী করে পাওয়া গেল তা দেখার বিলক্ষণ ইচ্ছে ছিল ওর। এদিকে সমু দেখেনি শুনে ওর বন্ধুরা অবধি যেন ওকে করুণা করছে আজকাল। সমুর আর সহ্য হল না। সোজা ছোটো ঠাকুমার ঘরে গেল সমু। ছোটো ঠাকুমা তখন একটা বই পড়ছিলেন মন দিয়ে।
"ছোড়দিদি," সমু আস্তে করে ডাকল, ছোটো ঠাকুমাকে এই বলেই ডাকে ও।
"উঁ," মুখের সামনে থেকে বই না নামিয়েই ছোটো ঠাকুমা সাড়া দিলেন।
"আমি সব জানি, সব দেখেছি আমি," সাহস সঞ্চয় করে এক নিঃশ্বাসে বলে ফেলল সমু। বলার পরেই বুকটা একটু দুরদুর করে উঠল।
ছোটো ঠাকুমা এবার মুখের সামনে থেকে বইটা নামালেন, তীক্ষ্ণ চোখে সমুকে আপাদমস্তক দেখলেন, তারপর বললেন, "কী জানিস? কী দেখেছিস?"
"ওই শৈলেশ্বরানন্দ বাবাজীকে তুমি চেনো। বটুক না কী বলে যেন বেশ তুমি ওকে ডাকতে। আর ওই মাদুলিগুলোর ভেতরে..."
"আমার পেছন পেছন গেছিলি, তাই না? একদিন আমার যে একটু সন্দেহ হয়নি তা নয়," সমুর কথা শেষ হওয়ার আগেই বললেন ছোটো ঠাকুমা, "তা জেনেই বা কী করবি? বরং ভালো করে পড়াশোনা না করলে কী হয় দেখ। এসব কথা তোর ভালোর জন্যেই বলা দরকার তাই বলছি। ওই বটুক মানে শৈলেশ্বরানন্দ আমার একরকমের আত্মীয়ই বলতে পারিস। আমার মাসতুতো বোনের পিসতুতো দাদার নাতি। দেখেছিলাম ওকে আগে। সবাই যখন এত শৈলেশ্বরানন্দর এত জয়জয়কার করছিল, ভাবলাম দেখে আসি। যেতে হয়নি, রাস্তায় দেখেছিলাম, কোথাও যাচ্ছিল সে তখন, যেমন সাধু সন্ন্যাসী দেখতে হয় তেমনই। তারপর একদিন মিষ্টি কিনতে গিয়ে পাশের দেখি গণেশের হোটেলে একজন খাচ্ছে। মুখটা কেমন যেন চেনা চেনা। ওমা দেখি এ তো বটুক! ডাকিনি তখন, চুপচাপ তার পিছু নিলাম। বুঝলাম আমার অনুমান ঠিক, তিনিই স্বামী শৈলেশ্বরানন্দ হয়ে এখানে জমিয়ে বসেছেন। সেদিনই সন্ধ্যের পর একটু ফাঁক পেয়ে চেপে ধরলাম। সে তো কেঁদে কেটে পায়ে পড়ে একাকার একেবারে! এ কাজ ও কাজ কোনও কিছুতেই টিঁকতে না পেরে শেষে এই সব করছে। টিঁকবে কী করে? কোনও দিন পড়াশোনা করেছে মন দিয়ে না কোনও হাতের কাজ শিখেছে? এক বারে কোনও ক্লাস পাশ করেছে কখনও? সেভেনের বেশি তো আর যেতেই পারেনি! হতভাগা!"
"তাহলে ওকে তাড়িয়ে দিলে না কেন?" সমু জিজ্ঞেস না করে পারল না।
"তক্ষুণি এখান থেকে তাড়ালে আবার অন্য কোথাও গিয়ে লোক ঠাকাত। তার থেকে কিছু একটা হিল্লে করে বিদেয় করা ভালো। ধমকে বললাম, 'এখানে ওসব চলবে না। তোমার কিছু একটা গতি আমি করছি, ততদিন এখানেই থাকো, কিন্তু লোকের কাছ থেকে পয়সাকড়ি নেওয়া চলবে না।' একেবারে না নিলে সবার সন্দেহ হবে তাই মাদুলি পিছু পাঁচ টাকা নিতে বলেছিলাম। মাদুলির ভেতরে কী ভরবে তার ব্যবস্থাও করলাম। দুটো বই দিয়ে এলাম, বললাম, 'রাত জেগে এগুলো পড়ে মুখস্থ কর, অনেক আলো ভালো কথা আছে, লোকজন এলে এসবই বলবি।' তাতেও কি সে ছাড়ে, এর ওই সমস্যা, তার সেই অসুখ, কী করবে, কী বলবে সবই তাকে বলে বলে দিতে হত, আবার খাওয়া দাওয়ার টাকা পয়সাও দিতে হত।"
"কিন্তু ওই মাদুলিতেই তো জেঠুর ঘুম কমে গেল!"
"তোর জেঠুর কথা আর বলিস না! ওর সবই মনের ব্যাপার। যেমন ভগবানে ভক্তি তেমনিই ভূত, প্রেত, অপদেবতায় ভয়। মুখে না বললে কী হয়, আমি সবই জানি। বটুককে বললাম, 'এই মাদুলি দিয়ে বলবি, এটা মন্ত্রপূত, রাতে ছাড়া অন্য সময়ে ঘুমলে অপদেবতার ভর হবে, কেউ তখন কিচ্ছু করতে পারবে না। কিছু দিন গেলে দুপুরে ভাত খাওয়ার পর ঘন্টাখানেক জিরোনো যাবে, কিন্তু তার বেশি কিচ্ছু না।' ওতেই কাজ হয়েছে। ওদিকে আমার এক ছাত্রীর বাবাকে বলে রেখেছিলাম, উনি একটা আইসক্রিমের কারখানায় বড়ো চাকরি করেন, সেখানে একটা কাজের জোগাড় করে দিতে। তা দিলেন তিনি। বটুককে বললাম, 'যাওয়ার আগে আর একটা কাজ করে দিয়ে যা। পুকুরটার সংস্কার হওয়া দরকার কিন্তু হারাধন পালকে দিয়ে করানো মুশকিল। এইভাবে চেষ্টা করলে যদি হয়।' তা সেও হল। যাওয়ার আগে দেখা করতে এসেছিল বটুক, বললাম, 'যদি কখনও শুনেছি কাজে কোনও গোলমাল করেছিস বা কাজ ছেড়েছিস তাহলে মজা দেখাব।' মাদুলির টাকাগুলোও দিয়ে গেল। কোনও গরীব মানুষকে দিয়ে দেব। কিন্তু তুই যে খুব বীর দর্পে আমার সামনে এসে 'আমি সব জানি, সব দেখেছি আমি' বললি, তোর মতলবখানা কী শুনি? আমাকে ভয় পাওয়াচ্ছিস? ভাবছিস এসব কথা বলে দিলে ছোড়দিদি খুব বিপদে পড়বে?"
সমু মাথা নীচু করল। ও কথা বলে সত্যিই যে ও ছোটো ঠাকুমাকে ভয় পাওয়াতে এসেছিল তা অস্বীকার করে কী করে? ভেবেছিল সবাই ছোটো ঠাকুমাকে ভয় পায়, এবার উলটে ও ছোটো ঠাকুমাকে ভয় পাওয়াবে, তাহলে আর ছোটো ঠাকুমা ওকে শক্ত শক্ত অঙ্ক কষতে দিতে সাহসই করবেন না। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে কাজটা ঠিক হয়নি। ছোটো ঠাকুমা যে এত কিছু করেছেন সে তো ও ভাবতেও পারেনি। তাছাড়া বাবা, মা যদি শোনে ও ছোটো ঠাকুমার পেছন পেছন এভাবে গেছে, আবার এ কথা বলেছে তাহলে আর রক্ষে নেই।
"পড়াশোনার সময়ে পড়াশোনা না করলে কী হয় দেখলি তো? কোনও কাজকর্ম না পেয়ে শেষ অবধি মাথায় কুবুদ্ধি গজায়! এখানে না হয় আমি ঠিক সময়ে ধরে ফেলেছিলাম, নাহলে তো মার খেত!"
সমু চুপ। দুঃখে চোখে জল আসছে। আগু পিছু না ভেবেই চলে এসেছিল, এখন এসব কথা ছোটো ঠাকুমা কাউকে বললেই তো হয়েছে!
"কদিন অঙ্ক প্র্যাক্টিস করে করে দেখছিস এখন ভুল আর প্রায় হচ্ছেই না? তা না অঙ্ক করব না!" ছোটো ঠাকুমা বললেন।
"রোজ করব অঙ্ক," সমুকে বলতেই হল, ছোটো ঠাকুমাকে রাগিয়ে দেওয়াটা মোটেই বুদ্ধিমানের কাজ হবে না।
বলেই চলে আসছিল, ছোটো ঠাকুমা ডাকলেন, "দাঁড়া। এটা ধর। কিন্তু পড়াশোনায় যদি কোনও ফাঁকিবাজি দেখেছি তাহলে আবার সব বন্ধ।"
সমু দেখল ছোটো ঠাকুমার হাতে গল্পর বইএর আলমারির চাবিটা। মুহূর্তে সমুর দুঃখ, কষ্ট সব উধাও। আবার গল্পর বই পড়তে পারবে!
"সবাই শাঁখটা দেখল, আমারই শুধু দেখা হল না," চাবিটা পেয়ে সমুর সাহস আবার একটু একটু করে ফিরে আসছে।
"ঢের দেখেছিস ও শাঁখ। এ ঘরেই তো থাকত, ওই শাঁখগুলোর সঙ্গে, আমি পুরী থেকে এনেছিলাম। ওসব নিয়ে তুই ছোটোবেলায় কম খেলেছিস নাকি? ও শাঁখ বটুককে সঙ্গে করে রাখতে বলেছি, শাঁখটা চোখের সামনে থাকলে সব সময় আমার কথা মনে থাকবে ওর," ছোটো ঠাকুমা আবার বই পড়তে শুরু করেছেন।
সমু আর দাঁড়াল না, এক ছুটে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। নাহলে দেখতে পেত ছোটো ঠাকুমা মুখের সামনে থেকে বইটা নামিয়েছেন আর মুচকি মুচকি হাসছেন।
ছবিঃ আবির